ইহুদি আগ্রাসনের মুখে 'ঠুঁটো জগন্নাথ'! কেন নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই প্যালেস্টাইনের?
Israel Hamas War: গাজার জনসংখ্যায় দুই তৃতীয়াংশই তাদের ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। ইজরায়েলি আক্রমণের মুখে না গাজার কোনও রকম প্রতিরক্ষা নেই। শুধু গাজা কেন,গোটা প্যালেস্টাইনেরই কোনও নিজস্ব প্রতিরক্ষা নেই।
দেখতে দেখতে আটত্রিশ দিনে পড়ল গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধ। এই আটত্রিশ দিন ধরে কার্যত গাজাকে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে ইজরায়েল। একের পর এক হাসপাতালকে নিশানা করে গিয়েছে নেতানিয়াহু সেনা। হামলা চালানো হচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলিকে নিশানা করে। দু'দিন আগেই গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল কমপ্লেক্স আল শিফাতে রকেট হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। সেই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল অজস্র ফিলিস্তিনি। না, শুধু রকেট হামলা চালিয়ে শান্তি হয়নি। ইজরায়েলি সেনা ঘিরে ফেলে হাসপাতাল চত্বর। বাধ্য করা হয় ফিলিস্তিনিদের হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে। হাজার হাজার রোগী হাসপাতাল থেকে পালাতে বাধ্য হয়। গত দিন চারেক ধরে বিদ্যুৎহীন, জলহীন অবস্থায় রয়েছে আল শিফা হাসপাতাল। শুধু আল শিফা বলে নয়, গাজার জনসংখ্যায় দুই তৃতীয়াংশই তাদের ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। ইজরায়েলি আক্রমণের মুখে না গাজার কোনও রকম প্রতিরক্ষা নেই। শুধু গাজা কেন,গোটা প্যালেস্টাইনেরই কোনও নিজস্ব প্রতিরক্ষা নেই।
ইজরায়েলি সেনার আগ্রাসনের মুখে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ প্য়ালেস্টাইন। কারণ প্যালেস্টাইনের নিজস্ব কোনও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সৈন্যসামন্ত নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই। রাষ্ট্রকে বাঁচাতে তাই তারাই মাঠে নেমেছিল বলে দাবি করেছিল হামাস। সেই হামাসদের জন্য়ই কার্যত শেষের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাজা। শুধু গাজাই নয়, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ প্যালেস্টাইনের একাধিক অংশে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে ইজরায়েলি বাহিনী।
গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল হামাস জঙ্গিরা। তার পরেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেয় ইজরায়েল। যুদ্ধটা কার্যত ছিল গাজার সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের। তবে সেই যুদ্ধের বলি হয়েছে হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনি। ইজরায়েলি সেনা তাকে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বললেও ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে প্রধান ক্ষয়ক্ষতি ১১ হাজার সাধারণ ফিলিস্তিনির প্রাণ। রাষ্ট্রপুঞ্জের হাজার আর্জিতেও চিড়ে ভেজেনি। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কর্ণপাত করেননি ইজরায়ের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নিতেনিয়াহু। প্যালেস্টাইন থেকে হামাসকে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিন্ত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ থেকে পিছু হাটবে না ইজরায়েল। স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার।
আরও পড়ুন: সন্তানের মৃতদেহও আসবে যে কোনওদিন! রোজ ২০০ লাশকে কাফন পরাচ্ছেন গাজার এই বৃদ্ধ
ইজরায়েলের বিরোধিতায় সরব আরবের একাধিক দেশ। অন্তত ১২০টি দেশ সায় দিয়েছিল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। কিছুদিন আগে চার ঘণ্টা করে যুদ্ধবিরতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ইজরায়েলি সেনা, যাতে সেই সময়টুকুতে বাসিন্দারা নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পারে। তবে সেসব যেন শুধু কথার কথা। এই ক'দিনে যুদ্ধের প্রাবাল্য যেন আরও বাড়িয়েছে ইজরায়েল। প্যালেস্টাইনের সঙ্গে যুদ্ধ তাদের নয়। কারণ প্যালেস্টাইনের কোনও নিজস্ব সেনাবাহিনীই নেই। তার বিকল্প হিসেবে নিজেদেরকেই মুখ করে তুলেছিল প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। অবশ্য হামাস প্যালেস্টাইনের সরকার-স্বীকৃত নয় মোটেও।
