নারীত্বের মন্ত্রোচ্চারণে বাংলা কবিতার বাঁক বদলাতে পারেন কবি অমৃতা ভট্টাচার্য

Review of Amrita Bhattacharya's Poetry: ‘কড়ি’ শব্দে যোনি-প্রতীক মনে আসে। অমৃতা তাঁর বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন ইভ এন্সলারের লেখা ভুবনবিখ্যাত বই ‘দ্য ভ্যাজাইনা মনোলগস’ –এর উদ্ধৃতি।

১৯৯৫ সালে আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ক্লাসিক্যাল ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়। ট্রেড সেন্টারের ১০৭ তলায় হয়েছিল ফাইনালের আয়োজন। ওই ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলেন রাশিয়ার গ্যারি কাসপারোভ এবং ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ। কাসপারোভ তখন দু'বারের স্ট্যান্ডিং চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বনাথন আনন্দ তাঁর বিরুদ্ধে খেলছেন চ্যালেঞ্জার হিসেবে। এই বিশেষ খেলাটি নিয়ে ক্রীড়া জগতে বড় রকমের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কেননা দু'বারের বিশ্বখেতাব জয়ী কাসপারোভকে চ্যালেঞ্জ করছেন এক তরুণ। কিন্তু শুধু এইটুকুই নয়, আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণে এই প্রতিযোগিতা ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

বিশ্বনাথন আনন্দ জানতেন তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দাবা খেলোয়াড়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। তাই তিনি, আনন্দ, দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে এমন প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যে প্রথম আটটি গেমে বিশ্ব শ্রেষ্ঠ কাসপারোভ তাঁর রক্ষণ ভেদ করতে পারেননি। উপর্যুপরি ৮টি গেম ড্র হয়। যা কাসপারোভের পক্ষে একরকম অবমাননাকর – কেননা এত সময় ধরে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী কাসপারোভের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারেননি। এরপরে আসে এক অপ্রত্যাশিত বিস্ময়। কাসপারোভের ক্রীড়ারীতি, সিসিলিয়ান ডিফেন্স, ভেঙে নবম ম্যাচ আনন্দ জিতে যান। দাবা জগতে উত্তেজনা চরমে ওঠে ম্যাচটিকে নিয়ে। এরপর কাসপারোভ বুঝিয়ে দেন যে তিনি কেন কাসপারোভ! সকলের ধারণার বাইরে গিয়ে কাসপারোভ তুলে আনেন একাদশ শতাব্দীতে যা ব্যবহৃত হতো, দাবার এমন একটি গেম স্ট্র্যাটেজি। সিসিলিয়ান ড্রাগন ভ্যারিয়েশন নামক এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করে আনন্দকে তিনি প্রতিরক্ষাহারা অবস্থায় নিয়ে গিয়ে ফেলেন। আনন্দ অবশ্য লড়াই করেছিলেন। মোট ১৮ টি গেম হয় কিন্তু একটির বেশি জিততে পারেননি আনন্দ। তবে ১৩ টি গেম ড্র রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন যা কাসপারোভের বিরুদ্ধে রেকর্ড বলা যায়। কাসপারোভ জিতেছিলেন ৪ টি গেমে আনন্দের জয় ১ টিতে।

এরপর, ৩ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, গ্যারি কাসপারোভ খেলা থেকে অবসর নেন। বিশ্বনাথন আনন্দ অবশ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন সারা পৃথিবীর দাবা খেলোয়াড়দের। কিন্তু তা ঘটেছে কাসপারোভ অবসর নেওয়ার পরে।

দাবা খেলার এই বিশেষ প্রতিযোগিতাটির কথা মনে পড়ল একজনের সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পড়তে গিয়ে। এঁর লেখা আমার পূর্বপরিচিত। কিন্তু বিগত বছরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই কবির রচনা লক্ষ্য করে যুগপৎ বিস্ময় ও আগ্রহের উদ্রেক হচ্ছিল। উক্ত কাব্যগ্রন্থে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রায় সব কবিতাই আছে – এই সঙ্গে এও জানাই যে, বাংলাদেশ থেকে বেরনো কিছু সাহিত্যপত্রও আমি সংগ্রহ করে থাকি এক ব্যক্তির সূত্রে। সেখানেও এই কবির স্বল্প উপস্থিতি দেখেছি। উপস্থিতি স্বল্প হলেও তা খুবই চিন্তা উদ্দীপক। এখন আমি কাব্যগ্রন্থটির একেবারে প্রথম কবিতাটি পাঠকদের সামনে রাখছি, সেই সঙ্গে রাখব অন্য একটি কবিতাও যা আরেক কবির লেখা – হয়তো পাঠক আমার বিস্ময়ের কারণ অনুমান করতে পারবেন।

জল রয়েছে সার

(উৎসর্গ : ‘বিদায়’, শঙ্খ ঘোষ)

জল রয়েছে সার।   এসো    আঁজলা ভরে হারাই
বৃষ্টি অনুতাপ

আমি ভুলেই যাব    ফের     যতটা ভুল হয়
আসন পাতা হলে

সেই অরূপ জল     ছিঁড়ে     দেখাই ভাগ বিয়োগ –
বাড়তি কত ঘাম

ভাসে রাতের তারা   যাই       হেঁটেই পাই গলির
মুখের অনুরণন

যদি আবছা হয়       স্রোত     এসব চেনা কথার
দগ্ধ রাজবেশ

না-ই সারাই যদি      রোগ     চিনতে পারবে জল ?
নাকি কথাই সার ?

‘জল রয়েছে সার’ নামক কবিতাটির নীচে লেখা আছে (উৎসর্গ : ‘বিদায়’, শঙ্খ ঘোষ) এ তো পাঠক দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু কেন দিয়েছেন বইয়ের প্রথম কবিতাটিতেই এমন একটি উৎসর্গ? আমরা দেখছি এই কবিতাটির লেখক নিজের লেখা উৎসর্গ করছেন আরেকটি কবিতাকে যার লেখক শঙ্খ ঘোষ। একটি কবিতাকে অন্য কবিতার প্রতি উৎসর্গ করা, এ কি দেখা যায়? তখনই মনে প্রশ্ন জাগে কোন কবিতার প্রতি উৎসর্গ করা হলো? তাহলে শঙ্খ ঘোষের ‘বিদায়’ নামক কবিতাটির দিকে আমরা তাকাই :

বিদায় / শঙ্খ ঘোষ

তুমি আমার ভাই।   তুমি    সামনে রাখো আমার
নিঃস্ব অবসান

তুমি আমার ভয়।   তুমি    হাত থেকে নাও হাতে
গোপন পরিচয়

সেই পরিচয় আমার?   সেই    বাস্তবতাহীন
চরিত্রহীন মুখ ?

তুমিই আমার আমি।   তাই    আমার গায়ে ছাই
কলঙ্ক সবখানি

আমার কথাও তাই।    যদি    না বোঝো তার দায়
সমস্তটাই আমার

থালায় ভরা জল।      আমি—   সেই জলে মুখ দেখে
বিদায় নিতে চাই।

শঙ্খ ঘোষ লিখিত ‘বিদায়’ নামক এই কবিতাটি লেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘আদিম লতাগুল্মময়’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। শঙ্খ ঘোষের যে চারটি কবিতাসংগ্রহ আছে তার মধ্যে আর কোনও কবিতায় শঙ্খ ঘোষ একবারের জন্যও এই ‘বিদায়’ কবিতাটির রচনা-আঙ্গিক ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ, তিনি, সারাজীবনে মাত্র একবারই এই ফর্ম প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর কবিতায়। ‘জল রয়েছে সার’ নামক কবিতাটি লিখেছেন অমৃতা ভট্টাচার্য, ২০২৩ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতার বইয়ে। অর্থাৎ তিনি ৫২ বছর আগে ব্যবহার করা তাঁর ছয় প্রজন্মের পুরাতন এক কবির একবার মাত্র ব্যবহৃত ফর্ম তুলে আনলেন নিজের কবিতার বইয়ের প্রথম কবিতা হিসেবে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, অমৃতা ভট্টাচার্য নিজের পূর্বজ কবিদের রচনা কত মন দিয়ে পাঠ করেছেন এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। এই বিশেষ আঙ্গিকটি — যা শঙ্খ ঘোষ ব্যবহার করেছেন — তা গত ৫২ বছরে আর অন্য কোনও কবি ব্যবহার করেননি। শঙ্খ ঘোষের কবিতাটির নাম ‘বিদায়’ তা এই মাত্রই একাধিকবার পাঠকদের জানিয়েছি। কিন্তু অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতার বইয়ের প্রথম লেখাটিই ‘উৎসর্গ : ‘বিদায়’, শঙ্খ ঘোষ’ নামে চিহ্নিত হলো কেন? তার একটি উত্তর লেখক গোপন করে রেখেছেন যা ধরতে আমাদের সময় লাগলেও আমরা বুঝি এর দ্বারা তিনি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করলেন। কারণ শঙ্খ ঘোষ তো আর আমাদের মধ্যে নেই, সদ্যই ‘বিদায়’ নিয়ে গিয়েছেন! অথচ কবিতাটি কিন্তু শোকের কবিতা নয়। অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি বিমূর্ত ভাষায় কবিতা রচনা করায় পারঙ্গম — গত ৩৩ বছরের বাংলা কবিতা চর্চায় যে বিমূর্ততার স্থান প্রায় বিলীন হয়ে এসেছে। মাত্র ২/৩ শতাংশ কবি এখনও সংকেত ধর্ম ও কবিতার বিমূর্ততায় আস্থা রাখার সাহস ধরে রাখতে পেরেছেন।

অমৃতা ভট্টাচার্যের প্রথম কবিতার বই বেরোয় ২০১৮ সালে। আমার প্রথম কাব্যপুস্তিকা প্রকাশ ১৯৭৭–এ। অর্থাৎ ইনি আমার ৪০ বছর পরে লিখতে এসেছেন। কিন্তু আমি কখনও পারিনি শঙ্খ ঘোষের ‘বিদায়’ কবিতাটির ফর্মে অন্য কোনও কবিতা রচনা করতে— এবং তা যে পারা যায় সে কথা চিন্তাও করিনি। কেননা আমি ভয় পেতাম, লিখতে গেলেই আমি শঙ্খ ঘোষের উচ্চারণপ্রণালী দ্বারা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন ও প্রভাবিত হয়ে পড়ব। অথচ পাঠক, লক্ষ্য করুন অমৃতা ভট্টাচার্যের এই ‘জল রয়েছে সার’ কবিতাটির ভাষাচরিত্র শঙ্খ ঘোষের ‘বিদায়’ কবিতাটির ভাষাচরিত্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। নিজস্ব এক ব্যক্তিত্ব প্রোথিত করে দিয়েছেন অমৃতা তাঁর ‘জল রয়েছে সার’ নামক কবিতায়। কবিতাটি সম্পূর্ণ রহস্যময়। একবার পাঠে এর অন্তর্দেশ খোলে না। অথচ তা বারবার পড়ার জন্য আকর্ষণ করেই চলে। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় আছে বিদায় নিয়ে যাওয়ার এক সহজ লাবণ্যময় আলো। আর সেই কবিতা সামনে রেখে মকসো করা অমৃতার কবিতাটির মধ্যে এসেছে বিমূর্ত প্রেমভাষ্য, যা আলোর বদলে ছায়াচ্ছন্নতায় সংলাপ বলে চলে এবং প্রশ্নে শেষ হয়। শঙ্খ ঘোষের কবিতাটি স্পষ্টই জানায় ‘বিদায় নিতে চাই’— অর্থাৎ কবিতাটি সিদ্ধান্তে পৌঁছল। অমৃতার কবিতাটি পৌঁছল প্রশ্নে এসে।

এই কাব্যগ্রন্থে নেই কিন্তু বাংলাদেশের এক পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে অমৃতা ভট্টাচার্যের আরও একটি কবিতা, এখানে তুলে দিচ্ছি:

যুদ্ধ ও প্রেম (উৎসর্গ : আদিম লতাগুল্মময়)

ভূমি তোমার নাম    তুমি    পতাকা ধরো হাতে
শিকড় উৎসব

তার মূল্য নেই         শুধু      ছড়ানো গুণ ভাগে
আসন ভেসে যায়

ত্যাগ করেছো দিন   লড়ে   হারাও প্রতিকৃতি
সূর্য-পরিণয়

ছেড়ে নিজের মাঠ   যাও    অস্ত্র ফেরো তূণে
আর কী দরকার ?

ধুলো তরল হয়,       ছায়া    অবোধ বিশ্বাসে
তোমার কথা বলে

তুমি যুদ্ধে খোঁজো   মুখ     শত্রু নাশ হলে
প্রেমের কথা শেষ

এই কবিতাটির ক্ষেত্রে দেখছি আরও একবার, অমৃতা, ৫২ বছর আগে লেখা ওই ‘বিদায়’ কবিতাটির রচনা আঙ্গিক অনুসরণ করেছেন। তবে এবার তিনি ‘বিদায়’ কবিতাটির নাম আর আনেননি ‘উৎসর্গ’ কথাটির পরে — এনেছেন ‘আদিম লতাগুল্মময়’ শব্দ দু'টি। অর্থাৎ শঙ্খ ঘোষের কাব্যগ্রন্থের নামটি তিনি ব্যবহার করেছেন যে গ্রন্থে ‘বিদায়’ নামক কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে উপরোক্ত ফর্ম। কেন এক্ষেত্রে তিনি ‘বিদায়’ লিখলেন না? তার আগে মনে রাখা দরকার, কেন তিনি কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই ‘উৎসর্গ : ‘বিদায়’ শঙ্খ ঘোষ’ লিখেছিলেন? আগেই তো বলেছি, শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণকে স্মরণ করেই তিনি আরম্ভ করতে চেয়েছেন তাঁর নতুন কবিতার বই। তাই বইয়ের প্রথম কবিতার উৎসর্গে ‘বিদায়’ শব্দটি সচেতনভাবে স্থাপন করেছেন। কিন্তু বই বহির্ভূত কবিতাটি একই রচনা গঠন অনুসরণ করলেও সে তো প্রকাশ পাচ্ছে এক পত্রিকায় আরও অনেক অন্য কবিদের লেখার সঙ্গে— তাই শুধু শঙ্খ ঘোষের যে কাব্যগ্রন্থে ‘বিদায়’ কবিতাটি গৃহীত হয়েছে, সেই ‘আদিম লতাগুল্মময়’ কাব্যগ্রন্থের নামটি তিনি শুধু উৎসর্গ হিসেবে রেখেছেন। এটি একটি সংকেত। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বলেছেন তাঁর কাব্যে একটি অমোঘ বাক্য :

‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান’

গত ৩৩ বছরে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন তাঁদের রচনা থেকে সংকেতধর্ম ক্রমশই অপসৃয়মান হতে থেকেছে এবং তার স্থান নিয়েছে বিবরণধর্ম। যে-সময়ের যা যুগলক্ষণ তা পাঠককে মেনে নিতেই হবে। তবে বিবরণধর্মিতার প্রাবল্যের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় আরও একটি প্রবণতা। সেই প্রবণতা হলো অব্যবহিত পূর্বজ কবির রচনারীতি অক্লেশে হরণ করা এবং কোথাও তার স্বীকৃতি মাত্র না রাখা। যে সময়ের যা যুগলক্ষণ! অমৃতা ভট্টাচার্য কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দিচ্ছেন ‘আমি কোন কবিতা থেকে আঙ্গিক গ্রহণ করছি’। অর্থাৎ এ কথা স্বীকারে তাঁর কুণ্ঠা নেই। কেন নেই? দু'টি কবিতা পাশাপাশি পড়লেই বোঝা যাবে, যে কবিতা থেকে অমৃতা আঙ্গিক গ্রহণ করছেন সে কবিতার বিষয় ও ভাষাচরিত্রের সঙ্গে তাঁর কবিতার কোনও সাদৃশ্য থাকছে না। অমৃতা-লিখিত কবিতাটিতে তিনি একটি কঠিন আঙ্গিককে গ্রহণ করে নিজের ভাষা-সামর্থ্যকে পরীক্ষা করতে চাইছেন। ‘যুদ্ধ ও প্রেম’ নামক কবিতাটির ক্ষেত্রেও আমরা শঙ্খ ঘোষের তিলমাত্র প্রভাব প্রত্যক্ষ করি না। সে-লেখা অমৃতার নিজের কবিতা হিসেবেই ব্যক্তিত্ব পায়, পূর্বের ‘জল রয়েছে সার’ কবিতাটির মতোই।

এবার অমৃতার এই দু'টি কবিতার ক্ষেত্রে পাঠককে অন্য একটি জিনিস লক্ষ্য করতে বলব যা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। ‘জল রয়েছে সার’ কবিতাটির ঠিক মাঝখানে, মধ্যবর্তী স্পেস আগে-পরে রেখে, একবার পরপর পড়া যাক শব্দগুলি। কী পাচ্ছি? এসো / ফের / ছিঁড়ে / যাই / স্রোত / রোগ। পাচ্ছি তো? ‘যুদ্ধ ও প্রেম’ কবিতাটির মাঝখানের শব্দগুলি যদি আগের কবিতার মতোই পরপর রাখি তবে কী দেখব? তুমি / শুধু / লড়ে / যাও / ছায়া / মুখ। দেখব তো? এবার এক কাজ করি। তুলে দেওয়া যাক শব্দগুলির মধ্যবর্তী ‘স্ল্যাস’ চিহ্নগুলি। তাহলে যা পাওয়া যায় তার ফলাফল দেখি।

১ : এসো ফের ছিঁড়ে যাই স্রোত রোগ।

২ : তুমি শুধু লড়ে যাও ছায়া মুখ।

অর্থাৎ এই শব্দগুলি দিয়ে কবিতার ভিতরে এক ‘সেকেন্ড লাইন অব থট’ প্রবাহিত করে দিয়েছেন অমৃতা। তাহলে ৫২ বছরের পুরনো রচনা আঙ্গিকে শুধু ভাষাচরিত্রের দিক দিয়েই তিনি বদল আনলেন না এনে দিলেন ‘সেকেন্ড লাইন অব থট’-এর উদ্ভাবন। এই অমৃতা ভট্টাচার্য শঙ্খ ঘোষকে কখনও চোখে দেখেননি। নিজের বাড়িতে যে রবিবার-রবিবার শঙ্খ ঘোষ মিলিত হতেন নবীন কবি, প্রাবন্ধিক, পত্রিকা সম্পাদকদের সঙ্গে, তেমন সান্নিধ্যধন্য কখনই হতে পারেনি অমৃতা ভট্টাচার্যের জীবন। তা সত্ত্বেও, শঙ্খ ঘোষের ‘বিদায়’ কবিতাটি অমৃতার কবিতাজীবনে এক ‘আশ্চর্য আগমন’ হিসেবে উপস্থিত হতে পারল। কারণ একটিই। কী? কবি ও লেখকের প্রথম ও শেষ পরিচয় তাঁর লিখিত শব্দই, তাঁর ব্যক্তিসান্নিধ্য নয়। আমরা কি কেউ শেক্সপিয়রের সঙ্গে মেলামেশা করেছি? অথবা ইসকাইলাসের সঙ্গে? অথচ আমার ৪৫ বছর ধরে মনে আছে ইসকাইলাসের ‘ইউমেনেডাইস’ নাটকের এই সংলাপ : ‘হিয়ার মি, ও ব্রুডিং নাইট — মাই মাদার, ফ্রম হুজ উম্ব আই কেম ফর পানিশমেন্ট’। জীবনে যতবার হাসপাতালে গেছি ততবার এই লাইন আমার মনে পড়েছে, যা খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৮ সালে প্রকাশ পায়। আমি কি বলতে পারব ইসকাইলাসের সঙ্গে খালাসিটোলায় আমি মদ্যপান করেছি?

আরও পড়ুন- মৃত্যুর মুখোমুখি কি কবিতা হাতে দাঁড়ানো যায়? জয় গোস্বামী

অমৃতার এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতার নাম ‘জীবাশ্ম ও আই-পিল’। তলায় লেখা আছে (উৎসর্গ : ‘পথের মন্ত্র’, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)। দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় কবিতাটিও এই কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা উৎসর্গ করেছেন একটি কবিতার প্রতি। সে কবিতা কে লিখেছেন? অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। অলোকরঞ্জনের যে কবিতা বইয়ে ‘পথের মন্ত্র’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সে-বই প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬৭ সালে। বইয়ের নাম ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’। কবিতাটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১৯৬২-তে। অর্থাৎ আজ থেকে ৬১ বছর আগে লেখা একটি কবিতার রচনা আঙ্গিক এই নবীন কবি তাঁর ব্যবহারে আনলেন — যে আঙ্গিক তিনি পেয়েছেন নিজের ৬ প্রজন্ম আগের এক কবির লেখা থেকে। এই ‘জীবাশ্ম ও আই-পিল’ কবিতাটি ৫টি পর্বে বিভক্ত। কিন্তু সেই কবিতাটিতে যাওয়ার আগে এবার প্রথমেই আমরা দেখে নিই ‘পথের মন্ত্র’ নামক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতাটিকে।

পথের মন্ত্র

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

আমরা
পান্থশালার বারান্দায়
বসব না।

সূর্য
অরুণ বরুণ নিয়ে যখন
দিনান্ত;

চন্দ্র
কিরণমালা নিয়ে যখন
নিভন্ত;

আমরা
পান্থশালার বারান্দায়
বসব না।।

আমরা
দ্বিতীয় চুম্বনের আশায়
থাকব না।

খুলল
মেঘের দুয়ার, ঐ আমাদের
সিংহাসন;

নামল
বোশেখি ঝড়, বৃষ্টি ভেজায়
সিংহাসন;

আমরা
দ্বিতীয় চুম্বনের আশায়
থাকব না ।।

অলোকরঞ্জনের ‘পথের মন্ত্র’ নামক এই কবিতার পর আমরা অমৃতা ভট্টাচার্যের নতুন কবিতার বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটির ৫ পর্বের ৩ টি পর্ব পাঠকদের পড়তে দিই। (স্থান সংকুলানের জন্য ৫ টি পর্বই দিতে পারছি না, ৩ টি দিলাম)

জীবাশ্ম ও আই-পিল

(উৎসর্গ : ‘পথের মন্ত্র’, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)

জেনেছি
সর্বনাশের কারণ-ফল
খুঁজতে নেই

শুনেছি
রাত্রিযাপন ফুরিয়ে আসে
অরণ্যে

মন্ত্র
দৃশ্যবদল হলেই দেখো
মূল্যহীন

কর্ণ,
চাকার দাগটি জাতিস্মরেও
জ্বলন্ত

করেছি
হিসেবনিকেশ— অন্ধ এবং
উড়ন্তের

শুনেছি
অঙ্ক, আদর— একটা ঘরে
বাস করে

বুঝেছি
সহবাসের কার্যকারণ
জানতে নেই।

এ রোগের
আদি যেমন অন্তমুখ
সঞ্চয়ী

বর্মের
খোলস ছেড়ে যেই ছুঁয়েছি
এ স্বর্গ

শূন্যে
বিস্মৃতির তীক্ষ্ণ দায়
রেস্তোরাঁ

সঙ্গে
চিহ্ন সব রদবদল
আলগোছে

গলিতে
পর্দা সব উঠল আর
ফুল ফোটে

আজ এই
ভ্রমণ শেষ ; লবণস্বাদ
ওই ঠোঁটে

রাত্রি
বারবি-কিউ ; রক্ত পোড়া
গন্ধ পাই

একাকী
ডুবছে পাহাড় ; ঝিনুক খোল,
বীর্য ধর্ !

