আমজনতার রাগ, বেদনাকে জিতিয়ে দিলেন শাহরুখ! কেন দেখতেই হবে জওয়ান?
Jawan Movie Review: শাহরুখ হতে চেয়েছিলেন সত্তরের আগুন যুবক। অপেক্ষা করতে হলো ৫৭ বছর বয়স পর্যন্ত!
সত্তরের দশক! সেলিম-জাভেদ হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন বিজয়কে। কোনও নামকরা অভিনেতা রাজি নন এরকম রাগী রসকষহীন চরিত্রে অভিনয় করতে। বিখ্যাত নায়কেরা সব ফিরিয়ে দিচ্ছেন অভিনয়ের প্রস্তাব। অবশেষে একদিন পাওয়া গেল জঞ্জিরের অমিতাভ থুড়ি বিজয়কে! এরপর সেলিম-জাভেদ জুটির ‘ অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ একের পর এক ছবিতে সিস্টেমের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে থাকে সাধারণ মানুষের আওয়াজ হয়ে। ঘুণ ধরা সমাজের ছবি প্রতিফলিত হতে থাকে থিয়েটারের বিশাল পর্দায়। মানুষ খুঁজে পায় তাদের প্রতিনিধি স্বরূপ দীর্ঘদেহী এক নায়ক- অমিতাভ বচ্চন। জওয়ানের কথা লিখতে বসে অমিতাভের গুণবর্ণন কেন? শাহরুখের কথা লিখতে হলে, বলিউডের এই উল্লেখযোগ্য বাঁকের কথা লিখতেই হবে যে! ফিরে আসা যাক বিজয়ের কথায়। এরপর মাঝে কেটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর। নব্বইয়ের দশক শুধুই প্রেমের!
দিল্লির তরুণ এক যুবক কপাল ঢাকা চুল নিয়ে হাজির স্বপ্ন নগরী বম্বেতে! দু'চোখ ভরা স্বপ্ন। সিরিয়াল থেকে সরাসরি সিনেমা- জয় করে নিলেন আপামর ভারতবাসীর হৃদয়। কেরিয়ারের শুরুতে নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করলেও স্বপ্ন ছিল অ্যাকশন সিনেমা করার। কিন্তু যশ চোপড়ার পরামর্শে এক প্রকার বাধ্য হয়েই নামতে হলো রোম্যান্টিক নায়কের চরিত্রে। তারপর বাকিটা তো দুই বাহু ছড়ানো প্রেমের অথবা নিশির ডাক। দেশের কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর বুকে ফুটছে শাহরুখ নামের লাল গোলাপ! এই হিংসা হানাহানির জগতে যে মানুষটি পরের তিনটে দশক হাওয়ায় দু'হাত মেলে শুধুই শর্তবিহীন ভালবাসতে শেখায়। যশ চোপড়ার কাছে একবার শাহরুখ মনের ইচ্ছে প্রকাশ করেই ফেলেন, ‘একদিন আপনিই অমিতাভকে নিয়ে একের পর এক অ্যাকশন সিনেমা করেছেন; আমাকে নিয়ে নয় কেন?' উত্তর পেয়েছিলেন, 'এরকম স্বপ্নালু চোখ শুধুই অ্যাকশন করে নষ্ট করা যায় না।' শাহরুখ সেই পরামর্শ বেশ গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- নক্ষত্রের অবসর নেই, খুচরো জনতার খড়কুটো আজীবন শাহরুখই
পরবর্তী কিছু বছর তাই দেশ জুড়ে লাল গোলাপের বৃষ্টি নামে! গোলাপের সুগন্ধ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দেয় সুদূর বিদেশে, যেখানে শাহরুখ পা রাখা মাত্রই লক্ষ লক্ষ ভক্ত যারা একবর্ণও হিন্দি জানেন না, মূর্ছা যায়। কালের নিয়মে একদিন শাহরুখেরও সুদিন ভ্যানিশ হয়। খ্যাতি-ভক্ত-অর্থ ইত্যাদিতে কোনও আঁচ পড়েনি। শুধু নতুন ছবিগুলো আর চলে না। অথচ মানুষের তাঁর প্রতি উন্মাদনা-ভালবাসায় কোনও খামতি নেই। গুটি গুটি পায়ে সময় পার হতে থাকে। একদিন আচমকা করোনা এসে ঘেঁটে দেয় সবটা।
