গাজার আশ্রয় শিবির, স্কুলে বারবার হামলা! নিরপরাধের ‘গণহত্যা’ই কি পাখির চোখ নেতানিয়াহুর?
দু'দিন আগেই দক্ষিণ গাজার নিরাপদতম অঞ্চল আল মাওয়াসির একটি ছাউনিতে হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল। যেখানে বাস করছিল যুদ্ধোত্তর গাজার অসংখ্য বাস্তুচ্যুত মানুষ। ঘুমের মধ্যেই নিথর হয়েছিল চল্লিশের কাছাকাছি গাজাবাসী। তার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের হামলা গাজায়। এবার নিশানায় রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিচালিত একটি স্কুল। যে স্কুলটাও স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে উঠেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাবাসীর আশ্রয়স্থল। কমপক্ষে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ইজরায়েলের এই সাম্প্রতিকতম হামলায়। যার মধ্য়ে রয়েছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৬ সদস্যও। যারা ইউনাইটেড নেশনস এজেন্সি ফর প্যালেস্টেনিয়ান রিফিউজিস (UNRWA)-র হয়ে কাজ করতেন।
সেই কবে থেকে গাজায় যুদ্ধের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে ঢুকে বিধ্বংসী হামলা চালিয়েছিল ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস। তার পরেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেয় বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। তার পর থেকে লাগাতার হামলায় কার্যত নাস্তানুবুদ অবস্থা গাজার। আস্ত শ্মশানে পরিণত হয়েছে গাজা এতদিনে। যেদিকে তাকানো যায় মৃতদেহের সারি। কিছুদিন আগেই পোলিও টীকাকরণ কর্মসূচীর জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল ইজরায়েল। বলা হয়েছিল, উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় টানা তিনদিন করে যুদ্ধবিরতি দেওয়া হবে পোলিও টীকাকরণের জন্য।
আরও পড়ুন: ঘুমের মধ্যেই তাবুতে নিথর ৪০ প্রাণ! কেন গাজার ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ই বারবার হামলা ইজরায়েলের?
সেই পর্ব মিটতে না মিটতেই হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে ইজরায়েল। বুধবার মধ্য গাজার নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের একটি স্কুলকে নিশানা করে দু'টি বিমান হামলা চালায় ইজরায়েলি সেনা। যে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল কমপক্ষে ১২০০ বাস্তুচ্য়ুত ফিলিস্তিনি। যতদূর জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক এই হামলায় জাতিসঙ্ঘের ৬ কর্মী, ১৯ জন নারী ও শিশু-সহ মোট ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের তালিকায় রয়েছে UNRWA-র ওই আশ্রয়কেন্দ্রের ম্যানেজার ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তাকারী দলের অন্যান্য সদস্যরা।
সম্প্রতি গাজায় সব কটি বড় হামলা চলেছে এমন জায়গাগুলিতে, যেগুলিকে 'নিরাপদ' বলে চিহ্নিত করেছিল ইজরায়েলি সেনা নিজেই। স্বাভাবিক ভাবেই সেইসব এলাকায় কোনও মতে অস্থায়ী তাঁবু বিছিয়ে থাকছেন হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষজন। ইজরায়েলের অভিযোগ, মধ্য গাজার নুসিরাতে হামাসের কম্যান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রকে নিশানা করেই তাদের হামলা। জঙ্গি-নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই হামলা চালায় তাঁরা। ইজরায়েলের অভিযোগ, ওই স্কুলটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল হামাস জঙ্গিরা, আর সেটিকে ভিত্তি করেই বড়সড় হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
ইজরায়েল অবশ্য বারবার দাবি করেছে, সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করেই প্রতিটি হামলার পরিকল্পনা করছে তারা। কিন্তু তার পরেও প্রতিদিন মরছে নিরপরাধ মানুষ। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতারেস জানাচ্ছেন, গাজায় যেভাবে বারবার জাতিসঙ্ঘের কর্মী ও মানবিক সহায়তাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে, তার জন্য ইজরায়েলের কোনও জবাবদিহিই যথেষ্ট নয়। UNRWA জানাচ্ছে, যুদ্ধের শুরু থেকে নুসিরাতের আল-জাউনি প্রিপারেটরি বয়েজ স্কুলের এই শরণার্থী শিবিরটিতে অন্তত পাঁচ বার হামলা চলেছে। এই শিবিরটিতে মূলত আশ্রয় নিয়েছেন নারী ও শিশুরাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইজরায়েল বাস্তুচ্যুত মানুষের শরণার্থী শিবিরগুলিকেই নিশানা করছে ইজরায়েলি সেনা। যা দেখে বারবার এটাই মনে হয়, যত বেশি সম্ভব সাধারণ নাগরিক খতম করার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ ইজরায়েলের। এদিনের হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার সদস্য মোমিন সেলমির কন্যাসন্তানটিও। তেমনটাই জানা গিয়েছে।
ইজরায়েল যেন প্রতিবার বেশি করে মানবিকধার কর্মী আর সাধারণ মানুষকে শেষ করতে চেয়েছে গোড়া থেকেই। তাদের হামলার প্যাটার্ন দেখলে অন্তত তেমনটাই মনে হয়। শুধু যে আকাশপথে হামলা তা-ই নয়। কদিন ধরেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের শহরগুলিতে অভিযান চালাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। সেই অভিযানে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি গিভাত আসাফের একটি বসতি এসাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু হয় এক ইজরায়েলি সেনার। তুবাস এলাকায় ইজরায়েলি বিমান হামলাতেই মৃত্যু হয়েছে ৫ ইজরায়েলি সেনার। অন্য আরেকটি বিমান হামলায় ৩ জনের মৃত্যু হয়।
ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বেইট এল এলাকায় গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় ২৪ বছরের এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইজরায়েলি সেনার। গেরি গিডিয়ন হাঙ্গল নামে ওই যুবক নফ হাগালিলের বাসিন্দা। কেফির ব্রিগেডের নাহশোন ব্যাটেলিয়নের সদস্য ছিলেন ওই যুবক। ২০২০ সাল নাগাদ উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ইজরায়েলে চলে আসেন বেনি মেনাশে সম্প্রদায়ের ওই যুবক। মূলত ভারতের মণিপুর এবং মিজোরামের কুকি মিজো সম্প্রদায়ের বংশধর এই বেনি মেনাশেরা। ইজরায়েলি সেনায় প্রায় ৩০০ বেনি মেনাশে সম্প্রদায়ের যুবক রয়েছেন, যাদের বেশিরভাগেরই কাজ যুদ্ধ ইউনিটে। ২০০৫ সাল থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বেনি মেনাশে সম্প্রদায়ের মানুষজন ইজরায়েলে চলে এসেছেন। যার মধ্যে গত পাঁচ বছরে এসেছে দেড় হাজার জন। ভারতে এখনও সাড়ে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি ওই সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন, যারা ফিরে যেতে চান ইজরায়েলে।
আরও পড়ুন:ভয়াবহ হামলায় নিহত অন্তত ১৬, গাজার পর কেন ইজরায়েলের নিশানায় এবার সিরিয়া?
এদিকে গাজায় ইজরায়েলের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন গত কয়েকদিনে ফের মাথাচাড়া দিয়েছে। একের পর এক বিধ্বংসী হামলা নামছে গাজার অধিকাংশ শরণার্থী শিবিরগুলিকে নিশানা করে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, ৭ অক্টোবরের পর গাজার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধঘোষণার পর থেকে ৪১ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে গাজায়। আহতের সংখ্য়া ছুঁয়ে ফেলেছে এক লক্ষের কাছাকাছি। তার মধ্যে শিশুদের সংখ্যাটা ভয় ধরানোর মতোই।
এদিকে ইজরায়েলে লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লারা। দু-তিন ঘণ্টার মঘ্যে কয়েকশো রকেট ইজরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করেছে তারা। ইজরায়েলি হামলা পাল্টা হত্য়া করছে হিজবুল্লা কম্যান্ডারকে। এর মধ্যেই গাজায় হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে হামলা এবং মৃত্যুর সংখ্য়া। এর পর কোথায় গিয়ে মাথা লুকোবেন গাজাবাসী, সেই জায়গাটা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে গাজা থেকে। ইজরায়েল কবে থামবে, কবে থামাবে এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসন, তার উত্তর নেই তাদের কাছেই।