এখনও
সূর্যশোক ভুলল না
জীবাশ্ম

বেঘোরে
প্রলাপ অধীন অগ্নি, জল
মরুত ব্যোম

জলেরও
ঘাটের ধাপে জ্বরের আলোর
সঙ্গ চাই

গড়ছে
সাতকাহন আর সমর্পণের
শয্যাটি

তৃতীয়
ব্যক্তি জানায় না থাকলে সে
কোন শোকে

বিরহের
সহস্রনাগ যোনির মুখে
পদ্মজা

আমাকে
মিথ্যে ছায়ার ফেরত দেওয়া
কোন মুখে

জানাব
সাক্ষী থাকুক মোড়ের মাথায়
সূর্যেরা—

পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন অলোকরঞ্জনের ‘পথের মন্ত্র’ কবিতার গঠনআঙ্গিক গ্রহণ করলেও এই কবিতাটির ভাষাচরিত্র সম্পূর্ণই এক পৃথক ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করছে। শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণের অল্প কয়েকমাস আগেই অলোকরঞ্জনও চিরবিদায় নেন। এই অমৃতা ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় আছে বলে জানি, ইনি অলোকরঞ্জনকে কখনও দেখেননি, কথাও বলেননি। কিন্তু নিজের কবিতায় সেই পিতামহপ্রতিম কবিদ্বয়, শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জনের কাছ থেকে তিনি যেন তুলে নিলেন তাঁর পথের মন্ত্র। অলোকরঞ্জন যখন এই কবিতা লিখছেন ৬০ দশকের প্রথম দিকে, তখন আই-পিলের ধারণা মাত্র ছিল না। অমৃতা একজন নারী, তাই আই-পিল বা মেয়েদের জন্মনিরোধক ওষুধের মর্ম তিনি যেভাবে বুঝবেন তা একজন পুরুষের পক্ষে বোঝা কখনই সম্ভব নয়। কারণ মিলনের ফলে নারীর গর্ভসঞ্চারের ভয় থাকে— পুরুষ যার তোয়াক্কা করে না। তাই পুরুষকে ভয় পেতে হয় না এই নিয়ে। অথচ জীবন নারী-পুরুষকে একত্র মেলাবেই।

‘একাকী
ডুবছে পাহাড় ; ঝিনুক খোল,
বীর্য ধর !’

ঝিনুক খোলার সঙ্গে নারীর যোনিচিত্র স্পষ্ট হয় এবং সে-প্রয়োগ যে অবধারিত তা ‘বীর্য ধর’ এই শব্দ দু'টিতে এই অর্থ-দীপ্ত হয়ে ওঠে। কারণ বীর্য ধরে তো নারীর যোনিই।

বিরহের
সহস্রনাগ যোনির মুখে
পদ্মজা

এখানে ‘পদ্মজা’ শব্দটির এমন মন্ত্রতুল্য স্থাপনা যেন আবার বুঝিয়ে দেয় যে, এই কবি যেমন শাস্ত্র জানেন, তন্ত্র জানেন, তেমনি বিজ্ঞান জানেন, প্রত্নতত্ত্ব জানেন। জীবাশ্ম প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়, আই-পিল বিজ্ঞানের আবিষ্কার। দু'টির অনুপম সংঘর্ষ ঘটালেন এই কবি। যোনিপদ্ম তন্ত্রে পাওয়া যায়। এখানে তা সংকেতায়িত হল ‘পদ্মজা’ আসা মাত্রই। এবং একথাও মনে রাখা দরকার, ‘পথের মন্ত্র’ কবিতার এই ফর্ম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নিজের জীবদ্দশায় প্রকাশিত ৪৬টি বইয়ের মধ্যে আর একবারের জন্যও ব্যবহার করেননি। যে ফর্ম এই প্রবাদপুরুষ কবিরা আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করেননি, অমৃতা ভট্টাচার্য, এক নারী কবি সেই ফর্মকেই নিজের ব্যবহারে আনছেন যার মধ্য দিয়ে নিজের স্বতন্ত্র্য ভাষাব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। হ্যাঁ এবং অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর নারীব্যক্তিত্ব।

এইবার আমরা বইয়ের শেষের দিকে একবার চলে যাই। আগেই বলেছি এই কবির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। এখন সকলের সঙ্গে দেখা করতে পারি না। দ্বিতীয় কোভিডের পর দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাই মেইল পড়তেও পারি না। এই কবি, মাঝে মাঝেই নিজের কবিতা বড় বড় অক্ষরে প্রিন্ট আউট করে আমাকে ডাকযোগে পাঠিয়ে থাকেন। সে রকমই একবার একটি কবিতা আমাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন যা এই বইয়ে রয়েছে। কিন্তু আমাকে তিনি যেভাবে পাঠিয়েছিলেন অবিকল সেভাবে নেই। একটু বদল ঘটেছে বইতে মুদ্রণের সময়। কী বদল? সে-কথা বলার আগে আমাকে ডাকযোগে পাঠানো প্রিন্ট আউট থেকে আমি কবিতাটি পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। পরে কোনখানে বদল হয়েছে সে-কথা জানাব।

ঋণশোধ (উৎসর্গ : ভুক্তভোগী : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)

দেখিনি ভালো করে তখনও মুখ
অনভ্যাস তাড়া করে
পতঙ্গের আলো যমজ সুখ
আয়না নিজে পুড়ে মরে!

বিনিময়ের দিন ফুরোলে রাত
রজনীগন্ধার মন
কড়িটি বুঝেছিল সে সংঘাত
ঘুঁটির সখা কোন জন!

ছায়ার পিঠোপিঠি সাবেকি ঝড়
কী করে মুখ চিনি ভিড়ে?
কমলে আলোখানি সে-তস্কর
মূল্য দিয়ে যায় ফিরে!

এই কবিতাটি যখন আমার কাছে পোস্টে পৌঁছল তার আগে অমৃতা ভট্টাচার্য তাঁর ‘জল রয়েছে সার’ আমাকে পাঠিয়েছেন এবং একই রচনাআঙ্গিক প্রয়োগ করে লেখা ‘যুদ্ধ ও প্রেম’ কবিতাটি আমি বাংলাদেশের পত্রিকায় পড়েছি। সবই গতবছরের কথা। এবার এই ‘ঋণশোধ’ কবিতাটি পাওয়ার পর আমি লেখককে জানালাম: "বারবার এইভাবে কবিতার নীচে ‘উৎসর্গ’ শব্দটি দিয়ে অন্য কবিতা বা অন্য কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা ভালো দেখায় কি? এটা আপনার একটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে না কি? সেক্ষেত্রে ‘ভুক্তভোগী’ নামটি ব্যবহার করবেন কিনা, নাকি কবিতাটি উৎসর্গবিহীন রাখবেন তা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।"

এই বছর জানুয়ারি মাসে তাঁর কাব্যগ্রন্থ হাতে পাওয়ার পর দেখলাম যে আমার পরামর্শের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে অমৃতা ভট্টাচার্য তাঁর ‘ঋণশোধ’ কবিতাটি বইয়ে নেওয়ার সময় ‘উৎসর্গ : ভুক্তভোগী’ কথাটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

মুহূর্তে বুঝলাম আমি তাঁকে ভুল পরামর্শ দিয়েছি। তিনি আমার থেকে ৪ প্রজন্ম পরে লিখতে এসেছেন বলেই আমি তাঁকে নির্ভুল উপদেশ দিতে পারি এমন মূর্খ ধারণা আমার হল কী করে! সেই জন্যই ওই ভুল স্বীকার পূর্বক আমি বলতে চাই ‘উৎসর্গ : ভুক্তভোগী’ কথাটি ব্যবহার করে অমৃতা ভট্টাচার্য একটি সংকেত পাঠিয়ে ছিলেন পাঠককে। কী সেই সংকেত? ‘ভুক্তভোগী’ হলো অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের একটি কবিতার নাম, যা আমার মতো পুরনো হয়ে যাওয়া সকল পাঠকই জানেন। কিন্তু নবীন কবি পাঠকেরা সকলে জানেন কি? তার প্রমাণ পেয়েছি খুবই অল্প। এই ‘ভুক্তভোগী’ কবিতাটির নামে নিজের ‘ঋণশোধ’ কবিতা উৎসর্গ করে অমৃতা ভট্টাচার্য একটি সততার প্রমাণ রাখতে চেয়েছিলেন যা আমার মূর্খ পরামর্শে নির্ভর করে তিনি কবিতাটি বইয়ে দেওয়ার সময় তুলে নেন। কী সেই সততার প্রমাণ যা সকল পাঠকের কাছে পৌঁছল না? যেহেতু এর জন্য আমিই দায়ী তাই আমিই সেই প্রমাণ উপস্থিত করি।

ভুক্তভোগী

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

হুবহু বিবাহিত তিনটি লোক
অবিবাহিত থাকে দিনে,
জীবিকা নির্বাহ করে নিছক
দখিনা বাতাসের ঋণে।

অথচ প্রত্যহ দেখি তাদের
পাখা গজায় রাত্তিরে,
নিমজ্জিত করে সধবাদের
ভোগবতীর কালো নীরে।

তবুও পূজা করি আমি তাদের
শেষ রাতের সুপ্তিকে,
বিবশ হাতগুলি কৃশ চাঁদের
খেয়া ভাসায় পুবদিকে।

অলোকরঞ্জনের এই অসামান্য কবিতাটির গঠনস্থাপত্য থেকে অমৃতা তৈরি করেছেন নিজের কবিতাটি। সেই কথাটিই তিনি ‘উৎসর্গ : ভুক্তভোগী’ কথা দু'টি নিজের ‘ঋণশোধ’ কবিতার শিরোনামের ঠিক তলায় রেখে তার রচনাউৎস স্বীকার করতে চেয়েছিলেন। আবারও বলি, এখন কবিতা-সমাজে অক্লেশে পূর্বজ এমনকী পরবর্তী কবির বিষয় ও গঠনরীতি হরণ করার প্রচলন খুবই সহজ হয়ে গেছে। সেখানে ৬০ বছরেরও বেশি আগে প্রকাশিত এবং সাম্প্রতিককালে যথেষ্টই স্বল্পপঠিত কোনও পিতামহসদৃশ কবির প্রতি এই ঋণস্বীকার বিরল সততার পরিচয়। অমৃতার কবিতাটি, অলোকরঞ্জনের কবিতার চেয়ে উৎকৃষ্ট এমন কথা প্রমাণ করা আমার লক্ষ্য নয়। শুধু বলতে চাই, দু'টি লেখা সম্পূর্ণ দু'রকম। অলোকরঞ্জনের প্রায় অলৌকিক ছন্দসিদ্ধির কথা পুরনো পাঠকরা জানেন। এখনকার কবিতা লেখকদের মধ্যেও ছন্দদক্ষ ও মিলপটু কবিরা উপস্থিত। তবে অমৃতার ঝোঁক তাঁর নিজ রচনার বিষয়কেন্দ্রের দিকে এতদূর গভীরতাকে ভেদ করতে চায় যার ফলে অমৃতার কবিতা জনপ্রিয় হওয়া কঠিন। ছন্দদক্ষ কিন্তু বিষয়-লঘুত্বের অধিকারী সাম্প্রতিক কবিতালেখকের সংখ্যা কম নয়। অমৃতা তাঁর ‘ঋণশোধ’ কবিতায় অলোকরঞ্জনের সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তই ব্যবহার করেছেন। কবিতাটির চলন জটিল। ৭/৫, ৭/২, ৭/৫, ৭/২ এইভাবে এগিয়েছে চার লাইনের স্তবকগুলি। তিনটি স্তবকে কবিতা সম্পূর্ণ। অলোকরঞ্জনের। অমৃতারও। অমৃতা, নিজের কবিতায় অলোকরঞ্জনের ঋণ (‘দখিনাবাতাসের ঋণে’) শব্দটিকে ভ্রূণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাই নাম দিয়েছেন ‘ঋণশোধ’। এখানেও অলোকরঞ্জনের প্রতি স্বীকৃতিজ্ঞাপন। কিন্তু অমৃতার মূল কবিতাটি একেবারেই এক নারী-প্রকৃতির কেন্দ্র থেকে উদ্ভূত। অলোকরঞ্জনের কবিতার মধ্যেও নারীরা প্রাধান্য পেয়েছে, আছে নারী দেহ ভোগ করার ইঙ্গিতও। কিন্তু অমৃতার কবিতার ভাষাব্যক্তিত্ব এবং বিষয়ের সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বুঝিয়ে দেয় এই লাইনটি :

‘কড়িটি বুঝেছিল সে সংঘাত
ঘুঁটির সখা কোন জন’!

এখানে ‘কড়ি’ শব্দে যোনি-প্রতীক মনে আসে। অমৃতা তাঁর বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন ইভ এন্সলারের লেখা ভুবনবিখ্যাত বই ‘দ্য ভ্যাজাইনা মনোলগস’ –এর উদ্ধৃতি। ইভ্ এন্সলারের বইটি আমি ২০০১ সালে প্রথম পড়ার সুযোগ পাই। সে-সময় বিদেশে থাকার সুবাদে এই বইয়ের লেখিকা দ্বারা পাঠ অনুষ্ঠানেও শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়েছিল। নারী দেহের ওই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গটি— যা থেকে জন্ম সম্ভব হয়— সে যদি স্বগতোক্তি করতে পারত তাহলে কেমন হতো তার একক সংলাপ? এই নিয়েই লেখা হয়েছে ওই বই ‘দ্য ভ্যাজাইনা মনোলগস’। অতএব, ‘কড়ি’ যে ‘সংঘাত’ বোঝে এই উপলব্ধি কোনও পুরুষ কবির পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অত জটিল ছন্দচলন, প্রতিপদে অন্ত্যমিল যুক্ত করে অনায়াসে সম্ভব করেছেন অমৃতা ভট্টাচার্য। মিলগুলি এসেছে কোনও চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করতে নয়, স্বাভাবিকভাবে কবিতাটির গঠনকে বিষয়ের সঙ্গে মিলিত হতে দেওয়ার জন্য। যেভাবে নারীর সপ্রণয় মিলন ঘটে পুরুষের সঙ্গে তেমনই সহজতায়। চমকপ্রদ মিল প্রয়োগ দ্বারা অনেক সময়ই অন্য অন্য কবি পাঠকের বাহবা পান বটে তবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল প্রয়োগ আর মিলন থাকছে না। কেন? কারণ জোর করে যদি পুরুষ নারীর সঙ্গে মিলিত হয় তাকে বলা হয় ধর্ষণ। ধর্ষণে একপ্রকার বলপ্রয়োগ ঘটে, অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রেও এমন বলপূর্বক প্রয়োগ আমরা দেখি না তা নয়। অমৃতা সে-রাস্তায় যাননি। কারণ তিনি নারী।

একটি প্রশ্ন, আমার মাঝে মাঝেই মনে জাগে ফর্ম সচেতন কবিদের ক্ষেত্রে। ফর্মটি নির্ভুল জানি এটি দেখানোর জন্যই কি কবিতাটি লিখি? না কি একটি কবিতার জন্য দরকার হচ্ছে বলে এই ফর্মকে ব্যবহার করছি? কোনটি প্রধান? নির্ভুলভাবে ফর্ম অনুসরণ করে চলা? না কি বিষয়বস্তুর চাপে ক্লাসিক্যাল ফর্মকে প্রয়োজনে সামান্য বদল করা? কীসে আমার কৃতিত্ব প্রমাণ হবে? কোনও ক্লাসিক্যাল গঠন আমি কত নির্ভুল জানি তার স্বাক্ষর রাখা? অথবা আমার ভেতরকার উৎস থেকে বেরিয়ে আসা বিষয়-অগ্নিকে উপযুক্ত প্রকাশপথ দেওয়া?

অমৃতা তাঁর কাব্যগ্রন্থের একেবারে শেষ দু'টি কবিতার নামকরণ করেছেন এইভাবে : ‘ভিলানেল’ তার নীচে ‘উৎসর্গ : বিষ্ণু দে’। ভিলানেল কী তা অনেকেই জানেন। ফরাসি কাব্যের একটি বিশেষ মিল বিন্যাসের রীতির নাম ‘ভিলানেল’। ১৯৫১ সালে ‘ভিলানেল’ নামে বিষ্ণু দে যে কবিতা লেখেন তার দ্বারা বাংলায় ‘ভিলেনেল’ –র আগমন ঘটে। এক্ষেত্রেও, অমৃতা, তাঁর ৮ প্রজন্ম আগের ‘প্রপিতামহপ্রতিম’ ৩০ দশকের কবিতার এক প্রধান স্তম্ভ বিষ্ণু দে-র রচনার আঙ্গিক প্রয়োগ করলেন নিজের লেখায়। আমরা আগে বিষ্ণু দে-র কবিতাটি দেখে নেব— কেননা শেষ ৪৫ বছরে বিষ্ণু দে ক্রমশই স্বল্প থেকে স্বল্পতর পাঠক ভাগ্য লাভ করতে করতে এখন তাঁর কবিতার পাঠক প্রায় শূন্যতায় পৌঁছেছে। বিষ্ণু দে ৭২ বছর আগে প্রকাশিত এই ‘ভিলানেল’ আঙ্গিকটি তাঁর নিজের কবিতায় আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করেননি। বিষ্ণু দে-র কবিতাটি এইরকম।

ভিলানেল্

দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
সে কার হাওয়া আনে বনের নীল ভাষা।
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

আলোর ঝিকিমিকি তোমার কালো চুলে,
ঊষার ভিজে মুখে দিনের স্মিত আশা,
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে

পরশ মেলে মেলে তুমি যে ধর খুলে,
হৃদয় সে ঊষায় থামায় যাওয়া-আসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

কে খোঁজে পথে আর কে ঘোরে পথ ভুলে
অস্ত গোধূলিকে কে সাধে দুর্বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে ?

ঈশান মেঘে আর ওঠে না দুলে দুলে
ত্বরিতে কাঁদা আর চকিতে মৃদু হাসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

সে তরু এ হৃদয়, তুমি যে-তরুমূলে
বসেছ ফুলসাজে, ছায়ায় দাও বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে।
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।।

কবিতাটি ৭ মাত্রার দু'টি পর্ব পাশাপাশি রেখে রচিত। এবার এর মিলগুলি কীভাবে আসছে দেখা যাক। প্রথম ৫টি স্তবক তিন লাইনের। মিল আসছে ক খ ক— এই পথ ধরে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও জটিলতা আছে এই ফর্মটির ক্ষেত্রে। প্রথম লাইনটি অবিকল ফিরে আসবে ষষ্ঠ লাইনে। তৃতীয় লাইনটি অবিকল ফিরে আসবে নবম লাইনে। দ্বাদশ লাইনে আবার আমরা প্রথম লাইনটির দেখা পাব। পঞ্চদশ লাইনে পাব তৃতীয় লাইনটির সাক্ষাৎ। তিন লাইনের চলনে এগোতে এগোতে, ‘ভিলানেল’ নামক এই গঠন তার শেষ স্তবকে কিন্তু রাখবে চার লাইন। এবং চার লাইনও বিশেষ নিয়মাবদ্ধভাবে আসবে। কী রকম? কবিতার প্রথম লাইন এবং তৃতীয় লাইন দেখা দেবে কবিতার শেষ দু'লাইন হিসেবে। বিষ্ণু দে তাঁর রচনায় এই নিয়ম নির্ভুলভাবে রক্ষা করেছেন। সেই ‘ভিলানেল’ –এর রীতি অনুসরণ করেছেন অমৃতা ভট্টাচার্য তাঁর বইয়ের শেষ দু'টি কবিতায়— প্রথমটিতে তিনি ৭ মাত্রার ২টি পর্ব পাশাপাশি রেখেছেন যেমন রেখেছিলেন বিষ্ণু দে। কিন্তু দ্বিতীয় ‘ভিলানেল’ তথা বইয়ের শেষতম কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেন ৫ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত— যার চলন ৫/৫/২।

একমাস হয়নি অমৃতার বইটি বেরিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে নিজস্ব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাব্যসামর্থ্যের অধিকারী এক কবি আমাকে জানালেন অমৃতার ‘ভিলানেল’– এ ভুল আছে। আমি নীরব রইলাম। কেন আমার নীরবতা সে-বিষয়ে পরে আসছি। আগে অমৃতার ‘ভিলানেল’ দু'টি দেখে নিই:

ভিলানেল
(উৎসর্গ : বিষ্ণু দে)


লিখেছি পরিভাষা, শিকড় ছিঁড়ে যাই
বারণ শুনে আর থেমেছ কবে তুমি
শুষেছে মাটিবোধ, সহজ কবিতাই

আয়না বহুগামী ছায়াই খুঁটে খাই
শব্দ ছুঁয়ে যেই জাগল দেহ-ভূমি
লিখেছি পরিভাষা শিকড় ছিঁড়ে যাই

কামড়ে নাভিমূল, উজাড় যোনিভয়
বাঁধল ছায়ানট বিদেহী সেই ঝড়
শুষেছে মাটিবোধ সহজ কবিতাই

শূন্য করে আসে, কবিতা কেন হয়
এসব জানা শেষ — মৃত্যু চেনা ঘর
লিখেছি পরিভাষা শিকড় ছিঁড়ে যাই

প্রতিটি বাঁকে মেলে অঙ্ক আদিসাজ
পেল না উত্তর, তবু চাকার দায়
শুষেছে মাটিবোধ সহজ কবিতাই

বেঘোরে ছেড়ে যাও এত যে দোষ আজ
প্রতিটি ফিরে আসা উড়েছে কী হাওয়ায় ! —
লিখিত পরিভাষা শিকড় ছিঁড়ে তাই
শুষেছে মাটিবোধ সহজ কবিতাই।

অগ্নি আমি, তাকিয়ে দ্যাখো ওই
জ্বলছি শুধু, —অধীর কানাকানি
পোড়ার মতো সোহাগ মেলে কই !

