মৃত্যুর মুখোমুখি কি কবিতা হাতে দাঁড়ানো যায়? জয় গোস্বামী

এই যে দেড় বছর সময় পার হয়ে এলাম আমরা, এ যেন এক বন্দি জীবনের মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ। যেন এক জেলখানার বাসিন্দা আমরা। জেলখানার মতোই মেনে চলতে হচ্ছে বিভিন্ন কঠোর নিয়ম। মুখ ঢেকে রাখতে হচ্ছে সব সময়, মাস্ক দিয়ে। শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও ওই মুখোশ পরে থাকাই অন্যতম প্রধান বিধি। কেউ কারো কাছাকাছি বসতে পারছি না। দূরত্ববিধি মানতে তো হবেই। নাটক দেখার নেশা ছিল আমার, ঝোঁক ছিল গানের অনুষ্ঠান শোনার। আজ কত দিন হল তার সমস্তই বন্ধ রাখতে হয়েছে।

কিন্তু এই যে এত সব বিধিনিষেধ-- এর পিছনে আছে প্রত্যক্ষ মৃত্যুভয়। যে-মৃত্যু এই দেড় বছর ধরে বার বার হানা দিয়ে চলেছে। যাঁরা আমাদের নিকটজন, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন নিজেদের শিল্পপ্রতিভা দিয়ে, চিন্তাশক্তি দিয়ে, শিক্ষকতা দিয়ে- তাঁদের অনেককে একে একে তুলে নিয়ে গিয়েছে মৃত্যু।

২০২০-র মে মাসে চলে গেলেন দেবেশ রায়। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যে একটি অনন্য স্টাইলের স্রষ্টা ছিলেন। তার প্রমাণ তাঁর গল্প, উপন্যাসের মধ্যে আছে। সেই সঙ্গে দেবেশ রায়ের ছিল একটি সম্পাদক সত্তা। জীবনানন্দের রচনাবলী খন্ডে খন্ডে প্রকাশেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। প্রয়াণের কয়েক বছর আগে প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন ‘সেতুবন্ধন’ পত্রিকা। সেখানে একেবারে তরুণ গল্প-লেখকদের তুলে ধরতেন।

দেবেশ রায়ের মৃত্যুর পরেই জুলাই মাসে চলে গেলেন দেবেশ রায়ের একান্ত নিকট বন্ধু অরুণ সেন। তিনি, তার সারাজীবন নিবেদন করেছিলেন কবি বিষ্ণু দের প্রতি। একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন অরুণ সেন, তখন থেকে বিষ্ণু দের কবিতা নিয়ে একের পর এক প্রবন্ধ লিখে গেছেন – পরে লিখেছেন বিষ্ণু দে বিষয়ে গ্রন্থের পর গ্রন্থ। 'বিষ্ণু দে: এ ব্রত যাত্রায়', যামিনী রায় ও বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ –  সম্পর্ক নিয়ে 'এই মৈত্রী এই মনান্তর', 'স্বভাবে বিষ্ণু দে' এবং একেবারে শেষজীবনে অসুস্থ অবস্থায় বিপুল পরিশ্রমে প্রস্তুত করেছিলেন 'বিষ্ণু দে রচনাপঞ্জি'। বিষ্ণু দে-র কাব্যমর্মকে বোঝার জন্য এই সব বই আমাদের এক বড় অবলম্বন হয়ে আছে।

এর পরের মাসেই, অগাস্টে আমরা হারালাম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তুলনামূলক সাহিত্যের এই ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন অনুবাদের কাজে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে বিপুল পরিশ্রমে তিনি এনে দিয়েছিলেন বাঙালি পাঠকের গোচরে। অ্যান্টি-পোয়েট্রি বা প্রতিকবিতার তাত্ত্বিক পরিচয় আমরা তাঁর কাছেই প্রথম সুনিশ্চিত ভাবে জানতে আরম্ভ করি সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে। তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা বেরত “কালপুরুষ” নামে। তার সম্পাদকের নাম সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত, তিনি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়র এই অনুবাদ ও তৎসম্পর্কিত গদ্য রচনা প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ করতেন। এই সম্পাদককে এখন আমরা ভুলে গিয়েছি। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বহু কবিকে যেমন অনুবাদ করেছিলেন, গার্সিয়া মার্কেস ও হুয়ান রুলফো-র কথাসাহিত্যের বাংলা ভাষান্তরও তাঁরই করা।

