চার পায়ে হাঁটা থেকে কাঁচা মাংস খাওয়া, কেমন ছিল বাস্তবের মোগলি

Jungle Book: জেনে নেওয়া যাক, বাস্তবের মোগলির কাহিনি, যাকে সত্যিই নেকড়েরা লালনপালন করেছিল।

১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর ‘দ‍্য জাঙ্গল বুক’ বইটি। কিন্তু ভারতে ‘দ‍্য জাঙ্গল বুক’ এবং এর মুখ্য চরিত্র মোগলি জনপ্রিয় হয় দূরদর্শনে আশা কার্টুন শো-এর দৌলতে। কিন্তু জাঙ্গল বুকের আখ‍্যানের থেকেও বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল মোগলির সেই বিখ্যাত গানটি- “জঙ্গল জঙ্গল পতা চলা হ্যায়...।" গানটি লিখেছিলেন গুলজার। অনেকে যারা জাঙ্গল বুক দেখেনি তারাও এই গানটি শুনেছে। কিন্তু এই গানটি লেখার সময় একটি বিতর্ক তৈরি হয়। গুলজার গানটি নির্মাতাদের দেওয়ার পর নির্মাতারা গুলজারের কাছে একটি আবেদন রাখেন। গানে একটি লাইন রয়েছে, “চাড্ডি পেহেন কে ফুল খিলা হ্যায়, ফুল খিলা হ্যায়।" নির্মাতারা গুলজারকে অনুরোধ করেন দয়া করে গান থেকে ‘চাড্ডি’ শব্দটা সরিয়ে দিতে। বাচ্চাদের গানে 'চাড্ডি' শব্দটা ঠিক ভালো লাগছে না। শোনা যায়, জবাবে গুলজার বলেন, “আপনাদের সিনেমা আপনারা রাখুন, আমার চাড্ডি আমি রাখছি।” গুলজার রাজি না হওয়ায় চাড্ডি-র সঙ্গেই গানটি বেরোয় এবং সুপারহিট হয়। কিন্তু এছাড়াও এর সঙ্গে জড়িয়ে এক অন‍্য ইতিহাস। মনে করা হয়, রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের এই বইটি লেখার অনুপ্রেরণা আসলে একজন বাস্তবের মোগলি। কে সেই বাস্তবের মোগলি, আসুন জেনে নেওয়া যাক।

১৮৬৫ সালে ভারতের বম্বে-তে জন্মগ্রহণ করেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। নিজের আত্মজীবনীতে কিপলিং লিখেছিলেন শৈশবে বম্বে-তে তাঁর আয়া তাকে যে গল্পগুলি শুনিয়েছিলেন, তা তিনি কোনও দিনও ভোলেননি। সারাজীবন সেই গল্পগুলি তাঁর সঙ্গে ছিল। এই গল্পগুলি ছিল পঞ্চতন্ত্র, ঈশপ এবং জাতকের গল্প। এই গল্পগুলিতে জঙ্গলের জীবজন্তুরা কথা বলতে পারত। জাঙ্গল বুকেও আমরা দেখতে পাই, প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে মানুষের ভাষায় কথা বলছে। এই গল্পগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই কিপলিং জাঙ্গল বুকে মানুষের মতো কথা বলা বাঘ, হাতি, ভাল্লুক, নেকড়ে প্রভৃতি জীবজন্তু রেখেছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে লন্ডনে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রুডইয়ার্ড কিপলিং-কে। ১৮৭৭ সালে সেই বোর্ডিং স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁকে। একইরকমভাবে জাঙ্গল বুকে একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে মোগলিকে নেকড়েদের দল থেকে বের করে দেওয়া হবে এবং মানবসমাজও তাকে গ্রহণ করবে না। মনে করা হয়, মোগলির মাধ্যমে নিজের যন্ত্রণার জায়গাটি তুলে ধরেছিলেন লেখক।

আরও পড়ুন: এই ভারতীয়র নামে রয়েছে খুনের বিশ্বরেকর্ড, যার কারণে আজও ভুক্তভুগী ৬ কোটি মানুষ