জ্বলন সার ; পর্ব উড়ো খই
পাড়ার মোড়ে আলোর হানাহানি
অগ্নি আমি, তাকিয়ে দ্যাখো ওই

পুড়লে হৃদি দৃশ্যে রং-স্নান
তোমার স্বর সঞ্জীবনী — তবু
পোড়ার মতো সোহাগ মেলে কই!

শরীর জ্বলে ঊর্ধ্বমুখী ভান
উঠছে ঘোড়া যজ্ঞে সে-ই প্রভু
অগ্নি আমি, তাকিয়ে দ্যাখো ওই

হাঁমুখে চাঁদ গলছে ঘন বনে
এখন স্রোত লাভা-সমাদৃত
পোড়ার মতো সোহাগ তবু কই!

অরূপ যত হোমের কাঠ শোনে
ঊরুসন্ধি, —এবার ঢালো ঘৃত
অগ্নি আমি, তাকিয়ে দ্যাখো কোণে
পোড়ার মতো সোহাগ মেলে কই!

যে শক্তিমান কবি আমাকে জানিয়েছিলেন যে অমৃতার ভিলানেল–এ ভুল আছে — ভুল বলতে তিনি ঠিক কী বুঝিয়েছিলেন? আমি নিরুত্তর থাকা সত্ত্বেও তিনি দু' চার কথায় যা ব্যাখ্যা করেছিলেন তা হলো, বিষ্ণু দে’র ‘ভিলানেল’-টি আদর্শ ভিলানেল হিসেবে ধরলে অমৃতার লিখিত ভিলানেলে মিলের বিন্যাসে কিছু হেরফের দেখা যাচ্ছে। তাহলেই তো আর ভিলানেল হলো না? এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সেই কবি।

১৩৬৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৬২ বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার চতুর্দশ সংকলন ‘সনেট সংখ্যা’ রূপে প্রকাশ পায়। সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন : সনেটের বিশেষ রূপটি নির্ধারিত হয় Guittone d’arezzo (১২২৫-১২৯৪)–এর রচনায়। ইংরেজ কবিরা সনেট সম্পর্কে সচেতন হন ১৫৫৭ সালে Tottles Miscellany প্রকাশিত হবার পর। ফ্রান্সেও এই সময়েই Desportes, De Baïf, Ronsard প্রভৃতি সনেট রচনা শুরু করেছেন। তারপর থেকে সনেটের সপক্ষে এবং বিপক্ষে বহু মতামত গড়ে উঠেছে। অনেক কবি নির্দিষ্ট রীতি ছেড়ে স্বেচ্ছাপথে লিখতে চেয়েছেন। এখন আর মিলবন্ধন কিংবা পঙক্তি বিভাগের কোনও নিয়মই নেই। বিষয় সঙ্গতি রেখে সনেটগুচ্ছও রচিত হয়েছে অনেক। উদাহরণ হিসেবে নাম করা যায়— রবার্ট ব্রাউনিং তাঁর স্ত্রীর লেখা যে সনেট ‘মালা সনেটস্ ফ্রম দ্য পর্টুগিজ’ নামে প্রকাশ করেছিলেন। ব্রাউনিং তাঁর পত্নী ব্যারেটকে আদর করে পর্টুগিজ বলে ডাকতেন। ওই একই সংখ্যায় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর এক প্রধান কবি তারাপদ রায় ‘সনেট প্রসঙ্গে’ নামক একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তারাপদ রায় বলছেন দেখা যায় : ‘পেত্রার্কা যে সনেট পদ্ধতির প্রচলন করেন তাকে ক্লাসিক্যাল সনেট বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের সনেটগুলির প্রথম আট চরণে বা অষ্টকে একটি ভাব রূপ ধারণ করে এবং শেষের ছয় চরণে বা ষটকে সেই ভাবটি পরিণতি লাভ করে। এই ধরনের সনেটগুলির অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। প্রথম যুগের সনেটগুলি ছিল ব্যক্তিনিষ্ঠ। পেত্রার্কার পদ্ধতিতে ইংল্যান্ডে মিলটন ও ওয়ার্ডসওয়র্থ সনেট রচনা করেন। কিন্তু শেক্সপিয়রের সনেটগুলিতে একটি বিশিষ্ট ব্যতিক্রম দেখা যায়, সেটি অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ উভয়ত। মহাকবির সনেটগুলিতে শিথিলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় এবং আরও লক্ষণীয় এই যে পেত্রার্কার মতো তাঁর সনেট শুধু ব্যক্তিনিষ্ঠ নয় বস্তুনিষ্ঠও। এছাড়া তাঁর চরণান্তিক মিলেও ব্যতিক্রম আছে। মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক। প্রবাসে তিনি তাঁর অধিকাংশ সনেট রচনা করেন এবং এই ক্ষেত্রেও যদিও তিনি সনেটের আদিগুরু পেত্রার্কার দ্বারাই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন কিন্তু সর্বত্র পেত্রার্কাকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেননি’।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, শেক্সপিয়র ও মধুসূদনের মতো মহাশক্তিধর চিরজীবী কবিদ্বয়, পেত্রার্কা প্রবর্তিত সনেটের নিয়মাবলির ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন সনেট লেখার সময়। কারণ কী? পূর্বেই বলেছি যিনি সত্যকার কবি তিনি কেবল কোনও বিশেষ রচনা আঙ্গিকের অন্ধ অনুসরণ করেন না বা করে উঠতে পারেন না। কেননা তাঁর ভিতরের ‘বিষয়অগ্নিই’ তাঁকে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে বাধ্য করে। কারণ সেইসব কবির কাছে মূল গুরুত্ব পায় তাঁদের কাব্যের অন্তর্বস্তু। বাইরের নিয়মবদ্ধ বিন্যাসটুকু মেনে চলাই তাঁদের কাব্যরচনার মূল লক্ষ্য থাকে না। অমৃতার ক্ষেত্রেও সেইটাই ঘটেছে। কিন্তু অমৃতা-লিখিত ভিলানেল প্রসঙ্গে পুনরায় ফেরার আগে আমরা ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ‘সনেট সংখ্যায়’ প্রকাশিত তারাপদ রায়ের নিবন্ধটি বিষয়ে দু' এক কথা বলে নিতে চাই। তারাপদ রায় জানাচ্ছেন যে : সনেট লিখবার সময় মধুসূদন তাঁর দু'জন বন্ধুকে দু'টি চিঠি লিখেছিলেন একটি গৌরদাস বসাক মহাশয়কে। তাতে জানিয়েছিলেন : ‘আই হ্যাভ বিন লেটলি রিডিং পেত্রার্কা — দ্য ইটালিয়ান পোয়েট, অ্যান্ড স্ক্রিবলিং সাম ‘সনেটস’ আফটার হিজ ম্যানার’। আই ডেয়ার সে, দ্য সনেট চতুর্দশপদী উইল ডু ওয়ান্ডারফুলি ইন আওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ’। আর তিনি রাজনারায়ণ বসু মহাশয়কে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে এই ভবিষ্যৎবাণী ছিল যে : ‘ইফ কালটিভেটেড বাই মেন অব জিনিয়াস, আওয়ার সনেট উইল ইন টাইম রাইভাল দ্য ইটালিয়ান’। বোঝাই যাচ্ছে মধুসূদন দত্ত বলতে চেয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষার সনেট একসময় সনেটের আদি উৎস ইটালিয়ানের প্রতিস্পর্ধী রূপে দেখা দেবে। এবার আমরা আবার তারাপদ রায়ের নিবন্ধটিতে আসছি — সেই নিবন্ধ জানাচ্ছে : ‘মধুসূদনের এই ভবিষ্যৎবাণী কিন্তু সর্বাংশে মেলেনি, মধুসূদনই বাংলা সনেটের স্রষ্টা ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচয়িতা। মধুসূদন পরবর্তী বাংলা সনেটের ইতিহাস সাহিত্য ও কাব্যকলার অন্যান্য শাখার মতো তত গৌরবমণ্ডিত নয়’। এই নিবন্ধ যে সম্পাদক প্রকাশ করছেন — অর্থাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় — তিনিও নিবন্ধকারের উপরোক্ত মতেই বিশ্বাসী সেই প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর উক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়টির শেষ প্যারাগ্রাফটি পড়লে : ‘আধুনিক বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল সনেট বিশেষ নেই, কবিরা তেমন উৎসাহী নন। যে কোনওরকম প্যাটার্ন পোয়েট্রি উৎসাহের যোগ্যও নয়, আমাদের বিশ্বাস। মনে হয়, অচিরকালের মধ্যেই এই কাব্যরূপটিও প্রাচীন সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবেই গণ্য হবে’।

১৩৬৭ বঙ্গাব্দে এই ‘সনেট সংখ্যা’টি প্রকাশের পরবর্তী কাব্য ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা কবি-সম্পাদক ও কবি-নিবন্ধকার দু'জনেরই ভবিষ্যৎবাণীকে রক্ষা পেতে দেখি না। ষাটের দশক থেকে পঞ্চাশের কবিজ্যোতিষ্ক শক্তি চট্টোপাধ্যায় অজস্র সনেট রচনা করেছেন। ১০০ টি সনেট নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলি’ গ্রন্থটি তো বটেই, তাছাড়াও সমীর সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশন থেকে বেরনো ‘অগ্রন্থিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ নামক বইয়ে বহু সনেট পাওয়া যায়। এই সমীর সেনগুপ্তের সম্পাদনায় শক্তির প্রয়াণের পর আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ পাওয়া ‘অগ্রন্থিত গদ্য পদ্য’ নামক বইয়েও ‘প্রাণপণ কবিতাগুচ্ছ’ শীর্ষক সংখ্যাচিহ্নিত কিছু সনেট ছাপা হয়। এই কবির ‘পদ্যসমগ্র – ৬’ নামক সংকলনে কবির স্ত্রী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় শক্তি-লিখিত ৭৩ টি কবিতা যুক্ত করেন কবির পুরনো খাতা থেকে উদ্ধার করে, শক্তি যে কবিতাগুলিকে ‘চতুর্দশপদী’ নামে অভিহিত করে গেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই সকল সনেটই তার গতিবেগে, শব্দক্ষেপণের অভাবনীয়তায়, এবং কাঠামোর মধ্যে কখনও প্রথানুসরণ, কখনও নতুনত্বের আবির্ভাব এমনভাবে সম্ভব করেছে যে আমাদের বিস্ময়-মুগ্ধতায় অভিভূত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শক্তির পরবর্তী প্রজন্মে কবিতা লিখতে আসা পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল — যাঁর প্রথম কবিতা ১৯৬৫ সালে ছাপা হয় এবং ১৯৭০ সালে যাঁর প্রথম কবিতার বই ‘দেবী’ প্রকাশ মাত্রই বিশেষজ্ঞ পাঠককূল দ্বারা অভিনন্দিত হয় — সেই পার্থপ্রতিম নিজের মধ্য যৌবন থেকে জীবনপ্রান্ত পর্যন্ত এত ধরনের সনেটের রূপবন্ধ ব্যবহার করেছেন যা বাংলায় আর কোনও কবি করেননি। ১৯৮২ সালে মাত্র ১৪ টি কবিতা নিয়ে তাঁর সনেট সংগ্রহ ‘রাত্রি চতুর্দশী’ প্রকাশিত হয় যা বাংলার তরুণ কবিতায় বিশেষভাবে বন্দিত হয়ে চলেছে আজও। ১৪ টি সনেট প্রত্যেকটিই ১৪ মাত্রার। গঠনশিল্পের নির্ভুলতার সঙ্গে সঙ্গে কাব্য হিসেবেও সে-গ্রন্থ অতুলনীয়ভাবে উত্তীর্ণ। সেখানেই শেষ নয়। ২০০১ সালে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত পার্থপ্রতিমের ‘পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত’ নামক কাব্যগ্রন্থে ফরাসি সনেটের আদলে রচিত ‘দেয়ালগিরি’ কবিতাটির তলায় একটি ফুটনোট আছে ছোট হরফে। ফুটনোটটি এইরকম : {কেবল ‘সনেট’ বলার থেকে, আরেকটু বিনীত হয়ে, সনেটের আদলে কথাটি বসিয়েছি}। এই ‘পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত’ নামক কাব্যগ্রন্থে এবং ২০১৩ সালে ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’ থেকে বেরনো ‘বর্ণজীবের সনেট ও আগন্তুক’ নামক বইয়ের পাশাপাশি ২০১৫ সালে ‘রাবণ’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ’ নামক তিনটি কাব্যগ্রন্থ অনুসরণ করলে দেখা যায় যে, এই লেখক শুধু পেত্রার্কার সনেটের আদলেই নয় ই. ই. কামিংসের সনেটের আদলে চতুর্দশপদী লিখেছেন। ই. ই. কামিংস ও পেত্রার্কার নাম আমাদের পরিচিত। আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে পার্থপ্রতিম ‘দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির মিলকাঠামো’, ‘ফাৎসিও দেলই উবের্তির সনেটের মিলকাঠামো’ — এইরকম ছোট ছোট ঘোষণা দিচ্ছেন তাঁর একের পর এক সনেটে লেখার নামকরণটি ছাপা হওয়ার ঠিক নীচেই। পার্থপ্রতিমের কবিতাসংগ্রহ এখন ‘আদম’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, আগ্রহী পাঠক দেখে নিতে পারেন। সত্তরের আরেক প্রয়াত কবি বীতশোক ভট্টাচার্য নিজের কোনও কবিতার আগে সনেট বা ‘অমুকের মিলকাঠামো’ — এমন ঘোষণা না দিলেও বহু সার্থক সনেট রচনা করেছেন। পার্থপ্রতিম ও বীতশোকের দু'প্রজন্ম পরে লিখতে আসা নব্বই দশকের অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় চতুর্দশপদীর চর্চা করেছেন। 

নব্বইয়ের আরও এক কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য তাঁর ‘জগৎগৌরী কাব্য’ নামক গ্রন্থটিও একটি সনেটসংগ্রহ রূপেই প্রকাশ করেন ২০০৯ সালে। এছাড়াও যাঁর কথা বিশেষভাবে বলা দরকার, সত্তর দশকের প্রধান এক স্তম্ভ শ্রী অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র ১১৪ টি চতুর্দশপদী নিয়ে একটি কাব্য প্রকাশ করেন যা অতুলনীয় বললে কম বলা হয়। এই কবির কবিতাসংগ্রহ এই বছর বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং, অনেকদিন দুষ্প্রাপ্য থাকার পর এই সনেটগুলি এখন পাঠক আস্বাদন করতে পারেন। সত্তরের কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও নির্ভুল সনেট লিখেছেন যার নিদর্শন কবির ‘বঙ্গীয় চতুর্দশপদী’ গ্রন্থের মধ্যে পাওয়া যাবে। এঁর কবিতাসমগ্রের প্রকাশ ঘটেছে সম্প্রতি। সেখানে চতুর্দশপদী চর্চার আরও প্রমাণ আছে। সত্তরের আরও এক কবি সুবোধ সরকারের ‘কৃত্তিকায় সনেট ক্যাঙারু’ নামক গ্রন্থ ৫৬ টি সনেট নিয়ে সামনে আসে ২০০৩ সালে। এই লেখকের কবিতা সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডের গ্রন্থপরিচয় অংশ থেকে জানা যায় তিনি ১৫৫ টি সনেট রচনা করেছিলেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘যে জ্যোৎস্না হরিণাতীত’ শীর্ষক এক কাব্যগ্রন্থ তাও পুরোটাই চতুর্দশপদী কবিতা দিয়েই পূর্ণ। এ-গ্রন্থের লেখক শ্রীজাত।

তাহলে দেখা গেল, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার চতুর্দশ সংকলনে পঞ্চাশের দুই প্রধান কবির সনেট সম্পর্কিত ভবিষ্যৎবাণী একেবারেই মেলেনি। বদলে কার্যকর হয়েছে মাইকেলের দূরদৃষ্টি। ‘সনেট প্রসঙ্গে’ নিবন্ধটি তারাপদ রায় শেষ করেছিলেন এই বাক্যদ্বারা : ‘...সংশয় করি, সনেটের আয়ু বুঝি শেষ হল’। এই জন্যই আগামী দিনের কবিতা সম্পর্কে দুমদাম ভবিষ্যৎবাণী করা বিপদজনক। ভবিষ্যৎবাণী যদি করতেই হয় তবে মাইকেলের মতো মহাকবি হওয়া দরকার। সেই মাইকেল বিষয়ে তারাপদ রায় কিন্তু একটি খুবই প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। কথাটি আবার বলি : ‘যদিও তিনি (মধুসূদন দত্ত) সনেটের আদিগুরু পেত্রার্কার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন কিন্তু সর্বত্রই পেত্রার্কাকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেননি। যেমন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাঁর ‘পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তিগত’ বইতে ‘উপরোধ’, ‘মধুমতী’, ও ‘নৈঃশব্দ্যের পিতৃপক্ষ’ নামক উপর্যুপরি তিনটি সনেটের উপরে ঘোষণা দিয়েছেন ‘পেত্রার্কান সনেটের আদলে আবার তারপরেই ‘বজ্রযোগিনী’ শিরোনামের তলায় ঘোষণা করছেন ‘কামিংসের সনেটের আদলে’— এসব ক্ষেত্রে ‘আদলে’ শব্দটি তিনি কেন লিখেছেন? তার প্রমাণ আমরা পূর্বেই পেয়েছি এই লেখকের ‘দেয়ালগিরি’ কবিতার নিম্নবর্তী ফুটনোটে। সেই হেতু, আমরা বুঝতে পারি যে তিনি ‘বিনীত হয়ে’, ‘আদলে’ কথাটি বসাচ্ছেন। মূলে কিন্তু তিনি অনুসরণ করছেন উপরোক্ত কবিদের মিলবিন্যাসকে নির্ভুলভাবেই। এই ‘পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তিগত’ নামক বইতে একটি কবিতার নামকরণের তলায় লেখা আছে এই ঘোষণা : ‘স্যার টমাস ওয়াটের সনেটের ধরনে’। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি, আবারও বলি, ‘বিনীত হয়ে’, ‘আদলে’ ও ‘ধরনে’ কথাগুলি বসাচ্ছেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘বর্ণজীবের সনেট এবং আগন্তুক’ কাব্যগ্রন্থে কবি পার্থপ্রতিম সরিয়ে দিচ্ছেন তাঁর ‘পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তিগত’ বইয়ের ‘বিনীত হয়ে’, ‘আদলে’, ও ‘ধরনে’ বসানোর পদ্ধতিটি। ২০১৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে তিনি সরাসরি লিখছেন তাঁর কবিতার নামকরণের নীচে এই পরিচয় একের পর এক : ‘ফাৎসিও দেলই উবের্তির সনেটের মিলকাঠামো’, লিখছেন : ‘দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির সনেটের মিলকাঠামো’, সেইসঙ্গে ‘এডওয়ার্ড এস্টলিন কামিংস –এর সনেটের মিলকাঠামো’ তো আছেই।

এর দ্বারা তিনটি জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। এক, সনেট নিয়ে কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের পরীক্ষা তথা জ্ঞানপরিধি বাংলার আর কোনও কবির এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি এবং সেই কারণেই ২০১৩ –র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে তিনি সংগত আত্মবিশ্বাসগ্রস্ত হয়েই বিনয়বাচক ‘আদলে’ বা ‘ধরনে’ শব্দগুলি পরিত্যাগ করেছিলেন। দুই, স্যার টমাস ওয়াটের সনেট, ফাৎসিও দেলই উবের্তির সনেট, দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির সনেট, ই. ই. কামিংসের সনেট — এই ‘মিলকাঠামো’ সমূহের উল্লেখ প্রয়োজন হলো এই কারণে যে এক-এক কবির সনেটের ‘মিল কাঠামো’ এক-এক রকম। অর্থাৎ, সনেটের স্রষ্টা পেত্রার্কার, মিলবিন্যাস থেকে এই সকল কবিই সরে এসেছিলেন কিছু পরিমাণে— সেই জন্যই অমুকের মিলকাঠামো বা তমুকের মিলকাঠামো একথা উল্লেখ করার দরকার হলো। এই উল্লেখগুলি যেমন একদিকে বাংলা কবিতায় সনেট রচনার বৈচিত্র্যকে বিস্তৃত করল কবি পার্থপ্রতিমের একার চেষ্টায় তেমনি এখান থেকে আমরা পৌঁছই তৃতীয় কারণটিতে। কী বলে সেই ৩ নম্বর কারণ? সে বলে দেয়, এই বার্তা, যে, দেশে দেশে সনেট লেখার সময় কবিরা নিজেদের বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে সনেটের আদি স্রষ্টা পেত্রার্কার মিলকাঠামো থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। হ্যাঁ, কবিতারই প্রয়োজনে। কারণ তাঁরা একটি মিলকাঠামো মাত্র লিখতে চাননি। লিখতে চেয়েছেন একটি কবিতা।

এক্ষুণি বলেছি, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাঁর একটি সনেটের নামকরণের তলায় এই ঘোষণা দিয়েছেন: ‘স্যার টমাস ওয়াট-এর সনেটের ধরণে’। এই কবির নামটি অচেনা লাগতে পারে কারও কাছে, তাই জানিয়ে রাখি, টমাস ওয়াট এবং আর্ল অব সারে-র সনেটগুচ্ছ ‘রিচার্ড টোটেল’ নামক পাবলিশার্স দ্বারা প্রকাশিত হয় ‘সংস অ্যান্ড সনেটস্’ বা ‘টোটেল মিসলেনি’ শীর্ষক গ্রন্থে, যে গ্রন্থে আরও বেশ কয়েকজন কবির রচনা যুক্ত হয়েছিল। ১৫৫৭ সালে বেরোয় এই বই। এইটিই ছিল লন্ডনে প্রকাশিত প্রথম কবিতার অ্যান্থোলজি। এই সংগ্রহে টমাস ওয়াট বিভিন্ন ধরনের সনেট লিখেছেন। ‘কোয়ার্টার্ন’ নামক এক ধরনের সনেট যা ১৬ লাইনে লেখা তা-ও ওই সংকলনে পাওয়া যায়। এই কোয়ার্টার্ন নামক সনেট প্রকাশের কয়েক শতাব্দী পরে, টি এস এলিয়ট যে লিখবেন তাঁর বিখ্যাত ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস্’ কাব্যগ্রন্থ সে কথাও আমাদের মনে পড়ে যায় এ- প্রসঙ্গে। ‘হোয়াট শ্যুড আই সে’ নামক সনেটটি রচিত হয় ২৮ লাইনে- পরবর্তী সময়ে সমালোচকরা যাকে ‘স্টাইলড্ সনেট’ নামে চিহ্নিত করেন।

১৪ লাইনেই যে সনেট লেখা উচিত একথা জেনেও এবং ১৪ লাইনের সনেট অনেক পরিমাণে লিখে ওঠার পরেও একজন কেউ ২৮ লাইনের সনেট লিখছেন। কেন? কারণ ১৪ লাইনকে ২৮ লাইনে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে কবিতার অন্তর্বস্তুর দিক থেকে। ১৬ লাইনের ‘কোয়ার্টার্ন’ নামক গঠনের কথা যখন উঠল তখন বলে রাখা ভালো, আশির দশকের বাঙালি কবি রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ লাইনের সনেট লিখেছেন একটি পুরো কাব্যগ্রন্থ ভরে। সেখানে, তিনি, প্রচলিত ১৮ মাত্রা বা ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের বদলে ১৬ মাত্রার কবিতা দিয়ে পূর্ণ করেছেন তাঁর বই। দুঃখের কথা অসামান্য সেই কাব্যগ্রন্থ আজ দুষ্প্রাপ্য। তবে একটা জিনিস এখানে বোঝা গেল, আবারও বলি, সনেটের কাঠামো ও মিলবিন্যাস কতটা প্রথানুগ নিয়ম অনুসারে হবে আর কতটা হবে না তা স্থির করে কবিতার অন্তর্বস্তুর চাপ। যুগে যুগে, পৃথিবীর নানা দেশে, সনেটের আদি প্রবর্তক পেত্রার্কাকে স্বীকার করেও, কবিরা কবিতার কেন্দ্রস্থ বিষয়ের প্রতি সৎ থাকবার জন্য মিলবিন্যাসের ব্যতিক্রম ঘটাতে দ্বিধা করেননি, কারণ তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সনেটকে সার্থক কাব্যে উত্তীর্ণ করে দেওয়া। অন্ধ নিয়মানুগত্যের প্রমাণ দেওয়া নয়।

সেই সূত্রেই আমরা বুঝতে পারি অমৃতা ভট্টাচার্য ভিলানেল লেখার ক্ষেত্রে বিষ্ণু দে’কে আদিগুরু হিসেবে মান্য করলেও সর্বত্রই বিষ্ণু দে-কেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেননি। কোথাও কোথাও মিলবিন্যাসে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন অমৃতা। যেমন –

হাঁমুখে চাঁদ গলছে ঘন বনে
এখন স্রোত লাভা-সমাদৃত
পোড়ার মতো সোহাগ তবু কই!

