সিংহের ওপর বসে জগদ্ধাত্রী! আজও ঐতিহ্য মেনে পুজো হয় বটকৃষ্ণ পালের অট্টালিকায়
Jagaddhatri Puja 2022: উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে বটকৃষ্ণ পালের বাড়ির ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা জানেন না অনেকেই।
দীপাবলির সব আলো মা কালীর বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে যখন এক এক করে নিভতে থাকে, মনে হয়, এই বুঝি উৎসবের পালা শেষ। যে আলোর ছত্রছায়ায় এতদিন বড় রঙিন লাগত চারপাশ, সেই আলো এখন বুঝি কেবল আকাশপ্রদীপ হয়ে জ্বলবে প্রতি সন্ধ্যায়। আলোর উৎসব বিদায় নিলেই আমরা টের পাই, ভোরের হাওয়ায় হেমন্তের শিরশিরানি। যে আলো দীপাবলির শেষ লগ্নে বিদায় নিয়েছিল জগত থেকে, সেই জগতকেই আলো করে আবার ফিরে আসেন দেবী জগদ্ধাত্রী-রূপে, যাকে উপাসনা না করলে আমাদের ইষ্টদেবীর সাধনা সম্পূর্ণ হয় না। জগৎকে ধারণ করেন যিনি, তিনিই 'জগদ্ধাত্রী'। আর এই জগতের ধারককে যাঁরা 'হৈমন্তিকা' বলে আহ্বান জানান নিজ গৃহে, তাঁদের এহেন আরাধনা আসলে জগতের মূল শক্তির উৎসকে সাধনা করার এক অনন্য পন্থা।
জগদ্ধাত্রীর সৃষ্টি যেমন পৌরাণিক কাহিনির রেশ ধরে, তেমনই তাঁর উৎসবের উদ্বোধনের পিছনে রয়েছে বাংলার শিকড়ের ইতিহাস। তখন ১৭৪২ সাল। বাংলা তখনও নবাবের শাসনমুক্ত হতে পারেনি। এমনই সময় আলিবর্দি খাঁ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা খাজনা চেয়ে বসেন। রাজাবাহাদুর সেই অর্থ দিতে রাজি না হওয়ায় ঘটে যায় এক অনর্থ, বন্দি হন রাজা মুর্শিদাবাদের কারাগারে। অনেক পরে হিসেব-নিকেশের পালা সাঙ্গ করে যখন ঘরে ফেরেন, তখন কৃষ্ণনগরে বিসর্জনের সুর বাজছে। মা দুর্গা বিদায় নিচ্ছেন তাঁর দেশ থেকে। এই যন্ত্রণা সহ্য হয় না তাঁর। কিছুদিন পরেই স্বপ্নে পান মাকে এবং ফলস্বরূপ দুর্গার পরিবর্তে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা শুরু হয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে। এর পরবর্তীকালে এই একই পথ অনুসরণ করে ফরাসডাঙায় ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।
যদিও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এই পুজো শুরু করার বহু আগে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের জগদ্ধাত্রীর প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের বরিশালে। এছাড়াও শান্তিপুরের জলেশ্বর মন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যেও জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষ করা যায়। তবে, দুর্গাপুজোর পরই জগদ্ধাত্রীকে বনেদিয়ানার আমেজে ভরিয়ে তুলতে কৃষ্ণনগর আর সর্বজনীন করে তুলতে চন্দননগরের জুড়ি মেলা ভার।
আরও পড়ুন: ঘুঁটের আগুন থেকে এলইডি ল্যাম্প, জগদ্ধাত্রী পুজো পাল্টে দিল চন্দননগরের চালচিত্র
কার্তিক মাসের শুক্লা-নবমী তিথিতে আরাধ্য এই দেবীর উপাসনা সাধারণত একটি দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। তিথি অনুযায়ী যে দিনটিতে নবমী পড়ে, সাধারণত সেইদিনই সর্বত্র জগদ্ধাত্রীর আরাধনা শুরু হয় সকাল থেকে এবং একই দিনে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীপুজোর আয়োজন করা হয়। বাংলায় জগদ্ধাত্রীর আরাধনার মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম চন্দননগরই, যেখানে একেবারে দুর্গাপুজোর মতো করে মহাষষ্ঠী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত মহা-উৎসাহে এবং উজ্জ্বল আলোকসজ্জার মায়ায় দিকে দিকে সর্বজনীন বারোয়ারি সংগঠনগুলি জগদ্ধাত্রী পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে। এখানে প্রত্যেকটি মণ্ডপেই প্রতিমার অলংকারে সূক্ষ্ম নিপুণতার শোলার কাজ এবং ডাকের সাজের শৈল্পিক নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়।
জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় প্রাচীনত্বের নিদর্শন পাওয়া যায় কৃষ্ণনগরের বুড়িমা ও চন্দননগরের চাউলপট্টির পুজোয়। কলকাতাতেও কিছু বনেদিবাড়ি সহ বেশ কিছু বারোয়ারি মণ্ডপে জগদ্ধাত্রী পুজো হতে দেখা যায়।
উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে বটকৃষ্ণ পালের ঔষধের রাজকীয় দোকানটি আমাদের অনেকেরই যাতায়াতের পথে শোভাবর্ধন করেছে বহুবার। তবে কেবলমাত্র এই দোকানটি নয়, এর পিছনে যিনি ছিলেন, একজন কালজয়ী অগ্রদূত, তাঁদের ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা বলব আজ।
তখন ১৮৯৩ সাল। বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং-এর ওষুধের ব্যবসা বাজারে বেশ রমরমিয়ে ছেয়ে গেছে। বহু রোগের দেশীয় প্রতিকারক হিসেবে, তখন অনেকেই দ্বারস্থ হচ্ছেন বটকৃষ্ণ পালের তৈরি ওষুধের। যেহেতু ছোটবেলা থেকে দারিদ্র আর অনটনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা, তাই তাঁর স্বপ্ন ছিল অফুরন্ত। সেখান থেকেই ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের উদ্যোগে তিনি বানিয়ে ফেলেন ৭৭ নম্বর বেনিয়াটোলা স্ট্রিটে এক পেল্লায় বাসভবন। এরপর মনের বাসনা হলো মাতৃশক্তির আরাধনা করা, স্বগৃহে। কিন্তু যেহেতু তাঁর স্ত্রী স্বপ্নাদেশ পান শিবপুরের বাড়িতে মা অভয়ার পুজো করার, তাই বেনিয়াটোলার বাড়িতে শুরু হয় দেবীর জগদ্ধাত্রী রূপের আরাধনা। ১৯০০ সালে যে ঐতিহ্য-সহকারে পুজো শুরু হয়েছিল এই বাড়িতে, আজও তা সর্বসম্মতভাবে পালন করার চেষ্টা করেন বাড়ির সদস্যরা। এই বাড়িতে মা বসেন লাল শাড়িতে, সিংহের ওপর দু'পা মুড়ে বাবু হয়ে। তার দু'পাশে সহচরী হন মোট চারজন সখী। ধাতুনির্মিত বাহারি নকশাকাটা চালচিত্রের গোলাকার অংশটি ঢেকে রাখা হয় লাল কাপড়ে। আকুন্দ তুলোর ছোট ছোট রোঁয়া বের করে তা লোমের মতো করে সাঁটিয়ে দেওয়া হয় সিংহের সর্বাঙ্গে। এর ওপর মা বসেন তার নবসজ্জিত আভরণে। সখীরাও সেজে ওঠে ফুল হাতে নতুন ঘাগড়া চেলিতে।
এ-বাড়ির পুজো বাকি সব জায়গার মতোই একদিনে সম্পন্ন হলেও, সকাল থেকে পুজো হয় তিনটি পদক্ষেপে। অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় মা-কে দেওয়া হয় চালের নৈবেদ্য, গোটা ফল। সাজানো হয় ১০৮টি পদ্ম আর পিতলের প্রদীপ দিয়ে। পাশাপাশি চলতে থাকে কুমারী পুজো। এরপরই ঠাকুরদালানজুড়ে সারিবদ্ধভাবে বাড়ির সমস্ত মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় ধুনো পোড়ানোর উৎসব। তবে শুধু পুজো নয়, প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় যে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় আজও, তা দেখে ঊনবিংশ শতকের উৎসবের ছবি মনে পড়ে যায়। বিসর্জনের সময় মায়ের সমগ্র চালচিত্র ৪ সখীসমেত লরিতে রাখা মঞ্চের ওপর তুলে দেওয়া হয়। গোটা মঞ্চ সেজে ওঠে আলোক-বর্ণে। তারপর সেই আলোকসজ্জিত মঞ্চ যখন ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার রাজপথ ধরে গঙ্গার দিকে, তখন দু'পাশের মানুষের ভিড় আর উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয় টাইমমেশিনে চড়ে সবাই বুঝি একসঙ্গে পৌঁছে গিয়েছি উনিশ শতকের কলকাতায়। চোখে ভেসে ওঠে সাবেক শহর। মনে-মনে দিন গুনি পরবর্তী উৎসবের।