২০২০-র নভেম্বরে চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রধান পরিচয়ে অভিনেতা হলেও তিনি ছিলেন একই সঙ্গে নাটককার, গদ্যলেখক ও কবি। বাংলা সংস্কৃতির বহমান ধারায় দীর্ঘদিন ধরেই তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ’৬০-’৭০ দশকের ‘এক্ষণ’ নামক বিশিষ্ট পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন তিনি। আশি বছর পার করেও নিয়মিত অভিনয় করে চলেছিলেন চলচ্চিত্রে এবং মঞ্চে। হঠাৎই কোভিড আক্রমণ করল তাঁকে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে কষ্টদায়ক চিকিৎসা সহ্য করার পর ১৫ নভেম্বর চিরবিদায় নিলেন এই শিল্পী।

সৌমিত্র-প্রয়াণের মাত্র দু-দিন পর, দূর প্রবাসে, জার্মানিতে, জীবতারা খসে পড়ল কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের। সেই কোন কিশোর বয়স থেকে অলোকরঞ্জনের লেখা পড়তে-পড়তে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছি। প্রবন্ধপুস্তক, অনুবাদগ্রন্থ, নাট্যকোলাজ--- এইরকম কত শাখায় নিজের সৃষ্টিকে সঞ্চারিত করেছিলেন তিনি। শঙ্খ-অলোকরঞ্জনের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ কাব্যানুবাদের সঙ্কলনটি এক মহাগ্রন্থ হয়ে এখনও বিরাজমান। আজ এই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও তাঁর নতুন কবিতার জন্য আমার উৎসাহ ছিল একইরকম জাগ্রত। অলোকরঞ্জনের আগামী কবিতার জন্য আমার উদগ্রীব অপেক্ষা নির্বাপিত হল।

প্রয়াত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।

ডিসেম্বরে, ‘দেশ’ পত্রিকার সৌমিত্র স্মরণ সংখ্যায়, নিজের বাল্যবন্ধু ‘পুলু’ বিষয়ে লিখলেন প্রাবন্ধিক, সঙ্গীতবেত্তা, লোকসংস্কৃতির সর্বমান্য গবেষক সুধীর চক্রবর্তী। কিন্তু ওই রচনাই যে সুধীর চক্রবর্তীর জীবনের শেষ লেখা তা কে জানত! বন্ধুকে বিদায় দেওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় প্রয়াণ ঘটল তাঁর। এই সব মানুষের কোনো বিকল্প হয় না।

তবে এ-বছর, ২০২১-এর এপ্রিলে, যে আঘাত এল, বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে সে-আঘাত চরমতম। আমি কোভিডের দ্বিতীয় ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য একটি হাসপাতালে গেছি। নার্স সূঁচ ঢুকিয়েছেন আমার বাহুতে। বেজে উঠল পাশে রাখা মোবাইল। এল সেই সংবাদ- শঙ্খ ঘোষ আর নেই।