অরূপ যত হোমের কাঠ শোনে
ঊরুসন্ধি, —এবার ঢালো ঘৃত
অগ্নি আমি, তাকিয়ে দ্যাখো কোণে
পোড়ার মতো সোহাগা মেলে কই!

প্রথম ছ’লাইনে যে ক, খ, ক মিল থাকবে ভিলানেলে সেটাই আগাগোড়া অনুসরণ করা হবে। শুধু শেষ স্তবকে সামান্য তফাৎ ঘটবে— এটাই নিয়ম। অমৃতা, প্রথমত, বিষ্ণু দে’র ভিলানেল–র মতোই ৭ মাত্রার ২ টি পর্ব পাশাপাশি রেখে ১ টি ভিলানেল লিখে নিয়েছেন আগে। তারপরে চলে গেছেন ৫/৫/২ চালের মাত্রাবৃত্তে। অর্থাৎ নিজের ওপর আরও পরীক্ষা চাপিয়ে দিলেন নিজেই। এইমাত্র যে ৭ টি লাইন উদ্ধৃত করলাম সেখানে দেখা যায় — কবিতার প্রথম শব্দ অগ্নি কতখানি তীব্রতা নিয়ে বদলে গেল শেষ লাইনের আগে এসে। কারণ ‘পোড়া’ কথাটি আমরা প্রথম স্তবক থেকেই পাচ্ছি। অথচ তা যে ‘হোম’–এর অগ্নিতে দহনের মতো পবিত্র ও উদ্দীপিত শরীর বাসনার প্রকাশে এসে পৌঁছতে পারে তা আমাদের অকল্পনীয় ছিল। এই কল্পনাতীত ব্যাপারটি ঘটল দু'টি কারণে। এক, আমরা ‘লাভা-সমাদৃত’ কথাটি পেলাম শেষ স্তবকের আগের স্তবকে। দুই, এই ‘লাভা’ শেষ স্তবকের দ্বিতীয় লাইনে এসে দাউদাউ জ্বলে উঠল এক উক্তির দ্বারা : ‘ঊরুসন্ধি, এবার ঢালো ঘৃত’। বিষ্ণু দে-র ব্যবহৃত মিলবিন্যাস এখানে একইরকম রইল না। কিন্তু কবিতাটির মধ্যে তৈরি হলো আগ্নেয়-উদ্ভাস। বিশেষত শেষ স্তবকের প্রথম লাইনে ‘হোমের কাঠ’ শব্দটির প্রয়োগ বিশেষভাবেই দু'টি দিকে অর্থসংকেত পাঠায়। সেই দু'টি অর্থস্তর, ‘হোমের কাঠ’ শব্দদু'টি দ্বারা কঠিন পুরুষাঙ্গ অগ্নিতে প্রবেশ করানোর সংকেত যেমন বহন করে তেমনই নর-নারীর মিলন যে আসলে এক পূজাক্রিয়া সেই কথাও ব্যক্ত করে। ‘ভিলানেল’ ফরাসি রূপবন্ধ ঠিকই— কিন্তু অমৃতা কবিতাটিকে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়তায় মণ্ডিত করলেন বিদেশি আঙ্গিকের ব্যবহার সত্ত্বেও। কারণ ভারতবর্ষের আদিকালের ভাস্কর্য হিসেবে রূপায়িত বিচিত্র আসনে মিথুনমূর্তিগুলি কিন্তু মন্দিরের গাত্রেই আজও বিদ্যমান। ওই বিচিত্র সব মিথুনাসন একদিকে যেমন আর্টের ভিন্ন ভিন্ন দিককে সংকেতায়িত করে, অন্যদিকে তারা বোঝায় যে, নরনারীর মিলন আসলে এক সৃষ্টিপূজা — কারণ মিলন থেকেই সৃষ্টি হয় নবসন্তানের। সৃষ্টিপূজা বলেই তারা স্থান পেয়েছে মন্দিরগাত্রেই। এইখানেই এসে পড়ে টি. এস. এলিয়টের অতিখ্যাত ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়্যাল ট্যালেন্ট’ প্রবন্ধটির প্রসঙ্গ। বিষ্ণু দে-র ভিলানেলও একটি প্রেমের কবিতা। কিন্তু দু'টি ক্ষেত্রে বিষ্ণু দে-কে অনুসরণ করা সত্ত্বেও অমৃতা নিজস্ব কবিব্যক্তিত্বকে অগ্নিময় করতে পেরেছেন। প্রথমত, বিষ্ণু দে-র এই বিশেষ কবিতাটির সঙ্গে শরীর বাসনার সম্পর্ক নেই বা থাকলেও তা খুব আবছা। দ্বিতীয়ত, বিষ্ণু দে একজন পুরুষ কবি। অমৃতা এ যুগের এক নারী কবি যিনি বিষ্ণু দে-র থেকে গ্রহণ করছেন আবার নিজের রচনা আঙ্গিকের স্টিয়ারিং তিনি নিজপথ অনুযায়ী ঘুরিয়ে দিতে পারছেন। ট্র্যাডিশন থেকে নেওয়াও হলো আবার প্রয়োজনে, বিষয়অগ্নির প্রয়োজনে, তাঁকে নতুনত্বে প্রজ্জ্বলিত করা গেল। এই দুই দিক থেকেই যদি দেখি, তবে ওই যে সামর্থ্যবান কবি আমাকে বলেছিলেন, ‘অমৃতা ভট্টাচার্যের ভিলানেলে ভুল আছে’, সেই কবি লেখার সময়ে নিজের কবিত্ব প্রকাশে অব্যর্থ হলেও পাঠক হিসেবে তিনি কিন্তু ত্রুটিসন্ধানী। কেননা তিনি অমৃতার কবিতাটিকে বিষয়ের ভেতরের দিকে গিয়ে লক্ষ্য করেননি। বাইরের মিলবিন্যাসের ব্যতিক্রমটুকুই তাঁর চোখে পড়েছে এবং তিনি তাকে ভুল বলে চিহ্নিত করেছেন। কী আর করা যাবে! আমাদের সাম্প্রতিক কবিতাসমাজে তো এমন লেখকদেরই প্রাধান্য যাঁরা নিজেরা সার্থক কবিতা রচনায় সক্ষম হলেও অন্যের ক্ষেত্রে ভুল খোঁজেন প্রথমেই। এখানে সকলের জানা একটি তথ্য উল্লেখ করে রাখি। পেত্রার্কা — যাঁকে ‘ফাদার অব সনেট’ বলা হয়, সনেট রচনার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন ত্রয়োদশ শতকে। উইলিয়াম শেক্সপিয়র যিনি নাট্যকার হিসেবে বিশ্ববন্দিত, তিনি ষোড়শ শতকে দেড়শোরও বেশি সনেট রচনা করেন। শেক্সপিয়র কিন্তু, সনেটের জনক পেত্রার্কার ‘রাইম স্কিম’ অর্থাৎ মিল প্রয়োগের নিয়মগুলির ব্যতিক্রম ঘটান এবং নিজস্ব পদ্ধতির একটি পথ তৈরি করেন। একথা পুনরায় বলার কারণ, ‘ভিলানেল’ রচনার ক্ষেত্রে যদি কেউ বিষয়ের অন্তর্বস্তুর প্রয়োজনে ‘রাইম স্কিমে’ নতুনত্ব আনেন তবে তাকে ত্রুটি বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক কাজ বলে আমি মনে করি না।

অমৃতা কিন্তু মিলবন্ধ সনেট লেখার দিকে ঝোঁকেননি। যেহেতু তিনি পূর্বজদের রচনা খুব খুঁটিয়ে পড়েছেন সেহেতু তিনি বুঝেছেন সনেট রচনা এখন বাংলা কবিতায় একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও বহুল প্রচারিত আঙ্গিক চর্চা। নব্বই দশকের কবিরাও অনেকেই সনেট লিখে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়েছেন। তাই অমৃতা চলে গেলেন, আবারও বলছি পিতামহ বা প্রপিতামহপ্রতিম কবিদের অত্যন্ত স্বল্প ব্যবহৃত আঙ্গিক তুলে এনে নিজেকে নতুন নতুন পরীক্ষার সামনে ফেলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার দিকে। এখানে আরও একবার, ভিলানেল লেখার সময়ে, অমৃতা যে মিলবিন্যাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন সেই ব্যতিক্রান্ত প্রয়োগগুলি আমি সমর্থন করছি কারণ তার ফলে কবিতাটির তো ক্ষতি হয়ইনি। বরং পাখা মেলে উড্ডীন হতে পেরেছে নিজস্ব বিষয়-গন্তব্যের আকাশে। বিষ্ণু দে নিঃসন্দেহে একজন বিরাট মাপের কবি। তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয় পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা নেবে। কিন্তু শিক্ষা নেওয়া মানে কী? আমার কাছে শিক্ষাগ্রহণ মানে কোন পথে তিনি গিয়েছেন শুধু সেটাই নয়। কোন পথে আমার গন্তব্য আমাকে টানছে সেটাই লেখার সময় আমার কাছে প্রধান। বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান ডন ব্রাডম্যান, যার টেস্ট গড় ৯৯.৯৬ প্রতি ইনিংসে — যিনি সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে গড়ে প্রত্যেক তিন ইনিংসে ক্রিজে গিয়ে ১ টি করে সেঞ্চুরি করেছেন। উপরোক্ত দু'টি সার্থকতার দৃষ্টান্ত অর্থাৎ টেস্টগড় ৯৯.৯৬ এবং প্রতি ৩ ইনিংসে ১ বার সেঞ্চুরি সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে — পৃথিবীতে আর কারও দখলে নেই।

ব্রাডম্যান নিজের টেস্ট জীবনে ৪ বার শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন সে-কথাও আমরা মনে রাখতে বাধ্য। সেই ৪ টি শূন্যের মধ্যে ব্রাডম্যানের জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসও ছিল। অথচ সে ইনিংসে মাত্র ৪ রান করতে পারলে ব্রাডম্যানের টেস্ট গড় দাঁড়াত ১০০ রান প্রতি ইনিংসে। সেই ৪ রান তিনি করতে পারেননি। আগেই বললাম, শূন্য করেছিলেন। কিন্তু অত বড় ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও, বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস তাঁকে ৪ টি রান দিয়ে দেয়নি। কারণ ইতিহাস ক্ষমা করে না। ব্যর্থতা তার কাছে ব্যর্থতাই। কাব্যের ইতিহাসও ব্যতিক্রম নয়। বিষ্ণু দে, ত্রিশের দশকের রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার স্তম্ভস্বরূপ এ কথা ঠিক, একথাও ঠিক যে ভিলানেল, ত্রিওলেট, ব্যালাড, সেস্টিনা — এইরকম অনেক পাশ্চাত্যের কবিতা গঠন বাংলায় প্রথম আনয়ন করেছিলেন। কিন্তু এইমাত্র সেস্টিনার কথা বললাম তো। ‘সেস্টিনা’ শব্দটি আসছে সনেটে যে ‘অকটেভ’ এবং ‘সেস্টেট’ থাকে, সেই ‘সেস্টেট’ থেকেই। ‘সেসটিনা’ হলো ৬ লাইনের স্তবকের একটি গঠন যার ৬ টি স্তবক ধরে অগ্রসর হয়ে ৩৬ লাইনের মাথায় তার গন্তব্য সম্পূর্ণ করে। অর্থাৎ কবিতাটি হয় ৩৬ লাইনের। এই সঙ্গে বলা দরকার এই সেস্টিনার মিলবিন্যাস অত্যন্ত জটিল। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না কারণ তা অপ্রাসঙ্গিক হবে। শুধু একটি কথা বলা প্রয়োজন, প্রথম ৬ লাইনে ব্যবহৃত যে শব্দগুলির দ্বারা লাইন সমাপ্ত হচ্ছে পরবর্তী ৩০ লাইনে — অর্থাৎ ৩৬ লাইন ধরেই — সেই একই শব্দ অন্ত্যমিল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার নিয়ম পালন করতে হয় সেস্টিনা লিখতে গেলে। বিষ্ণু দে, তাঁর ‘বারোমাস্যা’ নামক দীর্ঘ কবিতাটির শেষ অংশটি ৩৬ লাইনের স্তবক দিয়ে নির্মাণ করেন। সেই অংশে তিনি সেস্টিনার মিলের নিয়ম সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু তার ফলে কী হয়েছিল?

একটি লাইন যখন পুনরাবর্তনে ফিরে আসছে কোনও কবিতায়, তখন কবিতাটি তার কাছে চাইছে, সে-লাইন যেন কবিতায় আরও নতুন একটি অর্থস্তর যোগ করে। অর্থাৎ প্রথমবার সে-লাইনে এসে যে অর্থস্তর যোগ করেছিল, পরের বার সেটুকু তো থাকবেই, তার সঙ্গে অধিকতর অর্থ যেন সে-লাইন যোগ করতে পারে কবিতায়। এইটেই, এই চাহিদাটাই চলতে থাকে লাইনের পুনরাবর্তনমূলক কবিতার মধ্যে। যতবার পুনরাবর্তনের লাইন আসবে ততবার কবিতা আগের বারের চেয়ে বেশি অর্থস্তর চাইবে সেই লাইনের কাছে। যোগ করো, যোগ করো — অর্থ যোগ করো — এইটেই কবিতার চাওয়া লাইনের পুনরাবর্তনের কাছে।
হয় কী, অনেক সময় লাইনের এই পুনরাবর্তন এক বিশেষ ফর্ম হিসেবে লেখকের কাছে আসে। নতুন অর্থ যোগ করার বদলে লেখক তখন ফর্মের মিলবিন্যাস তথা নিয়ম বজায় রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন বা মনযোগী থাকেন এবং নিজে সেটা বুঝতে পারেন না ফলে লাইনটিও অধিকতর অর্থস্তর যোগ করতে পারে না। লাইনটি কেবল মিলের শৃঙ্খলা বা পরম্পরা রক্ষা করে। তাতে মিলবিন্যাস নির্ভুল রক্ষিত হয়, কিন্তু কবিতাটি রক্ষা পায় না। কারণ লাইনটি অনেক সময় যে-অর্থ নিয়ে আগের বার এসেছে সেই একই অর্থ নিয়ে অবস্থান করে পরের বার এসেও। এখানেই ঘটে বিপদ। নতুন অর্থস্তর যুক্ত না হলে কী হয়? উচ্চাকাশে ধাবমান বিমানের ইঞ্জিন হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে, বিমান যেমন অতি দ্রুত অলটিচ্যুড হারাতে হারাতে নীচে নেমে আসে, পরিণামে পাহাড়ে প্রান্তরে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়, কবিতাটিও সেরকম ধ্বংস হয়ে যায়। সর্বজনমান্য কবি বিষ্ণু দে-র ক্ষেত্রে এই উদাহরণ আছে এই ‘বারোমাস্যা’ কবিতাটির ১২ নং পর্বের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। মিলের আশ্চর্য বিন্যাস, কঠোর শৃঙ্খল — সবই অক্ষুণ্ণ কিন্তু কবিতাটি ধ্বংস হলো। ব্রাডম্যানের শেষ ইনিংসের ব্যর্থতাকে যেমন ইতিহাস ব্যর্থতা বলেই মনে রেখেছে, বিষ্ণু দে-র ‘বারোমাস্যা’র সেস্টিনার প্রয়োগও আমরা তেমন কবিতার ব্যর্থতা রূপে গণ্য করতে বাধ্য। সেস্টিনা আঙ্গিকটির নির্ভুল গাণিতিক সাফল্য সত্ত্বেও।

অমৃতা, বিষ্ণু দে-র আঙ্গিক অনুসরণ করেছেন, তথাপি, কবিতার অর্থবস্তুর প্রয়োজনে নিয়মকে সরিয়ে নিজের নিয়ম বসাতে দ্বিধা করেননি। আশির দশকের এবং শূন্য দশকের দু'জন কবি শিরোনামে ‘সেস্টিনা’র ঘোষণা দিয়ে দু'টি কবিতা রচনা করেছিলেন। তাঁদের দু'জনেরই কবিতাসমগ্র আছে। কিন্তু বিষ্ণু দে-র ‘বারোমাস্যা’ রচনার থেকে আমরা প্রায় ৭৫ বছর দূরে দাঁড়িয়ে আছি। তাই বিষ্ণু দে-র উক্ত রচনা যে সার্থক হয়নি তা যেমন আমাদের চোখে ধরা পড়ছে অপর দু'জন কবির ক্ষেত্রেও ‘সেস্টিনা’র এই প্রয়োগ কবিতা হিসেবে উত্তীর্ণ কিনা তা বোঝার জন্য পাঠককে রচনা সময়ের পৌনে এক শতাব্দী দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এই মুহূর্তে কোনও বিচার দিলে, ১৩৬৭ সালে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় গদ্য, এবং সনেট সম্পর্কিত নিবন্ধটির মতন দূরত্ব আমরা পাব না। সময় — কবিতাকে দেখার জন্য এক দূরত্ব দাবি করে। আমি, পাঠক হিসেবে আমার আয়ু নিয়ে সেই দূরত্বে কখনও পৌঁছতে পারব না। তাই পূর্বোক্ত দু'টি কবিতার সার্থকতা বিচারের চেষ্টা আমার পক্ষে উচিত কাজ হবে না।

বাংলাদেশের এক পত্রিকায় অমৃতা ভট্টাচার্যের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে যা সম্প্রতি আমার হাতে এলো। এই কবিতাটি কিন্তু আমরা যে-কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলছি তার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কবিতাটি নিম্নরূপ :

কালী

উৎসর্গ : ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’

মোক্ষ চায় কে? জানি আলো
আলো নিরামিষ? কোন কানে?
গোপন কথাটি আটকালো
ধরা দেয় কথা কার ধ্যানে?
প্রতিরূপ সেই পথ জানে
ঘন ঝোপ তার ছায়া ঘিরে
‘ওঁ ক্রীং মহা’ সন্তানে
করাল বদনী আসে ফিরে —

রেখেছ প্রদীপ, শোক জ্বালো
শোকপুরাণের কোনখানে
ভয় বলে যায় শ্লোক ভালো
না থাক পূজারী তার গানে
অধিবাস হল অঘ্রাণে
বৃষ্টি রুগ্ন, জিরজিরে
চোখ কেঁপে ওঠে, কানে কানে
বলে, অনায়াস জাল ছিঁড়ে

জ্বলে ওঠো দীপ, জল ঢালো
ধুয়ে নিই খিদে, আয় স্নানে —
দেখেছি সাদা কে — জানি কালো
জিভ কেটে খাঁড়া সেই ভানে
রক্ত ও কাটা-চাঁদ জানে
মোক্ষ ভুলেই ঘোর তীরে
ডুবে যায় কালী, সন্ধানে
চাঁদের প্রসব জটা শিরে
তফাত বিপদে আর ত্রাণে
মেটেনি খাজনা তাও কি রে ?
ঋণ সাড়া দেয় মুঠো ধানে
জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে !

একটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, সেই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন এক লেখা নিয়ে আমি কথা বলতে প্রবৃত্ত হচ্ছি কেন? কারণ, ‘কালী’ নামক এই কবিতাটির পর লেখা আছে ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’। আবারও ভারতচন্দ্রের কবিতা পঙক্তিটি আমার মনে পড়ল : ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান’। কেননা ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ কোনও ব্যক্তিনাম নয়। একটি গ্রন্থনাম। গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। সে গ্রন্থের লেখক কে? বিষ্ণু দে। অর্থাৎ আবারও, অমৃতা ভট্টাচার্য বিষ্ণু দে-কে স্মরণ করলেন। কেন? কবিতাটির রচনা আঙ্গিক বা ফর্ম খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে সে-কথা বোঝা যায়। ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ বইয়ে বিষ্ণু দে-র একটি কবিতা আছে যার শিরোনাম ‘বালাদ্ : লুই আরাগঁ-র জন্য’ — কবিতাটি রচিত হয়েছিল চল্লিশ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। এখন একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথমার্ধ চলছে। অর্থাৎ প্রায় ৭৫ বছরেরও বেশি আগে লেখা একটি কবিতা আমাদের লক্ষ্য করতে হচ্ছে অমৃতা ভট্টাচার্যের উৎসর্গ পত্রটিকে বোঝাবার জন্য। বিষ্ণু দে-র সেই কবিতাটি এবার আমরা পাঠকদের পড়তে দিই।

বালাদ্ : লুই আরাগঁ-র জন্য

ওরে আমার হৃদয় আমার খুঁজিস অস্থাবরের বাসা
মনের মানুষ ভাঁড়ার ফেলে করিস যে তুই সন্ধান!
অস্তাচলের পার থেকে ঐ উদয়গিরির নীলে ভাসা!
আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়াস ক্লান্তিহীন, যে ধনমান
ভাসিয়ে দিয়ে কালের স্রোতে বনেদি চাল খানদান
শিবঠাকুরের আপনদেশে সদাগরের তক্তায়
চাপালি না রে — দুপারে গঙ্গা, ডরবি নাকি তাই বান,
সারাজীবন বিলিয়ে দিয়ে বাজার দরে সস্তায়?

জাত খোয়ালি কুল ভাঙালি একী নেশা সর্বনাশা
রূপসাগরে ডুব দিলি তুই ভুলে রূপার সম্মান
সূর্যে সোনা খুঁজিস শুধু তুচ্ছ সূর্যমুখীর ভাষা
কালের কালো বৃন্তে ফোটাস উদ্ভিদে চাস প্রাণদান!
মানুষ দেখেই অন্ধ হলি — এবার যাবে গর্দান্
আখের তুই খোয়ালি হায় তোর মাঝে যে বর্তায়
ছোটোলোকের আকাশআশা সবাই হবি আইভান্
সারাজীবন বিলিয়ে দিয়ে বাজার দরে সস্তায়!

অনেকদিনের ছলাকলা পায়ে ঠেলে সাজবি চাষা
মজুর কি তুই ? আপন স্বর্গে কোথায় হবি গদিয়ান!
রুশ ধরলি ? ভুললি রে তিন পুরুষে ইংরাজির আশা!
তারপর কী ? এখন তবে একলা ঘরে ধর্ গান
শূন্য ঘর শুকনো মন হোক না প্রাণ খান্ খান্।
বঞ্চনায় দুচোখ ঠাস্ বুলি ছড়াস্, পস্তায়
যদিই মন তখনই বল্, থাকুক বেঁচে ট্রুমান
সারাজীবন বিলিয়ে দিয়ে বাজার দরে সস্তায়।
সভ্যতার বড়াই গাই হে প্রভু কোলে দাও টান
আজ ইংরাজ যেয়ো না চলে জীবন বুঝি কস্তায়
রাঙায় সারা দুনিয়া জুড়ে, কাতরে ডাকি বুরিদান
সারাজীবন বিলিয়ে দিয়ে বাজার দরে সস্তায়।।

বিষ্ণু দে যেমন ‘ভিলানেল’ এর মিলবিন্যাসটি গ্রহণ করেছিলেন ফরাসি কাব্যপদ্ধতি থেকে, এখানে তেমন ইতালিয় একটি কাব্যগঠন গ্রহণ করেছেন যার নাম ‘ব্যালাড’। ইতালিয় উচ্চারণে ‘ড’ কে ‘দ’ বলা হয় বলে বিষ্ণু দে ‘বালাদ্’ কথাটি লিখেছেন। বিষ্ণু দে কেন বারবার প্রণিধানযোগ্য একজন স্তম্ভস্বরূপ কবি তাঁর একটি ছোট্ট প্রমাণ এই কবিতায় পাওয়া যায়, যখন দেখি ইতালিয় একটি রচনা আঙ্গিককে তিনি উৎসর্গ করছেন ফরাসি ভাষার কবি  লুই আরাগঁকে— অর্থাৎ দু'টি দেশের মধ্যে তিনি সংযোগ ঘটালেন। বুঝিয়ে দিলেন যে, কবিতা বিশেষ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এইজন্য বিষ্ণু দে-র কবিতাকে আমরা বলতে পারি যে সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতার ধর্ম অনুসরণকারী কাব্য।

অমৃতা ভট্টাচার্যের ‘কালী’ কবিতাটির প্রসঙ্গে আসি। কেন তিনি উৎসর্গ হিসেবে ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ শব্দটি লিখলেন? কারণ অমৃতা বিষ্ণু দে-র কাছ থেকে ইতালিয় ‘ব্যালাড’-এর মিলবিন্যাস গ্রহণ করেছেন। অথচ বিষ্ণু দে লিখেছেন স্বরবৃত্তে তাঁর নিজের কবিতাটি। আর অমৃতা প্রয়োগ করেছেন মাত্রাবৃত্তের একটি বিশেষ চলন। যা শুনতে ৬/৫ অথচ ৬ মাত্রার পরবর্তী পর্বটিতে ৫ মাত্রাকে তিনি আদায় করে নিচ্ছেন ৪ মাত্রার ধ্বনি বণ্টন দ্বারা। অতি সূক্ষ্ম ও জটিল এই চলন। অমৃতা, উৎসর্গ : ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ কথাটি উল্লেখ করে বিষ্ণু দে-র প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন না করতেও পারতেন। কিন্তু তিনি কবি হিসেবে এতই সৎ যে কবিতার ক্ষেত্রে যেখান থেকে যা শিখেছেন তার ঋণস্বীকার নিজের অবশ্যকর্তব্য বলে বিশ্বাস করেন। অমৃতার কবিতাটির নাম ‘কালী’। পুরাণকে অমৃতার কবিতা আত্মস্থ করছে সম্পূর্ণভাবে। তারপর অমৃতা নিজের কবিতায় পুরাণ প্রয়োগ ঘটান নির্ভুলভাবে পুরাণ অনুযায়ী হয়ে নয় — বরং শেক্সপিয়র যেভাবে পেত্রার্কার কাছ থেকে সনেট আঙ্গিক আত্মস্থ করে নিজস্ব ধারায় সেই আঙ্গিকের ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন, সেইভাবে অমৃতাও পুরাণকে ব্যবহার করেন একজন নারী হিসেবে। একদম আজকের নারীর নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই কবিতায় একটি লাইন আছে ‘ওঁ ক্রীং’ মহা সন্তানে — কালীর বীজমন্ত্র হল ‘ক্রীং’। সংস্কৃত পূজামন্ত্র কবিতায় প্রযুক্ত এখানে। কিন্তু ‘সন্তান’ শব্দটি এসে পূজা মন্ত্রটিকে সম্পূর্ণ নতুন অর্থস্তরের দিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল যা ওই পূজামন্ত্রে নেই। অর্থাৎ, পূজামন্ত্রকেও তিনি নবদৃষ্টিতে প্রয়োগ করলেন এক ভাঙনের দ্বারা। ‘সন্তানে’র আগে ‘মহা’ শব্দটি থাকায় সন্তান নিছক নশ্বর মানবরূপ থেকে উত্তীর্ণ হলো আদি দৈব স্তরে। ব্যালাডের জটিল মিলবিন্যাস অমৃতা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। এবং বিষ্ণু দে-র কাছ থেকে শুধুই মিলের ক্রমপর্যায়টি ছাড়া তিনি আর কিছুই গ্রহণ করেননি। বিষয়ের দিক দিয়ে অমৃতার কবিতাটি কালী, ধূর্জটির জটা, জটায় চাঁদের জন্ম এই সকল কিছু মিলিয়ে মহামায়ার রূপকে জাগ্রত করে তোলেন বিরাট এক অমাবস্যার আবির্ভাবের মধ্যেই। বাংলা কাব্যে অতি প্রচলিত শব্দবন্ধ ‘ধীরে, রজনী ধীরে’ কথাটিকে তিনি নিয়ে আসেন ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে’! — এই মহতী প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। অথচ একথাও আমরা ভুলতে পারি না এ কবিতা শুধু কালিকা বন্দনা রূপেই আসে না পাঠকের কাছে — মেঘে ঢেকে যাওয়া এবং মেঘ থেকে বেরনো চন্দ্রালোকের মতো প্রেমের কবিতার আভাসও রেখে যায়। ‘কিং ইদিপাস’ নাটকে সফোক্লিস ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেখিয়েছিলেন সন্তান, ভুলবশত, নিয়তি বিধানে, মাতৃগমন করছে। এখানে অমৃতার কবিতা চাপা সংকেত পাঠাল সেই দিকে, যেখানে প্রেমিক সন্তান হয়ে ওঠে অর্থাৎ ইদিপাসের বিপরীত এক প্রয়োগ। যদি এই বিশেষ কবিতার ছন্দচলনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে হবে প্রথম ৬ মাত্রার পরে আসা পরবর্তী পর্বাংশটিকে। হ্যাঁ, পূর্ণ ৬ মাত্রার পর্ব নয়, পর্বাংশই। কিন্তু তা আসছে কেমন ভাবে? একটু পরখ করা যাক তার ক্রম : ‘জানি আলো’ / ‘কোন কোণে’ / ‘আটকালো’ / ‘কার ধ্যানে ?’ / — শেষের দিকে এসে পাব : ‘জটা শিরে’ / ‘আর ত্রাণে’ / ‘তাও কি রে?’ / ‘মুঠো ধানে’ / ‘অমা ধীরে!’ — এই পর্বাংশগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘এ’ কার, ‘ও’ কার ব্যবহার করেই পূর্ণ মাত্রার কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে ছন্দকে দিয়ে। পর্বাংশ কথাটি যখন বলছি তখন পূর্ণ পর্ব নেই! কিন্তু ৪ মাত্রা চোখে দেখতে পাচ্ছি অথচ কানে পাচ্ছি ৫ মাত্রা! নবীন কবির কাছে সারাক্ষণ এই ধ্বনি বণ্টনের সামর্থ্য ২৮ লাইনের কবিতা ধরে বজায় রাখা এক অতুলনীয় কাজ! তবে এই কবি কিন্তু অন্ত্যমিলের স্বাভাবিকতায় বিশ্বাসী। একটি লাইনেও কোনও অন্ত্যমিলই চমৎকৃতির প্রদর্শন দ্বারা কবিতাটির থেকে বড় হয়ে উঠছে না। এই সংযম ও অমৃতার এই কবিতাটির বৈশিষ্ট্য। কেন অমৃতা এই ‘কালী’ নামক রচনাটি তাঁর বইয়ে গ্রহণ করলেন না ভেবে পাইনি। এই কবিতাটি প্রসঙ্গে একটি কথা বলা খুবই দরকার যে এই কবিতাটি কোথাও শেষ হয় না। চলতেই থাকে। কী যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছি? কবিতাটির শেষ দিকে তাকাই :

‘মোক্ষ ভুলেই ঘোর তীরে
ডুবে যায় কালী, সন্ধানে
চাঁদের প্রসব জটা শিরে
তফাত বিপদে আর ত্রাণে
মেটেনি খাজনা তাও কি রে?
ঋণ সাড়া দেয় মুঠো ধানে
জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে’!

এখানে যিনি আগে লিখেছেন ‘ওঁ ক্রীং মহা’ সন্তানে’ — তিনি যে পরে অনেক দূরবর্তী ভাবে ‘সন্তানে’-র সঙ্গে ‘সন্ধানে’-র অন্ত্যানুপ্রাস নিয়ে আসছেন তা আমাদের চোখেই পড়ে না। পরিবর্তে আমরা এক মহাদৃশ্যের সম্মুখীন হই। যেখানে কালী একবার ডুবে যাচ্ছেন, আবার জেগে উঠছেন। যেখানে মহেশ্বরের জটায় চাঁদের জন্ম হচ্ছে। শেষ লাইনটি এইভাবে রাখা হয়েছে : ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে!’ ছন্দের পর্ব সংস্থান এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ‘জাগে কালী’ কথাটি বলে যতিচিহ্নের বাধায় আমাদের থামতে হচ্ছে। অর্থাৎ এতক্ষণ ধরে চলে আসা ৬ মাত্রার প্রথম পর্ব, শেষ লাইনে এসে ৪ মাত্রায় থমকাল। ফলে পাঠকের মনে কী ঘটছে? এতক্ষণ ধরে প্রথম পর্বে পরপর ক্রমাগত ৬ মাত্রা পড়ে আসবার কারণে পাঠক নিজের অজান্তেই একটি ২ মাত্রা আসবার আকর্ষণ নিজের পঠনে অনুভব করছেন। অবশ্য পাঠক যদি উপযুক্তভাবে ছন্দ জানা পাঠক হন তবেই তিনি এমন আকাঙ্ক্ষা করবেন। ওই ২ মাত্রা কম থাকায় শেষ লাইনে আচমকা কবিতাটির গতি বেড়ে গেল। ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে!’ এখানে অমৃতার উচিত ছিল বিস্ময় চিহ্নের বদলে কবিতার শেষ শব্দের পরে ত্রিবিন্দু ব্যবহার করা। তাহলে লাইনটি দাঁড়াত এই রকম : ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে...’ কারণ কালী জাগছেন শেষ লাইনে এসে — এবং কালীর জাগরণ কোথাও থামছে না। তিনি বারবার জেগে উঠছেন, জেগে উঠছেন। তাই ‘ধীরে, অমা, ধীরে’ র পরে ত্রিবিন্দু রাখা দরকার ছিল কারণ এই জাগরণ ঘটেই চলবে। আর অমারাত্রিকে সেই জাগরণের জন্য অপেক্ষা করে চলতেই হবে। এ এক চিরকালীন জাগরণসম্ভবা মূর্তির উদ্ভাস!

আরও পড়ুন- আনন্দগ্রন্থ, শোকগ্রন্থ : আলো-আঁধারির আবিষ্কার কবি অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

আমরা ভুলে যাই না কালী আসলে এক নারী। আমরা এও ভুলে যাই না, যে কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে কথা বলে চলেছি এতক্ষণ তার রচয়িত্রী একজন নারীই। এই গ্রন্থে দু'টি কবিতা আছে যাদের নাম যথাক্রমে, ‘ভুলতে চাই যদি’ এবং ‘একা’। দু'টি কবিতায় যেহেতু একই ছন্দপথ ব্যবহার করা হয়েছে, তাই আমি একটি কবিতা বেছে নিচ্ছি যার নাম ‘একা’। বলা দরকার কবিতা দু'টি প্রকাশের পূর্বে তার প্রিন্ট আউট আমাকে ডাকে পাঠিয়েছিলেন লেখিকা পড়ার জন্য। দু'টি কবিতার শিরোনামের নীচেই লেখা ছিল — “উৎসর্গ : ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ কাব্যনাট্যের প্রথম সংলাপটির প্রতি”। কবিতাটির মধ্যে আমি ছন্দের কোনও ত্রুটি দেখতে পাইনি। তেমনই ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বুদ্ধদেব বসুর এই কাব্যনাট্যর বিষয়বস্তুর সঙ্গেও এই কবিতাটির অন্তঃসারের কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পাইনি। ফলে আমি লেখিকাকে জানাই ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ –র উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে আমার। এবং বারবার, কবিতার পর কবিতায়, এভাবে ‘উৎসর্গ’ দেওয়াও একটা ম্যানারিজমের মতো হয়ে দাঁড়াতে পারে তাঁর পাঠকের চোখে। লেখিকা, বিনাবাক্যে, আমার পরামর্শটি মেনে নিয়েছিলেন। ফলে যে কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে আমরা কথা বলছি সেখানে, ‘ভুলতে চাই যদি’ এবং ‘একা’ কবিতা দু'টির উপর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’–র কোনও উল্লেখ আমরা দেখতে পাই না।

এখানে আমি স্বীকার করতে বাধ্য অমৃতা ভট্টাচার্যকে এই কবিতা দু'টির ক্ষেত্রে আবারও আমি ভুল পরামর্শ দিয়েছিলাম। এবং আমি তার চেয়ে চার প্রজন্ম আগে লিখতে এসেছি বলে, বয়সেও যেহেতু তাঁর পিতার সমান, তাই তিনি এই বিষয়ে বাকবিস্তার করেননি। আমার ভুল আমি বুঝতে পারলাম অমৃতার কাব্যগ্রন্থটি হাতে আসার পর। বলা দরকার, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমি কয়েকদিনের জন্য বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম, বাংলাদেশের পাঠক ও প্রকাশক মহল বুদ্ধদেব বসুকে এখনও এতই সম্মান দিয়ে থাকেন যে বুদ্ধদেব বসুর ‘আমার শৈশব’, ‘আমার যৌবন’, ও ‘আমাদের কবিতাভবন’ নামক তিনটি স্মৃতিকথা একত্র করে ‘আত্মজৈবনিক’ শিরোনামে একটিই খণ্ডে প্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থের প্রকাশক ‘বাতিঘর’। পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসুর সমগ্র কাব্যনাটকগুলি দু'টি মলাটের মধ্যে ধরে দিয়েছে ‘অবসর’ প্রকাশনা। গ্রন্থনাম : বুদ্ধদেব বসু / ‘কাব্যনাটক সমগ্র’। বুদ্ধদেব বসুর এরকম আরও গুরুত্বপূর্ণ লেখা, তাদের রচনা চরিত্র অনুযায়ী একত্র করা হয়েছে এমন বইয়ের সন্ধানও পেলাম। নির্বিশেষে সঙ্গে নিয়ে এলাম সব। নতুন করে পড়তে শুরু করেছি ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ অনেকদিন পর। যথারীতি মুগ্ধ হয়ে আছি। এই সময় হাতে এসে পৌঁছল অমৃতা ভট্টাচার্যের নবতম কাব্যগ্রন্থ। পাতা উল্টে চললাম সে-বইয়ের। উপরে উল্লেখিত কবিতা দু'টির কাছে এসে আমার খটকা লাগল। বুঝলাম, আবারও ভুল পরামর্শ দিয়ে বসেছি নবীন কবিকে, আমার বয়সোচিত ‘সবজান্তা’ মানসিকতার কারণে।

তবে কি ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’–র অন্তর্বস্তুর সঙ্গে কোনও যোগ ছিল অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতা দু'টির, যা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে? পুনর্পাঠে ওই কাব্যনাট্যের সঙ্গে যে সংযোগ আমি ধরতে পারছি?

না, তেমন কিছু ঘটেনি। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’–র বিষয় থেকে কোনও ঋণ গ্রহণ করেনি অমৃতার উক্ত কবিতা দু'টি। আমার মনে পড়ল দু'টি কবিতারই নামকরণের নীচে ‘উৎসর্গ’ কথাটির পর ঠিক কী লেখা ছিল। লেখা ছিল — “ ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ কাব্যনাট্যের প্রথম সংলাপটির প্রতি”। কেন আমি বলছি যে আমি ভুল পরামর্শ দিয়েছিলাম? তার আগে দেখা দরকার ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ কাব্যনাট্যের প্রথম লাইনটি গাঁয়ের মেয়েদের সমবেত সংলাপ হিসেবে প্রযুক্ত হয়েছে এই কাব্যনাট্যে। সমবেত সংলাপ কাদের? গ্রামের মেয়েদের। অর্থাৎ আবার নারীসত্তাটি উঠে এল অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতায়, কিন্তু প্রযুক্ত হল এক ধরনের আন্ডারস্টেটমেন্ট হিসেবে। গ্রামের মেয়েদের সমবেত সংলাপের সঙ্গে একই রেখায় নিজের নারীজীবন দাঁড় করাচ্ছেন। প্রথম লাইনটি হলো : "আকাশে সূর্যের অটল আক্রোশ, জ্বলছে রুদ্রের রক্তচক্ষু", এবার আমরা অমৃতার ‘একা’ কবিতাটি পড়তে দিই পাঠকদের। পাঠক নিজেই বুঝবেন আমি কোথায় ভুল করেছিলাম। কবিতাটি এরকম —

একা

চিনেছ আমাকেই, আবার অন্দরে রেখেছ বাঁধামুখ বন্যজন্তু
কে বলে সন্দেহ? গরিব কিন্নরও চেহারা ধার নিয়ে সজল কৃষ্ণ
মাথায় ঘুণপোকা ময়ূর পালকের সস্তা লণ্ঠনে কাফের আলোরা
নড়লে শিখাময় কালির মাথাচাড়া — আগুন কবে সেই কারণ ভুলেছে
হারিয়ে উত্তাপ শুধুই দিকভুল যেমন জোনাকিরা বর্ণে গন্ধে
মিশেছে সাগরের যতটা নদীমুখ রক্ত ধার নিয়ে ছুঁয়েছে মোহনা
তবুও থামেনি সে — অন্তঃসলিলার গর্ভ বোঝা ভার ধারণ বিষাদে
দু-চোখ টলটলে ফোঁপানি শিরাময় তবু কি ঠাঁই মেলে আজ এ মহড়া!
বলেছে সংলাপ, নৃত্যে তালে তাল সময় মাপজোক পর্দা পড়বে
কতই মনোহর বাজাল বাঁশি তার ঠোঁটের কোণ জুড়ে ক্ষতের সে জ্বালা —

জানো কি বন্দির বিজোড় ধারাপাত তোমাকে দিয়ে শুরু তুমি যবনিকা?
তবু তো অচেনাই, কারণ সন্দেহ, আয়না একা জানে ছায়াই জয়টিকা!

