প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে! ফিরছে ইন্দিরা হত্যার স্মৃতি

এমন নাটকীয় হত্যা ভারতের ইতিহাসে বিরল নয়। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার কথা মনে করাচ্ছে এই আক্রমণ। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর।

পশ্চিম জাপানের নারা শহরে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করা হল জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে। গুলি গায়ে লাগতেই রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন শিনজো আবে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক ভাবে কোনও সাড় পাওয়া যাচ্ছিল না। বর্তমানে মনে করা হচ্ছে তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। আজ একটি মিছিলে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সংবাদসূত্রে জানা যাচ্ছে, পরপর দু'বার গুলির আওয়াজ পেয়েছিল আশেপাশের লোকজন। আবে ভাষণ দেওয়ার সময় ঠিক তাঁর পিছনদিক থেকে গুলি চালায় আততায়ী। বুক চেপে ধরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। জামা রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনী প্রচারেই এই মিছিল ডাকা হয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারের বক্তৃতা দেওয়ার সময় আক্রন্ত হন আবে।

আশ্চর্যের ব্যাপার এমন ঘটনা জাপানে ঘটল। জাপানের বন্দুক ব্যবহার সংক্রান্ত আইন পৃথিবীর সবথেকে কড়া আইনের মধ্যে একটি। ফলে বাৎসরিক হিসেবে গড়ে মাত্র এক দু'জন লোক বন্দুকের অপব্যবহারে মারা যান। বলে রাখা ভালো, জাপানের জনসংখ্যা সাড়ে বারো কোটি। বোঝাই যায় বন্দুকের অপব্যবহার এই দেশে কত কম! বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ এবং জটিল জাপানে। কোনও নামকরা শ্যুটিং অ্যাসোসিয়েশনের রেকমেন্ডেশন তো লাগেই, চলে পুঙ্খানুপুঙ্খ পুলিশি তদন্ত। রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা জাপানে সচরাচর শোনাই যায় না। সেই দেশের ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় গুলি খেয়ে খুন হলেন, বিষয়টা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।

বছর দুয়েক আগে, ২০২০ নাগাদ, স্বাস্থ্যের কারণে প্রধান মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন আবে। “মানুষের জন্য নিজের সেরাটা দিতে না পারলে, প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার আমার কোনও যোগ্যতা নেই। আমি ঠিক করেছি এই পদ থেকে আমি ইস্তফা দেব” — বলেছিলেন তিনি। বহুদিন থেকেই আলসারেটিভ কোলাইটিসে ভুগছিলেন। এর আগেও, ২০০৭ নাগাদ প্রধানমন্ত্রী পদথেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর ক্যাবিনেটে নানান কেলেঙ্কারি সেবার জনসমক্ষে এসে গিয়েছিল। আবের দলও গোহারা হেরে গিয়েছিল নির্বাচনে। সেবারও স্বাস্থ্যের অজুহাতে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। ।

২০২০তে দ্বিতীয়বার পদত্যাগ করার আগে সবথেকে দীর্ঘকালীন প্রধান মন্ত্রীত্বের নজির গড়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের একটি ব্যর্থ সরকারসহ জাপানের আরও ছ ছবার বদলানো সরকার একটু থিতু হয় তাঁর আমলে। তাঁর আমলেই জাপানের ব্যাপক মূল্যস্ফীতি কমে আসে। ট্রাম্পের শত সমালোচনা সত্ত্বেও চিনের সঙ্গে সামরিক সখ্য গড়েন আবে। চিনকে বৃহত্তম বাণিজ্যিক সঙ্গীও করে তোলেন। অথচ এই চিন দীর্ঘদিন জাপানবের সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ রাখতে চায়নি। আবে যখন গদিতে বসেন তখনও অবস্থা একই রকম ছিল। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। আবে সবথেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জাপানকে ফের দাঁড় করানোর চেষ্টায় নিজস্ব অর্থনীতি চালু করে। একে পরে গোটা বিশ্ব জানবে অ্যাবেনমিক্স বলে। দক্ষ হাতে সরকার চালানোয় তাঁর খ্যাতি ছিল। যাবতীয় কেলেঙ্কারি কাটিয়ে উঠে সরকার বজায় রাখার ক্ষমতা ছিল আবের।

২০১৭ সালেও এমনই এক কেলেঙ্কারি সামনে আসে। অভিযোগ আবে এবং ওঁর স্ত্রী আকি-র নিকট বন্ধুকে স্কুলের জন্যে অ্যালট করা একটি জমি পাইয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে আবের বয়েস হয়েছিল ৬৭ বছর। এই কাণ্ডে রাস্তার উপরেই আততায়ীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৪১ বছর বয়সি একজন পুরুষ শটগান থেকে দু'রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল বলেই জানা যাচ্ছে।

