মানুষের গল্প বলে তাঁর ছবি! অসমিয়া চলচ্চিত্রকে একাই বদলে দিয়েছেন জাহ্নু বড়ুয়া
Jahnu Barua: জাহ্নু বড়ুয়ার সমান্তরাল চলচ্চিত্রের মন্থন ঘটিয়েই সমকালীন অসমিয়া ছবি এগিয়ে চলেছে আপন খেয়ালে।
অসমিয়া চলচ্চিত্রের ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়, তাতে বৈচিত্র্যও কম। তবে আটের দশকের শুরু থেকে জাহ্নু বড়ুয়া যেভাবে সময়ের দাবি মেনে অবিচলভাবে সমান্তরাল চলচ্চিত্র করে চলেছেন এবং নিজেকে এখনও সক্রিয় রেখেছেন, সেক্ষেত্রে তাঁকে নব্যধারার অসমিয়া চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ বলা যেতেই পারে। যদিও জাহ্নু বড়ুয়ার সমসাময়িক ও তাঁর আগের প্রজন্মের কয়েকজন চলচ্চিত্রকারের সামগ্রিক অবদান কোনও ভাবেই অস্বীকার্য নয়। তাই আজ জাহ্নু বড়ুয়ার সত্তরতম জন্মদিবসে তাঁর সিনেমা-যাপন সম্পর্কে দু'-চার কথা লেখার আগে সেইসব অবদানের কথাও সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন।
১৯৩৫ সালে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়াল পরিচালিত ও প্রযোজিত ছবি 'জয়মতী' দিয়ে অসমিয়া চলচ্চিত্রের সূচনা হয়। এটি একটি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র, যা পৌরাণিক এবং অতি-নাটকীয় ঘরানার তৎকালীন ভারতীয় সিনেমার প্রবণতাকে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময়পর্বে মূলধারার ভারতীয় ছবিতে হয় দেব-দেবী, আর নয়তো কোনও মনীষীর জীবনী দেখানো হতো। সেই প্রেক্ষিতে, জয়মতী কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকা চলচ্চিত্র। এর বছরচারেক পর আগরওয়াল 'ইন্দ্রমালতী' নামের একটি ছবি বানান। তারপরের কয়েক বছর অসমিয়া চলচ্চিত্র হৃৎস্পন্দন হারায়। ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনীর পরাজয় ঘটে, ইতালিতে এই সুযোগে একদল ফিল্মমেকার ঠিক করেন, তাঁদের রুক্ষ, কঠোর বাস্তবকেই ছবির পর্দায় ধরবেন এবং এইভাবে তাঁরা নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রের সূচনা করেন। ভারতেও চারের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-র (আইপিটিএ) সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়, এতে পৃথ্বীরাজ কাপুর, বলরাজ সাহানি, ভূপেন হাজারিকা, শচীন দেববর্মন, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটকরা শামিল হন। কে. এ. আব্বাস 'ধরতি কে লাল' (১৯৪৬) বানিয়ে তাতে বাংলার মহাদুর্ভিক্ষকে নথিভুক্ত করেন এবং অমানবিক আচরণের জন্য ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করেন। এই চলচ্চিত্রটিকে প্রথম মূলধারার ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা সিনেমাকে সামাজিক সংস্কারের মাধ্যম হিসেবে সমর্থন জানিয়েছিল। চল্লিশের দশকেই আবার নতুন করে অসমিয়া চলচ্চিত্র ক্রমশ বিস্তার লাভ শুরু করে; রোহিণী কর বড়ুয়া, পার্বতীপ্রসাদ বড়ুয়া, কমল নারায়ণ চৌধুরী, ফণী শর্মা, অসিত সেন, প্রবীণ ফুকনরা চারের দশকে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ছবি তৈরি করেন। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি ফণী শর্মা পরিচালিত ছবি পিয়লি ফুকন (১৯৫৫) সেই প্রথমবার শ্রেষ্ঠ অসমিয়া চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সেই সময়ের অসমিয়া চলচ্চিত্রে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সামাজিকভাবে সচেতন মানসিকতার প্রকাশ হতে থাকে, তবে তথাকথিত নব্যধারার ভারতীয় ছবি থেকে অসমিয়া ছবির নির্যাস তখনও অনেকটাই দূরে।
