কলকাতার তো বটেই, যিশু গোটা বাংলার, খ্রিস্ট-কৃষ্ণকে সত্যিই মিলিয়েছে বাঙালি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘কলকাতার যীশু’। তবে বড়দিন এলে যিশু কেবল কলকাতার থাকে না। শহরের গন্ডি ছাড়িয়ে সে হয়ে ওঠে সারা বাংলার আরাধ্য ইষ্টদেবতা। প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে দিয়ে সংস্কৃত রামায়ণের যে তিনটি অনুবাদ হয়েছিল, তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কম্বনের তামিল রামায়ণ, ভক্তি আন্দোলনের স্রোতে প্রভাবিত তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ এবং বাংলায় কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত ‘রামায়ণ পাঁচালি’। কৃত্তিবাসের রাম হয়ে উঠেছিল বাঙালির ঘরের ছেলে। যা বাঙালির রোজের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেই পাঁচালির ছন্দেই তিনি বেঁধেছিলেন তাঁর রামকথাকে। একইভাবে, বড়দিন এলে যিশুও হয়ে ওঠে বাংলার একান্ত আপন, চিরনিজস্ব। ক্রুশবাহক মানবপুত্র কেবল পাশ্চাত্যের ধর্মপ্রচারক পরিচয়ে চিহ্নিত থাকেন না আর।
পুঁটিমারি বা চাপড়া প্রভৃতি অঞ্চলে ডিসেম্বর সকালে গেলে আজো শোনা যাবে যিশুখ্রিষ্টের পদ। তাদের সুর আমাদের ভারতের নিজস্ব রাগ রাগিণীতেই গাঁথা, কোনোটা ইমন, কোনোটা পরজ, পূর্বী, আবার কখনো বা জয়জয়ন্তীর রেখাবের ছোঁয়া। তাল জৎ বা একতাল। বড়দিন এগিয়ে এলেই নদিয়ার মানুষজন খোল করতাল হাতে পথে বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের গলায় শোভা পায় যিশুর কীর্তন। দূর থেকে শুনে এ সমস্ত পদকে মনে হবে অবিকল কোনো বৈষ্ণব ধর্মগীতের মতো, কিন্তু কাছে গেলেই আপনি চমকে উঠতে বাধ্য। গানের ভাষার সাথে রাধা কৃষ্ণের কীর্তনকাব্যের তো বিশেষ সাদৃশ্য নেই, রয়েছে কেবল ভাবের সাদৃশ্য। ‘পূরব গগনে দেখো গো চাহিয়ে, নবতারা উদয় হল / জ্যোতির্বিদগনে নিরখি নয়নে, সেই তারার পিছে ধাইল।’ বোঝাই যাচ্ছে, যে ‘নবতারা’র কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা আমাদের বহুল পরিচিত ‘the star of Bethlehem’।
এভাবেই চলতে থাকে। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় ‘নভেনা’ বা ‘নবহ প্রার্থনা’। তারপর পঁচিশে ডিসেম্বর মধ্যরাতে, ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলে, পরম পিতার আরাধনায় গাওয়া হয় ক্যারল। সে ক্যারল ও রচিত খাঁটি বাংলায়। গানের লিপি ‘পরম করুণাময় আশীর্বাদ করো আমাদের’-এই ধরনের।
আরও পড়ুন-মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিনদুপুরে বিমান অপহরণ! ইতিহাসে লেখা থাকবে এই স্পর্ধা…
কোম্পানির আগমনের আগেও খ্রিষ্টচর্চার ইতিহাস এ দেশে ছিল। কোসমাস নামক এক অ্যালেকজান্দ্রিয় বণিক তাঁর ভ্রমণকথা লিখছেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সেখানে তিনি দক্ষিণ ভারতের একটি গির্জা ও তার পাদ্রির উল্লেখ করছেন। এরপর বিপুল পরিমাণে আগমন ঘটে পর্তুগিজ ও আর্মেনিয়ানদের। বহির্বিশ্ব থেকে খ্রিষ্টচর্চার ধারা তারা বয়ে নিয়ে আসেন এ দেশে। বাংলা জুড়ে তৈরি করেন একাধিক উপাসনালয়।
