৫০০ টাকা নিয়ে পালালেন দুঃশাসন! 'জানে ভি দো ইয়ারোঁ'-র নির্মাণকাহিনি এক রূপকথা
Jaane Bhi Do Yaaro Movie: সূক্ষ্ম ফাজলামো দিয়ে গভীর আর অন্ধকার এক ভারতকে দেখান কুন্দন। যেখানে অর্থ, দুর্নীতি আর নারীদেহ সবকিছু সুলভ, সহজ।
আশির দশকের ভারত। চারিদিকে তৈরি হচ্ছে নিত্য নতুন হাইরাইজ বিল্ডিং, সব কাজেই লাগছে পারমিট। আর এই পারমিটের মাঝেই টেবিলের তলা দিয়ে এদিক ওদিক করছে লক্ষ লক্ষ টাকার নোট। কালোবাজারি, দুর্নীতি আর মন্দার চাপে হাঁসফাঁস করছে গোটা দেশ। কুন্দন শাহ ঠিক করলেন এই সব নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। বানাবেন তো ঠিক আছে, কিন্তু টাকা পয়সার বড্ড অভাব। এনএফডিসি থেকে কয়েক লাখ টাকা ধারে নিয়ে কোনওক্রমে সিনেমা বানানোর কথা ভাবেন কুন্দন। অনেকটা ইন্ডিছবির স্টাইলে বানানো এই ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পাবে তেমন আশা কেউই করেননি। এদিকে একেবারে টাইট বাজেট। ফলে যেমন হয় আর কী! ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার একগাদা ছাত্রছাত্রীকে একেবারে নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা গেল। গল্প দুই বন্ধুকে নিয়ে যারা সদ্য ফটোগ্রাফি স্টুডিও খুলেছে। একজনের নাম সুধীর, অন্যজন বিনোদ। নাম দুটোও সিনেমার প্রোডাকশন কন্ট্রোলার বিধু বিনোদ চোপড়া আর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সুধীর মিশ্রর নাম থেকে ধার নেওয়া। স্টুডিওর ব্যবসা না চলায় দুই বন্ধু খবরদার নামে এক পত্রিকার ফ্রিলান্স হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। আর তা করতে গিয়েই জড়িয়ে পড়ে দুর্নীতির এক ভয়ানক চক্রে। কী নেই সেই চক্রে? আছে ঘুষখোর সরকারি আমলা, চরিত্রহীন রিয়েল এস্টেটের মালিক, আছে ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত, এমনকী দিন দুপুরে খুন পর্যন্ত। এই প্রথম ভারতীয় দর্শক এমন একটা সিনেমা দেখলেন, যাতে সব চরিত্রই কালো। একজনের সঙ্গে অন্যের তফাৎ শুধু কালোর ঘনত্বে।
এই বিষয় নিয়ে একটা ভয়ানক গম্ভীর ছবি বানানোই যেত। কুন্দন সেই পথে হাঁটলেনই না। ডার্ক উইট, স্যাটায়ার, অ্যাডাল্ট কমেডি আর স্ল্যাপস্টিকের পাঁচমিশালিতে যা বানালেন, তা ভারতীয় সিনেমার সেরা কাল্ট ছবি হয়ে রইল। যারা সিনেমাটা দেখেছেন, প্রায় সবাই জানেন, গোটা ছবিতে নাসিরুদ্দিনের হাতে একটা নিকন ক্যামেরা দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমার টাইট বাজেটের জন্য, নাসির নিজের ক্যামেরা দিয়েই গোটা সিনেমায় অভিনয় করেন। সিনেমা শেষে ক্যামেরাটি খোওয়া যায়। সে দুঃখ তিনি আজও ভুলতে পারেননি। দুঃখ রয়ে গেছে আরও একজনের। অনুপম খের। সিনেমাতে তাঁর রোল ছিল এমন এক সুপারি কিলারের (সিনেমায় তার নাম ছিল ডিস্কো কিলার) যিনি চোখে দেখতে পান না। মানুষ মারতে গিয়ে বেশ ক’বার আম খুন করে এসেছেন। তাই তিনি এখন আমকেই টার্গেট করেন, যাতে মানুষ মারা যায়। অনুপমকে নিয়ে দিন দশ পনেরো সাত-আট ঘণ্টা করে শুটিং হলেও শেষে এডিটিং টেবিলে তাঁর কাজের পুরোটাই বাদ যায়। বিধু নিজে অনুপমকে বলেন “ভাই কুন্দন পুরো পাগল। তোমার রোলটা কাটা গেছে।” অনুপম বললেন, “দেখো যেন বেশি না কাটে।” “বেশি কমের ব্যাপারই না। রোলটাই সিনেমায় আর নেই।” এই দুঃখ ভোলার না। সিনেমায় মাত্র একবার তাঁকে 'শোনা' গেছে। এক শ্রমিকের সঙ্গে তানেজার (পঙ্কজ কাপুর) ডায়লগে শ্রমিকের গলায় অনুপম ডাব করেছিলেন।
আরও পড়ুন- ফুটপাথ থেকে কেনা হয়েছিল অমিতাভের পোশাক! ‘ডন’ কেন আজও এক ম্যাজিক?