জাতীয় স্তরে আইপিটিএ মূলত নব্য বাস্তববাদের দু'টি দিকের ওপর জোর দিয়েছিল, প্রথমত সামাজিক সমালোচনা এবং দ্বিতীয়ত নির্মাণ ও চলচ্চিত্র শৈলী। এটি ভারতে নব্যবাস্তববাদের জন্য দু'টি গতিপথ গড়ে তোলে― সমান্তরাল চলচ্চিত্র এবং বম্বে-কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক ছবি। বিমল রায়ের 'উদয়ের পথে' (১৯৪৪), নীতীন বসুর 'মজদুর' (১৯৪৫), নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' (১৯৫১), হেমেন গুপ্তর '৪২' (১৯৫১), ঋত্বিক ঘটকের 'নাগরিক' (১৯৫২), সলিল সেনের 'নতুন ইহুদী' (১৯৫৩), সত্যেন বসুর 'রিকশাওয়ালা' (১৯৫৩) ইত্যাদি চলচ্চিত্র এই ভাবধারা বজায় রেখেই গড়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয় এবং বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের, বিশেষত ইউরোপীয় ছবিগুলো ভারতীয়রা দেখার সুযোগ পায়। ভিত্তোরিও দে সিকার নিওরিয়ালিস্ট ফিল্ম 'বাইসাইকেল থিভস' (১৯৪৮) এবং কে. এ. আব্বাসের 'ধরতি কে লাল' (১৯৪৬) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিমল রায় 'দো বিঘা জমিন' (১৯৫৩) তৈরি করে নব্য বাস্তববাদের বৈশিষ্ট্যগুলিকে মূলধারার চলচ্চিত্রে সর্বতোভাবে আপন করে নেওয়ার প্রয়াস নেন। সেই সময়পর্বেই সত্যজিৎ রায়ও নব্যবাস্তববাদী চলচ্চিত্রের আবহে ১৯৫৫ সালে 'পথের পাঁচালী' তৈরি করেন। পাঁচের দশকে ফণী শর্মা ছাড়াও অসমিয়া চলচ্চিত্রে আরও কয়েকজন নতুন প্রজন্মের ফিল্মমেকার ছবি বানানো শুরু করেছিলেন। যেমন নিপ বড়ুয়া পরপর কয়েকটি ছবি বানিয়ে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে পরিচিত হতে থাকেন। ভূপেন হাজারিকা পরিচালিত ও প্রযোজিত প্রথম ছবি 'ইরা বাটর সুর' (১৯৫৬) এই সময়পর্বেই মুক্তি পায়। প্রভাত মুখোপাধ্যায় সার্বজনীন মাতৃত্ব নিয়ে 'পূবেরুণ' (১৯৫৯) তৈরি করেন, যা বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়।
ছয় ও সাতের দশক ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক যুগ-পরিবর্তনের সময়কাল, কেননা এই সময়েই শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, জি. অরবিন্দন, আদুর গোপালকৃষ্ণন, গিরিশ কারনাড, গিরিশ কাসারভাল্লি, মণি কউল, কুমার সাহানি, অরিবাম শ্যাম শর্মার মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা মূলধারার চলচ্চিত্র থেকে সরে গিয়ে সমান্তরাল চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। ছয়ের দশকে অসমিয়ায় লক্ষ্যধর চৌধুরী ও প্রবীণ ফুকনের 'লাচিত বরফুকন' (১৯৬১) ও ভূপেন হাজারিকার 'শকুন্তলা' (১৯৬১) বের হয়। এর ঠিক পরে-পরেই একগুচ্ছ অসমিয়া ছবি নিয়মিত প্রযোজিত হওয়া শুরু করে। যেমন নিপ বড়ুয়ার 'নরকাসুর', অনিল চৌধুরীর 'মাতৃ স্বর্গ', ব্রজেন বড়ুয়ার 'ইতো সিতো বাহুতো' ও 'মুক্তো' এবং আনোয়ার হুসেইনের 'তেজিমালা'। সাতের দশকে একঝাঁক নতুন পরিচালকের দেখা পাওয়া যেতে শুরু করে, যেমন সমরেন্দ্র নারায়ণ দেবের 'অরণ্য' (১৯৭০), কমল চৌধুরীর 'ভাইটি' (১৯৭২, অসমিয়ায় তৈরি প্রথম রঙীন ছবি), মনোরঞ্জন সুরের 'উত্তরণ# (১৯৭৩), প্রবীণ বোরা-র 'পরিণাম' (১৯৭৪), দেউটি বড়ুয়ার 'বৃষ্টি' (১৯৭৪), পুলক গগৈ-এর 'খোঁজ' (১৯৭৪), পদুম বড়ুয়ার 'গঙা চিলনীর পাখি' (১৯৭৬), ভবেন্দ্ৰনাথ শইকীয়ার 'সন্ধ্যারাগ' (১৯৭৭) ও অতুল বরদলৈ-এর 'কল্লোল' (১৯৭৮) উল্লেখযোগ্য। কিন্তু মূলত ভবেন্দ্ৰনাথ শইকীয়া ও আটের দশকে জাহ্নু বড়ুয়ার হাত ধরেই অসমিয়া সমান্তরাল চলচ্চিত্রর স্বয়ংসম্পূর্ণ সূচনা হয়।
