খেলার ভিতরে এত বিদ্বেষ, ভাবিনি কখনও

Barreto on Derby Experience: মোহনবাগানের খেলার সময়ে এমন বহু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। কখনও সমর্থকদের গালিগালাজ কখনও বা খেলোয়াড়দের প্রতি কুৎসিত ইঙ্গিত। কিন্তু নবীর এইভাবে আহত হওয়া আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

নতুন কিছু নয়, আমরাই আসলে ততটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি। কিন্তু এখন এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা খবরের শিরোনাম দেখলেই, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যন্ত্রণার ছবিটা মনে পড়ে। কথা শুরু করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতিহাস। রবিবার গ্যালারিতে বিনা টিকিটে ঢুকতে গিয়েই আটক ৮১ জন সমর্থক। বোঝা যায় কী পরিমাণ উন্মাদনা ছিল ডুরান্ড কাপ ঘিরে। একইসাথে চলেছে টিকিটের হাহাকার। সুদূর অতীতে একবার চোখ রাখা যাক। ৯ ডিসেম্বর ২০১২, যুবভারতীতে আই লিগ চলাকালীন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচে আহত ২০ জন পুলিশকর্মী-সহ ৪০ জন। ৯০ মিনিটের খেলার কারণে আহতের তালিকা এত লম্বা? ব্যক্তিগত হতাশা, আক্ষেপ, ক্ষমাহীন বাস্তবের প্রতিচ্ছবি এই রক্তপাত। কোভিড মহামারীর দীর্ঘ বিরতির পর খেলোয়াড়েরা ফিরছেন মাঠে। ক্রমশ চেনা ছন্দ ফিরছে শহরে। এইসময় আরও অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে মানুষকে। অনেক যত্নে আগলাতে হবে প্রিয় ফুটবলের চেনা সম্প্রীতির বাতাবরণ। কোথায় হারিয়ে গেল কলকাতার উচ্ছাসের শালীনতা? খুঁজে বেড়াচ্ছেন ফুটবলপ্রেমীরাও। কলকাতা ফুটবল নিয়ে গর্বিত হয়ে থাকে। তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হতাশা, পাওয়া না-পাওয়া জড়িয়ে থাকে এই খেলার সঙ্গে। তারই বহিঃপ্রকাশ হয় মাঠে। কিন্তু এই বহিঃপ্রকাশ যেন মাত্রা না ছাড়ায়। উগ্রতা অনেক মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। এ ব্যাপারে ক্লাবগুলিকে সচেতন হতেই হবে। ক্রিকেটে এ জিনিস দেখা যায় না, ফুটবল মাঠ থেকেই এই ধরনের হিংসা ছড়ায়, কারণ নিয়ন্ত্রণের অভাব। এই ঘটনায় সবাই জড়িত নয়। জড়িত গুটিকয়েক। গুটিকয়েকের জন্য যেন ফুটবল কলঙ্কিত না হয়।


গ্যালারি থেকে উড়ে আসা ঘৃণা

ডুরান্ড কাপ চলাকালীনই নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড এবং ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচের দিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা কিছু পড়ুয়াকে জাতিগত বিদ্বেষের মুখে পড়তে হল। তাঁদের 'অপরাধ' তাঁদের বাস ভারতের উত্তর পূর্ব সীমান্তে। উড়ে এল চটি, জলের বোতল, এমনকী পাথর পর্যন্ত। এমন ঘৃণা কোথায় শিখলেন শহরের মানুষ? কোথায় লুকিয়ে ছিল জাতিগত বিদ্বেষের রক্তবীজ? ঘরে ফিরতে চাওয়া সেই বিধ্বস্ত পড়ুয়ারা আর সুরক্ষিত নন এই শহরে, জানিয়েছেন তাঁরা। এই লজ্জা শহরবাসী রাখবে কোথায়? শুধু কি তাঁরাই নাকি বিপর্যস্ত খেলোয়াড়েরাও। এই পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের মানসিক চাপ সামলানো অত্যন্ত কঠিন। সমর্থকদের উন্মত্ততা নষ্ট করে দেয় ফোকাস। বৃষ্টিভেজা মাঠ আর উন্মত্ত দর্শক, জিতে নেওয়ার নিশানায় ফারাক টেনে দেয় লক্ষ যোজনের। প্রিয় ফুটবলারের কাছ থেকে গোলের আশা করে থাকা দর্শক অচিরেই হয়ে ওঠেন ঘৃণার জ্যান্ত অবয়ব। কলকাতা লিগ খেলা হতো বর্ষার দিনে।

আরও পড়ুন: মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচে কেন গ্রেফতার হলো ৮১ জন?

