মাঠ জুড়ে কেবল রক্ত আর লাশ, এখনও তাড়া করে বেড়ায় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড

Jallianwala Bagh Massacre : কেবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশদের অরাজকতার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন। আর তার পরিণাম? রক্ত, আর্তনাদ আর মৃতদেহ…

বাঙালিদের যেমন পয়লা বৈশাখ, পাঞ্জাবে তেমনই নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখী উৎসবের মাধ্যমে। দুটো দিনই এপ্রিলে; ফসল, মাঠ, মেঠো আওয়াজ আর সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে সেখানে। আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে এমনই এক বৈশাখী উৎসবের সাক্ষী ছিল অমৃতসর। তখন অবশ্য দিনটি পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেবল অমৃতসর নয়, গোটা ভারত তখন বাকরুদ্ধ। পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে কেবল কান্না আর আর্তনাদের রোল। সেই সময়ই বছর কুড়ির এক যুবক এসে উপস্থিত হল সেই মাঠে। আরও কয়েকজন যুবক তখন সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ১৩ এপ্রিল দিনটি পেরিয়ে গিয়েছে, অথচ এখনও যেন কান পাতলে শোনা যাচ্ছে চিৎকারের আওয়াজ। বারুদের গন্ধ নাকে এসে বিঁধছে। সেইসঙ্গে মাঠে, মাটিতে, দেওয়ালের গায়ে তাজা রক্তের দাগ। এখনও শোকায়নি সেসব।

ওই যে একটু দূরে মাঠের মধ্যে রয়েছে একটি কুয়ো। হয়তো এখনও অনেকগুলি লাশ সেখানে ভেসে রয়েছে। বছর কুড়ির ওই যুবকটি নিজেও আহত। তবুও সে রক্তমাখা সেই মাটি ছুঁল। চোখের আগুন ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে জল। মাত্র কয়েকঘণ্টা আগেই এখানে অনেক মানুষ ছিল, নিরীহ তাঁরা, সামান্য ছুরিটুকুও ছিল না হাতে। ব্রিটিশ পুলিশের গুলি তাঁদের চিরকালের মতো স্তব্ধ করে দিল। কী দোষ করেছিলেন ওই মানুষগুলো? কেবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশদের অরাজকতার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন। আর তার পরিণাম? রক্ত, আর্তনাদ আর মৃতদেহ…

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। পেরিয়ে গিয়েছে অনেকগুলি বছর। অমৃতসরের সেই ছোট্ট মাঠে আজও মানুষের ভিড়। দেওয়ালের ইটে লেগে রয়েছে গুলির ক্ষতচিহ্ন। রয়েছে সেই কুয়োটিও। ঢোকার মুখে বড় বড় করে লেখা ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ’। এই নামটি শুনলে আজও ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। ১৯১৯ সালের ওইদিন মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই অতীত হয়ে গিয়েছিলেন কয়েকশো মানুষ। আট থেকে আশি – কেউই ব্রিটিশ পুলিশের গুলি থেকে বাঁচেনি। ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও ভারতের ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস, ভয়ংকর গণহত্যা এখনও যেন তাড়া করে বেড়ায়। জালিয়ানওয়ালা বাগ আসলে এক আগুনের নাম, ব্রিটিশ বর্বরতার সাক্ষী। যে আগুনে ফিনিক্স হয়ে উঠে এসেছিলেন অজস্র বিপ্লবী।

jallianwala bag 2

পূর্বকথন

জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের আগে তার আগের সময়টার কথা একটু জেনে নেওয়া যাক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তখন ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেছেন ভারতীয়রা। সেই ময়দানে আত্মপ্রকাশ হয়েছে মহাত্মা গান্ধী, তরুণ সুভাষচন্দ্র বসুদের মতো নেতাদের। কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিবাদও স্পষ্ট। বিপ্লবীরা গোটা দেশজুড়ে নিজেদের সংগঠন মজবুত করছেন। বিশেষ করে পাঞ্জাব আর বাংলায় আগুন জ্বলছে। সেই সময়ই একটি বিশেষ আইন আনল ব্রিটিশ সরকার। নাম ‘রাওলাট আইন’।