গোটা সিনেমায় মাইকেলএঞ্জেলো অ্যান্টনিয়োনিকে ট্রিবিউট দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর ব্লো-আপ ছবিটিকে। যে পার্কে বাঁদর নাচের ছবি তুলতে গিয়ে কপালদোষে খুনের ছবি তুলে ফেলল, সেই পার্কের নামটা মনে করুন 'অ্যান্টনিয়নি পার্ক' আর খুনের দৃশ্য ছবিতে দেখে ফেলার সিনটাও হুবহু ব্লো-আপ থেকে নেওয়া। এটা অনেকেই খেয়াল করেছি হয়তো। কিন্তু যেটা খেয়াল করিনি, তা হলো সিনেমার একেবারে ক্লাইম্যাক্সে সেই বিখ্যাত দ্রৌপদীর চিরহরণ সিনের সঙ্গে অরসন ওয়েলসের দ্য থার্টিন চেয়ারস ছবির ডাক্তার জেকিল অ্যন্ড মিস্টার হাইড সিকোয়েন্সের অদ্ভুত মিল! শোনা যায়, মূল স্ক্রিপ্টে নাকি এই দৃশ্যটাই ছিল না। শুধু লেখা ছিল নাটকের সব চরিত্ররা এক রঙ্গালয়ে জমায়েত হবে। তারপর কী হবে কেউ জানে না। প্রায় দশ দিন ধরে সতীশ কৌশিক আর রঞ্জিত মিলে ডায়লগ লেখেন। প্রথমেই চ্যালেঞ্জ ছিল কী বিষয়ে নাটক হবে? অনেক ভেবে মহাভারতের এই দৃশ্য ঢোকানো হয়। নাটকের মতো ভারতেও তখন মাৎসন্যায় চলছে। প্রধানমন্ত্রী শুধু চেয়ারে বসে “ইয়ে সব ক্যায়া হো রহা হ্যায়” করছেন, কেউ তাঁর কথা শুনছে না। গোটা সিস্টেমকে মক করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি কৌশিক। তবে এই নাটকের সূত্রেই ভাগ্য খুলে গেছিল আর একজনের। বিধু বিনোদ চোপড়া। ছবিতে তাঁর অভিনয়ের কথাই না। একজন অভিনেতাকে দুঃশাসনের ভূমিকায় অভিনয় করতে ডাকা হয়েছিল। চারদিনের শুটিং। পাঁচশো টাকা। প্রথম দিনের শুটিং শেষ হতে না হতে, সে বলে আমার পাঁচশো দাও। বিধু বললেন “সেকী! সব মিলিয়ে পাঁচশো-র রফা হয়েছিল তো”। অভিনেতা রেগে মেগে চলে গেলেন। বেচারা বিধুকেই দুঃশাসনের ভূমিকায় অভিনয় করতে হলো। FTII, পুনেতে যখন প্রথমবার এই ছবির ছয় ঘণ্টার আনকাট ভার্সান দেখানো হলো, প্রায় গোটা রাস্তায় ছাত্ররা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছিল।
“কেউ জানত না আমরা কী বানাচ্ছি। শুটিং চলছিল। তবে শেষটা কারও জানা ছিল না। কুন্দন বাদে,” বলছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়া। ধার নেওয়া টাকায় তৈরি এই ছবি নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না সিনেমার একমাত্র স্টার নাসিরুদ্দিনও। কুন্দন শুধু বলতেন, “শেষে সব ঠিক হয়ে যাবে।” হলোও তাই। ফাইনাল কাট দেখে কারও কিছু বলার রইল না। মারাঠা মন্দিরে সিনেমার প্রিমিয়ার। সবাই ভাবলেন এনএফডিসির প্রথম ছবি। নিশ্চয়ই বিরাট করে ওপেনিং হবে। রেড কার্পেট ইত্যাদি দিয়ে। ভুল ভাঙল হলে ঢুকতে যেতেই। দরজার সামনেই একতাড়া টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কুন্দন শাহ নিজে। “যাচ্ছ কোথায়? আগে টিকিট কাট, তারপরে ভিতরে যাও।” নিজের অভিনয় করা ছবি নিজেই টিকিট কেটে দেখতে হয়েছিল অভিনেতাদের। এমন আগে বা পরে কোনওদিন হয়েছে কিনা জানা নেই।
আরও পড়ুন- “এই ছেলেকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব,” বাথরুমে কিশোরের গলা শুনে বলেছিলেন শচীন কত্তা!
