কৃষ্ণচন্দ্র দর্শন পেয়েছিলেন যোদ্ধাবেশী জগদ্ধাত্রীর! আজও অটুট যে কিংবদন্তি
Jagaddhatri Puja 2022: কৃষ্ণনগরে অনেকেই বাইরে থেকে আসেন এ-সময়ে। প্রধানত চাষা পাড়া বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী ‘বুড়ি-মা’-র টানে।
দুর্গাপুজো শেষ। পেরিয়ে গেল লক্ষ্মীপূর্ণিমা-ও। মা কালি ফিরে গেছেন এখন কৈলাসে। পড়ে থাকল কী? মাঠ, শুকনো ঘাস-মাটি। অল্প-অল্প শীতের হাওয়া। আর হেমন্তকাল।
বেশ কয়েক বছর আগে, এরকমই এক হেমন্তকাল। প্রতিমা দর্শনে গেছি কৃষ্ণনগরের এক জগদ্ধাত্রী বারোয়ারিতে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে, আমারই মায়ের বয়সি একজন মহিলা। গায়ে ময়লা শাড়ি, সম্পূর্ণ অলংকারহীন, জোড়হাতে বিড়-বিড় করে বলে যাচ্ছেন: ‘মা গো, আমার ছেলেটা মরে গেছে, তুমিই তো ওকে নিয়ে নিয়েছ মা। কত বছর হয়ে গেল। তোমার কাছেই তো আছে এখন! ওকে একটু সামলে রেখো। ওকে একটু দেখো মা গো! ওকে একটু দেখো!’ যে এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই আর, নিজের সেই মরা ছেলের জন্য একজন মা আরেক মায়ের কাছে প্রার্থনা করছেন! ‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দটির অর্থ হল জগৎকে ধারণ করে আছেন যিনি। ওই সন্তানহারা মায়ের শোক-ও তাহলে সেই ধারণপাত্রে ঠাঁই পায়!
জগদ্ধাত্রীকে অনেকেই ধরিত্রীদেবীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে এশিয়া মাইনরে তানতোশিয়ার পার্বত্য এলাকায় গুহার ভেতর সিংহবাহনা এক দেবীর পুজো হতো। সেখানকার অধিবাসীদের কাছে সেই দেবী পরিচিত ছিলেন ‘গাদান মা’ নামে। সুকুমার সেন-এর মতে, ‘গাদান মা’-ই ধরিত্রীদেবী। কেননা পুরাণ-বর্ণিত পৃথিবী-দেবীর সঙ্গে ‘গাদান মা’-র সাদৃশ্য রয়েছে। শশিভূষণ দাশগুপ্তের লেখা ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থেও দেখতে পাওয়া যায় জগদ্ধাত্রী দেবী আর বসুন্ধরা দেবীর মধ্যেকার সাদৃশ্য। আরও একটি সূত্র পাওয়া যায় কালিকা পুরাণে। মিথিলার রাজা জনক, দেবী বসুন্ধরার দর্শন পেয়েছিলেন জগদ্ধাত্রী-রূপে। দেবী দুর্গা-র সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর বেশ কিছু মিল রয়েছে। ‘মার্কন্ডেয় পুরাণ’, ‘কাত্যায়নী তন্ত্র’, ‘তন্ত্রসার’- এইসব গ্রন্থেও রয়েছে জগদ্ধাত্রীর অনুষঙ্গ। এছাড়া বেশ কিছু বৌদ্ধতন্ত্রেও এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন: সিংহের ওপর বসে জগদ্ধাত্রী! আজও ঐতিহ্য মেনে পুজো হয় বটকৃষ্ণ পালের অট্টালিকায়
কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষে নবমী তিথিতে পূজিত হবেন জগদ্ধাত্রী- এমনই এক নির্দেশবাক্য খুঁজে পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকে শূলপানি-র ‘ব্রতকালবিবেক’ গ্রন্থে: ‘কার্ত্তিক মলপক্ষস্য বেতাদৌ নবমেহনি/পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে নিষেদুষীম্।’ জগদ্ধাত্রীর এই পূজাতিথির সমর্থন জানায় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর দুই গ্রন্থ ‘স্মৃতিরত্নহার’ এবং ‘কৃত্যন্তত্ত্বার্ণব’-ও। এইসব উল্লেখের পাশে রাখতে চাইব ‘উৎসবে মেলায় ইতিহাসে’ বইয়ে কৃষ্ণনাগরিক সুধীর চক্রবর্তী-র এই বয়ান:
