তিস্তা নদীর তিন ধারার মাঝে অবস্থান দেবীর! এই শক্তিপীঠে পূজিত হয় সতীর বাম পা
তিস্তা নদী এখানে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এরই ঠিক মধ্যস্থলে এই মন্দিরটি অবস্থান করছে। 'ত্রিস্রোতা' মন্দিরটিকে অনেকটা সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে তিস্তা নদীর তিনটি ধারা, তাই একে 'ত্রিস্রোতা' বলা হয়ে থাকে। এই শক্তিপীঠে এস...
৫১ পীঠের মধ্যে ত্রিস্রোতা হলো এক শক্তিপীঠ। এখানে দেবী ভ্রামরী অবস্থান করছেন। দেবী ভ্রামরীর মন্দির পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের তিস্তা নদীর তীরে পুরনো শালবাড়িতে অবস্থিত। মতান্তরে এই শক্তিপীঠ টি জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জ অথবা সাতকুরা অঞ্চলে অবস্থিত। মন্দিরটি নদীর তিন স্রোতের মাঝখানে অবস্থান করছে বলে একে ত্রিস্রোতা বলা হয়। এই শক্তিপীঠ খুবই জাগ্রত। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী সতীর বাম পদ এই ত্রিস্রোতায় পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী 'ভ্রামরী' অন্যতম আদি শক্তি। ভৈরব 'জল্পেশ' এখানে অবস্থান করছেন।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জানা যায়, ব্রহ্মার পুত্র প্রজাপতি দক্ষ এক কঠিন তপস্যা শুরু করলেন। তিনি মহামায়াকে কন্যারূপে পেতে চান, তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া তাঁকে বর দিলেন ঠিকই, কিন্তু এই কথা বলে দিলেন যে, এই কন্যার যদি কোনওদিন কোনওরূপ অনাদর হয়, তাহলে সেই কন্যাকে তৎক্ষণাৎ হারাতে হবে। দক্ষরাজ কথা দিলেন, তাঁর গৃহে কখনওই কন্যার কোনও অনাদর হবে না। স্বয়ং মহামায়া দক্ষরাজ এবং প্রসূতির গৃহে 'ঘর আলো' করে 'সতী'-রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। সতী বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই চালচুলোহীন দেবাদিদেব মহাদেবকে বিবাহ করে বসলেন। কিছুতেই দক্ষরাজ এই বিবাহ স্বীকার করে নিলেন না। দক্ষরাজ তাঁকে অপমানিত করতে লাগলেন প্রতি পদে।
একদিন দক্ষরাজ তাঁর গৃহে এক বিরাট বৃহস্পতি যজ্ঞর আয়োজন করলেন। সকল দেবদেবী এবং তাঁর সকল কন্যা এবং জামাতাদের আমন্ত্রণ জানালেও সতী এবং দেবাদিদেব মহাদেবকে আমন্ত্রণ জানালেন না। পিতার যজ্ঞের কথা সতীর কানে পৌঁছলে বিনা নিমন্ত্রণেই সতী দক্ষরাজের যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। সতীকে দেখে দক্ষরাজ শিবনিন্দা শুরু করলেন। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে সেই যজ্ঞকুণ্ডর অগ্নিতেই প্রাণ বিসর্জন দিলেন দেবী সতী। ক্রোধে উন্মত্ত শিব, ভৈরব বীরভদ্রর রূপ ধরে প্রজাপতি দক্ষর যজ্ঞ পণ্ড করে দিলেন। এরপর তিনি সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে নটরাজ রূপ ধরে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করলেন। পরের কাহিনি আমরা সকলেই জানি। বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে দিলেন। সতীর দেহাংশ মর্তে প্রস্তরখণ্ডরূপে পতিত হলো। যেসব স্থানে সতীর দেহের অংশ গিয়ে পড়ল, সেই সব স্থানে গড়ে উঠল এক একটি শক্তিপীঠ।
আরও পড়ুন: কালীর মূর্তি নেই, বীজমন্ত্রে পূজিত হন দেবী || বর্ধমানের এই শক্তিপীঠে পড়েছিল সতীর বাম বাহু
এমনই একটি শক্তিপীঠ 'ত্রিস্রোতা'। তিস্তা নদী এখানে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এরই ঠিক মধ্যস্থলে এই মন্দিরটি অবস্থান করছে। 'ত্রিস্রোতা' মন্দিরটিকে অনেকটা সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে তিস্তা নদীর তিনটি ধারা, তাই একে 'ত্রিস্রোতা' বলা হয়ে থাকে। এই শক্তিপীঠে এসে পতিত হয়েছিল দেবী সতীর বাম পদ (মতান্তরে বাম পদের বুড়ো আঙুল)।
এখানে দেবী 'ভ্রামরী' আর ভৈরব 'জল্পেশ' (জলেশ্বর) নামে পূজিত হন। মূল মন্দিরে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে দেবী মূর্তি। সালংকারা, অষ্টভূজা, অপরূপ রূপের ছটায় আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন দেবী। সামনে বড় বড় কলসের ওপর পুষ্পপত্র আর তার ওপর দেবীর উদ্দেশে ভক্তদের নিবেদিত ওড়না, নারকেল ইত্যাদি রাখা। পাশে আছে পিতলের তৈরি দেবীর চরণদ্বয়, যা পূজিত হয় প্রতিদিন। দেবী কালীমূর্তির মতো শিবের ওপর থাকলেও জিহ্বা বের করা নয়। দেবীর ডান পাশে আছেন মহাদেবের মূর্তি আর তার পাশে আছেন ষাঁড়রূপী নন্দী মহারাজ। এই কক্ষের সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নিচে নামলেই দেবীর গর্ভগৃহ। এখানে দেবী মূর্তি সিংহবাহনা,দেবীর গাত্র কৃষ্ণবর্ণা। দেবীর সামনেই বেদিতে রাখা আছে দেবীর প্রস্তরীভূত বামপদ।
কথিত আছে, একসময় পৃথিবীতে 'অরুণাসুর' নামে এক ভয়ংকর অসুর বাস করত। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে স্বর্গের দেবতাগণ। অরুণাসুরের ভয়ে তীব্র আতঙ্কিত দেবতাগণ শরণাপন্ন হন স্বয়ং মহামায়ার। তখন দেবী মা তাদের রক্ষা করার জন্য অসংখ্য ভ্রমরের রূপ ধরে অরুণাসুরকে পরাস্ত করেন। সেই থেকে দেবী মাতা 'ভ্রামরী' নামে পরিচিতা হন। অনেকের মতে হৃদয়াস্থিত দ্বাদশ দলপদ্মে অবস্থিতা দেবী, তাই তিনি 'ভ্রামরী'।
এখানে বলিপ্রথা নিষিদ্ধ। পরপর তিনবার বলির পাঁঠা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে বলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মন্দিরে মায়ের নিত্যপুজোয় অন্নভোগ দেওয়া হলেও মাছ দেওয়া হয় না। এখানে আরও একটি আশ্চর্য বিষয় হলো, দেবীর পুজোয় কাটা ফল দেওয়া হয় না, গোটা ফল নিবেদন করা হয়। এখানে মকর সংক্রান্তি, রামনবমী, দীপান্বিতা কালীপুজো ছাড়াও শরৎকালে নবরাত্রিতে বড় উৎসব হয় এবং তখন প্রচুর ভক্তসমাগম হয়।