মানুষের জীবনকে করোনাকাল যে বাস্তব দেখিয়েছিল, তাকে অস্বীকার করে আর কোনও আলোচনাই করা যায় না। দীর্ঘকাল কর্মহীন মানুষজন গৃহবন্দি হয়ে দিন গুনতে থাকে। হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে অজস্র মানুষ দেশকে ঘাড় ধরে এক খাদের ধারে ঠেলে দেয়। আমাদের দেশে পুরো কোভিডকালের ঘটনা প্রবাহ বলিউডের মশলাদার সিনেমাকেও হার মানাবে। শাহরুখ সেই সময় মৌন ছিলেন। কথা বললেন না, করে দেখালেন। নিজের খরা এবং বলিউডের খরা কাটিয়ে পাঠান সুপারডুপার হিট করিয়ে ফেললেন। বয়কট বাহিনীর লম্ফঝম্পের মুখে ছাই। অথচ সিনেমায় কিং ক্যারিশ্মা ছাড়া কিছুই ছিল না।
আরও পড়ুন- চরিত্রে অহিংস দেশ, প্রমাণ শাহরুখের ছবি-জীবন
কিন্তু জাওয়ান আলাদা। কোথায় আলাদা? জওয়ান জনসাধারণের পুঞ্জীভূত বেদনা, নিরাশা, ঘৃণা ও রাগের উদ্গীরণ। শাহরুখ হতে চেয়েছিলেন সত্তরের আগুন যুবক। অপেক্ষা করতে হলো ৫৭ বছর বয়স পর্যন্ত! বলিউডের একটা বড় অংশ এখন শুধুই ‘মিশন’ ও ‘অ্যাটাক’ জুড়ে সরকারের প্রচার সর্বস্ব ছবিতে সীমাবদ্ধ। দরকার ছিল অ্যাটলি কুমারের। দক্ষিণের সাধারণ মানুষ বনাম সিস্টেম টেমপ্লেটে শাহরুখকে ফেলে পর্দায় তুফান তুলতে পেরেছেন তিনিই। আমাদের দুর্বল স্মৃতির দোরগোড়ায় অ্যাটলি টোকা মেরে মনে করালেন কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের আখ্যান। সিনেমার পর্দায় শাহরুখের এন্ট্রি হতেই দর্শকের কানফাটা চিৎকারে উৎসবের মেজাজ অটুট। ঝাঁ চকচকে ভিএফএক্স, তুমুল অ্যাকশন, চড়া ডায়লগ, দ্রুত মাংস কাটার তালে ঝপাঝপ এডিট, লার্জার দ্যান লাইফ শাহরুখ শুধুই বাইরের একটা মোড়ক। আসল বক্তব্য পরিবেশন হতে থাকে তালি-সিটির তালে তালে। দক্ষিণের ছবির নিজস্ব ভাষায় শাহরুখ হয়ে ওঠেন সত্তরের সেই ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ বিজয়! দুর্নীতিগ্রস্থ নেতা কিংবা ক্ষমতাশালী পুঁজিপতিকে মারার দৃশ্যে অনবরত বেজে ওঠে সিটি। এই দৃশ্য দেখে কোথাও মনে আশা জাগে। কানের কাছে বেজে ওঠে- ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’!
দেশে জি ২০ সম্মেলন সাঙ্গ। সবুজ কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল রাজধানীর দারিদ্র। সেই কাপড় তুলে বাস্তব চিত্র দেখানোর সাহস খুব মানুষেরই আছে। বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের ব্যর্থ চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে চুপ! শাহরুখ দেশের নাড়ি বোঝেন, শাহরুখ ব্যবসাটিও চমৎকার বোঝেন। তাই আদ্যোপান্ত কমার্শিয়াল ছবির ভেতরে গুঁজে দিলেন সেই সব গল্পগুলি যা আসলে এই বঞ্চিত মানুষের দল শুনতে চেয়েছে। দুর্বলের গলা দিয়ে বেরনো যে চিৎকার রাষ্ট্র শুনতে পায়না, শাহরুখ দেশের হল হলে সেই চিৎকার যেন গমগম করে বাজিয়ে দিলেন! জওয়ান সঞ্চিত হয়ে থাকল ভবিষ্যতের দলিল হয়ে। এই লেখা সিনেমার খুঁটিনাটি সমালোচনার জন্য লেখা নয়। সিনেমাটির খুঁত ধরার থেকে অনেক বড় বিষয় জওয়ানের প্রাসঙ্গিকতার আলোচনা। যে সুপারস্টার ইতিমধ্যেই সরকারের গুডবুকের বাইরে, তার হিম্মতকে কুর্নিশ। যে সাহস জওয়ান দেখিয়েছে, ভারতের এমন সাহসের খামতি ঘটছে দীর্ঘদিন ধরেই!
একদিন শাহরুখের বাবা বলেছিলেন, ‘জো কুছ নেহি করতে ওহ কামাল করতে হ্যায়!’
শাহরুখ যে কী কামাল করেছেন, দেশ হাঁ হয়ে দেখছে!