তবে এমন নাটকীয় হত্যা ভারতের ইতিহাসে বিরল নয়। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার কথা মনে করাচ্ছে এই আক্রমণ। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। আগের দিনই দিল্লি থেকে ফিরেছেন ইন্দিরা। প্রচণ্ড ধকল গিয়েছে। সে রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না তাঁর। হাঁপানির টান উঠেছে খুব। ভোর চারটের সময় তাঁকে ওষুধ খুঁজতে দেখেছিলেন সোনিয়া। সেই অবস্থাতেই পুত্রবধূকে বললেন, “কোনও প্রয়োজন হলে জানিও, আমি জেগেই রয়েছি।”

পরের দিন পিটার আলেকজান্ডার উস্তিনভের ইংরেজি ডকুর শ্যুটিং রয়েছে। আগের দিন ভুবনেশ্বরে পিটার ইন্দিরার সঙ্গে ছিলেন। একত্রিশে অক্টোবরে ইন্দিরার প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল পিটারের সঙ্গেই। এরপরে ইংল্যান্ডের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাগানের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল তাঁর। আর বিকেলে রানি দ্বিতীয় এইলিজাবেথের একমাত্র কন্যা প্রিন্সেস আনের সঙ্গে একটা ডিনার পার্টি। সাকুল্যে সেদিন এই ছিল কাজ। সকালে ডাক্তার কেপি মাথুর যখন দৈনিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য সফদরজং রোডে তাঁর বাসায় পৌঁছলেন, দেখলেন ইন্দিরা প্রাতঃরাশ শেষ করেছেন। এদিকে পিটার বসে ছিলেন বাসার পাশেই ১ আকবর রোডে প্রধান মন্ত্রীর অফিসে। ইন্দিরার অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ৯টা দশ নাগাদ সব সেরে অফিসের দিকে রওনা দিলেন ইন্দিরা। সঙ্গে কনস্টেবল নারায়ণ সিং, ব্যক্তিগত দেহরক্ষী রামেশ্বর দয়াল এবং পার্সোনাল সেক্রেটারি আর কে ধওয়ান। ১ আকবর রোডের গেটে পৌঁছে ধওয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন ইন্দিরা। এমন সময় তাঁর দেহরক্ষীদেরই একজন, বিয়ন্ত সিং, তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। প্রথম গুলিটা লাগে ইন্দিরার পেটে, পরের দুটো বুকে। গুলি চালাতে চালাতেই বিয়ন্ত চীৎকার করে গুলি চালাতে বলে আরেক দেহরক্ষীকে। সতওয়ন্ত সিং ইন্দিরাকে লক্ষ্য করে ২৫ রাউন্ড বুলেট ছোঁড়েন, গুলি লাগে রামেশ্বর দয়ালের গায়েও। তখনও বেঁচে ইন্দিরা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টা করেন ডাক্তারেরা, আশি বোতল রক্ত লাগে। কিন্তু সে সব ব্যর্থ করে দুটো তেইশ নাগাদ মারা যান ইন্দিরা। 

ইন্দিরা পুত্র রাজীবকেও প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় একই ভাবে। তামিল নাড়ুর শ্রীপেরাম্বুদুরে নির্বাচনী প্রচার করছিলেন রাজীব। সালটা ১৯৯১। সবাই ফুলের মালা দিয়ে সম্বর্ধনা জানাচ্ছিল। এই সময় আততায়ী ধনুও তাঁকে অভনন্দন জানান। রাজীবের পা ছুঁয়ে প্রণামের জন্য নিচু হয়ে নিজের কোমরে বেঁধে রাখা বোমা ফাটিয়ে দেয় সেই মহিলা। টুকরো টুকরো হয়ে যায় রাজীবের দেহ।

অতীতের এই হিংসাত্মক আক্রমণ বারেবারে তখনই হয়েছে যখন শাসক স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন। সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ভারতের ইতিহাসের রক্তাক্ত কিছু অধ্যায়। শিনজো আবের ক্ষেত্রেও কি তাই হল? অত্যধিক ক্ষমতার অত্যাচারের চাপে প্রত্যাঘাত এল আততায়ীর বন্দুক থেকে? নাকি এর পিছনে উদ্দেশ্য অন্য? এখনও আক্রমনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়।

More Articles