কৃষ্ণের সাথে খ্রিষ্টকে কিছু ক্ষেত্রে এক আসনে বসিয়ে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই দুই ধর্মনেতার কিছু সাংস্কৃতিক নৈকট্যও আমরা দেখতে পাই, কারণ জানা যাচ্ছে, কৃষ্ণের অত্যাচারী মামা কংসর মতোই খ্রিষ্টের ছিল রাজা হেরোদ। এ ছাড়াও ইংরেজ সাহেবরা খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে যে সমস্ত বইপত্র ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করছিলেন, তাদের নাম দেওয়া হচ্ছিল, ‘খ্রিষ্টবিবরণামৃতং’ বা ‘নিস্তাররত্নাকর’। ‘খ্রিষ্টবিবরণামৃতং’ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র আদলে, ‘নিস্তাররত্নাকর’ রচনার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় ‘ভক্তিরত্নাকরে’র ছাঁচ। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচনা করা হচ্ছিল এ সমস্ত গ্রন্থ। ধর্মপ্রচারে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা গড়ে তুলতে বৈষ্ণব গ্রন্থের আদলকেই বেছে নিয়েছিলেন ইংরেজরা। যদিও খ্রিষ্টে আর কৃষ্টে তফাৎ কিছু আছে বই কী। কৃষ্ণ তো আর জোসুয়ার মতো ক্ষমাশীল নন, সময় সময় তিনি প্রচণ্ড হয়ে ওঠেন। ইংরেজদের ধর্মপ্রচারের বিরুদ্ধে আঁটোসাঁটো প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বাংলার ‘নবজাগরণে’র চালকরা। এমনকী খ্রিষ্ট প্রচারের প্রাবল্যকে ঠেকাতে পৌত্তলিকতাবাদীদের সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু সংস্কৃতির স্রোত কে আর কবে আটকাতে পেরেছে। তা তো বহতা নদীর মতোই সমতলের জীবনকে জাপ্টে ধরে ভূখণ্ড নির্বিশেষে। বাংলার মদেশীয়রা তো এই দিনটিকে পরব হিসেবে পালন করেন। পেগানিজমের স্রোত ঢুকেছে প্রান্তিক সমাজে। এই যিশু লালিত হন একান্তই দেশীয় লোকাচারে। এখানে কোনও পশ্চিমা ছায়া নেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার জল হাওয়া লেগে যিশুও হয়ে উঠলেন বাঙালির কাছের মানুষ। ‘ম্লেচ্ছ’ দেশের অপরজন হয়ে থাকল না মেষপালক পৃথিবীর রাজা। খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যাবে বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারগুলিও এতটাই সম্পৃক্ত বাংলার জল হাওয়া-যাপনের সঙ্গে, বাঙালি খাবার দাবার ছাড়া মুখে কিছুই তাদের মুখে রচেনা। মিলে মিশে গিয়েছে নতুন গুড়, প্লাম আর পুডিং। বিবাহ অনুষ্ঠান হয় খ্রিষ্টান পাদ্রি ডেকে, কিন্তু বাংলার সব রীতি নীতিই সেখানে বজায় থাকে। অনেকেই জানেন সম্বৎসর যিশুপুজো হয় বেলুড় মঠে। সন্ধ্যা আরতির পর সেখানে বিতরণ করা হয়েছে কেক, সন্দেশের ভোগ, গাওয়া হয়েছে যিশুর গান। এই প্রতিগ্রহণই, বাংলার মাটিতে সকল ধর্মকে এক সুরে বেঁধেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ-যিশুপ্রেমিক বাঙালি মণীষার তালিকাও কিন্তু লম্বা। সেন্ট পলস গির্জায় যিশুর শেষ ভোজ এঁকেছেন যামিনী রায়। হিব্রুর ‘জোসুয়া’ থেকে বাংলার ‘করুণাময় ইশ্বর’ হয়ে ওঠা খ্রিস্টের সৌজন্যে বাংলার সাংস্কৃতিক যে সমৃদ্ধি তাকে চেটেপুটে খেতে হয় বইকি।
তথ্যঋণ-
দিশিকৃষ্ণ ও ঋষিকৃষ্ণঃ বিশ্বজিৎ রায়