সন্তানলাভের সঙ্গে জড়িত জামাইষষ্ঠীর আচার, পার্বণের আড়ালে রয়েছে যে কাহিনি
বধূর বাবা-মা একদিন ষষ্ঠী পুজো আয়োজন করেন। সেদিন আমন্ত্রণ করেন জামাই ও মেয়েকে। শোনা যায়, এই পুজোয় ষষ্ঠীদেবী খুশি হন।
গ্রীষ্মের দহন-জ্বালা রয়েছে। রয়েছে পকেটে ছ্যাঁকা খাওয়া বাজারদর। তার মধ্যেও বাঙালি যে উৎসবের জোয়ারে ডুব দেবে, তা বলাই বাহুল্য। সব প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ করে পয়লা বৈশাখ দিয়ে বাঙালির বার্ষিক পার্বণের শুরু। এবার জামাইষষ্ঠীর পালা। আদরের জামাইকে এই বিশেষ দিনে কোন নতুনত্বে ভরিয়ে দেওয়া যায়, তার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন শাশুড়িরা। বাজারে ছ্যাঁকা খেলেও আড়ম্বর কম করার উপায় নেই। দুই বছর পরে জামাই বাবাজীবনের এই আদরের পালা। কাজেই ধুতির কোঁচায় আজ আর সেই বহর না থাকলেও সব জামাই এদিন মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে মাঞ্জা মেরে যান শ্বশুরবাড়ি। এমন ভুরিভোজের সুযোগ তো আর সারা বছর মেলে না। জামাইয়ের ভুরিভোজের আয়োজনে শ্বশুরের পকেট কতটা খসল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আজকের জামাইকে খুশি করতে কেন শ্বশুরকে দেউলিয়া হতে হবে, এই প্রশ্ন একপাশে রেখেও বলা যায়, যে আরাধনা ও বিশ্বাসে নারীসত্তা প্রশ্নের মুখে, তার যৌক্তিকতা কতটা?
পুজোর নিয়ম
সকালে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরে শাশুড়িরা জামাইয়ের জন্য পালন করেন জামাইষষ্ঠী। জলভর্তি ঘট স্থাপন করে তাতে আমপাতা ও তালপাতা রাখার নিয়ম রয়েছে। এরপর তাতে ১০৮টি দুর্বা বেঁধে রাখতে হয়। এরপর হলুদ, কাঁঠালপাতা, সুতো, বেলপাতা একসঙ্গে গিঁট বেঁধে মা ষষ্ঠীর পুজোয় অর্পণ করার নিয়ম রয়েছে। পরবর্তীতে পুজোর প্রসাদ জামাইকে দেওয়ার পর লাগিয়ে দিতে হবে হলুদের তিলক বা ফোঁটা। এরপর শুরু হবে খাওয়ার পর্ব।
জামাই-আদরের রীতিনীতি
জামাইষষ্ঠীর দিন জামাইয়ের হাতে হলুদমাখানো সুতো বেঁধে দেওয়া হয় মা ষষ্ঠীর আর্শীবাদরূপে। এরপর দীর্ঘায়ু কামনায় তেল-হলুদের ফোঁটা কপালে দিয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হয়। ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। সঙ্গে একটি থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয় পাঁচটি বিভিন্ন রকমের গোটা ফল। এ তো গেল পুজোর রীতিনীতি। জামাইষষ্ঠীর আসল চমক হল জামাইয়ের জন্য শাশুড়ির নিজের হাতে রান্না করা পঞ্চব্যাঞ্জন। বিভিন্ন ধরনের মাছ, মাংস, মিষ্টির এলাহি আয়োজন। এখন অবশ্য উপহার দেওয়া-নেওয়ারও একটা পর্ব থাকে। নিয়মকানুন, রীতিনীতি, খাওয়াদাওয়া, উপহার আদানপ্রদানের ভিড়ে এই উৎসবে মিশে থাকে সারা বছর ব্যস্ততার কারণে মেয়ে জামাইকে কাছে না-পাওয়া মায়ের আবেগও। জামাই আদর মানে শুধু পাখার বাতাসের রেওয়াজ নয়, দুপুরের দেখার মতো আহার। এই একটা দিন খাবারে বাদশাহী আয়োজন। থালার চারদিকে বাটির বাহার। তাতে ইলিশ, চিংড়ি থেকে পাঁঠার মাংস। কী নেই! সঙ্গে শেষ পাতে মিষ্টিমুখ।
আরও পড়ুন: ভোজ কয় যাহারে! জামাইষষ্ঠীর ভুরিভোজে যে যে পদ রাখতেই হবে
জামাইষষ্ঠী ঘিরে সংস্কার