সার কথা হল জগদ্ধাত্রী পূজা আসলে একদিনে নিষ্পাদ্য দুর্গাপূজা’, বলেছিলেন অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী আমাদেরই অনার্স ক্লাসে, কৃষ্ণনগর কলেজে। ছাত্রাবস্থায় তাঁর কাছেই জেনেছিলাম, একদিনে জগদ্ধাত্রী পুজো করলে নাকি চতুর্বর্গ ফললাভ হয়। কৃষ্ণনগরে কার্ত্তিক নবমীতে একইদিনে জগদ্ধাত্রীর সাত্ত্বিকী, রাজসিকী এবং তামসী পূজা হয়। প্রাতে মধ্যাহ্নে ও সন্ধ্যায়। চন্দননগরে তা হয় না। সেখানে জগদ্ধাত্রী পূজা চারদিনের।
সুধীর চক্রবর্তী-র প্রতি এই লেখা কৃতজ্ঞ। তাঁর স্মৃতিকে অনুসরণ করে এবার প্রবেশ করা যাক কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো-র প্রসঙ্গে। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি ও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের কিংবদন্তী। জানা যায়, একবার নবাবকে খাজনা দিতে না-পারায় কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর ছেলে শিবচন্দ্র বন্দি হন। তখন ১৭৬৩ সাল। আশ্বিন মাসে কারামুক্ত হলেও সেবার দুর্গা পুজোয় অংশ নিতে পারেননি কৃষ্ণচন্দ্র। এ-ঘটনা তাঁকে খুবই হতাশ করে। এরপরই ঘটে দেবীর এক স্বপ্নাদেশ। সেই স্বপ্নে চাক্ষুষ করা দেবী-রূপকেই রাজা গড়ে নেন কৃষ্ণনগরের দক্ষ মৃৎশিল্পীদের সহযোগিতায়। কৃষ্ণনগরে শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজো!
সাধারণত জগদ্ধাত্রীর যে-মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। কেমন সে-মূর্তি? প্রচলিত জগদ্ধাত্রী-র বাহন কেশরবহুল সিংহ। কিন্তু রাজবাড়ির সিংহ কেশরহীন। দেখতে অনেকটা সাদা, লম্বা ঘোড়ার মতন। মুখে রয়েছে মকরের ছোঁয়া। যেন যুদ্ধের জন্য উন্মুখ। একে বলা: নরসিংহ। দেবী রক্তাম্বর, চতুর্ভুজা। শঙ্খ, চক্র ও ধনুর্বাণ নিয়ে অশুভ-নাশে প্রস্তুত।
রাজবাড়ির যোদ্ধাবেশী দেবীর রূপ-পরিকল্পনার পিছনে রয়েছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। বন্দিদশা থেকে মুক্তির অব্যবহিত পরেই রাজা এই মূর্তির দর্শন পেয়েছিলেন। এখানে মনে হয়, মূর্তি-পরিকল্পনায় যুদ্ধবেশ কৃষ্ণচন্দ্রের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপণ। আসলে, দেবতা-নির্মাণের নেপথ্যে সর্বদাই ক্রিয়াশীল মানুষেরই কামনা-বাসনার অন্তঃসার।
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর রেশ চন্দননগরে পৌঁছেছিল আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। নদিয়াররাজ কৃষ্ণচন্দ্র চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত ছিলেন। সেই প্রেক্ষিতেই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয় চন্দননগরে।
কৃষ্ণনগরের বারোয়ারিগুলিতে দেখা যায় জগদ্ধাত্রী-র মনোহর ও দীর্ঘকায় দেবীমূর্তি। স্থানীয় ঘূর্ণি, নতুন বাজার ও কুমোর পাড়ার মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার স্পর্শ থাকে এইসব মূর্তি-নির্মাণে। প্রতিমার অন্যান্য আনুষঙ্গিক সজ্জা- চুল, মুকুট, ডাকের সাজ সরবরাহ করে কৃষ্ণনগরের আনন্দময়ী তলা, চৌরাস্তা ও বাগদী পাড়া অঞ্চলের কারিগররা। চোখে পড়ে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা অসংখ্য ঢাকিদেরও।
প্রতিমা বিসর্জন কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী উৎসবের এক বিশেষ আকর্ষণ। এখানে বিসর্জনের রীতি দু-রকম। দশমীর সকালে প্রত্যেক বারোয়ারির দেবী-ঘট মাথায় করে বা পালকি করে জলাঙ্গি নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার দু'-পাশে থাকে ঢাকের তালবাদ্য। বহুরূপী বা সঙ-এর সাজে দেখা যায় কালি, দুর্গা, গোপাল ভাঁড় প্রভৃতি চরিত্রদের। লোকসমাজে উৎসবে, অনুষ্ঠানে সঙ-এর প্রচলন দেখা যেত। সঙ সাজবার জন্য মানুষ বেছে নিত রামায়ন-মহাভারত-পুরাণসহ সাম্প্রতিক-সময়ে জনপ্রিয় বিভিন্ন চরিত্র। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজনে এরকম অজস্র লৌকিক উপাদানের দৃষ্টান্ত এখনও খুঁজে পাওয়া যায়।
