ভারতবর্ষের মিনি আফ্রিকা
পশ্চিম ভারতের ছোট্ট গ্রামে আফ্রিকা। কালো চকচকে হাসিমুখ। যেন খোদ মাসাইমারা। একবার ঢু মারলেই হাত ধরে ছুটে আসবে কোঁচকানো চুলের কচি মুখ। বা সাইকেল চালানো তরুণ। বা ব্যস্ত দোকানি। এসবে আশ্চর্য না হলেও আশ্চর্য তাঁদের গড়নে। যেন খোদ আফ্রিকা বা ক্যারিবিয়ান কোনও গ্রামে ভুল করে ঢুকে পড়েছি। শুধু রঙের ভিত্তিতেই না, মুখশ্রী বা শরীরের গড়নেও আফ্রিকান ছোঁয়া। কিভাবে? কবে থেকে? কোথায়ই বা সেই গ্রাম? প্রিয় পাঠক, যাবেন নাকি জম্বুর?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। গুজরাটের জম্বুর গ্রাম। গির ন্যাশনাল ফরেস্টের ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই জম্বুর যেতে গেলে গির থেকে ২৬ নম্বর স্টেট হাইওয়ে ধরে তালালা গ্রাম পর্যন্ত এসে বাঁদিকের রাস্তায় নেমে উনা-তালালা রোড ধরে কিছুদূর গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে জম্বুর। কাছাকাছি বিমানবন্দর বলতে দিউ এয়ারপোর্ট, ৭১ কিলোমিটার দূরে। সরস্বতী ও কারকারি নদীর কাছাকাছি এই জম্বুর এবং এখানকার আফ্রো-ইন্ডিয়ান সিদ্দি উপজাতিদের গল্প। কবে থেকে শুরু সেই গল্প? ধরা হয় অষ্টম শতকে ভারতবর্ষের ইসলামি সাম্রাজ্যবিস্তারের শুরুর দিকে এঁদের এদেশে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু হয়। প্রধানত দেশের প্রিন্সলি স্টেট বা রাজপরিবারগুলির চাহিদায় আরব মুসলিমদের মাধ্যমে পূর্ব আফ্রিকার ক্রীতদাসদের এদেশে চালনা করার এই ইতিহাস একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। পরে পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরাও এই কাজে হাত দিয়েছিলেন বলে ইতিহাস বলছে। পূর্ব আফ্রিকার সম্ভবত ইথিওপিয়া (তৎকালীন আবিসিনিয়া) থেকে আগত বান্টু উপজাতির এই বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচলিত একটি স্থানীয় মিথ বলছে, গুজরাটের সমুদ্রতটে একটি আফ্রিকান জাহাজডুবির ঘটনা ঘটলে বেঁচে ফেরা যাত্রীরা শেষমেশ ভারতের সমুদ্রতটে উঠে আসেন। এসেই দেখেন গিরের সিংহ। আফ্রিকা নাকি? এই ভুল ভাঙতে সময় লেগেছিল। প্রত্যন্ত গ্রামে বসতি গড়তে গড়তে পরে জানা যায় আসলে তাঁরা ভুল করে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়েছেন। অবশ্য এই মিথের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্টই। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সত্য এবং ক্রীতদাস ব্যবস্থার করাল ইতিহাসকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরে নেন অধিকাংশ গবেষকরাই। আবিসিনিয়া থেকে আসায় তাঁদের একটা সময়ে ‘হাবসি’ নামটি পরবর্তীকালে ভারতে এসে সিদ্দি হওয়া যাওয়ার পেছনে যদিও বড় কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। যদিও আরবি ‘সৈয়দ’ থেকেও সিদ্দি নামটি আসতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন, যেহেতু আরবি ব্যবসায়ীরা এই স্থানান্তরণে একটা বড় অংশ ছিলেন।
ক্রীতদাস ব্যবস্থার বিলোপ এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজন্য প্রথাও একটা সময় উঠে যায়। অবশ্য সিদ্দিদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি আশানুরূপ হয়নি। আফ্রিকা থেকে চলে আসার পর স্থানীয় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সিদ্দিরা যদিও ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছে ভারতবর্ষকে, গুজরাটকে। স্থানীয় নাগার্চি পীর বাবার দরগার খুব কাছেই বসবাস এদের। সৌরাষ্ট্রের জুনাগড় জেলার এই প্রত্যন্ত জম্বুর গ্রামের বাসিন্দার প্রত্যেকেই সিদ্দি উপজাতির আফ্রিকান, যারা গোটা ভারতে মূলত গুজরাট ও কর্ণাটকে ছড়িয়ে থাকা আড়াই লক্ষ সিদ্দি উপজাতির একটি ছোট্ট অংশ।