আর একজনের কথা না বললে অন্যায় হবে। ওম পুরি। সিনেমায় রিয়েল এস্টেট টাইকুন আহুজা, যিনি প্রায় সব সময় অরণ্যদেবের মতো একটা সানগ্লাস পরে থাকেন। ওম বান্দ্রা থেকে একটা ট্রেন ধরে শুটিং যাচ্ছিলেন। সেই ট্রেনে কোনওক্রমে তাঁকে পাকড়াও করে গল্পটা অল্পকথায় বলেন কুন্দন। ব্যাস! আর কিচ্ছুটি না শুনেই হ্যাঁ বলে দেন ওম। একেবারে শেষের দিন যখন সেই মহাভারতের দৃশ্য হচ্ছে, তখন অবাক ওম বলেন, “আরে ইয়ার, ইয়ে তো আচ্ছে স্ক্রিপ্ট হ্যায়”। অনেকদিন পরে সুধীর মিশ্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “মাত্র বাইশ বছর বয়সে কুন্দন শাহ-র উৎসাহে এই সিনেমার গল্প লিখি। এই সিনেমা নির্মাণ আমার কাছে ফিল্ম স্কুলের মতো। কী জানি কেমন করে একদল প্রতিভাকে চোখের সামনে এক জায়গায় দেখতে পেলাম। এমনটা আর খুব বেশি হয়নি।”
সত্যি বলতে কুন্দন শাহ নিজেই জানতেন না, এই ছবি একদিন ভারতীয় সিনেমার ল্যান্ডমার্ক হবে। সিনেমায় অনেক কিছু আছে, যা দেখলেই বোঝা যায়, গোটা ব্যাপারটায় একটা তিরতিরে ফাজলামো ছিল। সেখানে নাসিরুদ্দিন যে কোডওয়ার্ড বলে, তা হলো, “আলবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়”, কুন্দনেরই অন্য এক ছবি। সিনেমায় এক পরিচালকের নাম শুনি 'কুন্দন শাহ'। আর এই সূক্ষ্ম ফাজলামো দিয়ে গভীর আর অন্ধকার এক ভারতকে দেখান কুন্দন। যেখানে অর্থ, দুর্নীতি আর নারীদেহ সবকিছু সুলভ, সহজ। ছবির নায়কও কম্প্রোমাইজড হন, করেন। সংবাদপত্রের সম্পাদক শোভা সেন নিজেই এই ছবির ফেম ফেটালে। হাসতে হাসতে অনায়াসে আমরা শিউরে উঠি। এই ছবি দেশ কাল ছাপিয়ে সর্বজনীনতা পায়।
ওহ! ছবির নামই বলিনি এতক্ষণ। অভিনেতা-লেখক সতীশ শাহ একটা গান লেখেন। সিনেমাতে শেষ মুহূর্তে সেটাও বাদ যায়। কুন্দন এমনটা করতেন, বন্ধুরা দুঃখ পেলেই যা বলতেন সেটা নিয়েই ছিল এই গান। সে যাই হোক, এ যাত্রা সতীশকে খুশি করতে গানের প্রথম লাইনকেই সিনেমার নাম করে দেন কুন্দন। ক্যাজুয়ালি। যেমনটা করতেন। সিনেমার নাম রাখেন “জানে ভি দো ইয়ারোঁ”।