শঙ্খ ঘোষ যে কবি হিসেবে জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিতাধারায় সবচেয়ে বড় কবি ছিলেন সেকথা তর্কাতীতভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে বহুদিন। সেই সঙ্গে তাঁর প্রবন্ধাবলী বাঙালি পাঠককে দিয়েছে বিশেষ ধরনের এক সাহিত্য বিচারশক্তি, যা শঙ্খ ঘোষের নিজস্ব উদ্ভাবন। রবীন্দ্রনাথকে নতুন ভাবে চিনতে শিখিয়েছেন তিনিই, রবীন্দ্রবিষয়ে গ্রন্থের পর গ্রন্থ রচনা করে। কবিতা-সম্পর্কিত তাঁর পুস্তকসমূহ পরবর্তী প্রজন্মের অনেক কবিকে শিক্ষিত ও সংশোধিত হওয়ার রাস্তা দেখিয়েছে। যেভাবে, জীবনপ্রান্তে এসেও তিনি অবিরাম লিখে চলেছিলেন, তা কেবলই উজ্জ্বলতর করে তুলছিল পাঠকের বোধিপ্রদীপ। সমাজ সম্পর্কে তিনি ছিলেন সদা-জাগ্রত প্রহরীর ন্যায় অবিচল। আমার মনে পড়ছে অভিনয় বিষয়ে শম্ভু মিত্রের লেখা ‘সম্পৃক্তি’ প্রবন্ধটির প্রথম দু'টি লাইন: “অভিনয়ের কেন্দ্রে, আমার মনে হয়, একটি সম্পর্কের কথা আছে। মানুষের নিজের কী সম্পর্ক আর তার সমাজের সঙ্গেই বা তার কী সম্পর্ক।” ‘অভিনয়ের কেন্দ্রে’ কথাটি তুলে নিয়ে যদি আমরা কাব্যসাহিত্যের কেন্দ্রে কথাটি বসাই তাহলে দেখব শঙ্খ ঘোষের কবিতা ও প্রবন্ধ একদিকে সমাজের সঙ্গে কবির কী সম্পর্ক তার খোঁজ চালিয়ে গেছে--- অন্য দিকে নিজের সঙ্গে নিজের কী সম্পর্ক তার অনুসন্ধানও করেছে নিরন্তর। তাঁর সারা জীবনব্যাপী সাহিত্য-সৃষ্টির মধ্যে ধরা আছে তারই প্রমাণ।

সেই শঙ্খ ঘোষ আর রইলেন না। বহু বছর ধরে অনেক তরুণ কবির কাছে তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। সমাজজিজ্ঞাসু, রবীন্দ্রমর্মানুসন্ধানীদের কাছে তিনি ছিলেন এক অপরিহার্য পথপ্রদর্শক। শঙ্খ ঘোষকে হারানোর শোক বাংলা সাহিত্য ভুলবে না কোনোদিন।

তাঁর বিদায়ের আটদিন পরেই চলে গেলেন তাঁর সহধর্মিণী প্রতিমা ঘোষ। আমার কাছে এই বিদায় বড় বেশি মর্মান্তিক শোক নিয়ে এল। ৪৫ বছর ধরে এই মাতৃপ্রতিমা আমার জীবনে বড় এক স্নেহচ্ছায়া নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষত আমার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে। প্রতিমা ঘোষ প্রবীণ বয়সে তিনটি বই লিখেছিলেন নিজের দৃষ্টিশক্তির অসীম বাঁধা অতিক্রম করে। স্নেহসিক্ত, মায়াময়, স্মৃতিমধুর সেই বই তিনটি আমি সকলকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। তাঁর প্রবল সাহিত্যশক্তিধর স্বামীর লেখার কিছুমাত্র প্রভাব প্রতিমা ঘোষের রচনায় আসেনি। এই দু’জন মানুষকে হারানোর শোক আমাকে আজীবন বহন করে চলতে হবে।

এই দু’জন মানুষকে হারানোর শোক আমাকে আজীবন বহন করে চলতে হবে।

এই বছরই জুন মাসে চলে গেলেন কবি গৌতম বসু। বাংলা কবিতার ভাষাকে তাঁর কলম এক নতুন স্বর দিয়েছিল। ক্রমশ বড় হয়ে উঠছিল তাঁর তরুণ অনুরাগীদের বৃত্ত। এই সময়েই তাঁর অন্তর্ধান। তাঁর প্রবন্ধেও এক গভীর চিন্তাশীলতার পরিচয় পাই আমরা। ফুসফুসে কষ্ট ছিল তাঁর। তবু নাকে অক্সিজেনের নল নিয়েও গৌতম বসু লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ বিষয়ে এক স্মরণীয় গদ্য। সেইটি তাঁর জীবনের শেষতম রচনা।