পাঠক এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’–র উল্লেখ দেখেই আমি ধরে নিয়েছিলাম এই কাব্যনাট্যের বিষয়সাযুজ্যের ব্যবধানটি। আর সেই ব্যবধান দেখেই আমি তাকে প্রত্যাহার করার পরামর্শ দিই উৎসর্গে উল্লেখিত সংলাপটিকে। আসলে বুদ্ধদেব বসুর লাইনটি চলেছে ৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের এমন একটা চলনে যার শেষ পর্বটি থেমে যাচ্ছে ৬ মাত্রায় : ‘আকাশে সূর্যের অটল আক্রোশ, জ্বলছে রুদ্রের রক্তচক্ষু’। এখানেই ধরা যাক, যদি ‘চক্ষুই’ কথাটি প্রযুক্ত হত তাহলে আরেকটি ৭ মাত্রার পর্ব চলে আসত। কিন্তু বুদ্ধদেবের লাইনটি চলছে কীভাবে? ৭ / ৭ / ৭ / ৬। অমৃতার কবিতার প্রথম লাইনটি দেখি আমরা : ‘চিনেছ আমাকেই, আবার অন্দরে রেখেছ বাঁধামুখ বন্যজন্তু’। এখানে যদি ‘বন্যজন্তুই’ কথাটি ব্যবহার হতো তাহলেই আরেকটি ৭ মাত্রা এসে যেত। কিন্তু অমৃতা তা দেননি। বুদ্ধদেবের ছন্দচলনটিই তিনি ঋণ নিয়েছেন অথচ বিষয় তাঁর নিজের। ‘রেখেছ বাঁধামুখ বন্যজন্তু’ — এখানে স্পষ্টতই চিরকাল ধরে পিতৃতন্ত্রের দ্বারা দমিত যে নারীজীবনধারা বয়ে আসছে তার প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো। কিন্তু সেই প্রতিবাদ ঘটল অত্যন্ত সংকেতধর্মী, সংহত এবং বিমূর্ত ভাষাব্যক্তিত্ব দ্বারা। ৭ / ৭ / ৭ / ৬ বুদ্ধদেবের ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’–র প্রথম সংলাপটির অবিকল ছন্দানুসরণ আছে অমৃতার ‘একা’ নামক কবিতার প্রত্যেকটি লাইনে। কিন্তু বিষ্ণু দে-র ভিলানেলের ক্ষেত্রেও যেমন, অলোকরঞ্জনের ‘পথের মন্ত্র’ এবং শঙ্খ ঘোষের ‘বিদায়’ কবিতাটির ক্ষেত্রেও যেমন তেমনই বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রেও অমৃতার কবিতার সংযোগ ঘটেছে বড় বিস্ময়কর ভাবে। এইসব মহারথীদের আপন ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল ভাষাচরিত্র সম্পূর্ণ অতিক্রম করে অমৃতা ভট্টাচার্য শুধু গঠনটির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন নিজস্ব ভাষাব্যক্তিত্ব। কী করে এত বড় কবিদের ছন্দগঠন পুরোপুরি অনুসরণ করেও একান্ত নিজস্ব ভাষাব্যক্তিত্ব জাগিয়ে তুলতে পারলেন অমৃতা? আমার অনুমান এর কারণ তিনটি। প্রথমত, এসব রচনার সঙ্গে অমৃতার রচনাগুলির সময় ব্যবধান ৬০/৬৫ থেকে ৭৫ বছরের মতো। সময়ের এতখানি দূরত্বে দাঁড়িয়ে যদি কোনও কবি তুলে আনেন প্রপিতামহপ্রতিম পুরাতন কবিদের শ্রেষ্ঠ কাজকে নিজ ব্যবহার্য রূপে তাহলে গ্যারি ক্যাসপারোভের সেই একাদশ শতাব্দীর গেম স্ট্র্যাটেজি সিসিলিয়ান ড্রাগন ভ্যারিয়েশনের মতোই তা আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে এক নবজন্মান্তর পায়। দ্বিতীয় কারণ, অমৃতার ভাষাব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ নিজস্ব, কেননা তাঁর কবিতার অর্থবস্তুর মধ্যে সেই নিজস্বতা রয়েছে। সেই বিষয়বস্তু আপন স্বাতন্ত্রে জ্বলমান। কেন তা আপন স্বাতন্ত্রে জ্বলে উঠতে পারছে? এখানেই আসছে তৃতীয় কারণটি। অমৃতা ভট্টাচার্য একজন নারী। একজন নারী জীবন ও আবহমান নারীজীবনের ইতিহাস তার বিষয়কেন্দ্র থেকে চাপ দিচ্ছে তার কবিতাকে স্ফুটমান হয়ে উঠতে।

‘তবুও থামেনি সে — অন্তঃসলিলার গর্ভ বোঝা ভার ধারণ বিষাদে’ — এই লাইন কোনও পুরুষ কবির পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। এই লাইনে ‘অন্তঃসলিলা’ শব্দটি রয়েছে, এক নারীই তো ‘অন্তঃসলিলা’ হতে পারেন। পুরুষ পারেন না। এই লাইনে ‘অন্তঃসলিলা’র পরের ৫ টি শব্দও আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। ‘গর্ভ বোঝা ভার ধারণ বিষাদে’ — নিজের গর্ভ সঞ্চার হয়েছে কিনা তা একজন নারীই মাত্র বুঝতে পারেন। এখানে পুরুষের কোনও ঠাঁই নেই। গর্ভ কী তা বোঝা পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ‘বোঝা’র পর ‘ভার’ শব্দটি আছে এবং তারপরের শব্দ দু'টি হচ্ছে ‘ধারণ’ এবং ‘বিষাদে’। গর্ভ যেমন বুঝতে পারা বোঝাচ্ছে তেমনি তা এক ‘বোঝা’ বহন করাও বোঝাচ্ছে। কেননা ‘বোঝা’–র পরেই ‘ভার’ শব্দটি রয়েছে — ভার তো মানুষকে বইতেই হয় তাই ‘বোঝা’ শব্দটি দু'রকম অর্থ নিয়ে এই লাইনে এল। এখন সাধারণত একমাত্রিক অর্থস্তরযুক্ত কবিতা রচনার প্রচলন অধিক বলে এইসব সূক্ষ্মতর অর্থস্তর প্রয়োগ অন্য কবিদের কাছে হয়তো মূল্য পাবে না। কিন্তু কবিতার সন্ধিৎসু পাঠক এ কথাটি লক্ষ্য করবে যে ‘ভার’ কথাটির পর ‘ধারণ’ শব্দটিও আছে। তাহলে কী দাঁড়াল? গর্ভভার ধারণ! যা একমাত্র নারীর পক্ষেই সম্ভব। এই কবিতার বই কিন্তু এই লাইনের শেষ শব্দ যে ‘বিষাদে’ তাতে থামে না। আমরা এই কবিতার শেষ শব্দ হিসেবে পাই ‘জয়টিকা’ শব্দটিকে। অর্থাৎ এই কবিতার বইটি, তার সংকেতধর্মী বিমূর্ত ভাষা নিয়ে নারী জন্মের জয় ঘোষণা করতে করতে চলেছে। জয় ঘোষণা ঠিকই, কিন্তু কোথায় কোথায় অমোঘ-বন্ধন নারী জন্মকে শৃঙ্খলিত করে তার ইশারাও এই বই দিতে দিতে এগিয়েছে। একটি কবিতার প্রথম ৮ লাইন বলছি :

সীমানা যা কিছু তোমার সঙ্গে পেরোনো
ভুলব কী করে? পরিযায়ী সেই কাঁটাতার
যখন আকাশ কোষের ভিতর গোটানো
হাঁটু মুড়ে, শুধু হাত মেলে রাখা ঘরবার!

ভূমি মানে জানি, ভাগ হয়ে যাওয়া এ-জানলায়
নখর চমক, চেন বাঁধা হাওয়া চিরন্তন!
আসলে স্বপ্ন, ঢেউ এসে বসে বারান্দায়
আর খুঁজে যায়, শামুক, নিজের ধীরগমন —

এও এক জটিল ছন্দচলনের কবিতা, যা আমি পুরো পড়তে দিলাম না পাঠককে। প্রথম লাইনে ‘সীমানা যা কিছু তোমার সঙ্গে পেরোনো’ — এই লাইনে ‘তোমার সঙ্গে’ বাধাহীন এক যাত্রার কথা দিয়ে কবিতার শুরু। অথচ পরের লাইনেই আমরা পাচ্ছি ‘পরিযায়ী সেই কাঁটাতার’! ‘কাঁটাতার’ কী করে ‘পরিযায়ী’ হবে? পরিযায়ী তো হয় পাখিরা। তারা যেকোনও দেশে উড়তে পারে। তাদের কোনও সীমান্ত নেই! কিন্তু নারী? তার পুরুষের সঙ্গে ‘সীমান্ত যা কিছু’ পেরোলেও কাঁটাতার নারীর সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। ‘কাঁটাতার’ অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক পুরুষশাসন। যে দেশেই সে যাক, নারী, এই কাঁটাতার তার পায়ে পায়ে থাকবেই! সেই জন্যই ‘আকাশ কোষের ভিতর গোটানো’! আকাশ, যা চিরমুক্ত — সেই আকাশও কোষের ভিতর গুটিয়ে রাখতে হয় বাধ্য হয় নারী। এই যে আকাশকে কোষের ভিতর গুটিয়ে রাখা –এর ভেতর যে প্রবল পরস্পর বিরোধিতা — সেই একই পরস্পর বিরোধিতা ফুটে ওঠে ‘চেন বাঁধা হাওয়া চিরন্তন’ কথাটির অভাবনীয় ব্যবহারে। হাওয়াকে কি চেন দিয়ে বাঁধা যায়? যায় না। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে বাঁধা যায়। হ্যাঁ, হাওয়াকেও, চেন দিয়ে। ‘চিরন্তন’ শব্দটির মধ্যে আদিকাল থেকে হাওয়ার স্বাধীন বহমানতা যেমন বোঝা যায় তেমনই ‘চেন দিয়ে বাঁধা হাওয়া’ আসার ফলে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর চিরবন্ধনযুক্ত দশাও পরিস্ফুট হয়। এখানে, পাঠককে লক্ষ্য করতে বলছি, আবারও একটি শব্দ দিয়ে দু'দিকে অর্থসংকেত পাঠিয়ে দু'রকম অর্থস্তর উদ্ঘাটন করা হলো। অথচ বিবৃতিমূলক কোনও একমাত্রিক মতবাদ প্রকাশের বদলে এলো বহুস্তরীয় বিমূর্ত ভাষা। অমৃতা ভট্টাচার্যের এই কাব্যগ্রন্থের ২২ পৃষ্ঠায় এসে আমরা পেয়ে যাই একটি কবিতা সিরিজ। ১২ টি কবিতার এই সরণীকে চিহ্নিত করা হয়েছে একটিই শিরোনামে। শিরোনামটি হলো : ‘কৃষ্ণার প্রতি’। এর প্রথম কবিতাটি আমরা দেখে নিই। কবিতাটি এইরকম :

কৃষ্ণার প্রতি

অরণ্য উজাড় করে সূর্যে যত ডাকনাম রাখো
সে অস্থি কী অপরূপ ! আলোর জারজ শামিয়ানা
যে পাত্রে ভরেছ ব্রাত্য — অধিকন্ত ন দোষায় স্বর
সে-ও কি বিকল্প স্নান ? আমার সে অমোঘ ঋতুরং —
মায়ার খুনেও বয় মাধবীলতার কারসাজি
যে অস্ত্রে রেখেছ হাত, সে এখন পরিযায়ী মাটি
রঙের বদল হয়, ঊরুবাসিনীর ডানা ছুঁয়ে
ঋতুশেষ। — ক্ষতরাগ তূণের গভীর দুপুরের
একজন্মে কত রূপ ! পাতা ঝরা মরশুম শেষে
অগ্নিস্নানে উঠে এসো — তবু কৃষ্ণা দূর বহুদূরে —
আদিগন্ত শোক তার, অনশন কৃষ্ণলোভাতুর!

এই কবিতাটি বিষয়ে কথা বলবার আগে এই উল্লেখটুকু প্রয়োজন যে এই কাব্যগ্রন্থে মাত্রাবৃত্তে লেখা একটি দীর্ঘ কবিতাও সংযোজিত হয়েছে যার নাম — ‘উত্তরায়ণ : ভীষ্মের প্রতি’। অর্থাৎ বোঝা যায় যে, এই কাব্যগ্রন্থটি লেখার সময়ে কবির মনে খুবই সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল ‘মহাভারত’। ‘কৃষ্ণা’ দ্রৌপদীর আরেক নাম। ‘কৃষ্ণা’ নামক বাংলা ভাষায় লিখিত একটি দীর্ঘ কবিতা আছে যা লিখেছিলেন কবি সব্যসাচী দেব। সে কবিতা ছন্দমুক্ত টানা গদ্যে লেখা। সব্যসাচী দেবের ‘কৃষ্ণা’ নামক অতি পরিচিত কবিতাটির সঙ্গে কিছুমাত্র সাদৃশ্য নেই অমৃতা ভট্টাচার্যের ‘কৃষ্ণার প্রতি’ শীর্ষক এই ১২ টি কবিতা-যাত্রার। বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে এই ১২ টি রচনাই পুরোপুরি নিয়মবদ্ধ ছন্দে রচিত। ৮ টি কবিতাই অক্ষরবৃত্তের ১৮ মাত্রার ছন্দে লিখিত হয়েছে, প্রতিটি লাইনের সমমাত্রিকতা বজায় রেখে। এছাড়া, স্বরবৃত্তে আছে ২ টি কবিতার আশ্রয় যা একটি অগ্রসর হয়েছে দ্বিপদীর চালে, মিত্রাক্ষর মান্য করে। স্বরবৃত্তের অন্য রচনাটি ৩ মাত্রার স্তবকে চালিত এবং একেবারে শেষ স্তবকেই শুধু ২ টি অন্ত্যমিল এনেছে। ৭/৭ এবং ৭/৫ –এর মাত্রাবৃত্ত ছন্দচলন অনুসরণ করেছে ২ টি কবিতা। ফলে মুক্তগদ্যে লেখা সব্যসাচী দেবের ‘কৃষ্ণা’ কবিতাটির সঙ্গে কোনও দিক দিয়েই অমৃতা ভট্টাচার্যের এই ‘কৃষ্ণার প্রতি’ কবিতা সিরিজ সমভূমিতে দাঁড়ায় না। এছাড়া কেবল ছন্দই নয় দ্বিতীয় কারণটি মূল কারণ কেননা ‘কৃষ্ণার প্রতি’ সিরিজটি এক নারী কবির দ্বারা লিখিত। অন্যপক্ষে এই দুই কবির প্রজন্ম ব্যবধানও চার দশকের বেশি। ফলে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে রচনা পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে। এবার অমৃতার ‘কৃষ্ণার প্রতি ১’ এই কবিতাটির দিকে তাকাই আমরা। এর শেষ দু'টি লাইন আমাদের এক নতুন চিন্তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কৃষ্ণা বা দ্রৌপদী যে পাঁচজন স্বামী সত্ত্বেও মনে মনে একাকিনী থেকে গেছেন আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এ কবিতার শেষ লাইন বলে : ‘আদিগন্ত শোক তার, অনশন কৃষ্ণলোভাতুর’! এই ‘কৃষ্ণলোভাতুর’ শব্দটি এবং তার আগে ‘অনশন’ শব্দটি পাঠকের কাছে কী অর্থ সংকেত পাঠায়? ‘অনশন’ শব্দে, দ্রৌপদী বা কৃষ্ণা যে ক্ষুধিত থেকে গেছেন পঞ্চস্বামীর অস্তিত্ব সত্ত্বেও — সেকথা আমাদের মনে আসে। পাশাপাশি ‘কৃষ্ণলোভাতুর’ শব্দটি একটি নতুন চিন্তাগতি দেয় কৃষ্ণা চরিত্রটিকে। কী সেই চিন্তাগতি? দ্রৌপদী কি কৃষ্ণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিলেন? অন্তত আমাদের এই কাব্যগ্রন্থের কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতাটির ইঙ্গিত সেই দিকেই। শাঁওলী মিত্র রচিত ও অভিনীত ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকে একটি দৃশ্যে দ্রৌপদীরূপী কথকের এই সংলাপ আমরা মনে করতে বাধ্য হই : ‘আঃ, দুঃশাসন, আমার কেশ ছেড়ে দাও, আমায় সভায় নিয়ে যেও না। ... আমি রজস্বলা, একবস্ত্রা হয়ে আছি — এই অবস্থায় আমাকে সভায় সবার সমক্ষে নিয়ে যেও না। পায়ে পড়ি, দয়া করো, দয়া করো আমাকে’। ... কিন্তু দ্রৌপদীকে যে সভায় ওইভাবেই তৎক্ষণাৎ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে-কথা ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকে আছেই — আছে, ইরাবতী কার্ভে লিখিত ‘যুগান্ত’ গ্রন্থটির মধ্যেও। কেননা, এই দুই নারী, শাঁওলী মিত্র এবং ইরাবতী কার্ভে — অবলম্বন করেছেন মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের অবস্থাটিকেই। ৫ জন স্বামী উপস্থিত। তবু প্রকাশ্য সভাস্থলে কৃষ্ণার বস্ত্রহরণ করা হচ্ছে। কোনও স্বামীরই প্রতিবাদ করার কোনও ক্ষমতা নেই। হ্যাঁ, অনেক পরে ভীম এই অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বটে দুঃশাসনকে হত্যা করে — কিন্তু সেই মুহূর্তে যখন একবস্ত্রা দ্রৌপদীর শাড়ি পাকে-পাকে টেনে খোলা হচ্ছে, তখন? তখন একমাত্র কৃষ্ণ অন্তরাল থেকে ‘অন্তহীন শাড়ি’ সরবরাহ করে দ্রৌপদীর শেষ লজ্জা রক্ষা করেছিলেন। ‘অন্তহীন শাড়ি’ কথাটি আমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা থেকে এখানে সরাসরি প্রয়োগ করলাম। বুদ্ধদেব লিখেছেন : ‘অসম্ভব দ্রৌপদীর / অন্তহীন শাড়ি’। দ্রৌপদী অর্থাৎ কৃষ্ণার শাড়ি যে অন্তহীন হয়ে উঠতে পেরেছিল তা কার শক্তিতে? অবশ্যই কৃষ্ণের। কৃষ্ণই জুগিয়ে চলেছিলেন দ্রৌপদীর লজ্জাবস্ত্র অন্তহীনভাবে। তাই যে বন্ধু এক নারীর চরম বিপদের মুহূর্তে তার লজ্জাকে বাঁচিয়ে ছিলেন সেই বন্ধুর প্রতি কি একটা গোপন আকর্ষণ থাকা একেবারেই অসম্ভব? পাঁচজন স্বামী যে নারীর লজ্জা লুণ্ঠিত হওয়ার সময় কোনও বাধা দিতে একান্তভাবে অপারগ ছিলেন — এবং এক স্বামী পাশা খেলার সময় নিজের স্ত্রীকে বাজি রাখার অসম্মানকর কার্যেই তো ওই লজ্জা সম্পূর্ণ লুণ্ঠিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল — একথা তো আমরা সকলেই জানি। দ্রৌপদীকে পণ রাখার সময়ে একবারও কি দ্রৌপদীর সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন তার ক্রীড়ারত স্বামী? না। তাই এই ‘অনশন কৃষ্ণলোভাতুর’ শব্দটি আমাদের দ্রৌপদীর মনের এক গহনে প্রবেশ করায় যে গহন আজকের যুগের এক তরুণী কবির দৃষ্টি অনুভব করেছে।

এর পাশাপাশি আমরা ‘কৃষ্ণার প্রতি’ কবিতা সিরিজের ৮ সংখ্যক কবিতাটির দিকে অবলোকন করতে পারি।

সঙ্গোপনে দিয়ে গেলে, কী এমন পালক সংলাপ?
বয়ামে আচার রাখি, মুখবন্ধ কাগজের নাম
কাচ ভুলে আলো হয়ে, সে ছায়া ফেরত দিয়ে যায়
যত নাম খুঁজে যাই, তত তার আগুন মায়ায়

দুরন্ত আকার ধরে ধোঁয়ার আমিষ অনশন
একে তুমি ভুল বলো ? আঘাত প্রমাণ কিছু নেই
রং ঘিরে কী উৎসব! — তবু ক্ষত দগদগে রোদ
অক্ষরে ক্ষতের ছবি ? সে কথার কাটাকাটি ক্লেশ —

কথা তো জারজ, কালো — আকার নিজের কিছু নেই
এ পক্ষে সে পূর্ণচাঁদ, পক্ষ ঘুরে সব তর্ক শেষ!

এই কবিতার মধ্যেও আমরা ‘অনশন’ শব্দটিকেও দেখতে পাই আবার। সেই ‘অনশন’ –এর আগের শব্দটি আমাদের কাছে এক তীব্র অর্থসংকেত পাঠায়। কী সেই শব্দ? ‘আমিষ’! ‘আমিষ অনশন’ — এখানে শরীরী ক্ষুধার অনশনের দিকেও কিন্তু এই নারী কবি তাঁর সাহসী অর্থ নির্দেশে পিছিয়ে আসেন না। কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে কী পাব? ‘...আঘাত প্রমাণ কিছু নেই / রং ঘিরে কী উৎসব! — তবু ক্ষত দগদগে রোদ / অক্ষরে ক্ষতের ছবি? সে কথার কাটাকাটি ক্লেশ / কথা তো জারজ, কালো — আকার নিজের কিছু নেই / এ পক্ষে সে পূর্ণ চাঁদ, পক্ষ ঘুরে সব তর্ক শেষ’!

শেষ লাইনটি নারীজীবনের সকল ক্ষতের ছবি ও ক্ষত বিষয়ক সব কথার ‘কাটাকাটি ক্লেশ’ যে শেষ পর্যন্ত সব তর্কের শেষেই ফুরিয়ে যায় — একদিন যখন তার যৌবন থাকে, সে মানে নারীর, তখন পুরুষের কাছে সে পূর্ণ চাঁদের মতো আদরনীয়া, ঠিকই তবু তাকে ব্যবহৃতা হতেই হয় এবং পরিণামে যখন পক্ষ ঘুরে যায় তখন? পূর্ণ চাঁদ তো শুক্লপক্ষের চূড়ান্তে এসে প্রস্ফুটিত, তাই নয় কি? কিন্তু পরবর্তী দিন থেকেই তো কৃষ্ণপক্ষের আরম্ভ — সে পক্ষের চূড়ান্তে কিন্তু আসে অমাবস্যা। তাই ‘পক্ষ ঘুরে সব তর্ক শেষ’! ১১ সংখ্যক কবিতায় শেষ দু'টি লাইন হিসেবে আমরা কী পাই?

‘কোথায় সে-বন্ধন আর! ভয় পুড়ে আলো দানাময়
পাঁচ স্বামী ঘরে ফেরে — কৃষ্ণা কিন্তু তখনও অক্ষয়!’