কিন্তু আস্ত একটা দেশ, তাতে এত এত নাগরিক। তবে কেন কোনও নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই প্যালেস্টাইনের? কেন নিজস্ব কোনও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। এর মূলেও অবশ্য রয়েছে ইজরায়েল। প্যালেস্টাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াসের আরাফৎ ইজরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তিতে সই করেছিলেন। সেই চুক্তির শর্তই ছিল এই যে প্যালেস্টাইন দেশের প্রতিরক্ষার জন্য কোনও সেনাবাহিনী রাখতে পারে। আর সেই চুক্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে আসলে এই যুদ্ধের বীজ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্যালেস্টাইনে যে কোনও সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠলে সেখানকার সরকার নিজেই সেই বাহিনীকে ইজরায়েলের হাতে তুলে দেবে। আর যদি তা না করে, তাহলে ইজরায়েল প্যালেস্টাইন আক্রমণ করতে পারে।
বরাবর কিন্তু এমন সেনাশূন্য ছিল না প্য়ালেস্টাইন। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-র অধীনে এককালে সেখানে ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। তারাই ছিল দেশের সামরিক বাহিনী। কিন্তু তা ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে প্যালেস্টাইন এবং ইজরায়েলের মধ্যে যে অস্ত্রচুক্তি হয়েছিল, তার মূল লক্ষ্যই আসলে ছিল প্যালেস্টাইনকে নিরস্ত্র করে দেওয়া।
ওই অস্ত্রচুক্তিতে বলা হয়, প্যালেস্টাইন সরকার তাদের দেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে বটে। তবে পুরোদস্তুক সামরিক বাহিনী প্যালেস্টাইন রাখতে পারবে না কোনও মতেই। এখানেই শেষ নয়, নিরাপত্তার স্বার্থে যে আধা সামরিক বাহিনী প্যালেস্টাইন গঠন করবে, তার উপরেও জারি করা হয় নানাবিধ বিধিনিষেধ। বেঁধে দেওয়া হয় বাহিনীর পরিসীমা। তাদের গতিবিধি থেকে অস্ত্রবহন ক্ষমতা সমস্ত কিছুরই নিয়ন্ত্রণ থেকে গেল ইজরায়েলের হাতেই। এমনকী পুলিশের বাহিনীতে কারা নিযুক্ত হবেন, কারা তার মাথায় বসবেন, তা নির্ধারণের ভারও নিজের হাতেই রেখেছিল ইজরায়েল। এইভাবে ক্রমশ ফিলিস্তিনিদের সমস্ত ক্ষমতা একে একে খর্ব করেছিল ইজরায়েল। কার্যত ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সমস্ত শক্তি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
আর এতদিনকার সেই অবস্থাকেই চোখ চোখ রেখে সওয়াল করেছিল হামাস। যা রুখতে কার্যত ভয়াল রূপ ধারণ করেছে ইজরায়েল। প্যালেস্টাইনে পুলিশ বাহিনীর নামে প্রথমে ছিল ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স বা জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। পরে তা নাম বদলে হয় প্যালেস্টিনিয়ান সিকিউরিটি ফোর্স বা প্যালেস্তিনীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে। সেখানকার সমস্ত বাহিনীই আদতে এই পিএসএফ-এর অন্তর্গত। গাজার সমুদ্র উপকূল পাহারা দেওয়ার কিছু নৌসেনা বা দেশের পরিবহণ পরিচালনার জন্য ট্র্যাফিক পুলিশ আছে বটে, তবে তা কার্যত শক্তিহীন। মজার কথা, ওই চুক্তির শর্তকে কাজে লাগিয়ে প্যালেস্টাইনের এই বাহিনীকে প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধেই একাধিক বার কাজে লাগিয়েছে ইজরায়েল।
দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি আগ্রাসনের মুখে কোণঠাসা ফিলিস্তিনিরা। আর এই পরিস্থিতিটাকে বদলাতেই উঠে এসেছিল হামাসেরা। গোপনে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সদস্যদের তৈরি করা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই ইজরায়েল এবং আমেরিকা-সহ একাধিক পশ্চিমি দেশের কাছে হামাসরা বিপজ্জনক। তাই তাদের সন্ত্রাসবাদী তকমাও দিয়ে দিয়েছে পশ্চিমি দুনিয়া। এদিকে গোড়া থেকেই হামাসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সাহায্য করে গিয়েছে ইরান। শোনা যায়, হামাসকে অস্ত্রশস্ত্রের জোগানও দেয় তারা। এদিকে, হামাসের সমর্থনে রয়েছে আমেরিকার শত্রু চিন ও উত্তর কোরিয়া। অস্ত্র-সাহায্য আসে সেখান থেকেও।
আরও পড়ুন: মেরুদণ্ড টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ইজরায়েলি বোমা! যেভাবে অথর্ব হচ্ছে গাজার শিশুরা
ইজরায়েলের কবল থেকে স্বাধীন হোক দেশ। ফিলিস্তিনিদের নিজভূমে চলুক নিজেদের মর্জি। আর সেই স্বাধীনতার জন্যই বহু দিন ধরে লড়ে চলেছে প্যালেস্টাইনের বহু ছোট ছোট সশস্ত্র সংগঠন। না, সেসব সংগঠনের সরকারি স্বীকৃতি নেই বটে। প্যালেস্টাইনের সামরিক বাহিনীর মধ্যেও ফেলা যায় না তাদের। তবে এরা প্রত্যেকেই কাজ করে চলেছে দেশকে ইহুদি আগ্রাসনমুক্ত করতে। আর সেই সব শক্তিকেই একেবারে গোড়া থেকে ছেটে ফেলতে চাইছে ইজরায়েল। হামাসকে শেষ করা মানে সেই সম্ভাবনাকেই সমূলে উৎপাটন করা। আর সেই উদ্দেশ্যেই এই ভয়াবহ ধ্বংসলীলা প্যালেস্টাইন জুড়়ে চালিয়ে যাচ্ছে নেতানিয়াহুর সেনা।