কী বলা হয় এই আইনে? ব্রিটিশ সরকার বলে, এই আইন অনুযায়ী, সরকার বিরোধী কোনওরকম কার্যকলাপ করা যাবে না। সংবাদপত্রগুলির ওপরও কোপ পড়বে। সেইসঙ্গে সামান্য সন্দেহ হলেই ব্রিটিশ পুলিশ কোনও ওয়ারেন্ট বা নোটিশ ছাড়াই যে কোনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। যে কোনও সময় বাড়ি তল্লাশিও করা যাবে। শুধু তাই নয়, বিচার চলার সময় বিচারক কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ না দেখেই দণ্ড দিতে পারবেন। অর্থাৎ এক কথায়, বিপ্লবী আন্দোলন দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ও পুলিশ যা খুশি তাই করতে পারবে। কেউ কিচ্ছু বলতে বা করতে পারবে না। কারও কোনও বলার জায়গা থাকবে না।

jallianwala bag 1

এমন আইনের কথা সামনে আসার পরই কার্যত আগুন জ্বলে উঠল। এটা তো এক প্রকারের হিটলারি শাসন! পরাধীনতার শেকলে আটকে রেখে ভারতীয়দের ওপর যা খুশি তাই ব্যবহার করা হবে নাকি! গোটা দেশ একসঙ্গে গর্জে উঠল। মহাত্মা গান্ধী শুরু করলেন রাওলাট সত্যাগ্রহ। অবিলম্বে এই আইন যাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তার দাবি উঠতে শুরু করল। বিশেষ করে, পাঞ্জাবে ব্যাপক প্রভাব পড়ল। অমৃতসর সহ অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের আগুন। এমন পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবকে ‘সায়েস্তা’ করার জন্য লেফটেন্যান্ট গভর্নর করে আনা হল জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ারকে।

হত্যাকাণ্ড ও রক্তের বন্যা

জেনারেল ডায়ার এসেই শুরু করলেন নিজের কাজ। মহাত্মা গান্ধী যাতে পাঞ্জাবের কোথাও ঢুকতে না পারেন, তার ব্যবস্থা করলেন। সেইসঙ্গে সব রকমের জমায়েতের প্রতি জারি করলেন নিষেধাজ্ঞা। পাশাপাশি শুরু হয় ধরপাকড়। রাওলাট আইনের ছাড় তো হাতের সামনেই আছে! তাই অত্যাচারের মাত্রাও বাড়ল। ১৯১৯ সালের এপ্রিলেই ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন পাঞ্জাবের দুই নেতা – ডঃ সত্যপাল ও সইফুদ্দিন। বিদ্রোহের আগুন আরও কয়েক গুণ বাড়ল এর জেরে।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। পাঞ্জাবের নতুন বছর পবিত্র বৈশাখী শুরুর ঠিক আগের দিন। অমৃতসরেরই একটি ছোট্ট মাঠ জালিয়ানওয়ালা বাগে জড় হলেন কয়েক হাজার মানুষ। কোনও অস্ত্র নেই, কিচ্ছু নেই। কেবল একসঙ্গে জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সেটাই চলছিল। এরপরের ঘটনা বলার আগে একবার সেই সময়ের জালিয়ানওয়ালা বাগের ছবিটা বলে নেওয়া ভালো। গোটা মাঠের প্রবেশপথ মাত্র একটাই। তাও সেটা সরু একটা গলির মধ্যে দিয়ে। সেই গলি দিয়ে ঢুকলেই সামনে পড়বে আস্ত জালিয়ানওয়ালা বাগ। চারিদিকে আর কোনও রাস্তা নেই বেরনোর। মাঠ ঘিরে রয়েছে উঁচু দেওয়াল। ফাঁকা মাঠে রয়েছে কেবল একটি কুয়ো। মানে একবার সরু গলি দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর, সেই গলি দিয়েই বাইরে বেরোতে হবে। তা না হলে অতিকষ্টে যদি পাঁচিল টপকানো যায়…