ভবেন্দ্ৰনাথ শইকীয়ার চলচ্চিত্র, যেমন 'সন্ধ্যারাগ' (১৯৭৭), 'অনির্বাণ' (১৯৮১), 'অগ্নিস্নান' (১৯৮৫), 'কোলাহল' (১৯৮৮), 'সারথী' (১৯৯১), 'আবর্তন' (১৯৯৩), 'ইতিহাস' (১৯৯৫) ও 'কালসন্ধ্যা' (১৯৯৭) ছবিগুলি সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে যেমন সচেতন, তেমনি নারীবাদী সত্তায় মুখর। এই ধারাটিকেই জাহ্নু বড়ুয়া তাঁর প্রথম ছবি 'অপরূপা' (১৯৮২)-তে ধরেন এবং পরপর অনেকগুলি জাগরুক ছবি বানিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অসমিয়া চলচ্চিত্রকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
জাহ্নু বড়ুয়ার জন্ম ১৯৫২ সালে। ১৯৭৪ সাল নাগাদ তিনি পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় স্নাতক হন এবং ছোটখাটো বিভিন্ন প্রোজেক্টে কাজ করা শুরু করেন। অবশেষে SITE-এর জন্য ১০০টিরও বেশি শিক্ষামূলক টিভি প্রোগ্রাম তৈরি করতে ইসরো-তে যোগদান করেন। যদিও বেশিদিন স্থায়ী হননি; তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি পদত্যাগ করেন। অপরূপা ছবিটির একটি হিন্দি সংস্করণ (অপেক্ষা) পরের বছর বের হয়। অসমের ঔপনিবেশিক উচ্চবিত্ত সমাজে, একজন তরুণীকে এক ধনী চা-ব্যবসায়ীর সাথে একটি সাজানো বিয়ের কারণে তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সাধনা ছেড়ে দিতে হয়। বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক নিয়মকানুন মেয়েটির পক্ষে একঘেয়েমির কারাগারে পরিণত হয়, কারণ তার স্বামী তার ব্যবসার জন্য তাকে সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করতে শুরু করে। মেয়েটি যখন আবিষ্কার করে যে, তার বাবার বিশাল ঋণ পরিশোধ করার অভিপ্রায়ে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন সে ক্ষুব্ধ হয়। সে নিজেকে তার স্বামীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে বলে মনে করে। তারপর একদিন একজন পুরনো সহপাঠী ও প্রাক্তন প্রেমিক, যে কিনা বর্তমানে একজন সেনা অফিসার, তার সঙ্গে মেয়েটির আবার নতুন করে দেখা হয়। বিষণ্ণ মেয়েটি এই পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পিত করে নতুন জীবনের প্রত্যাশায়।
১৯৮৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত নির্বাচন বয়কটের দাবিতে ব্যাপক ছাত্র অস্থিরতার পটভূমিতে জাহ্নু বড়ুয়ার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র 'পাপড়ি' (১৯৮৬) নির্মিত। এই আন্দোলন চলাকালীন কয়েক হাজার নিরপরাধকে হত্যা করা হয়। তিনি এই আন্দোলনের ওপর একটি ডকুমেন্টারি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তবে রাজ্য সরকার অনুমতি না দেওয়ায়, তিনি পরিবর্তে একটি ফিচার তৈরি করার সংকল্প গ্রহণ করেন। একজন সাধারণ গৃহবধূ পাপড়ি তার স্বামী এবং একটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছোট মেয়ের সংসার চালায়। নির্দোষ স্বামীকে হত্যার দায়ে গ্রেফতার করা হয় এবং শিশুটি হাসপাতালে মারা যায়। একজন পাচারকারী পাপড়িকে ধর্ষণ করে এবং তার স্বামী দোষী সাব্যস্ত হয়। ফুকন নামের একজন পুলিশ পরিদর্শক প্রকৃত খুনিকে খুঁজে পায়, কিন্তু তাকে গ্রেফতার করতে পারে না কারণ খুনি রাজনৈতিক সুরক্ষা লাভ করে। পরিদর্শককে বদলি করা হয়; পাপড়ি আত্মহত্যার চিন্তা ত্যাগ করে এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াই করার সংকল্প নেয়।