এইখানে আমরা বুঝি যে ‘কৃষ্ণা’-র কোনও ক্ষয় নেই! সে নারী চিরদিনই অক্ষয়। যেমন আগে আমরা দেখেছি অমৃতার কবিতায় : ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে!’ এখানে ‘কালী’ চিরকাল জেগেই উঠছে তার জাগরণ কখনও শেষ হয় না, তেমনই কৃষ্ণা বা দ্রৌপদীরও কোনও ক্ষয় হয় না। এখানে যখন ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে!’ লাইনটি আরেকবার আনতেই হলো তখন ছন্দবিষয়ক একটি কথাও বলে নেওয়া দরকার। আগেই জানিয়েছি ‘কালী’ কবিতাটি ইতালিয়ান ব্যালাডের মিলবিন্যাস অনুসারে রচিত কিন্তু তার বিষয় সম্পূর্ণ ভারতীয় পুরাণ। তার বিষয় দেবী কালী ও মহেশ্বর। এখানে, এই শেষ লাইনে ‘জাগে কালী’–তে এসে পূর্বের ২৭ লাইন ধরে পড়ে আসা লাইনের প্রথম পর্বের ৬ মাত্রা অপূর্ণ থাকায়, তখনও না-আসা ২ মাত্রার জন্য পাঠকের শ্বাস উদ্দীপিত হয় এবং ‘ধীরে, অমা, ধীরে’ পর্বাংশটি এসে পড়ামাত্র লাইনটির গতিবেগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এই কবির কবিতা শারীরিক চাহিদাকে ভিত্তি করে পুরাণকে অবতীর্ণ করায় বলে এই কবিতাসমূহে এত ‘চার্জ’ বা অগ্নিক্ষরণ ধরা পড়ে। ছন্দ প্রয়োগেই তার প্রমাণ রক্ষিত হয়। ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে!’ — এখানে লাইনটির গতিবেগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলো কারণ কবিতাটি সমাপ্তির দিকে চলেছে (যদিও এ-কবিতাটি সমাপ্ত কখনও হয় না। শুধু এক সাময়িক বিরতিমাত্র নির্দেশ করে)। নরনারীর মিলনসময়েও মিলনের গতিবেগ বৃদ্ধি পায় শেষ মুহূর্তে এসে। সেই ত্বরণকে ‘জাগে কালী — ধীরে, অমা, ধীরে!’ এর মধ্যে ধারণ করা হয়েছে, শুধু একটি ২ মাত্রাকে পরের পর্বাংশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে। কবিতাটি শেষ মুহূর্তে এসে — নরনারীর মিলন চূড়ান্তের মতোই — তার গতিবেগ দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। এও কবিতাকে শরীর-সত্তার একেবারে উৎস-কেন্দ্র থেকে উদ্ঘাটিত করার এক প্রমাণ এবং তা বারবারই ধরা পড়েছে অমৃতার বিভিন্ন কবিতায়।
আমরা কৃষ্ণার প্রসঙ্গে আসি। দেখলাম ‘কৃষ্ণা’ চিরদিনই ক্ষয়হীন থেকে যাবেন। এই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, ১০ সংখ্যক কবিতাটির মধ্যে আমরা আবারও নানারূপ আশ্চর্যের দেখা পাই।

১০

আমার ভুলের নাম তরুবাসী তক্ষকের জিভ
সবুজ আতস পেয়ে গরলকে নিরামিষ ভেবে
সুড়ঙ্গে সে হেঁটে গেল, পেরোল গোলাপ মহাদেশ
দুরস্ত দৃশ্যের খাঁজে কুঁড়ি ফোটে প্রবল কোমায়
আমাকে অর্ধেক করে আকারান্ত অটুট মোহের
গ্লানির্ভবতি চক্ষু শুষে নেয় ঘুমের সহিস
আমাকে অধীর করে জড়াও হে করুণ ঈশ্বর!
কাব্যটি যেখানে পূর্ণ, যেখানে আঁতুড় বাঙময়
সেখানে অশান্ত পাখি, উড়ে যায় অরণ্য কঠিন

অনন্তের চক্রে ঘোরো অহোরাত্র অনাবিল দেহ
উপগ্রহ তুমি তবু, ভরাচাঁদ দাও জ্যোৎস্নাঋণ —

এই কবিতায় আমরা দেখি ৪র্থ লাইন থেকে ৭ম লাইন পর্যন্ত ‘আমাকে অধীর করে জড়াও’ এই আর্তি। এবং ঠিক তার আগেই আমরা শব্দ ব্যবহারে দু'টি অপ্রত্যাশিত সংঘাত লক্ষ্য করি : ‘দুরস্ত দৃশ্যের খাঁজে কুঁড়ি ফোটে প্রবল কোমায় / আমাকে অর্ধেক করে আকারান্ত অটুট মোহের / গ্লানির্ভবতি চক্ষু শুষে নেয় ঘুমের সহিস’ — এরপরেই আসবে ‘আমাকে অধীর করে জড়াও হে করুণ ঈশ্বর!’। ঈশ্বর কে? এই ঈশ্বর কি কোথাও কৃষ্ণ নন? সেই সংকেতও স্পর্শ করে অর্থস্তর। কেননা আমরা সবাই জানি কে বলেছেন সেই কথা : ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। / অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজম্যহম্’।। এ কবিতায় আমরা পাই ... ‘প্রবল কোমায় / আমাকে অর্ধেক করে আকারান্ত অটুট মোহের / গ্লানির্ভবতি চক্ষু শুষে নেয় ঘুমের সহিস’ — তারপরেই সেই আর্তি আসে ‘আমাকে অধীর করে জড়াও ...’। ‘গ্লানির্ভবতি’ কথাটি কি অকারণে এল? না, কখনই নয়। কৃষ্ণবাক্য স্মরণ করাল এই ‘গ্লানির্ভবতি’ কৃষ্ণকে স্মরণ করাবে বলেই। কৃষ্ণই এখানে সেই করুণ ঈশ্বর। অর্থাৎ ‘অনশনে কৃষ্ণলোভাতুর’ এই বাক্যবন্ধটির বিদ্যুৎস্পর্শ এই ১০ সংখ্যক কবিতাটিতেও ঘটে গেল। তার আগেই পেয়েছি ‘প্রবল কোমায়’ — চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই পরিভাষার সঙ্গে গীতার ‘গ্লানির্ভবতি’ মিলিয়ে দেওয়া কত সহজেই সম্ভব করল কবিতাটি। আমরা ভুলে যাই না ‘গ্লানির্ভবতি’র ঠিক আগেই আছে ‘অটুট মোহের’ শব্দ দু'টি এবং শেষ ৪ টি লাইনও আমাদের মনে পড়ে যেখানে রয়েছে :

‘কাব্যটি যেখানে পূর্ণ, যেখানে আঁতুড় বাঙময়
সেখানে অশান্ত পাখি, উড়ে যায় অরণ্য কঠিন

অনন্তের চক্রে ঘোরো অহোরাত্র অনাবিল দেহ
উপগ্রহ তুমি তবু, ভরাচাঁদ দাও জ্যোৎস্নাঋণ’ —

আবারও বলি, ‘আমাকে অধীর করে জড়াও হে করুণ ঈশ্বর’ এই উচ্চারণের পরেই আসছে ‘কাব্যটি যেখানে পূর্ণ’ এই বাক্যবন্ধ। কবিতার উপসংহারে আমরা পাই : ‘অহোরাত্র অনাবিল দেহ’ এবং সেইসঙ্গে পাই ‘ভরাচাঁদ দাও জ্যোৎস্নাঋণ’। ‘অরণ্য’র পরে ‘কঠিন’ শব্দটি আছে সেকথা আমরা ভুলি না। সেই সূত্রে ‘কাব্যটি যেখানে পূর্ণ’ এই বাক্যবন্ধে কাব্য একদিকে যেমন কবিতা অন্যদিকে তেমনই নারী শরীরের বাসনার পূর্ণ মুহূর্তে পৌঁছনোর ইঙ্গিতও। কাব্য বা কবিতা এখানে স্বয়ং নারীত্ব হয়ে অধিষ্ঠান করছেন। অনন্তের চক্রে ঘুরছেন সেই ‘অনাবিল দেহ’ কারণ নারী শরীর কখনও অপবিত্র হয় না, অশুচি হয় না! কারণ নারী জন্ম দেন! এ কবিতায় আছে ‘যেখানে আঁতুড় বাঙময়’ — ‘আঁতুড়’ অর্থে, সকলেই জানি, যেখানে শিশুর জন্ম হয়। একদিকে নারীর শরীর-বাসনার পূর্ণতাই কাব্য অন্যদিকে জন্মদান করাও কাব্য — যা শুধু নারীর অধিকারেই আছে। হ্যাঁ, আমরা মনে রাখছি ‘অরণ্য’ শব্দটির পর ‘কঠিন’ কথাটির ব্যবহার শুধু এক লাইনের ব্যবধান রেখে ‘জ্যোৎস্নাঋণ’ শব্দটির সঙ্গে অন্ত্যমিল রাখবার প্রয়োজনেই মাত্র ব্যবহৃত হয়নি— মিলন মুহূর্তে পুরুষাঙ্গ কঠিন হওয়া আবশ্যক — সেই দিকেও কবিতাটির অর্থ নির্দেশ চলে গেছে।

এইবার আমরা চলে যাব একটি প্রবন্ধের কাছে যে প্রবন্ধ লিখেছেন ইন্সটিটিউট অব ক্রিশ্চিয়ান স্টাডিজের Janet C. Wesselius। প্রবন্ধটির মধ্যে আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াব।

The feminist philosopher Susan Bordo suggests that the dilemma of twentieth-century feminism is the tension between a gender identity that both mobilizes a liberatory politics on behalf of women and that results in gender prescriptions which excludes many women. This tension seems especially acute in feminist debates about essentialism/deconstructionism. Concentrating on the shared sex of women may run the risk of embracing an essentialism that ignores the differences among women, whereas emphasizing the constructed natures of sex and gender categories seems to threaten the very project of a feminist politics.

... Recently, however, more and more feminists have protested that these differences matter just as much to one's identity as one's sex. They argue that privileging the purportedly Shared sex of women is based on a fundamental misunderstanding of the identities of actual Women. Women are not all the same and their differences are not merely insignificant accidents but are in fact inextricably intertwined with their identities as women.

... As important as a shared sex might be, many feminists are now arguing that things like race, class, and sexual orientation make the notion of a common gender identity problematic.

... The subject of feminist politics, to the extent that it is assumed to be representative of womenkind, is a paradigmatic gender identity in which all women are united. However, to the extent that this subject does not represent all women, it also functions as a gender prescription that legislates an essential gender identity and excludes those women who do not have the 'correct' gender identity. In her essay "Feminism, Postmodernism, and Gender- Scepticism", Susan Bordo suggests-citing Nancy Cotts-that the dilemma of twentieth- century feminism is "the tension between the preservation of gender consciousness and identity (as a source of political unity and alternative vision) and the destruction of gender prescriptions... which limit human choice and possibility". Feminism betrays its own ideals when it excludes any woman. However, in an effort to represent all women and not just paradigmatic women, feminists find themselves in another quandary: if the category of women is problematized, on what can we base a feminist politics? And if we give up gender identity, how can we mobilize a libratory politics on behalf of women? The question really is how to view sameness and difference.

... I shall first examine one possible feminist response, influenced by what are broadly called postmodern theories, which tries to deconstruct the notion of 'woman' in order to rectify the historical exclusion of some women. Then I shall analyse another possible response, one that takes account of the insights of postmodern-influenced feminism but tries to retain some form of gender identity for political purposes.
... historically, feminism has often used a form of essentialism- this belief in a shared essence-to justify political activity on behalf of women. Elizabeth Grosz explains essentialism in the following way:

Essentialism... refers to the attribution of a fixed essence to women.... Essentialism entails all women at all tirnes Essentialism thus refers to the existence of fixed characteristics, given attributes, and ahistorical functions.

... In the recent intersection with what is generally called postmodern theories, feminism has been accused of engaging in totalizing discourses by assuming, and hence imposing, the same gender identity on all women. Judith Butler, for example, criticises contemporary feminist politics because "the identity categories often presumed to be foundational to feminist politics, that is, deemed necessary in order to mobilize feminism as an identity politics simultaneously work to limit and constrain in advance the very cultural possibilities that feminism is supposed to open up".  For such women, the problem with that is in fact not universally shared. They point to the differences among women and argue current feminist politics is that it is based on a shared gender identity between all women that the political emphasis on sameness has suppressed difference and has excluded some Women by maintaining that differences among women such as race, class, and sexuit orientation are appurtenant to the more essential identity of gender.  Nancy Fraser and Linda Nicholson give a very clear statement of the problem of exclusion within feminist theory:

While gender identity gives substance to the idea of sisterhood, it does so at the cost of repressing differences among sisters. Although... [feminist) theory allows for some differences among women of different classes, races, sexual orientations, and ethnic groups, it construes these as subsidiary to more basic similarities. But it is precisely as a consequence of the request to understand such differences as secondary that many women have denied an allegiance to feminism. 

... Elizabeth Spelman, argues that “though all women are women, no woman is only a woman”.  A feminist politics based on an essential similarity among women cannot represent all women because we have yet to be able to specify some essence that is genuinely common to all women.

... Moreover, feminists have long since argued that the content of gender is a complex and continuously shifting category, (9) Femininity does not always have the same meaning for all women in all cultures at all times.

... Gender coherence itself can be seen as a regulatory fiction designed to keep women (and men) in their place; women must always be feminine (and men must always be masculine). In fact, some feminists point out that if gender is a socially and historically constructed category, then there are more than two possible genders and gender does not necessarily follow from sex; for example, there are more possibilities than femininity and masculinity and not all males are masculine nor are all females feminine. In other words, sex does not determine gender.  Sex might be a given but we do not have access to sex apart from gender. In any case, since sex does not exist independently of gender and apparently not all women share the same gender, mere physical similarity appears to be a poor candidate on which to base a womanly essence.

... These feminists continue to pay attention to gender but they do not think that it can be generalized across cultures, races, historical periods and so on. Nor can we assume that there is gender sameness among women. Fraser and Nicholson, for example, criticise “the category of gender identity” as essentialist and ahistorical, they assert that “the idea of a cross-cultural, deep sense of self, specified differently for women and men, becomes problematic when given any specific content”.

... According to Fraser and Nicholson, a “postmodern feminist theory” should dispense with universalizing gender claims; instead, “it would replace unitary notions of woman and feminine gender identity with plural and complexly constructed conceptions of social identity, treating gender as one relevant strand among others, attending also to class, race, ethnicity, age, and sexual orientation”, They do not deny any similarity among women they simply deny any essential similarity. Difference in general is privileged over sameness. Emphasizing sameness threatens to minimize or even ignore the diverse identities of women whereas attending to difference exposes universal essences as oppressive a and totalizing fictions.

The question of the real essence of women is the location of hotly contested debates among feminists. But there is a widespread recognition that women are assigned an essence. Most notably, feminist standpoint theorist Sandra Harding argues that :

Women are, indeed, like each other by virtue of their sex and also by virtue of the otherness that men assign to women. Of course, they differ by race, class, culture, and other important social features; in important respects, they are more like men in their own class, race, culture than like women in other races, and so on. But... [feminist] theory does not require any kind of feminine essentialism.... It analyzes the essentialism that androcentrism avsigns to women. locates its historical conditions, and proposes ways to counter it... [We] constantly call for more vigorous feminist analysis of and politics against these forms of oppression. 

... Women occupy socially marginalized positions that are justified by appeals to their sex. regardless of the multiple forms this marginalization takes. According to feminists as diverse as Sandra Harding, Alison Wylie, and Susan Bordo, marginalization on the basis of Sex and gender is one thing that all women qua women share even though some women. might also be marginalized, or might even be privileged, with respect to race or class, Of course, the objection can be made that marginalization is not what makes women women. But that is exactly the point: women are indeed a marginalized group but it is social conditions, and not nature, that marginalize them. In other words, marginalization is not the ontological essence of women. Rather, it is a socially constructed, and hence, contigent essence.
We need to be able to acknowledge that androcentrism assigns an essence to women while denying that this is a real essence; we also need to acknowledge that marginality is a real commonality among women while denying that marginality is the real essence of women. Androcentrism naturalizes the essentialism it assigns women by positing it as a real essence but feminist theory enables us to see that this essentialism is assigned and hence, nominal. The consequent marginalization is quite real but it is not the essence of women nor is the gender essentialism that marginalizes women based on a real essence, Women are indeed a marginalized group but it is not nature that marginalizes them; androcentric social conditions make them a marginalized group.

... What women are apart from this. socially constructed essence assigned by androcentrism remains an open question. I find marginalization a particularly powerful term because it describes not only sexism which affects all women, but other forms of oppression and exclusion that some women suffer as well. In other words, we will have a better chance of understanding the oppression of women in its “endless variety and monotonous similarity”, to use Gayle Rubin's well- known phrase, if we acknowledge the ubiquity of marginalization without absolutizing any of the forms it historically or currently takes. Politically, we can do justice to the similarity of women (without riding roughshod over their differences).

We need to preserve our gender identities “as a source of political unity and alternative vision” : indeed, considering the society in which we live, it is impossible not to be conscious of gender. But this does not preclude the destruction of gender prescriptions. In fact, perhaps we need to confess that we too often make careless generalizations based on the categories we use.

... Marginalization is not an inevitable commonality among women; indeed, the political hope is that some day it will not be common to women at all. But, in the meantime, feminists need not rely on a reified essentialism that elides the differences of race, class, and so on. While we cannot predict in advance what future gender identities will look like, we can, to paraphrase Harding, analyse these essentialisms, focate their historical conditions, and propose ways to counter them.

পাঠকদের ধৈর্যের ওপর বোধহয় একটু বেশিই চাপ দিয়ে ফেললাম, কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটি পড়তে গিয়ে Janet C. Wesselius –এর প্রবন্ধটির কথা বলে নেওয়া খুব দরকারি বলে মনে হলো। প্রবন্ধটির নাম : ‘Gender Indentity Without Gender Prescriptions : Dealing with Essentialism and Constructionism in Feminist Politics’. একেবারে আজকের দিনের নারীচিন্তক তথা নারী দার্শনিকরা কী ভাবছেন এই ‘Essentialism’ নিয়ে সে কথার কিছু কিছু চিন্তাংশ অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতার বইটি পড়লে মনে জাগরিত না হয়ে পারে না। এই প্রসঙ্গে আরও একটি প্রবন্ধের সামান্য একটু উল্লেখমাত্র করেই সরে যাব — তার আগে সে প্রবন্ধটির নাম উল্লেখ করি : LUCE IRIGARAY AND ‘THIS SEX WHICH IS NOT ONE’। সে প্রবন্ধ শুরু হচ্ছে কীভাবে তার সূচনাটুকু পাঠককে জানিয়ে দিই।

Luce Irigaray. like Hélène Cixous, follows the thinking of post- structuralist theorists in asking questions about the relationship between language and bodies, specifically male and female bodies and masculine and feminine language. Like Cixous, she focuses on the female body and how it has been constructed in phallogocentric systems like Freudian and Lacanian psychoanalysis. Irigaray. however, discusses the question of a female or feminine sexuality in more depth than Cixous; she wants specifically to explore the ques- tion of a feminine jouissance and what that might be when defined on its own terms, in reference to the female body only.

‘Female sexuality has always been conceptualized on the basis of masculine parameters’, Irigaray declares in the first sentence of her essay ‘This Sex Which Is Not One’.

