আসছে গুড়ের মরশুম! স্বাদে নয় শুধু, পুষ্টিগুণেও সেরা এই শীতের মিষ্টিমুখ
Jaggery: গুড় সাধারণত শরীরকে যে কোনও অসুখ থেকে রক্ষা করে শক্তি জোগায়। একে আয়ুর্বেদিক নানা ওষুধ তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়।
শীতের মরশুম এল বলে। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া বইতে শুরু হলেই বাঙালির মনটা পিঠে, পায়েস করে ওঠে। আর পিঠে-পায়েস মানে গুড়ের কথা আসবেই। আবার এখনকার দিনে স্বাস্থ্যসচেতন বহু মানুষই চিনির বিকল্প হিসেবে গুড় ব্যবহার করেন। চিনি অনেক বেশি প্রসেসিং করে আজকাল বিক্রি হয়। ফলে চিনির যে খাদ্যগুণ, তা অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে গুড় অনেক অকৃত্রিম। গরমকালে যেমন শসা, তরমুজ শরীর ঠান্ডা রাখে, তেমনই শীতকালে গুড় শরীরের জন্য খুবই উপকারী। হ্যাঁ ঠিকই, গুড়ের খাদ্যগুণ জানলে অবাক হতে হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল, আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে। গুড় সাধারণত শরীরকে যে কোনও অসুখ থেকে রক্ষা করে শক্তি জোগায়। একে আয়ুর্বেদিক নানা ওষুধ তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত তিন ধরনের গুড় বেশি জনপ্রিয়, ১. আখের গুড়, ২. তালের গুড় এবং ৩. খেজুরের গুড়।
গুড়ের পুষ্টিগুণ
গুড় রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত হলেও তা পুষ্টিগুণে ভরপুর। প্রতি ১০০ গ্রাম গুড়ে নিম্নলিখিত উপাদানগুলি রয়েছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম গুড়ে পুষ্টিগুণ
শক্তি ৩৭৫ কিলোক্যালোরি
কার্বোহাইড্রেট ৯২.৮৬ গ্রাম
চিনি ৮৫.৭১ গ্রাম
খনিজ বস্তু
ক্যালশিয়াম ২৯ মিলিগ্রাম
লোহা ২.৫৭ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম ৩৬ মিলিগ্রাম
আরও পড়ুন: মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিকের কণা! কতটা নিরাপদ আপনার শিশু
গুড়ের উপকারিতা
১. রক্তাল্পতার জন্য গুড়
রক্তাল্পতার কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অত্যন্ত কমে যায়। এর ফলে শরীরে সঠিকভাবে অক্সিজেন পৌঁছয় না, যার ফলে চাপ ও ক্লান্তির মতো বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা যায়। গবেষণা বলছে, গুড় লোহাতে সমৃদ্ধ এবং সেজন্য এটি রক্তাল্পতা প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। মহিলা এবং কিশোরীরা দৈনিক গুড় সেবন করে রক্তাল্পতা রোধ করতে পারে।
২. গুড় রক্ত শুদ্ধ করে
গুড় একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান। এটি শরীরের বিষক্রিয়া দূর করে এবং যকৃৎ ও অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করে।
৩. মস্তিষ্কের ক্রিয়া উন্নত করে
গুড়ে বেশ ভালো পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে, যা মস্তিষ্কের স্নায়ুতে বার্তা নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত করার জন্য দায়ী। তাই গুড় খেলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং স্নায়বিক ক্ষয় প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
৪. ওজন হ্রাসে সহায়ক
আপনি যদি ওজন কমাতে চান, তাহলে চিনির অত্যন্ত ভালো একটি বিকল্প হলো গুড়। চিনির বিপরীতধর্মী হিসেবে গুড় স্বাস্থ্যবর্ধক ভিটামিন ও খনিজ বস্তু দিয়ে তৈরি এবং বিপাকীয় কার্যকলাপ উন্নত করে বলে ওজন হ্রাস পায়।
৫. ফুসফুসের জন্য উপকারী
ফুসফুস প্রতিনিয়ত ক্ষতিকারক ধূলিকণা এবং দূষণে উন্মুক্ত হতে থাকে। যদিও ফুসফুসের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ধূলিকণা নিষ্কাশিত হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধুলোর মধ্যে থাকতে থাকতে ফুসফুসের রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষত বর্তমানে যে হারে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ফুসফুসের রোগ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তাছাড়া যাঁরা নির্মাণ কাজে নিযুক্ত শ্রমিক বা খনির শ্রমিক, রাসায়নিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্লিনিক্যাল গবেষণা বলছে যে, গুড় ফুসফুস থেকে ধূলিকণা অপসারণে সক্ষম। এমনকী, গুড় ফুসফুসের ক্ষত নিরাময় করতেও কার্যকর। এছাড়া গুড়ে থাকা পুষ্টিগুণের ক্যানসার প্রতিরোধক ক্ষমতা রয়েছে। ফলে ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়।
৬. ঋতুস্রাবে উপকারী
ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা, মেজাজ পরিবর্তন, মাথা ব্যথা এবং পেশির সংকোচনের মতো বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। এইসব সমস্যার ঘরোয়া প্রতিকার করতে চাইলে গুড় বেছে নিন। তাই ঋতুস্রাবের সময় গুড় খেলে রক্তের বাধাহীন চলাচল বজায় থাকে।
কীভাবে খাবেন?
১. গুড় এমন এক ধরনের খাদ্যবস্তু, যা প্রায় সবসময়ই পাওয়া যায় এবং যে-কোনও ঋতুতে যখন ইচ্ছে, খাওয়া যেতে পারে। দুধের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায় এবং ভালো ঘুমও হয়।
২. খাওয়ার পর যদি মিষ্টি খেতে মন চায়, তাহলে গুড় খেতে পারেন। এর ফলে মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছেও মিটবে এবং যেহেতু গুড় হজমশক্তি বাড়িয়ে দেয়, তাই দ্রুত খাবার হজমও হয়ে যাবে।
৩. সকালে জলখাবারের আগে বা পরে চিনাবাদাম, আখরোট ও গুড় খেলে সারাদিন ভরপুর এনার্জি পাওয়া যায় কাজের।
৪. শীতের সময় গুড়ের তৈরি খাবার খেলে শরীরে ঠান্ডার প্রভাব পড়ে না। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে এবং মাইগ্রেনের সমস্যাও কমবে।
৫. গুড়ের হালুয়া করে খেতে পারেন, এর ফলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে। ভাতের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে খেলে গলা খুলে যায় এবং স্বাভাবিক স্বর ফিরে পাওয়া যায়।
গুড়ের অপকারিতা
১. কোনও কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। তাই অতিরিক্ত পরিমাণে গুড় খেলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাঁরা ভুলেও খাবেন না গুড়।
২. গুড় খাওয়ার আগে শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। যদি সঠিকভাবে শুদ্ধিকরণ না করা হয়, তাহলে তাতে নানা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু থেকে যায় এবং তা খেলে শরীরে একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩. অত্যধিক পরিমাণে গুড় খেলে তা ক্রমে কোষ্ঠকাঠিন্যর রূপ নেয়, চর্মরোগ, বমি ভাবও হতে পারে। তাই পরিমাণ মেপে গুড় খান।