কোথা থেকে বিরিয়ানি এল এই শহরে? কেন কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানিতে আলু 'মাস্ট'
সমস্ত দিনের আয়োজনের শেষে ফুটে উঠছে মিহি লম্বাটে চাল। পারিপার্শ্বিক মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে তার হৃদয় বিদারক ঘ্রাণ। এরপর আটার ময়ানের উপর থেকে হাঁড়ির ঢাকনা সরবে। চওড়া মাপের হাতা দিয়ে হলদেটে ভাতের অতল গহ্বর থেকে চেঁছে আনা হবে মাংসের টুকরো। প্লেটে প্লেটে খাদ্যরসিকদেরর খাওয়ার টেবিলে পৌঁছে যাবে বেহেস্তের নজাকত। ঠিক যেভাবে 'বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়' নেমে আসে রুক্ষ মাটির উপর। বিরিয়ানি পাগল বাঙালি। তার বাস্তুভিটের অলিগলি জুড়ে ছড়িয়ে আছে লাল সালুতে মোড়া অসংখ্য রত্নপেটিকা। তাদের ইবাদতখানায় চলে ক্যাওড়া জলের গন্ধ আর কেশরী অভার আলাপচারিতা। ঢাকাইয়া কাচ্চি চাও? ঘুরে এসো খিদিরপুরের 'ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্টে' থেকে। হায়দরাবাদির জন্য 'সর্বদা হুহু করে মন'? গন্তব্য তাহলে পার্ক স্ট্রিট মোড়ের প্যারাডাইস। খাঁটি কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানির লজিজ্ স্বাদ মিলবে রহমানিয়া, আরসালান, সিরাজে। আবার শহরতলির দিকে পাবে আজমা। এ ছাড়াও, পাড়ার মোড়ে মোড়ে লাল কাপড়ে ঢাকা হাঁড়ির জাদুকররা তো আছেনই। তাঁদের মায়ামাখা হাতের ম্যাজিকেই তো বিরিয়ানি হয়ে উঠেছে কলকাতাবাসীর নিত্য জীবনের সঙ্গী। তবে, যে ইন্দো-পারসিক খাদ্যকে ঘিরে এত উন্মাদনা,তার উৎস আসলে কোথায়, সে প্রশ্নে বিতর্কের অন্ত নেই।
বিরিয়ানির জন্মবৃত্তান্ত
নানা মুনির নানা মত। কেউ মনে করেন তৈমুর লঙের সঙ্গে ভারতবর্ষের মাটিতে আবির্ভাব ঘটেছিল বিরিয়ানির। আবার কারোর মতে, তার সৃষ্টি সেই মুমতাজ মহলের যুগে। কিন্তু, দুটো তত্ত্বই খানিক ত্রুটিপূর্ণ। বিরিয়ানির জন্মভূমি যে ইরান সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে বর্তমানে তার যে চেহারাটা পাওয়া যায়, সেটা গড়ে উঠেছিল ভারতে।ফার্সি 'বিরিয়ান' থেকে উৎপত্তি হয়েছে 'বিরিয়ানি' নামের। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কি জনজাতির দূরপাল্লার যাত্রার খাদ্য ছিল এই 'বিরিয়ান'। রান্নার ব্যবস্থা বেশ সহজ সরল। 'ডেগ' বা হাঁড়ির ভেতর ভাত হালকা ভেজে নিয়ে তার উপর ছড়িয়ে দাও মাংসের টুকরো। তারপর ঢিমে আঁচে রান্না করে গরম গরম পরিবেশন করো। কালে কালে ভারতবর্ষের সঙ্গে মধ্য প্রাচ্যের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হল। হিন্দুস্থান হয়ে উঠল বিরিয়ানির পরিণয়ক্ষেত্র।
আরও পড়ুন-বুকের উপর আস্ত হাতি তুলতেন, বাঙালি ভুলেছে ‘ভীম ভবানী’কে