বুদ্ধদেব গুহকে আমরা হারালাম এরপরেই। অসংখ্য পাঠক-পাঠিকার মুগ্ধতা জয় করা এই লেখকের প্রয়াণ এক শূন্যতার সৃষ্টি করল সাহিত্যে।

সেপ্টেম্বর মাসে প্রয়াত হলেন অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী। বাংলা কবিতার এত বড় বন্ধু আমরা কমই পেয়েছি। বিভিন্ন কবি সম্পর্কে স্বপন চক্রবর্তী-প্রদত্ত স্মারক বক্তৃতাসমূহ, কবিতা বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধাবলী এই চিন্তককে অনন্য করেছিল। কবিতাকে ভরকেন্দ্রে রেখে স্বপন চক্রবর্তীর শেষ প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে ‘কলকাতা ২১’ পত্রিকায়- এখানে বলা দরকার গত কুড়ি বছরে বাংলায় নতুন যত পত্রিকা প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যে এই পত্রিকাটি সবচেয়ে উচ্চমানের। স্বপন চক্রবর্তীর কলম ইংরাজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই ছিল স্বচ্ছ ও সাবলীল। যে কোনও বিপন্নতায় তাঁর ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতেন এই শিক্ষক।

কোভিডের আতঙ্ক আমাদের জনজীবনে যে সর্বব্যপ্ত বিচ্ছিন্নতা ও ভয়াবহতা তৈরি করেছে তা কিন্তু এসেছে খুব নিঃশব্দে। মৈনাক বিশ্বাস ও অর্জুন গৌরীসারিয়া পরিচালিত ‘স্থানীয় সংবাদ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের কথা বলছি। এক বসতি উচ্ছেদ করার বৃত্তান্ত বলে সেই ছবি। উচ্ছেদের কথা প্রথমে বসতির অভিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। ফিল্মের একদম শেষে পৌঁছে আমরা দেখি ঘরবাড়ি ভাঙার জন্য বিশাল বুলডোজার আসে। অতিকায় ডাইনোসরের মতো সেই যন্ত্রের হাঁ-মুখ বসতি ভাঙার কাজ করতে থাকে। সেই ধ্বংস-দৃশ্যটি হয়তো এক মিনিট পর্দায় ছিল বড়জোর। ওই বিশেষ এক মিনিটের দৃশ্যটির ব্যাকগ্রাউন্ডে তিলমাত্র শব্দ রাখেননি পরিচালকদ্বয়। কিন্তু বসতি যদি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হয় তবে বিরাট আওয়াজ হওয়ার কথা। বদলে হঠাৎ সম্পূর্ণভাবে শব্দহারা হয়ে যায় ওই ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যটি। যন্ত্রের বিশাল হাঁ-মুখ শুধু খোলে আর বন্ধ হয়। আচমকা সমস্ত আবহ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় যে-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দর্শকের মনে- কোভিড যেন সেই নিঃশব্দ মারণলীলা চালিয়ে যাচ্ছে এখনও। আমি যখন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলাম আমার সামনের বেডে এক ৩৫ বছরের যুবক মারা যায় একেবারে নিঃশব্দে। আমি ফিরে এসেছি। কতজন আর ফিরল না!

আমি ফিরে এসেছি। কতজন আর ফিরল না!

সদ্যই এক সকালবেলা ছড়িয়ে পড়ল কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুসংবাদ।আগের বছরেই তিনি হারিয়েছিলেন স্ত্রী কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়কে। শরৎকুমারের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকারযে-চারজন যুবক একদা মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করতেন তাঁদের কেউ আর রইলেন না।

ধারাবাহিক এই মৃত্যুযাত্রার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় আমার ও এক দিন বিনাশ-মুহূর্ত আসবে।শোক অতিক্রম করে চেপে ধরে নিজ মৃত্যু-যন্ত্রণার ত্রাস। তার মুখোমুখি কি কবিতা হাতে দাঁড়ানো যায়? জানি না। ঘরে বসে শুধু সেই চেষ্টাই করে চলি।

More Articles