জাহ্নুর তৃতীয় ছবি 'হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়' (১৯৮৭)-তে নীতিজ্ঞানহীন রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে তৈরি হওয়া অন্ধকারকে তীক্ষ্ণভাবে প্রদর্শিত করে। একজন মধ্যবয়সি কৃষক রসেশ্বর তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে একটি ছোট জমিতে অনিশ্চিতভাবে বসবাস করেন। একজন ধনী মহাজন তাকে এসে একদিন জানায় যে, তার বাবার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বিনিময়ে কৃষকটির বাবা তার কাছে জমিটি বন্ধক রেখেছিল। এই বলে ধনী মহাজনটি জমির দখল নিয়ে নেয়। ধনী মহাজনটির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য কৃষকটি গরু পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়, কিন্তু ঘুষ দিতে না পারায় সে মামলায় হেরে যায়। তার ছেলে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে মোড়লের বাড়িতে চাকরের কাজে যোগ দেয়। যেহেতু ধনী, শঠ ব্যক্তিটি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাই বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে কৃষকের করা মামলাটি ব্যবহার করার চেষ্টা করে। তার জমি কেড়ে নেওয়া শঠ লোকটির পোস্টার দেখে কৃষকটি নিজের সীমাহীন দুর্দশার কথা ভেবে ব্যথিত হয়। ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফি ও সামগ্রিক বক্তব্য প্রশংসিত হয়েছিল এবং পরের বছর লোকার্নো ফেস্টিভালে পুরস্কার পায়। প্রায় তিন দশক ধরে এটি ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র চলচ্চিত্র, যা গোল্ডেন লোটাস পুরস্কার (১৯৮৭) জিততে সক্ষম হয়। তারপর ২০১৮ সালে অন্য একটি অসমিয়া চলচ্চিত্র, রিমা দাসের 'ভিলেজ রকস্টারস' আবার এই পুরস্কার পায়।
আরও মর্মস্পর্শী হলো জাহ্নু বড়ুয়ার ১৯৯৫ সালের 'সাগরলৈ বহুদূর' ছবিটি। ছবিটি একজন খেয়ামাঝিকে নিয়ে। পাওয়াল দিহিং নদীর তীরে নেমুগুড়ি গ্রামের একজন মাঝি। নদীর ওপর একটি সেতু না হওয়া পর্যন্ত তিনি নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। তাদের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে দিহিং নদীতে পালতোলা নৌকা চালিয়ে আসছে। যখন সরকার নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়, তখন তার জীবন নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। এই ছবিটির জন্য বড়ুয়া শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর অন্য চলচ্চিত্রগুলিও সমসাময়িক থিম নিয়ে খুব ভালোভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যেমন ব্যাপকভাবে বন উজাড় করা (বনানী), পুরুষ নৈরাজ্যবাদ (ফিরিঙতি), ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম (কুশল), সরলতার শক্তি (পখী) এবং সন্ত্রাসবাদের কুপ্রভাব (বন্ধন)।
বড়ুয়ার ২০০১ সালের চলচ্চিত্র 'কণিকার রামধেনু' ১১ বছর বয়সি কুকৈ নামের একটি প্রতিভাধর ছেলেকে নিয়ে। সে তার দেশের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং একটি মোটর গ্যারেজে কাজ শুরু করে। একদিন মালিক তাকে গালি দেয় ও শারীরিক অত্যাচার করে। আত্মরক্ষার্থে সে লোহার রড দিয়ে মালিককে মারধর করে। এতে ঘটনাস্থলেই মালিকের মৃত্যু হয়। কুকৈ-এর বিচার হয় এবং একটি কিশোর হোমে পাঠানো হয়। সেখানে সে আহত হয়। তার সুপারিনটেনডেন্ট বিশ্ব বোরো তাকে প্ররোচিত করে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঘটনার কথা ছেলেটি স্বীকার করে। ম্যাজিস্ট্রেট কুকৈকে তার পিতামাতার কাছে হস্তান্তর করার আদেশ দেন। বিশ্ব কুকৈ-এর গ্রামে গিয়ে জানতে পারেন যে, তার মা এক বছর আগে মারা গেছেন। সৎ বাবা তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ব বোর-র নিজের কোন সন্তান ছিল না, ফলে কুকৈ-এর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