এক সময়ে সংস্কার ছিল যে, ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মেয়ের বিয়ের পর তাঁর বাবা বা মা মেয়ের বাড়িতে তত দিন পর্যন্ত যেতে পারবেন না, যত দিন না মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হন বা সন্তানের জন্ম দেন।
জামাইষষ্ঠী মূলত লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠী দেবীর পার্বণ থেকেই এই প্রথার উদ্ভব। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠীদেবীর পুজোর আয়োজন করা হতো। ষষ্ঠী দেবী মাতৃত্বের প্রতীক। তাঁর বাহন বিড়াল। তাই মেয়ের মুখ দেখতে এবং মেয়ের দ্রুত সন্তানলাভের কামনায় মেয়ে-জামাই আদরের পরিকল্পনা করা হলে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে পালিত হয়ে আসছে জামাইষষ্ঠী উৎসব।
জামাইষষ্ঠী ও কাহিনি
জানা যায়, বহু বছর ধরে জামাইষষ্ঠী নিয়ে এক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। তা হল, এক গৃহবধূ বাপের বাড়িতে গিয়ে মাছ চুরি করে খান। তার দোষ তিনি দিয়ে দেন বাড়ির বিড়ালের ওপর। বিড়ালকে যেহেতু ষষ্ঠী দেবীর বাহন মনে করা হয়, তাই এই চুরির বোঝা বিড়ালের ওপর পড়তেই তার পাপ গিয়ে পড়ে ঘরের বধূর উপর। হারিয়ে যায় সেই বধূর সন্তান। তখন তিনি গিয়ে ষষ্ঠী দেবীর আরাধনা করেন।
এদিকে, ষষ্ঠীদেবীর আরাধনার মধ্যেই বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেন বধূ। চুরির দায়ে লজ্জায় আর গৃহমুখে যেতে পারছেন না তিনি। তখন সেই বধূর বাবা-মা একদিন ষষ্ঠী পুজো আয়োজন করেন। সেদিন আমন্ত্রণ করেন জামাই ও মেয়েকে। শোনা যায়, এই পুজোয় ষষ্ঠীদেবী খুশি হন। আর ওই বধূ ও তাঁর স্বামী সুখের জীবন কাটান এরপর।
জনপ্রিয় মিথ
জামাইষষ্ঠীকে ঘিরে বহুকাল ধরে লোকগাথা প্রচলিত। কাহিনি বলছে, এক রাজা ও তাঁর স্ত্রী ১২ বছর ধরে সন্তানলাভের জন্য যজ্ঞ করেছিলেন। রানি প্রতিবারই মৃত সন্তান প্রসব করেন। মৃত সন্তানকে নিয়ে ঘাটে আসেন দম্পতি। তখন মা ষষ্ঠী তাঁর বাহনে চেপে উদয় হন। তিনি আশীর্বাদ করেন, মা ষষ্ঠীর পুজো চালু করলেই, তাঁরা জীবিত সন্তান পাবেন।
বিশ্বাস ঘিরে প্রশ্ন
মা ষষ্ঠীর দয়া মানেই শুধুই সন্তান দাও? এর সঙ্গে জড়িয়ে যে বিশ্বাস ও মিথ, তা নিয়ে এই শতকের মেয়েদের প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। আজকের মেয়েরা কেরিয়ার-সচেতন এবং আত্মনির্ভরশীল। ফলে তাঁরা যে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয়, তা বলাই বাহুল্য। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, মায়েদের ষষ্ঠীদেবীর আরাধনা মেয়ের সন্তানলাভের আকাঙ্ক্ষা না জামাইয়ের ভুরিভোজ? জামাই কবজি ডুবিয়ে খান বা ভার্চুয়াল ভোজন- মোদ্দা কথা হলো, এখনও সামাজিক বিয়েতে সম্প্রদানের মতো জঘন্য প্রথা রয়ে গেছে, যেখানে মেয়েকে একটি সামগ্রীর মতো তাঁর স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। আর এটাই বা কেমন আরাধনা! জামাইকে তুষ্ট করার মধ্য দিয়ে মেয়ের সন্তানলাভের জন্য মায়ের আকুতি! শ্বশুরবাড়িতে তা না হলে নাকি বাপের বাড়ির সম্মান থাকে না। একজন নারী কখন মা হবেন, এটা ঠিক করবে সমাজ? আজকের দিনে!