মূর্তিমান বিভীষিকা : উন্মত্ত জনতা

খেলোয়াড় যেমন বুঝবেন দর্শকের মন, দর্শককেও বুঝতে হবে খেলোয়াড়কে। আমি নিজেও খেলার স্বার্থে, দর্শকের মন জিতে নিতে যাবতীয় কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। শরীর সবসময় সঙ্গ দেয় না, অনুকূল থাকে না পরিবেশও। কিন্তু যখনই সমর্থকদের দিকে তাকাই, মনে হয় এই জয় সেই সব মানুষের জন্য জরুরি যাঁরা এই খেলা দেখতে বহু আশা নিয়ে এসেছেন। জিততে ইচ্ছে করে মানুষের জন্যেই, জিততে ইচ্ছে করে ক্লাবের কথা মনে পড়লে। আমার সঙ্গে সমর্থকদের একটা অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিনে নয়, দীর্ঘ দিন লেগেছে এই সম্পর্ক তৈরি হতে। এখন যখন পিছনে ফিরে তাকাই, আমার অবাক লাগে। সমর্থকরা অনেকে দুঃখ ভুলে থাকতে আমাদের খেলা দেখতে আসত। নানা সময়ে আমি হয়তো ফিট ছিলাম না, হয়তো আমার শরীরটা যুতসই ছিল না, কিন্তু এই সমর্থকদের দেখেই আমি মাঠে নেমে গেছিলাম। সমর্থকরা আমায় বিশ্বাস করতেন। আবার মোহনবাগান মাঠ থেকে দর্শকদের দেখেছি অনেকবার, কারণ মাঠটা ছিল খুবই ছোট। খারাপ খেললে দর্শকদের দিক থেকে কটূক্তি ভেসে আসত। হয়তো গোল হল না, বা আমরা গোল খেয়ে গেলাম, ভেসে আসত গালিগালাজ। হতাশাটা ধরতে পারতাম। তবে হ্যাঁ, আমাকে অনেকে মাথায় করে রেখেছিল। আমি বাংলাটা বুঝতাম না, এটা আশীর্বাদ। কিন্তু স্থানীয় খেলোয়াড়দের অবস্থাটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। যে ডার্বিতে সৈয়দ রহিম নবী আহত হলেন, কোনও এক সমর্থকের ছোড়া পাথরের আঘাতে সেই দিনটা মনে পড়লে আজও মন ভারী হয়ে আসে। যে কারওর সঙ্গে এটা হতে পারতো। নবী না হয়ে অন্য যে কেউ। ভাবতে অবাক লাগে এমন বিদ্বেষ ভরে আছে খেলারই ভেতরে।

এ শহর ততটা নিরাপদ নয়

মোহনবাগানের খেলার সময়ে এমন বহু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। কখনও সমর্থকদের গালিগালাজ কখনও বা খেলোয়াড়দের প্রতি কুৎসিত ইঙ্গিত। কিন্তু নবীর এইভাবে আহত হওয়ার ঘটনা আমাকে সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বলতে বাধ্য হচ্ছি, খেলোয়াড় হিসেবে কলকাতায় আসতে ভয় করে। দর্শকদের উন্মাদনা, প্রত্যাশার পাহাড়প্রমাণ চাপ এই দেশের অন্য কোনও প্রান্তে নিতে হয় না। কলকাতা ততটা নিরাপদ নয়। আমার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সমস্যা হয়নি। তবে তার মানে যে অন্যদের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না, তা কিন্তু নয়। বাইরে থেকে এসে ফুটবলারেরা সুযোগ থাকলে ভারতের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের সাহচর্যে থাকার জন্য অন্য যে কোনও জায়গায় যাওয়ার কথাই ভাববে। কিন্তু, কলকাতা নয়। কলকাতাবাসী, এ বড় লজ্জার কথা। কলকাতার ঐতিহ্য সম্প্রীতির। কলকাতা হুল্লোড়ে বাঁচে। আজ এত বছরের রক্ত জল করা শ্রমে, এত বছর ধরে একসঙ্গে বড় হওয়ায় আমরা ক্রমে তাঁদেরই একজন হয়ে উঠছিলাম, সেই নবীই যদি নিরাপত্তাহীন হন এই শহরে, তবে এমন খেলার মানে কী?

আরও পড়ুন:এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…

কলকাতা থাকুক কলকাতাতেই

সমর্থকদের বলতে চাই, প্লিজ মাঠে প্রবেশ করবেন না। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করুন। মাঠে কিছু ছুঁড়ে মারবেন না। আপাত ভাবে ছোট ঘটনা কিন্তু বড় আকার ধার৷ করতে পারে, এমন কিছু করবেন না৷ বাংলার ফুটবল গোটা দেশকে পথ দেখায়। বাংলার ফুটবল নিয়ে গোটা দেশের নিউজ রুমে আলোচনা চলে। সমর্থকরা খেলোয়ারদের মতোই কিন্তু ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় এই সংবাদপত্রের হাত ধরে। কাজেই খেলার মাঠে এমন কিছু করা যাবে না যাতে সুনাম নষ্ট হয়। গ্যালারি জুড়ে তো কতবার আমরা দেখেছি ভালোবাসার ছবি। দেখেছি মানুষ বিশাল ব্যানারে লিখে এনেছেন 'এই মাটি আমাদের। কাগজ আমরা দেখাবো না।' সেই মাটি হঠাৎ বদলে গিয়ে বদলা নেওয়ার মোড়ে পৌঁছে গেল কেন? ভাবুন। আমাদের প্রিয় চেনা শহরটাকে একেবারে পাল্টে যাওয়ার আগে সম্প্রীতি, একসঙ্গে থাকার ইতিহাস আমাদের আগলে রাখুক। বাঁচতে শেখাক।

More Articles