jallianwala bag 3

ঠিক এটারই সুবিধা নিলেন জেনারেল ও’ডায়ার। ১৩ তারিখে জালিয়ানওয়ালা বাগে কয়েক হাজার মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়েছেন, এই রিপোর্ট আগে থেকেই পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এবার পুরো ফৌজ নিয়ে চললেন সেই মাঠের দিকে। সিপাইদের বন্দুক হাতে দাঁড় করালেন প্রবেশপথের মুখে। সরু গলিটা ঘিরে দাঁড়াল ব্রিটিশ পুলিশ। ভেতরের মানুষরা তখন বক্ত্রিতা শুনছেন। কোনও কিছু বোঝার আগেই ডায়ারের মুখ থেকে কেবল একটাই শব্দ বেরোল – ‘ফায়ার’।

তার পরবর্তী দৃশ্যের বর্ণনা নানা সিনেমায় উঠে এসেছে। অনেক লেখাতেও ধরা দিয়েছে। কিন্তু সেই হিংস্রতা, নৃশংসতাকে বর্ণনা করার মতো ভাষা কোথায় আমাদের! মাঠের ভেতর ছোটাছুটি করছে মানুষ, আর এক নাগাড়ে গুলি চালিয়েই যাচ্ছে ব্রিটিশ ফৌজ। রক্তে রক্তে ভেসে গেল জালিয়ানওয়ালা বাগের মাটি। কেবল চিৎকার আর চিৎকার। কেউ আহত হয়ে বসে পড়লেন, কেউ আবার ওখানেই শেষ। আর মহিলারা কোলের শিশুকে নিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছেন। শেষমেশ কুয়োর জলেই ঝাঁপ দিয়ে দিলেন অনেকে। জানা গিয়েছিল, পরে যখন মৃতদেহগুলি উদ্ধার করা হয়, তখন কুয়োর ভেতর কোলে সন্তানকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মহিলাদেরও পাওয়া যায়। কেউই আর জীবিত নেই তখন…

এরপর ব্রিটিশ সরকার একটি রিপোর্টও পেশ করে। সেখানে বলা হয় ৩৭৯ জন মানুষ এই হত্যাকাণ্ডে মারা গিয়েছেন। যদিও ভারতের দাবি, সেদিন নিহতের সংখ্যা ছিল হাজারেরও বেশি। আরও বহু মানুষ আহত হয়েছিল। উইনস্টন চার্চিল এই ঘটনার নিন্দা করলেও ব্রিটিশ সরকারের ওপরমহল থেকে ডায়ারকে কোনও দোষই দেওয়া হয়নি। বরং ব্রিটেনে মাইকেল ও'ডায়ারের নামে জয়ধ্বনি উঠেছিল। ডায়ারেরও প্রথমে বক্তব্য ছিল, 'কালো চামড়ার' ভারতীয়রা যাতে আর সাহস দেখাতে না পারে, তার জন্যই এমনটা করেছিলেন তিনি। 

jallianwala bag 4

একবার গোড়ার কথায় ফিরে আসা যাক। জালিয়ানওয়ালা বাগের সেই নৃশংস ঘটনা ঘটার পর কয়েকজন যুবক সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। রক্তে ভেজা মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এর বদলা তাঁরা নেবেনই। বেশ কয়েকবছর পর গোটা পাঞ্জাব ফের উত্তাল হল এই দুজনকে ঘিরে। একজনের বিপ্লবের মন্ত্র তখন গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গী সুকদেব ও রাজগুরুর সঙ্গে ফাঁসিকাঠে আত্মাহুতিও দিয়েছেন। তিনি, বিপ্লবী শহিদ ভগৎ সিং। 

আরেকজনও ছিলেন, যিনি ওইদিনের ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। কিন্তু মাইকেল ও'ডায়ারের মুখ ভোলেননি তিনি। ভোল পাল্টে সোজা লন্ডনে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেন ডায়ারকে। শহিদ সর্দার উধম সিংয়েরও জন্ম এই মাটিতেই। কারার ওই লৌহকপাট ভেঙে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। জালিয়ানওয়ালা বাগের দেওয়ালের সেই গুলির চিহ্ন, সেই কুয়ো, রক্তমাখা মাটি আজও সেই লড়াইয়ের কথা মনে করায়। 

More Articles