জাহ্নু বড়ুয়া এছাড়াও 'তরা' (২০০৪), 'মেনে গান্ধী কো নেহি মারা' (২০০৫), 'অজেয়' (২০১৪) তৈরি করেন। বিগত আড়াই বছর ধরে আগামী ছবির রিসার্চ ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, ছবির বিষয় সপ্তদশ শতাব্দীর আহোম জেনারেল লাচিত বরফুকনের জীবন। সম্প্রতি স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ করেছেন এবং খুব সম্ভবত ২০২৩-এর মধ্যে শুটিং শেষ করে ফেলবেন।
জাহ্নু বড়ুয়ার চলচ্চিত্র নির্মাণের কেন্দ্রে বরাবর চরিত্রের মানবিক উপাদান এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে এবং এইভাবে তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিক অসমিয়া সমাজের দ্বিধাগুলিকে চলচ্চিত্রে জায়গা দিয়েছেন। তাঁর বামপন্থী মতাদর্শ এবং চলচ্চিত্রের নান্দনিকতার সমন্বয় সামাজিক সংগ্রামকে উপস্থাপন করে, সমাজের লোভ ও দুর্নীতিকে উন্মোচিত করে। বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমাটিক চিত্রায়ন নিওরিয়ালিজম এবং ভারতীয় নিউ ওয়েভের বৈশিষ্ট্যগুলি অন্তর্ভুক্ত করে।
এহেন এক ফিল্মমেকারের অবদান আমরা তাই অস্বীকার করতে পারি না। কোনও রকম প্রভাব ব্যতীতই জাহ্নু বড়ুয়া নিজের মতো করে সেই আটের দশক থেকে অসমের কথা তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যার কথা বলে আসছেন। অথচ তাঁর ছবিগুলো রেস্টোরেশন নিয়ে সরকারের তরফে কোনও উদ্যোগ এখনও গ্রহণ করা হয়নি কখনও। একটি ছবিরও ভালো প্রিন্ট উপলব্ধ নেই!
জাহ্নু বড়ুয়ার কাজকর্ম পরবর্তী সময়ের অসমিয়া চলচ্চিত্রনির্মাতাদের নানা রকমভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। জাহ্নুর প্রথম ছবি 'অপরূপা'-র নানা মোটিফ ভাস্কর হাজারিকার 'আমিষ' চলচ্চিত্রে লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে একঝাঁক নতুন প্রজন্ম আবার অসমিয়া চলচ্চিত্রকে সেই সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। ববি শর্মা বরুয়ার 'সোনার বরণ পাখি' (২০১৬), রিমা দাসের 'অন্তর্দৃষ্টি' (২০১৬), 'ভিলেজ রকস্টারস' (২০১৭), 'বুলবুল ক্যান সিং' (২০১৮) ও "তোরা'স হাজবেন্ড" (২০২২), ভাস্কর হাজারিকার 'কথানদী' (২০১৫) ও 'আমিষ' (২০১৯), বিদ্যুৎ কটকীর 'শৈশবতে ধেমালিতে' (২০১৭), রিমা বোরার 'বকুল' (২০১৫) ও 'অনুনাদ' (২০২২), সান্ত্বনা বরদোলৈ-এর 'মাঝ রাতে কেতেকী' (২০১৭), উৎপল বরপুজারীর 'ঈশ্বু' (২০১৭), হিমজ্যোতি তালুকদারের 'ক্যালেন্ডার' (২০১৭), অনুপম কৌশিক বোরার 'বরনদী ভোটিয়াই' (২০১৯), বিশ্বজিৎ বোরার 'ব্যালকনিতে ভগবান' (২০২১) ও 'বুম্বা রাইড' (২০২২), প্রদ্যুৎ কুমার ডেকা-র 'ধুনিয়া তিরুতাবুর' (২০০৯) ও সমীরণ বড়ুয়ার 'আহি আছে' (২০১২), জাদুমণি দত্তর 'পানি' (২০১৪), মৃগাঙ্ক বোরার 'রিয়াজ' (২০২০), কৃপাল কালিটার 'ব্রিজ' (২০২১), পঙ্কজ সোরামের 'ঘোস্ট অফ মাইখুলি' (২০২১), ধনজিৎ দাসের 'নিঃশব্দ কোলাহল' (২০২২), হেমন্ত কুমার দাসের 'ওথেলো' (২০১৪), প্রবাল বড়ুয়ার 'মোর শেষ গান' (২০২২) প্রভৃতি ছবি নতুনভাবে অসমিয়া চলচ্চিত্রকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করে চলেছে। কেবল অসমিয়াতেই নয়, অসমের অন্যান্য সাবেক ভাষাতেও চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে, যেমন সম্প্রতি ডিমাসা ভাষায় আইমি বড়ুয়া 'সেমখোর' (২০২১) বানিয়েছেন।
জাহ্নু বড়ুয়ার সমান্তরাল চলচ্চিত্রের মন্থন ঘটিয়েই সমকালীন অসমিয়া ছবি এগিয়ে চলেছে আপন খেয়ালে। এই যাত্রা শুভ হোক।