রুজির তাগিদে ইজরায়েলে, কেমন আছেন গাজা থেকে ইহুদিদের দেশে যাওয়া শ্রমিকরা?

Israel-Palestine conflict: ইজরায়েলে কাজ করতে আসা বহু ফিলিস্তিনি শ্রমিককেই অবৈধ ভাবে গ্রেফতার করেছে ইজরায়েল প্রশাসন। বাকিদের জোর করে সীমান্ত পার করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়।

বারুদের গন্ধে ক্রমশ শ্বাসবায়ু ফুরিয়ে আসছে গাজার। বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে বাসিন্দাদের। তার উপর প্রতিদিন আক্রমণের মাত্রা বাড়াচ্ছে ইজরায়েল। সেই যে ৭ অক্টোবরের পর গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল নেতানিয়াহু সরকার, তার পর আর একদিনও স্বস্তিতে ঘুমোতে পারেননি গাজার মানুষ। সে দেশ যেন সাক্ষাৎ হননভূমি। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষের মৃতদেহের ভিড়। মায়ের কোলে নিথর হয়ে যাচ্ছে শিশু, প্রতিদিন নিজের হাতে ছেলের কবর সাজাচ্ছে বাবা। সমগ্র গাজা জুড়ে ছবিটা এখন এটাই।

ইজরায়েল আর হামাস-এই দু'পক্ষের মধ্যে পড়ে শাঁখের করাত যেন গাজাবাসী। ইজরায়েল গাজাবাসীর কথা ভাবছে না স্বাভাবিক ভাবেই। এদিকে হামাস সাধারণ বাসিন্দাদের মানবঢাল বানাচ্ছে। একের পর এক হামলায় স্বজনহারা, ভিটেমাটি হারা গাজাবাসীর কোথাও যাওয়ার নেই এই হননভূমিতে জেগে থাকা ছাড়া। শুধু গাজাতে যারা আছেন তাঁরাই নন, গাজা পরিচয়খানা জুড়ে আছে যাদের সঙ্গে, তাদের মাথার উপরেও চক্কর কাটছে বিপদের মেঘ। এতদিন গাজা থেকে কাজের খোঁজে ইজরায়েলে যেতেন হাজার হাজার গাজাবাসী। আরও একটু ভালো করে বাঁচার আশায়, দু'পয়সা রোজগারের আশায়। ইজরায়েলে বসবাসকারী সেই সমস্ত মানুষগুলোও ভয়ানক বিপদে পড়েছেন।

আরও পড়ুন: গাজাকে ঘিরে ফেলেছে ইজরায়েল সেনা? কী অপেক্ষা করছে বাসিন্দাদের জন্য?

সূত্রের খবর, ইজরায়েলে কাজ করতে আসা বহু ফিলিস্তিনি শ্রমিককেই অবৈধ ভাবে গ্রেফতার করেছে ইজরায়েল প্রশাসন। বাকিদের জোর করে সীমান্ত পার করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়। ৭ অক্টোবর যখন হামাসবাহিনী ইজরায়েলের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়, তারও আগে থেকে সেই সব ফিলিস্তিনি শ্রমিকেরা ইজরায়েলেই ছিলেন। কিন্তু হামাসের ওই একটা আক্রমণ যেন পাল্টে দিল তাঁদের জীবনটা।

অথচ তারা যে বেআইনি ভাবে গাজায় ঢুকে পড়েছিল তা তো নয়। বরঞ্চ নিয়মকামনুন মেনে রীতিমতো ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ইজরায়েলে এসে ছিল। যুদ্ধ লাগার আগে অন্তত ১৮ হাজার গাজাবাসীর কাছে ইজরায়েলে ঢুকে কাজ করার অনুমতিপত্র ছিল। যাতে বড় শহরে এসে আর একটু বেশি টাকা রোজগার করতে পারেন গাজাবাসী। তবে সেই ওয়ার্ক পারমিট যে মৃত্যুর পরোয়ানা হয়ে ফিরবে তা কে-ই বা ভেবেছিল।

যুদ্ধঘোষণার পর থেকেই গাজার সঙ্গে সমস্ত রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ইজরায়েল। গাজায় বসবাসী সমস্ত ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের ইজরায়েল থেকে বের করে দিতে উঠেপড়ে লাগে প্রশাসন। ঘোষণা করে দেওয়া হয়, যুদ্ধ শুরুর দিন থেকে ইজরায়েলে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের অবিলম্বে গাজায় ফেরত পাঠানো হবে।

গাজা থেকে কাজ করতে আসা বহু শ্রমিককেই বেআইনি ভাবে গ্রেফতার করেছে ইজরায়েল পুলিশ। হামাসদের হামলার বদলা যেন তাঁদের উপরে নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি একটি ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, ইজরায়েলের কেরাম শালোম ক্রসিং দিয়ে গাজায় ঢুকতে দেখা গিয়েছে অজস্র শ্রমিকদের। যাদের জেনেশুনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুর মুখে। কারণ গাজায় কোনও কিছুই আর আগের মতো নেই। গাজা এখন শুধুই বধ্যভূমি। যেখানে প্রান্তরের পর প্রান্তর জুড়ে শুধুই মৃতদেহের ভিড়। যেদিকে কান পাতা যায়, শুধুই কান্না আর বুক ফাটা আহাকারের শব্দ।

