রাম ভগবান না কি ইতিহাসপুরুষ? যে প্রশ্ন গুলিয়ে দিচ্ছে রামমন্দির
Ramchandra God or Human p-0o: ভ্রান্তি কি কোথাও শ্রীরামচন্দ্রর মধ্যেও ছিল না? যদি ভ্রান্তি নাই থাকে, তাহলে এরকম বিদগ্ধ একজন মানুষ কী করে সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে পারেন?
রাম কি আমাদের রক্তে? না আমাদের মগজে? না কি কেবলই তা বাল্মীকির কল্পনায়? যদি প্রশ্ন করি রামের উৎস কী, তাহলে হয়তো উত্তর আসবে রামায়ণ। রামায়ণের কবি বাল্মীকি এবং আর সকল মহাকবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –
“সমগ্র দেশের, সমগ্র জাতির সরস্বতী ইঁহাদিগকে আশ্রয় করিতে পারেন- ইঁহারা যাহা রচনা করেন তাহাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলিয়া মনে হয় না। মনে হয় যেন তাহা বৃহৎ বনস্পতির মতো দেশের ভূতলজঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া সেই দেশকেই আশ্রয়চ্ছায়া দান করিয়াছে।”
যদি ধরে নিতে হয় রবীন্দ্রনাথের কথা সত্যি, তাহলে বাল্মীকিকে একজন ব্যক্তি না ধরে একটি সম্প্রদায় হিসাবে দেখাই সম্ভবত শ্রেয় হবে। তাহলে রামায়ণ রচনা করলেন কে? সে যেই করুন, বাল্মীকি, তুলসীদাস, কৃত্তিবাস বা সন্ধ্যাকর নন্দী যেই হন, আমাদের লাভ একটাই, সেটা একটি গল্প। গল্প? না কি ইতিহাস?
মহাকাব্য কি ইতিহাস নয়? হয়তো হ্যাঁ। আমাদের কাজ শুধু পরমহংসের বিশ্বাসে দুধ আর জলটাকে আলাদা করে নেওয়া। সে যাই হোক, আমরা কী পেলাম প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমরা পেলাম একজন ঈশ্বরকে, পেলাম একজন ভগবানকে, রামস্তু ভগবান স্বয়ম। এক বার রাম নামে যত পাপ হরে পাপীর সাধ্য নাই তত পাপ করে!
কিন্তু রাম যদি ভগবান হন, তাহলে ইতিহাসপুরুষ তিনি কী করে হবেন? আর সেই ইতিহাসকে দেখে বাল্মীকি(রা) লিখবেনই বা কী করে?
আরও পড়ুন- ২২ জানুয়ারিই বজরং দলের হাতে হত্যা হয় পাদ্রীর! প্রাণ প্রতিষ্ঠার আড়ালে হারাচ্ছে যে ঘটনার স্মৃতি
বলা হচ্ছে – “শুদ্ধ ব্রহ্ম পরাৎপর রাম”। এবার, রাম যদি ব্রহ্ম স্বরূপ হন, তাহলে তিনি মূর্তি হচ্ছেন কী করে? ব্রহ্ম তো নিরাকার। আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা, আবার রামকৃষ্ণ বলেছেন ব্রহ্ম এখনও এঁটো হয়ে যায়নি, অর্থাৎ ব্রহ্মকে ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। তাহলে এই বিমূর্ত ব্যাপারটি শ্রীরামচন্দ্র কী করে হতে পারেন? কিন্তু অন্যদিকে আবার বলা হচ্ছে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, অর্থাৎ আমিই ব্রহ্ম। তাহলে যদি সকল মানুষ ব্রহ্ম হয়, তখন রামচন্দ্রও ব্রহ্ম।
যাহ! রাম তো ভগবান, এখন বলছি মানুষ! এ তো আচ্ছা ঘাঁটা ব্যাপার, তাই না? এই জট ছাড়াতে ফিরে যেতে হবে আদিকবির কাছেই। তিনি একটু পরেই নারদের সঙ্গে কথা বলবেন। বাল্মীকি চান –
“দেবতার স্তবগীতে দেবেরে মানব করি আনে,
তুলিব দেবতা করি মানুষেরে মোর ছন্দে গানে।”
সেই এক কথা। দেবতারে প্ৰিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা। বাল্মীকি যে গান গাইবেন, তিনি দেবতা নন, তিনি মানুষ, সেই মানুষকেই তিনি দেবতা করে তুলবেন। এখানে থেকে এই কথা প্রমাণ হয়ে গেল, রামচন্দ্র প্রথমিকভাবে একজন মানুষ। কেমন সেই মানুষ?
“কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,
কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম
ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,
মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত,
সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,
কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,
কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম
সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম–”
এতগুলো স্ববিরোধী গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি কি সম্ভব? এর উত্তর তো আমরা দিতে পারব না, পারবেন একমাত্র নারদ। নারদকে বাল্মীকি বললেন –
“কহ মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পুণ্য নাম।”
“নারদ কহিলা ধীরে, "অযোধ্যায় রঘুপতি রাম।”
শ্রীরামচন্দ্র এমন মানুষ যাঁর মধ্যেও বীর্য ও ক্ষমা, ঐশ্বর্য ও নম্রতা, দান ও দুঃখ গ্রহণের ক্ষমতা একইসঙ্গে বর্তমান। এই গুণগুলি বর্তমান হলে তো যে কোনও মানুষই প্রায় দেবতা হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু তারপরেও রামচন্দ্র মানুষ কোথায়? রামচন্দ্র মানুষ তাঁর ভ্রান্তির কারণে।
ভগবতী চণ্ডীতে বলা হয় – ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
সেই ভ্রান্তি কি কোথাও শ্রীরামচন্দ্রর মধ্যেও ছিল না? যদি ভ্রান্তি নাই থাকে, তাহলে এরকম বিদগ্ধ একজন মানুষ কী করে সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে পারেন? তবে কি শুধুই ভ্রান্তি? না কি ভালোবাসাও? ভালোবাসা না থাকলে এমন করা যায়? রাম কি সত্যিই সীতাকে এতটাই ভালোবাসতেন? তাহলে তাঁকে পরিত্যাগ করলেন কেন? কেউ কেউ বলেন রামায়ণের উত্তরকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত। তা হলেও কি প্রশ্ন থামে? সে যাই হোক – আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই।
আরও পড়ুন- বঞ্চিতদেরই শাস্তি, অত্যাচারীদের পুরস্কার! রাম মন্দিরের রায়ে ঠিক কী প্রমাণ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট?
অস্বীকার্য করা যাবে না, দেশের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত আজ। বাঁক বদলে যাচ্ছে চেতনার, রাজনীতির। যে রাম আমাদের মনে থাকেন, যে রামের জন্মভূমি কবির মনে অযোধ্যার থেকেও সত্য, তিনিই আজকে অনেক দূরের মানুষ, অনেক দূরের দেবতা। আমাদের বেছে নিতে হবে আমরা কোন দলে? আমরা কি সেই রাজারই দলে যিনি মন্দিরে নিজেকে স্থাপিয়াছেন, জগতের দেবতারে জায়গা দেননি। না কি সেই সাধুর দলে যিনি বলেন, “ভক্তবৎসলেরে তুমি যেথায় পাঠালে নির্বাসনে / সেইখানে, মহারাজ, নির্বাসিত কর ভক্তজনে”। সেই দ্বাদশকলা বিশিষ্ট পুরুষ, যাঁকে ভক্তজন বিষ্ণুর সপ্তম অবতার মানেন, যিনি নিজের পদ্মের মতো পা ফেলে সাগর পার করে এগিয়ে গেছেন শুধু প্রেমের জন্য, আবার যিনি নিজের কোমললোচন অর্পণ করতে চান দেবীর চরণে কেবল ধর্মরক্ষার জন্য (যদিও এই ধর্ম মন্দিরে ঘণ্টা নাড়া ধর্ম নয়), সেই ব্যক্তিকে, সেই লোকশ্রুতির নায়ককে, সেই মহাকাব্যিক মহামানবকে যখন রাজার আঙুল ধরেই নিজের মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় তখন কে স্থাপিত হয় আসলে? মহাকবি বলে গেছেন–
“অহংকার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের
রিক্তভূষণ দীনদরিদ্র সাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে॥
ধনে মানে যেথায় আছে ভরি
সেথায় তোমার সঙ্গ আশা করি,
সঙ্গী হয়ে আছ যেথায় সঙ্গিহীনের ঘরে
সেথায় আমার হৃদয় নামে না যে
সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে॥”