যেমন ধরা যাক, লখনউ-এর বিরিয়ানি। লখনৌর নবাবদের আসল মুলুক ছিল ইরান। তাঁদের বংশের প্রধান পুরুষ সাদত আলি খান ভাগ্যান্বেষণে এসে পৌঁছন দিল্লিতে। তারপর ফারুকশিয়ারের উত্তরসূরি মোহম্মদ শাহর স্নেহভাজন হয়ে তাঁর কাছ থেকে লাভ করেন 'আউধ' নামক একটা সুবা। সাদাত আলির নাতি আসফউদ্দৌলার সিদ্ধান্তেই আউধের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় লখনউ। কালক্রমে তার রন্ধনশালার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে বিরিয়ানি। পারস্য দেশের প্রভাবের ফলে সেই বিরিয়ানি চেহারায় লাগে ইরানি স্বাদের চেকনাই। মোরাদাবাদী বিরিয়ানি স্বাদে এবং গন্ধে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। লখনৌর সাথে তার মিল বিশেষ নেই। তার কারন, আফগানিস্তানের রোহিল্লা পাঠানদের হাত ধরেই উত্তর প্রদেশের পশ্চিমভাগে ছড়িয়ে পড়েছিল এ বিরিয়ানির খ্যাতি। ফলত, আফগানি রঙেই রঞ্জিত হয়েছিল সে।
হায়দরাবাদি আর কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানির ফারাক
হায়দরাবাদের বিরিয়ানিতে পাওয়া যাবে অন্ধ্রের মরিচের তীক্ষ্ণ ঝাঁজ। কলকাতা বা লখনৌর বিরিয়ানির যে স্বাদের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার থেকে হায়দরাবাদের অবস্থান যোজন মাইল দূরে। তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নিজামি ভাঁড়ারের বিশেষ কলা কৌশল। আর আছে খাস কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানি। উত্তর বা দক্ষিণ ভারতীয় বিরিয়ানিতে আলুর দেখা পাওয়া যাবে না। সেখানে শুধুই ভাত আর মাংসের রাজত্ব। মাঝে মধ্যে ভাত দিয়ে খাওয়ার মতো এক ধরনের তেল ঝালের মশলাদার ঝোল। কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু এসে হাজির হয়েছিল খোদ ওয়াজিদ আলি শাহর দৌলতে। সেও এক বিস্ময়কর গল্প ।
যে ভাবে আলু এল কলকাতার বিরিয়ানিতে
১৮৫৬ সালে, অর্থাৎ সেপাই বিদ্রোহের আগের বছর, রূপকথার শহর লখনৌ থেকে নির্বাসিত হয়ে ওয়াজিদ আলি এসে উঠলেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তিতে প্রতি মাসে এক লক্ষ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা হল তাঁর। একসময় যাঁর এক এক খিলি পানে থাকত আসল মুক্তাভস্ম, তাঁর কাছে আর এক লক্ষ টাকা এমনকী। কিন্তু তখন তাঁর নবাবীর দিন গিয়েছে। ইংরেজদের কাছে গলবস্ত্র হয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। অথচ, মাসিক রাহাখরচও কম নয়। মাত্র লাখ টাকায় কি আর আউধি বিরিয়ানির সেই রাজকীয় ঠাঁট প্রত্যেকদিন বজায় রাখা চলে? কী আর করার। এমন সময় তাঁর বাবুর্চিরা একটা উপায় বের করলেন। গোটা আলু মাঝখান থেকে কেটে, তার টুকরোগুলোকে হালকা ভেজে পরিবেশন করলেন বিরিয়ানির সাথে। এতে বিরিয়ানির স্বাদও বজায় থাকল, খরচেও কুলিয়ে গেল। এভাবেই মাংসের সঙ্গে বঙ্গ বিরিয়ানির শরীরী অলংকারে পরিণত হল আলু।
এমন কত গল্প যে বিরিয়ানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার ঠিক নেই। তার যাত্রাপথ কেমন, সে বিতর্ক চলুক নিজের রাস্তায়। তবে আজকের দিনে সে যে আসলে নানান খাদ্যসংস্কৃতির মেলবন্ধনেরই এক প্রতীকে পরিণত হয়েছে, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। আতশবাজির মতোই তার জাফরানি রঙ ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধ। আর রঙকে তো কোনও সীমান্তে বেঁধে রাখা চলে না। দেশ কাল নির্বিশেষে সে এক অনন্ত মুসাফির।