হোক বধ্যভূমি, তবু তো দেশ। ইজরায়েল থেকে ঠেলে দেওয়া শ্রমিকদের চোখে তাই ছলকে উঠছে আনন্দাশ্রু। নিজের দেশে তাঁদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা অপেক্ষা করছে জেনেও মাটি তুলে কপালে ঠেকান বৃদ্ধ। কেউ বা পরিবারকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কেউ আবার বন্ধুকে জানিয়েছেন ঘরে ফেরার শুভেচ্ছা। কীভাবে ইজরায়েলে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, সে কথা বলতে বলতে ভেঙে পড়ছেন কেউ কেউ।

এক শ্রমিক জানালেন, "ইজরায়েলে তাঁদের সঙ্গে যা যা হয়েছে, তা যেন কোনও মানুষের সঙ্গে কক্ষনও না হয়। যুদ্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ওয়ার্কিং পারমিট সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে আমরা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফেরার চেষ্টা করতে থাকি। সেসময় আমাদের গ্রেফতার করে এমন জায়গায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল, যে সেখানকার নামটাও জানতাম না আমরা। আমরা কোথায় আছি তা আমাদের জানতে দেওয়া হত না।"

 

গাজার জন্য বরাদ্দ তহবিল পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইজরায়েলি মন্ত্রিসভা। এতদিন হাজার হাজার গাজার শ্রমিককে তাদের দেশে কাজ করার অনুমতি দিত ইজরায়েল। কাজের সুবিধা, বাড়তি অর্থ রোজগারের সুযোদ তাদের হামাসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াবে, এমনটাই ছিল আশা। তবে ৭ অক্টোবরের ওই হামলা চোখ খুলে দিয়েছে তাদের। যার জন্য গাজাবাসীদের উপর থেকে সমস্ত দয়াদৃষ্টি প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইজরায়েল। আপাতত হামাসকে সমূলে বিনাশ করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর তা করতে গিয়ে যদি কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে কয়েক হাজার গাজাবাসীর বলি দিতে হয়, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় নেতানিয়াহুর দেশ। আর এ কথা এক রকম বুঝিয়েই দিয়েছে তারা।

গাজা বরাবরই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে। সেখানকার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে শূন্যেও। না রয়েছে কোনও চাকরির সুবিধা, না কোনও উন্নতির সুযোগ। বাধ্য হয়েই পড়শি দেশগুলিতে ছোটেন মানুষ। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য বলছে, গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশই বাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে। গত দু'দশকে তার তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি। ফলে বহু মানুষই কাজ খুঁজতে আসেন ইজরায়েলে। ইজরায়েল প্রশাসনও এতদিন তাদের সেই সুবিধা দিয়ে আসছে।

আরও পড়ুন: ৫০ হাজার গর্ভবতী মহিলা যুদ্ধের শিকার! প্রিম্যাচিওর শিশুদের মৃত্যু দেখবে গাজা?

গত ১৭ বছর ধরেই গোটা পৃথিবীর থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে রয়েছে গাজা। একগুচ্ছ কড়াকড়ি, হ্যাঁ-না, নিয়ম-কানুন পথ আঁকড়ে ধরে। বেশ কয়েক বছর ধরে সেই সুযোগটা নিয়েই জাঁকিয়ে বসেছিল হামাস। ইজরায়েল ও মিশর দ্বারা পরিবেষ্টিত যে ১৪০ বর্গমাইলের ছিটমহল এলাকা, তা দখলে রেখেছিস হামাস। ইজরায়েলের অভিযোগ, সেখানে ঘাঁটি গেড়ে ইজরায়েলে হামলার ছক সাজিয়ে গিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। ৭ অক্টোবের হামলার পর ওই এলাকা সম্পূর্ণ ভাবে অবরোধ করে দেয় ইজরায়েল। বন্ধ করে দেয় জল, খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ। আর তাতে হামাসদের কতটা ক্ষতি হয়েছে জানা নেই, বিপাকে পড়েছে সাধারণ নিরাপদ মানুষ।

রামাল্লায় প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্যমন্ত্রক তরফে জানানো হয়েছে, হামাস নিয়ন্ত্রত ছিটমহলে লাগাতার হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। গোটা গাজা জুড়ে এখনও পর্যন্ত ৯ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে শিশু। আহত ২৫ হাজারের কাছাকাছি। রাষ্ট্রপুঞ্জের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কানে নেয়নি ইজরায়েল। এদিকে ক্রমশ নাগরিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে গাজায়। প্রয়োজনীয় সাহায্য চেয়ে মরিয়া আবেদন করে চলেছে গাজা। তবে লাভ কিছুই হচ্ছে না। সকলেই আঙুল তুলছে সকলের দিকে। গাজাকে সাহায্যর জন্য প্রতিশ্রুতিটুকুই সার। এগিয়ে আসছে না কেউ-ই। ধ্বংস থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে শেষের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তাই খোলা নেই গাজার কাছে।

More Articles