ঘট বিসর্জন শেষে রাত্রিবেলায় শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। পূর্বে ঢোল-সানাই বাজিয়ে খেমটা গান হত। সারারাত কারবাইট গ্যাসের আলোয় প্রতিমা সাজিয়ে চলত দেবীর বিসর্জন। একে বলা হত: আড়ং। বর্তমানে খেমটা গান, খেউড়-এর দেখা তেমন আর মেলে না। তবে এখানে সাঙ-এ বিসর্জনের প্রথা এখনও বহাল। মোটা বাঁশ দড়ি দিয়ে বেঁধে লম্বালম্বি ও আড়াআড়িভাবে এক বিশেষ বিন্যাসে তৈরি হয়: সাঙ। সাঙ-এর ওপরে দেবীকে বসিয়ে, সাঙ কাঁধে তুলে নেন বেহারারা। তারপর ছুটতে থাকেন। কৃষ্ণনগরের যে-অঞ্চলেরই বারোয়ারি-ই হোক না কেন, মন্দির-ঘর থেকে ওঠবার পর সাঙ-এ চড়ে কৃষ্ণনগরের প্রায় সমস্ত জগদ্ধাত্রী-ই যান রাজবাড়ি প্রদক্ষিণ করতে। পূর্বে, দেবীকে যখন রাজবাড়িতে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে যাওয়া হত, রানি-মা খুশি হয়ে নানা পারিতোষিক দিতেন। যে-প্রতিমা সবচেয়ে পছন্দ হতো রানি-মার, তাঁর নির্মাণশিল্পীর হাতে তুলে দিতেন কাঁসার ঘড়া।
আজ আর রাজা নেই। রাজত্ব-ও নেই। তবুও বারোয়ারিগুলি তাদের প্রতিমাকে নিয়ে নিরঞ্জনের আগে সমারোহে উপস্থিত হয় নিস্তব্ধ রাজবাড়ি-র প্রাঙ্গণে। এ কি রাজার স্মৃতি ও ক্ষয়িষ্ণু রাজতন্ত্রের প্রতি সম্ভ্রম-নিবেদন? না কি আভিজাত্যের প্রতি এক অমোঘ টান? জানি না। তবে একে অনায়াসেই বলা যেতে পারে ঐতিহ্যের এক আবেগপূর্ণ উত্তারধিকার।
কৃষ্ণনগরে অনেকেই বাইরে থেকে আসেন এ-সময়ে। প্রধানত চাষা পাড়া বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী ‘বুড়ি-মা’-র টানে। বহু মানুষ মানত করেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে শাড়ি, সোনার টিপ, অলংকার দিয়ে যান। এবার বুড়ি-মার আড়াইশো বছরের উদযাপন। লোক-সমাগম তাই আরও বেশি। বুড়ি-মার সৌন্দর্যের বিভাকে বাড়িয়ে দেয় তাঁর পূজার প্রভূত বিলাস-আয়োজন ও কোটি-কোটি টাকার গয়না। ঈশ্বরের স্বর্ণ-সম্পদ ঠিক কতটা? এখানে ভিড় জমে তা দেখতেও।
বিসর্জন যখন মধ্যরাত পার করে যায়, বুড়ি-মাকে নিয়ে আসা হয় চাষা পাড়ার মুখে। সামনেই শহরের প্রধান রাজপথ। বুড়ি-মা যাবেন সবার শেষে। এমনই প্রথা! তার আগে একের-পর দেবী তাঁর সামনে দিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যান। যেন কোনও গুরুজনের কাছে মুখটুকু দেখিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা!
পথে হাজার-হাজার লোক, এত আলো, ঢাকের আওয়াজ, রংমশাল, বাজি- এসবের মধ্য দিয়ে হেমন্তকালের জলের মধ্যে ডুব দেন জগদ্ধাত্রী। ঘরে ফেরে মা।
জগদ্ধাত্রী মায়ের বাড়ি ফেরার পর, উৎসব শেষে মনে হয়, সেই যে মৃত সন্তানের মা, তিনিও কি নিজের সন্তানশোক থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন নিজের রোজকার জীবনে? পরের বছর আবার আলো, আবার ঢাক-বাদ্য, আবারও উৎসব! এবং হয়তো আবারও সেই সন্তানহারা মা পৌঁছে যাবেন কোনও-না-কোনও জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রাঙ্গণে। তাঁর মনে জ্বলতে থাকবে সেই একই প্রার্থনা: তাঁর মৃত ছেলে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকে যেন!
যিনি সমস্ত জগৎকে ধারণ করে আছেন, সেই জগদ্ধাত্রী যাওয়া-আসার পথে একবারও কি মৃত ছেলের খবর তাঁর মা-কে দিয়ে যাবেন না?