এবার রিচুয়ালের কথায় আসি। সিদ্দিদের দৈনন্দিন জীবনের কথায় আসি। সিদ্দিরা তাঁদের নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে বিবাহকে সীমাবদ্ধ রেখে এসেছে, যার ফলে কাছাকাছি থাকা ভারতীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে জিনের মিশেল হয়নি। অধিকাংশ আফ্রিকান আনুষ্ঠানিকতা বা রিচুয়াল ছেড়ে এঁরা মূলত স্থানীয় গুজরাটি সংস্কৃতিকেই আপন করে নিয়েছে। অবশ্য প্রাচীন বান্টু ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ‘গোমো’ নাচের ক্ষেত্রে এখনও প্রসিদ্ধ সিদ্দিরা, স্থানীয় গুজরাটি ভাষায় যে নাচকে ‘ধামাল’ বলা হয়। ধামাল অর্থাৎ ড্রাম, যেহেতু রাজন্য ভারতবর্ষে সিদ্দিরা ড্রাম বাজিয়ে নবাবদের খুশি করত। বছরে একবার করে সফল শিকার উৎসব সেরে এঁরা এই ধামাল বা গোমো নাচে মেতে ওঠে সারারাত।
এর বাইরেও আরেকটা দিক আছে। সিদ্দিদের কালো রং, আফ্রিকান উৎস এবং সর্বোপরি মুসলিম ধর্মের জন্য বাকি ভারতবর্ষের কাছে বরাবরই এক ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত হয়ে ধরা দেয় জম্বুর। অসম্ভব দারিদ্র, আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় কৃষি ব্যবস্থার সমস্যার জন্য এঁদের অনেকেই হস্তশিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যা স্থানীয় লোকশিল্পের মান উন্নয়ন করতে সাহায্য করলেও ধর্মীয় বা জাতিগত দিক থেকে একঘরে করে দেওয়ার চিরাচরিত উচ্চবর্ণীয় বর্বরতায় পেশাগত উন্নয়ন কোথাও এসে আটকে যাচ্ছে। শারীরিক দক্ষতার জন্য ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যাওয়ায় ভারত সরকার থেকে জম্বুরের সিদ্দিদের দিকে সাম্প্রতিক কালে নজর দেওয়া হচ্ছে একটু একটু করে। যদিও গল্পটা খুব বেশি বদলাচ্ছে কি? মার্শাল আর্ট শেখা ১৬ বছরের রোহিত মইগুল বা শট-পুটার শাহনাজ লোবি গ্রামের ভেতরেই পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে টিটকিরি পেয়েই বড় হচ্ছে। মাঝামাঝি অবস্থায় স্কুল কেরিয়ার শেষ করে দিতে বাধ্য হওয়া রোহিত মইদুল দারিদ্র এবং বঞ্চনা থেকে বেরোতে জুডো বা মার্শাল আর্টকেই পাখির চোখ করে নিয়েছে। ‘কেউ বিশ্বাস করে না, যখন আমি বলি যে আমি একজন ভারতীয়। ওরা ধরেই নেয় যে আমি আফ্রিকান। আর খারাপ ভাষায় গালি দেয়, টিটকিরি দেয়। একবার বাস থেকেও নামিয়ে দিয়েছিল কালো আফ্রিকান বলে দাগিয়ে দিয়ে। তবু, আমি সহ্য করে আসছি। একদিন জুডো খেলে নিজের জায়গা দেখিয়ে দেব।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে যায় ষোলো বছরের কিশোর।
রোহিত বা শাহনাজরা জানে গ্রামে ড্রেনেজ ব্যবস্থা শোচনীয়, ঠিকমতো টয়লেট নেই, পানীয় জলের অবস্থাও তথৈবচ। খালি পায়ে, ধুলোমাখা গায়ে, কখনও ছেঁড়া জামায় সিদ্দি ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়ায় জম্বুরের ঘরে ঘরে। দৈবাৎ পর্যটক বা ইতিহাস-গবেষকেরা এলে স্থানীয় হস্তশিল্প বিক্রি করে যেটুকু পয়সা। তাও একগাল হাসি মুখে আপায়ন ওদের।
‘সিদ্দি গ্রাম দেখনা হ্যায়?’
ভারতবর্ষের কালো চকচকে সিদ্দি গ্রাম জম্বুর যেন বঞ্চনার ট্র্যাডিশন থেকে বেরোয়, খুব তাড়াতাড়ি। এটুকুই আশা ...
তথ্যসূত্র: