বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ ইস্যুই একমাত্র হাতিয়ার? ঝাড়খণ্ড দখল করতে পারবে বিজেপি?
Jharkhand Election 2024: ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী বসতিগুলিতে বিজেপি নির্বাচনে লাগাতার খারাপ ফল করেছে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত একটা আসনেও বিজেপি জেতেনি।
ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা ভোট হচ্ছে দু'দফায়। ১৩ নভেম্বর ৪৩টি বিধানসভা আসনে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। ২০ নভেম্বর বাকি আসনে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ। ফল ঘোষণা হবে ২৩ নভেম্বর। ঝাড়খণ্ডে বিধানসভার আসন ৮১টি। এবং এই রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রার্থী ৬৮৩জন। ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতায় রয়েছে জেএমএমের (ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা) মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। হরিয়ানা এবং জম্মু কাশ্মীরের পরে আবার মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড বিধানসভা ভোটে মুখোমুখি লড়েছে এনডিএ এবং 'ইন্ডিয়া'। ঝাড়খণ্ডে এবার পালাবদল হবে কিনা, এই নিয়ে এখন জল্পনা তুঙ্গে।
ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতা পেতে মরিয়া বিজেপি। ঝাড়খণ্ডবাসী নাকি এবার বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে বদ্ধপরিকর, একথা দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে। তাঁর দাবি, জেএমএম-কংগ্রেস শাসনের দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যবাসী বিরক্ত, তাই তাঁরা এবার বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবার বলেছেন, বিজেপি জিতলে নতুন আইন আনা হবে, যেখানে বলা থাকবে, ঝাড়খণ্ডের জনজাতির মেয়েকে বিয়ে করলেও তাঁর জমির অধিকার যেন স্বামীর হাতে না যায়। ঝাড়খণ্ডে প্রচারলগ্নে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ ছুটে গিয়েছেন। লোকসভা ভোটের সময় নিচুতলার বিজেপি কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল। তাই মোদি এবার আলাদা করে তাঁদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। প্রচারগুলিতে হেমন্ত সোরেন এবং ইন্ডিয়া জোটকে বারবার কটাক্ষ করেছেন তাঁরা।
বিজেপির তরফে নির্বাচনী প্রচারে এও অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, ঝাড়খণ্ডের জোট সরকার মদত দিচ্ছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের। তারাই নাকি আদিবাসী জমি দখল করছে। অমিত শাহ বলেছেন, "এই সরকার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। আমাদের সরকার রাজ্যে এলে বেছে বেছে এই অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াবে।" বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকে ইস্যু করে তোলা আসলে বিজেপির কৌশল, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের ভোট টানতেই এটা করা হচ্ছে। বিজেপির নেতারা নির্বাচনী প্রচারে ঝাড়খণ্ডের সারিনা হাঁসদা এবং ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনার বেশ কয়েকজন প্রধানের নাম বারবার উল্লেখ করেছিল। তার কারণ, এঁরা সাঁওতাল আদিবাসী এবং তাঁদের স্বামীরা ধর্মে মুসলিম।'
আরও পড়ুন- বিজেপির শরণে শরদ পাওয়ার? ৫ বছর আগে আদানির ‘গোপন’ নৈশভোজে কী ঘটেছিল?
কেন এই ইস্যুতে এত জোর দিচ্ছে বিজেপি? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই নিয়ে স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন যে, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী বসতিগুলিতে বিজেপি নির্বাচনে লাগাতার খারাপ ফল করেছে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত একটা আসনেও বিজেপি জেতেনি। কেন গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল? ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে জিততে হলে সাঁওতাল পরগনার ৬টি জেলার ভোটারদের মন জয় করতেই হয় বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। বলা হয়, এই অঞ্চলে যিনি ভোটে এগিয়ে থাকেন, রাজ্যে তাঁর সরকার গঠনের প্রবল সম্ভবনা থাকে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও এই অঞ্চলের। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার জন্য এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, ক্ষমতা পেতে বিজেপির জন্যও এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্যই বিজেপি ঘুরে ফিরে বারবার বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারী, আদিবাসীদের ঐতিহ্য, আদিবাসী নারীদের সম্মানের মতো বিষয়গুলিকে ইস্যু করে তুলেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার ক্ষমতাসীন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের জোট সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। প্রচার সভাগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে জমি কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়গুলি নিয়ে এসেছে বিজেপি। বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন হেমন্তও। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাহলে কি বিজেপির কোনও সমঝোতা চুক্তি রয়েছে?
২০২৪-এর লোকসভা ভোটে ঝাড়খণ্ডে ১৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৯টি এবং ইন্ডিয়া (জেএমএম ৩টি, কংগ্রেস ২টি) ৫টি। ২০১৯-এর বিধানসভা ভোটে প্রায় সাড়ে ৩৫% ভোট পেয়ে জিতেছিল জেএনএম-কংগ্রেস-আরজেডির ‘মহাজোট’। এবারের বিধানসভা ভোটেও ওই তিনদল একসঙ্গে লড়ছে। এই নির্বাচনে মহাজোটটিতে বামদল সিপিআইএমএল (লিবারেশন) যুক্ত হয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে সাঁওতাল পরগনায় ১৮টি আসনের মধ্যে ১৩টি জিতেছিল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেস। উল্লেখ্য, যখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জন্ম হয়েছিল তখন প্রথম ১৩ বছর বিজেপির শাসন ছিল। সেখানে আদিবাসীদেরও সমর্থন ছিল। কিন্তু এর আগের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস আদিবাসীদের বিরুদ্ধে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাতেই আদিবাসী সমাজ অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
ঝাড়খণ্ডে এবার মূল লড়াই হবে ক্ষমতাসীন জোট সরকার এবং বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র সঙ্গে। এবার প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুদেশ মাহাতোর 'অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন' (আজুস)-এর সঙ্গে জোট করেছে বিজেপি। গত নির্বাচনে এরা আলাদা লড়েছিল। এই জোটে আরও রয়েছে বিহারের নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ানের দল এলজেপি (রামবিলাস)। দ্বিতীয় দফায় হাইপ্রোফাইল প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন, বরহেট থেকে হেমন্ত সোরেন, গাঁডেয় থেকে হেমন্তর স্ত্রী কল্পনা, দুমকা থেকে ভাই বসন্ত। এবং বিজেপির তরফে রয়েছেন ধনওয়ার থেকে দলের রাজ্য সভাপতি বাবুলাল মারান্ডি, জামতাড়া থেকে প্রাক্তন জেএমএম বিধায়ক তথা বর্তমান বিজেপি নেত্রী হেমন্তের বৌদি সীতা।
আরও পড়ুন-লাগাম নেই খোদ যোগী আদিত্যনাথের! কেন বিজেপি নেতারাই ফুঁসছেন পুলিশের বিরুদ্ধে?
প্রথম দফার ভোটে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চম্পাই সোরেন (সরাইকেলা), তাঁর পুত্র বাবুলাল (ঘাটশিলা), প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার স্ত্রী তথা প্রাক্তন সাংসদ গীতা কোড়া (জগনাথপুর) এবং অর্জুন মুন্ডার স্ত্রী মীরা (পোটকা)। বিজেপির আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের পুত্রবধূ পূর্ণিমা। উল্লেখযোগ্য কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক তথা প্রাক্তন আইপিএস অজয় কুমার এবং মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনর মন্ত্রীসভার সদস্য তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামেশ্বর ওরাওঁ।
দ্বিতীয় দফা ভোটের আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর ভিডিও পোস্ট করার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। কংগ্রেস এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এই অভিযোগ করেছে। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে, নির্বাচন কমিশন বিজেপির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশন ঝাড়খণ্ড নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া টিমের এক্স এবং ফেসবুক পেজে পোস্ট করা বিজ্ঞাপনগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় জনতা পার্টি ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী অঞ্চলগুলিতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বেড়েছে বলে যে দাবি করেছে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আদালতে দিতে পারেনি। কিন্তু মূলত এই ইস্যু নিয়েই বিজেপি ভোটের ময়দানে প্রতিযোগিতা করছে। আবার অনেকেই মনে করছেন যে, রাজ্যের বড় অংশ পরিবর্তন চাইলেও সেটা অনেকটাই নির্ভর করবে মানুষ ভোট দিতে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন কিনা তার উপর। ঝাড়খণ্ডে মূলত তিনটি ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। একটি হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক, যা সাধারণত বিজেপির দিকেই যায়। দ্বিতীয় মুসলিম ভোট যা, ইন্ডিয়া জোটে যাবে। এবং অন্যটা সাঁওতাল আদিবাসীদের ভোট। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকে ইস্যু করা হলেও, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এখনও কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং মৌলিক সুযোগ-সুবিধার মতো বিষয়গুলোই গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার কোন জোট শেষ অবধি বাজিমাত করে রাজ্যের ক্ষমতা জয় করবে।