আমার তুলে দেওয়া অংশটিতে একটি শব্দ অচেনা লাগতে পারে। শব্দটি হলো ‘Jouissance’, শব্দটি ফরাসি। এর অর্থ ইংরেজিতে Physical or intellectual pleasure, delight, or ecstasy. এই ‘Jouissance’ শব্দটিই হচ্ছে অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতা বোঝার পক্ষে একটি জরুরি সূত্রপথ। তেমনই জরুরি, আগের প্রবন্ধটির মতোই।

এই কাব্যগ্রন্থটি পড়তে গেলে পরপর ছন্দের কবিতা আসতেই থাকে। বিভিন্ন ছন্দ। হঠাৎই মাঝখানে দেখা দেয় পাশাপাশি দু'টি পৃষ্ঠায় দু'টি ছন্দমুক্ত কবিতা, প্যারাগ্রাফের মতো সাজানো। অর্থাৎ, ‘ফ্রি ভার্সে’র মধ্যে নিজের লেখাকে ফেলে দিয়েও অমৃতা ভট্টাচার্য পরীক্ষা করে দেখেছেন। কবিতা রচনার সম্ভাব্য সমস্ত পথই তিনি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে প্রয়োগ করে বুঝতে চেয়েছেন নিজের সামর্থ্যকে। হ্যাঁ, সনেট তিনি লেখেননি, ঠিকই। অথচ ১৮ মাত্রার কবিতা পরপর লিখে গেছেন সমমাত্রিকতা বজায় রেখে, যেখানে শেষ ৩ লাইনে ২ টি অন্ত্যমিল অথবা শেষ ২ লাইনে ২ বার অন্ত্যমিল প্রয়োগ করেছেন। পুরো কাব্যগ্রন্থটি পড়লে বোঝা যায় যেহেতু, ১৯৮২ সালে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের ‘রাত্রি চতুর্দশী’ নামক বিখ্যাত সনেট সংগ্রহটি প্রকাশের পর বাংলা ভাষায় যাঁরাই কবিতা লিখতে এসেছেন তাঁদের অন্তত আশি ভাগ কবিতা লেখক ওই সনেট সংগ্রহটির দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে একের পর এক সনেট লিখে গেছেন — তাই সযত্নে অমৃতা বিভিন্ন রকম মিল বিন্যাসের সনেট রচনার পথটি পরিহার করেছেন। বদলে, ওই যা একাধিকবার বলেছি সে কথারই পুনরুক্তি করে জানাই যে, পিতামহ ও প্রপিতামহপ্রতিম কবিরা যে রচনা আঙ্গিক একবার মাত্র ব্যবহার করে দ্বিতীয় বার আর ব্যবহার করেননি সেইসব অপ্রচলিত ও জটিল ছন্দচলন ও মিলবিন্যাস আশ্রয় করেছেন। কেননা তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনেও যেমন তিনি তাঁর একক সত্তাকে উদযাপন করতে চান — কবিতার ফর্ম নির্বাচনেও সেই পথেই গেছেন। একক সত্তার উদযাপন? কীভাবে? অমৃতা ভট্টাচার্য যেহেতু একজন নারী তাই এই উদযাপনও তাঁর একক নারী সত্তাটির জয়গাথার মন্ত্রোচ্চারণ হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে আমরা আর একটি কবিতা ব্যবহার করব, আমাদের আজকের আলোচনায়।

রজস্বলা

ভোরের আজান সাঁতরে পেরোও দু-তিনটে খড়কুটো
স্রোত চেয়েছিল ভাসিয়ে রাখতে প্রশ্রয় একমুঠো

পুরাণ হাজার জ্বালিয়ে দিয়েছে রক্ত-মাংস নারী
দেবীর অসুখে আটকে আগুন, ছাই মানবীর বাড়ি

ধর্মান্তর কিংবা ভুলের উল্লাস আনাগোনা
নদীতে জোয়ার এলেই নদীর স্বপ্ন আকাশগোনা

জলের তখন অশ্বিনী-মঘা, বিরোধে মুকুট ধারণ
মানবী গুনছে রক্তের মাপ, রজস্বলার বারণ

জ্বলছে, কারণ, উন্মন কোণ — এ রক্ত অজুহাত
মূলত যৌন, শূর্পণখার নাক কাটা সংঘাত

মূল্য তোমার দেবীকর্ষণে, পবিত্র নষ্টামি
আদিমের স্রোত ভাগাভাগি যদি, ওহে অন্তর্যামী

ইগল শরীর, সূর্যের কাছে — কায়া ? নাকি দেবালয় ?
টাটকা রুধির, ধোঁয়ার আড়াল, অনন্ত সংশয় —

তবু যদি কিছু অধীর, নিষেধ, স্পর্ধার সংলাপ
ঋণ রেখে দিয়ো, জমাট ভ্রূণের স্রোত হারানোর পাপ।

পাঠক দেখতেই পাচ্ছেন কবিতাটির শিরোনাম : ‘রজস্বলা’। এখানে তিনটি কথা বলবার। প্রথমত, কোনও কন্যা যখন রজস্বলা হয় তখন সেই চারদিন সেই কন্যাকে কোনও পূজার উপচার স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না। সে যেন তখন অশুচি। অথচ নারী যদি রজস্বলা না হয় তা হলে সে জন্ম দেবে কী করে? কী করে চলমান থাকবে সৃষ্টি? সেইজন্যই অন্য একটি কবিতায় অমৃতা লেখেন : ‘আমার সে অমোঘ ঋতুরঙ’ লাইনটি। অর্থাৎ নারী রজস্বলা অবস্থায় কখনও অশুচি নয়, অপবিত্র নয়। তাহলে তো সমগ্র নারী জীবনকেই অশুচি ঘোষণা করতে হয়! অমৃতা ভট্টাচার্য তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে, নারীকে রজস্বলা অবস্থায় অশুচি-অপবিত্র ঘোষণা করার সমাজ প্রথার বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু কোথাও উচ্চকিত নয় সেই বিরোধ স্বর।

এবার দ্বিতীয় কারণটিতে আসি। এক্ষুনি যে কবিতাংশ উল্লেখ করেছি, ‘আমার সে অমোঘ ঋতুরঙ’ — সেই বাক্য কোন কবিতায় রয়েছে? ‘কৃষ্ণার প্রতি’ নামক কবিতা সিরিজের প্রথম কবিতাটিতেই এই বাক্য পাওয়া যাবে। কেননা কৃষ্ণা অর্থাৎ দ্রৌপদীকে যখন প্রকাশ্য রাজসভায় টেনে আনা হলো তখন দ্রৌপদী বা কৃষ্ণা ছিলেন রজস্বলা অবস্থায়। তাহলে ‘রজস্বলা’ নামক কবিতাটি অমৃতা ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থে আচমকা এসে পড়েনি। আগে একথাও বলেছি ভীষ্মের প্রতি রচিত একটি দীর্ঘ কবিতা জায়গা পেয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। শুধু ‘কালী’, ‘মহেশ্বর’, ‘অমারাত্রি’, এই সকল অনুষঙ্গই নয়, এসেছে মহাভারতও, স্পর্শ করেছে এই কাব্যের বিষয়কেন্দ্র। সেইজন্যই ‘আদিগন্ত শোক তার, অনশন কৃষ্ণলোভাতুর!’ এই লাইনটি ‘কৃষ্ণার প্রতি’ উদ্দিষ্ট প্রথম কবিতাটির অন্তিম লাইন রূপে আমরা দেখতে পাই। রজস্বলা অবস্থার মধ্যেও দ্রৌপদীকে রাজসভায় আসতে তো বাধ্য করা হয়েই ছিল সেই সঙ্গে তার বস্ত্রহরণ করে চরম অপমান করাও হতো যদি কৃষ্ণ অন্তরীক্ষ থেকে ‘অন্তহীন শাড়ি’ সরবরাহ না করে যেতেন।

এইবার আমরা আসব এই কাব্যগ্রন্থের ‘রজস্বলা’ নামক কবিতাটির অবস্থান-বিষয়ক মূল কারণটিতে। পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন এতক্ষণ ধরে আমি কাব্যগ্রন্থটি বিষয়ে কথা বলছি অথচ একবারও বইটির নাম উচ্চারণ করিনি। ইচ্ছে করেই করিনি। কেননা আমার সমস্ত কথা বলার শেষাংশে এসে আমি এই কাব্যের নাম আপনাদের জানাচ্ছি। অমৃতা ভট্টাচার্য, তাঁর কবিতার বইটির নাম দিয়েছেন : ‘রজস্বলা’। বাংলা ভাষায় এমন অনেক নারীবাদী কবিরা এসেছেন যাঁরা নিজের কাব্যসামর্থ্যে অত্যুজ্জ্বল মহিমায় স্থায়িত্ব পেয়েছেন কাব্য জগতে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তাঁদের কেউ কেউ নিতান্ত অকালেই প্রয়াণ লাভ করেছেন যদিও তাঁদের রচনা চিরজীবিত আছে। আর কেউ কেউ এখনও নিজ নিজ সৃষ্টি-আলোকে উদ্ভাসিতা। কিন্তু ঘটনাচক্রে, কেউই নিজের কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রজস্বলা’ রাখেননি। অন্তত বাংলা কবিতায় আমার অত্যল্প পাঠ অভিজ্ঞতার মধ্যে ‘রজস্বলা’ নামক কোনও কবিতার বই পড়েছি বলে আমার স্মরণে আসছে না। নারী কবিদের রচনায় তাঁদের ঋতু প্রসঙ্গ অবশ্যই এসেছে কারও কারও ক্ষেত্রে, কিন্তু বইয়ের নামকরণে ‘রজস্বলা’ এই শিরোলেখ কখনও প্রযুক্ত হতে দেখিনি। একটি কাব্যগ্রন্থ আরম্ভ হয় কোথা থেকে? সেই কাব্যগ্রন্থের প্রথম শব্দ থেকেই তো? তাহলে, যে কোনও কাব্যের প্রথমেই আমরা কী পাঠ করি? পাঠ করি তার নামকরণটি। সেই দিক দিয়েও অমৃতা ভট্টাচার্যের এই ‘রজস্বলা’ কাব্য এক দীপ্তিময় ব্যতিক্রম। বইয়ের পাতা উল্টে গেলে প্রথম কবিতায় পৌঁছনোর আগে, এমনকী সূচিপত্রের আগেও, আমরা কী দেখি? দেখি উৎসর্গ পত্রটি। এই ‘রজস্বলা’ কাব্যের উৎসর্গ পত্রটি দু'ভাগে বিভক্ত। প্রথমে রয়েছে একটি চারলাইনের কবিতা। তারপর আমরা দেখতে পাই একটি মোটিফ, যা প্রকাশক কর্তৃক অলংকরণ হিসেবে ব্যবহৃত। মোটিফের নীচে খানিকটা স্পেস দিয়ে রাখা হয়েছে তিনটি ইংরেজি লাইন — যার লেখক অমৃতা ভট্টাচার্য নন, যা মূলত এক উদ্ধৃতি। আমি উৎসর্গ পত্রটির দু'টি বিভাগ পাঠকের সামনে অবিকল তুলে দিচ্ছি :

“প্রাচীন রজস্বলা। ‘প্রাচীনা’ বলতে হত ? জানি না।
রক্তক্ষরণ দৃশ্যমান সব? কত দূর? প্রতি স্রোতে ডুবে যায় চাঁদ —
ভাটা এলে পূর্ণিমা হয়। প্রস্রবণ ... প্রস্রবণ শুধু ...
# #
রজস্বলা এক অনন্ত ধারণ ...”

এরপর উৎসর্গ পৃষ্ঠায় আছে মোটিফ ও স্পেস। তারপর আসছে গদ্যে লেখা তিনটি ইংরেজি লাইন :

“There was a choral thing that began to occur, a kind of
wild collective song ... I let the voices bleed into
one another. I got lost in the bleeding ...”

[The Vagina Monologues : Eve Ensler]

আমি এখানে প্রথমেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এই অনন্য সাধারণ উৎসর্গ পত্রটির মধ্যে একটি ছাপার ভুল থেকে গেছে। ভুলটি কী? ‘I let the voices bleed into one another’ এই লাইনটিতে ‘let’ কথাটি নেই উৎসর্গ পত্রে — ছাপা হয়েছে ‘I left’। মূলগ্রন্থে ‘I let’ কথাটি অমৃতার উৎসর্গ পত্রে ‘I left’ হিসেবে ছাপা হওয়ায় মূল অর্থটি পুরোপুরি বদলে যায়। আমার কাছে মূল বইটি আছে তাই আমি নির্ভুল উদ্ধৃতিটি পাঠকের সামনে তুলে দিতে পারলাম।

‘Eve Ensler an internationally bestselling author and Tony Award-winning playright whose theatrical works include the Obie Award-winning The Vagina Monologues, as well as Necessary Targets’.

এই ‘নেসেস্যারি টার্গেট’ পড়ে দেখেছি ইভ্ এন্সলার ‘নেসেস্যারি টার্গেট’ বলতে বুঝিয়েছেন কাদের? নারীদের। পিতৃতান্ত্রিক সমাজশাসনে নারীরাই ‘নেসেস্যারি টার্গেট’। আর অমৃতা ভট্টাচার্য ইভ্ এন্সলারের যে লাইনগুলির আংশিক উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন তাঁর ‘রজস্বলা’ কাব্যের উৎসর্গ পৃষ্ঠায়, আমি সেই অংশটি পুরোটাই তুলে দিচ্ছি। তার আগে জানাই একবার আমেরিকার একটি শহরে ইভ্ এন্সলার এই ‘The Vagina Monologues’ বইটি থেকে একক পাঠ অভিনয় করছেন কালো পোশাক পরে মঞ্চে বসে, দু' পাশে দুটি মাইক্রোফোন নিয়ে — এমন এক সন্ধ্যায় আমি দর্শক হিসেবে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে অনুষ্ঠানের শেষে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে ফিল্ড ওয়ার্ক বা ক্ষেত্রসমীক্ষা বলতে যা বোঝায় তা করেই এই বইটি তিনি লিখেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তার মধ্যে আছে, কিন্তু শুধু ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে রচনা কার্যে প্রবৃত্ত হননি তিনি। কথাগুলির সত্যতা বোঝা যায় যদি অমৃতা ভট্টাচার্য উদ্ধৃত লাইনগুলির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে পাই আমরা। যা ইভ এন্সলার লিখিত মূল গ্রন্থে আছে :

“I interviewed many women about menstruation. There was a choral thing that began to occur, a kind of wild collective song. Women echoed each other. I let the voices bleed into one another. I got lost in the bleeding.”

এখানে নারীর ঋতুকালীন রক্তপাত একটা ভয়েস হয়ে গেছে। হয়ে গেছে ‘কালেকটিভ সঙ’। সমস্ত নারীর ঋতু রক্তপাত যেন চিরকালীন এক বন্য বৃন্দগানের মতো একাকার হয়ে যায় — লেখিকা সত্তা ভেসে চলে সেই সংগীতের স্রোতে। ইভ এন্সলারের বইটি থেকে আরও দু' একটি জায়গা পাঠকদের জানাতে চাই। একটি অধ্যায়ের নাম : ‘MY VAGINA WAS MY VILLAGE’ (For the Women of Bosnia), অধ্যায়টি শুরু হচ্ছে এইভাবে :

“My vagina was green, water soft pink fields, cow mooning sun resting sweet boyfriend touching lightly with soft piece of blond straw.
There is something between my legs. I do not know what it is. I do not know where it is. I do not touch. Not now. Not anymore. Not since.
My vagina was chatty, can’t wait, so much, so much saying, words talking, can’t quit trying, can’t quit saying, oh yes, oh yes.”

ইভ এন্সলারের বইটির নামকরণ থেকেই বোঝা যায়, নারী শরীরের ওই বিশেষ প্রত্যঙ্গটি যদি কথা বলতে পারত তাহলে তার স্বগতোক্তি কী প্রকার হতো! নারীর ওই বিশেষ প্রত্যঙ্গটি দেশে-দেশে ইতিহাসধারায় বারবার পুরুষের আক্রমণের লক্ষ্য ও শিকার হয়েছে। মাত্রই কয়েক বছর আগে, ‘অসম রাইফেলস্’-এর বন্দুকধারীরা মণিপুরের বিপ্লবী নারী মনোরমাকে ওই বিশেষ প্রত্যঙ্গেই গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তার আগে অবশ্যই মনোরমাকে ধর্ষণ করতে ভোলেনি তারা। এই বিষয় নিয়ে ‘আরশিকথা’ নামে অমৃতা ভট্টাচার্য একটি দৃপ্ত প্রতিবাদমূলক কবিতা লিখেছিলেন ২০১৮ সালে যেখানে মণিপুর নামক পার্বত্য এলাকাটি পুরোটাই তার চড়াই-উতরাই-খাদ নিয়ে একটি অত্যাচারিত কিন্তু হার-না-মানা নারীশরীরে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই কবিতার শেষ দু'টি শব্দ হিসেবে কী প্রযুক্ত হতে দেখেছিলাম আমরা? ‘আমি ভারতবর্ষ’। অর্থাৎ শুধু মণিপুর নয় সমগ্র ভারতবর্ষই যেন কথা বলে উঠেছিল নিহত মনোরমার স্বরে। এবার আমরা আবারও ‘The Vagina Monologues’- এর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ইভ এন্সলারের উক্ত বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম : ‘MY ANGRY VAGINA’. অধ্যায়টির প্রথম কয়েকটি লাইন এইরকম :

“My vagina’s angry. It is. It’s pissed off. My vagina’s furious and it’s need to talk. It needs to talk about all this shit. It needs to talk to you. I mean, what’s the deal? An army of people out there thinking up ways to torture my poor-ass, gentle, loving vagina... Spending their days constructing psycho products and nasty ideas to undermine my pussy. Vagina motherfuckers.”

এখানে ফুটে বেরোচ্ছে ওই প্রত্যঙ্গটির সদর্থক ক্রোধ। ‘The right side anger’. বাংলায় এমন অনেক কবিতা লেখা হয়েছে যার মধ্যে নারী-ক্রোধ জ্বলমান অত্যন্ত সংগত দহনে। যেমন কবিতা সিংহ ঈশ্বর ও শয়তান — এই দু'টি চরিত্রকে বিষয় করে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন, মনকে আমূল বিদ্ধ করার মতো কবিতা। সেই লেখার শেষে ঈশ্বর ও শয়তান বিষয়ে এই বিচার দিয়েছিলেন কবিতা সিংহ তাঁর কবিতার লাইনে : ‘দুটোই পুরুষ!’ এবং মনে রাখা দরকার এই শেষ লাইনটির আগে একটি স্পেস ব্যবহার করেছিলেন তিনি। অমোঘ স্পেস।

আমরা ফিরে আসি অমৃতা ভট্টাচার্যের কাছে। একদিকে যেমন তিনি ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্য, গীতা শ্লোক ও তন্ত্রাচার তাঁর ব্যবহারে এনেছেন কবিতা রচনার ক্ষেত্রে তেমনই বইয়ের একেবারে সূচনায় ইভ এন্সলারের ঋতুরক্ত বিষয়ক লাইনগুলি তুলে দিয়ে আন্তর্জাতিক নারীচিন্তক ও নারী দার্শনিকদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করেছেন নিজ কবিতা চিন্তার। অবশ্য, আমার এই রচনাটি এত দীর্ঘাকার হয়ে উঠছে কারণ অমৃতার এই ‘রজস্বলা’ কাব্য পড়তে-পড়তে আমার মন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়েছে কেননা এই কাব্যে চিন্তাবীজ বহুগামী। কিন্তু এতক্ষণ ধরে কেই বা পাঠ করে চলবেন এই কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে আমার এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিবরণ!

ইভ এন্সলারের উদ্ধৃতির ঠিক উপরে অমৃতা ভট্টাচার্য তাঁর কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় নিজের যে ৪ লাইনের ক্ষুদ্র কবিতাটি ব্যবহার করেছেন তার কোনও তুলনা হয় না। ‘রজস্বলা’ কাব্যের ওই ক্ষুদ্র উৎসর্গ শ্লোকটির শেষ লাইন হলো : ‘রজস্বলা এক অনন্ত ধারণ...’ ‘ধারণ’ শব্দে গর্ভধারণ তো বোঝায়ই, সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ করাও বোঝায়। বসুন্ধরাও তো ঋতুমতী হন। নইলে পুরাণে যে সীতার জন্ম বৃত্তান্ত বলা আছে তা সম্ভব হতো কীভাবে? ভারতীয় পুরাণ, ক্লাসিক্যাল ইউরোপিয় রচনা আঙ্গিক (সনেট ব্যতীত), সাম্প্রতিক নারী চিন্তাবিদগণের ভাবনাসূত্র সর্বোপরি নিজ জীবনের স্বাধীন উদযাপনের প্রতি প্রবাহিত হয়ে চলেছে এই রজস্বলা কাব্য। বহুমাত্রিক অর্থস্তর, কাব্যভাষার বিমূর্ত বহমানতা, পরাবাস্তবের আগ্নেয়-অস্তিত্ব, বাসনাদৃপ্ত অবচেতনের উৎসারণ এ-কাব্যকে থেকে থেকেই প্রজ্জ্বলন দিয়েছে। বাল্মীকির প্রথম শ্লোকে ছিল ‘কামমোহিতম্’ শব্দটি। কোথাও কোথাও অমৃতার এই ‘রজস্বলা’ কাব্য সেই ‘কামমোহিতম্’ শব্দটির মুগ্ধ-পরিচয় সমূলে প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না।

‘অরূপ যত হোমের কাঠ শোনে
ঊরুসন্ধি এবার ঢালো ঘৃত’

ঠিক এরপরেই এই কাব্যের রচয়িত্রী নারী, মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলতে পারেন তাঁর কবিতায় : ‘অগ্নি আমি...’

এই মুহূর্তে যাঁরা কবিতা রচনা করে চলেছেন শুধুমাত্র তাঁদের মতামতের দিকে না তাকিয়ে যদি অমৃতা ভট্টাচার্য নিজের পাঠ পরিশ্রম এবং আপন-জীবন-অভিজ্ঞতাকে একত্রে মিলিয়ে চলতে পারেন এইভাবে, তাহলে এই কবির ভবিষ্যৎ রচনার দিকে আমরা সাগ্রহ-শ্রদ্ধায় তাকিয়ে থাকতে পারি।

আমি এই ‘রজস্বলা’ কাব্যের প্রকাশককে বাংলা কবিতার একজন পাঠক হিসেবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদই জানাতে চাই। সম্পূর্ণ মুদ্রণ প্রমাদবিহীন পুস্তক বাংলা ভাষায় খুব কমই ছাপা হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছাপার ভুল থাকলেও এক নবীন কবি প্রতিভাকে যতটা যত্ন এবং সম্মানের দ্বারা পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করানোর আন্তরিক চেষ্টা করেছেন এই প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা প্রতিভাস, সে-জিনিস নিশ্চয়ই সাধুবাদ যোগ্য। এই প্রকাশনা সংস্থার বাংলা কবিতার বই প্রকাশে কিছু বহুমূল্য অবদান আছে। প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে, এই প্রকাশনা থেকে অত্যন্ত নয়নশোভন রূপে প্রকাশ পায় আটের দশকের এক প্রধান প্রতিনিধি স্থানীয় কবি জয়দেব বসু রচিত ‘মেঘদূত’ কাব্যগ্রন্থ। সেই বই-ই ছিল জয়দেব বসুর প্রথম কবিতাগ্রন্থ। তারও স্বল্প কিছুদিন আগে আটের দশকেরই আরও এক উজ্জ্বল কবিজ্যোতিষ্ক মল্লিকা সেনগুপ্তের বই ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’ প্রকাশ করে এই সংস্থাই। সেই বই ছিল মল্লিকা সেনগুপ্তের প্রথম পূর্ণাঙ্গ একক কাব্যগ্রন্থ। এই দুই কবি আজ প্রয়াত কিন্তু এই দু'টি গ্রন্থই বাংলার কাব্য ইতিহাসে স্থায়ী কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই সূত্রেই বলা যায়, নবীন কবি প্রতিভা চিনে নিতে এই প্রকাশনা পূর্বেও তার অভ্রান্তির প্রমাণ রেখেছে।

পুনশ্চ : মহাভারতের বনপর্বে অগ্নির সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের পরিচয় করাতে গিয়ে ঋষি বলেছিলেন : ‘যে অগ্নি আশ্রম রক্ষা করেন, তিনি বৈশ্বানর; যে অগ্নি বিবাহকালে বধূর সঙ্গে পিত্রালয় থেকে শ্বশুরালয়ে আসেন তাঁর নাম দক্ষিণ অগ্নি; আর যে অগ্নি আত্মাকে দহন করে প্রজ্জ্বলিত হন, তিনি কবি। অর্থাৎ মহাভারত কী বলছে? বলছে, কবি আসলে এক অগ্নির নাম! অমৃতা ভট্টাচার্য তাঁর ‘রজস্বলা’ কাব্যের শেষ কবিতায় যে লিখছেন : ‘অগ্নি আমি ...’ সে তাঁর নারী পরিচয় তো বটেই— একই সঙ্গে তাঁর কবি পরিচয়, নিশ্চিতভাবেই — এবং এইখানেও অমৃতা পুনর্বার প্রয়োগ করেন মহাভারতকেই।

 

ঋণ : হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, রাজশেখর বসু, শাঁওলী মিত্র, ঋতুপর্ণ ঘোষ।

More Articles