Rudyard Kipling
রুডইয়ার্ড কিপলিং

১৮৮২ সালে ভারতে ফিরে আসেন কিপলিং। এখানেই নিজের বাকি পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৮৯২ সালে আমেরিকা চলে যান রুডইয়ার্ড কিপলিং। এই সময় তিনি লেখেন জাঙ্গল বুকের প্রথম গল্প। ১৮৯৩ সালে আসে জাঙ্গল বুকের দ্বিতীয় গল্প। ১৮৯৫ সালের এই সব গল্পগুলি একত্রে ‘দ‍্য জাঙ্গল বুক’ বলে সংকলিত করা হয়। এই বইগুলি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান রুডইয়ার্ড কিপলিং। তবে এই গল্পগুলি কিপলিংয়ের হৃদয়ের খুব কাছের ছিল। অন্যদের চোখে এটি সাধারণ গল্প হলেও, কিপলিংয়ের কাছে ছিল নিজের অসুস্থ মেয়ের শেষ ফরমাইশ। নিজের ৫ বছরের ছোট্ট মেয়ের জন্য গল্পগুলি লিখেছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত, মাত্র ৬ বছর বয়সেই অসুস্থতার কারণে ইহলোক ত্যাগ করে রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের কন্যা। শোনা যায়, জাঙ্গল বুক অবলম্বনে একটি নাটকও লিখেছিলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। এই গল্পটি ছিল একটি মানব-শিশুর, যাকে বড় করে তোলে নেকড়েরা। মানুষ এবং পশুর মধ‍্যে মধুর সম্পর্কের এই আখ্যান নিয়ে পরবর্তীকালে দশটির বেশি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, বেশ কয়েকটি কার্টুন শো হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘জঙ্গল জঙ্গল পতা চলা হ্যায়’-এর মতো কালজয়ী একটি গানও। সবই একের পর এক হিট।

Movie scene

'দ‍্য জাঙ্গল বুক' সিনেমার একটি দৃশ্য

তবে এ তো গেল কিপলিংয়ের কাল্পনিক মোগলির কাহিনি। আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক, বাস্তবের মোগলির কাহিনি, যাকে সত্যিই নেকড়েরা লালনপালন করেছিল। ইতিমধ্যেই একটি প্রতিবেদনে আমি আপনাদের ভারতের ঠগীদের ব্যাপারে বলেছি। সেখানে উল্লেখ রয়েছে ব্রিটিশ অফিসার উইলিয়াম স্লিম্যানের। ঠগীদের ভারত থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কৃতিত্ব ছিল এই স্লিম্যানেরই। স্লিম্যান লিখেছিলেন, অওয়াধে অভিযান চালানোর সময় তিনি এমন অনেক শিশুর মুখোমুখি হয়েছিলেন, যারা নেকড়ের মতো চার পায়ে হাঁটাচলা করত। নেকড়ের মতোই আওয়াজ বের করত গলা দিয়ে। তিনি জানিয়েছিলেন, সেই সময় প্রায়শই নেকড়েরা গ্রামে ঢুকে ছোট বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যেত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চাদের তারা খেয়ে ফেললেও এমন কয়েকটি বাচ্চা থাকত, যাদের নিজেদের কাছেই রেখে সন্তানের ন্যায় লালনপালন করত নেকড়েরা। স্লিম্যান জানিয়েছিলেন, এমন এক বাচ্চাকে লখনউয়ের বাজারে এক শাল ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে আসা হয়। ব্যবসায়ীর দোকানের এক কর্মচারী জানায়, রাত্রিবেলা তারা শুয়ে পড়লে সেই দোকানে হাজির হয় দু'-তিনটে নেকড়ে। তারা ওই বাচ্চাটির সঙ্গে খেলা করে আবার রাতের অন্ধকারেই জঙ্গলে ফিরে যায়। শোনা যায়, এরকম কয়েকদিন চলার পর ওই বাচ্চাটি দৌড়ে জঙ্গলে চলে যায়। এরপর আর কোনও দিনও তাকে দেখা যায়নি। স্লিম্যান জানিয়েছিলেন, এই বাচ্চারা নেকড়েদের মতোই চার পায়ে ভর দিয়ে চলে, কাঁচা মাংস খায়, আওয়াজ করে। সভ্যসমাজে নিয়ে এসে এদের মানুষের মতো কাজ করা শেখাতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। এরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায়।

বুলন্দশহরের জঙ্গল থেকে এরকম ৬ জন শিশুকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সকলে ৩ বছরের মধ্যে মারা গেলেও বেঁচে ছিল মাত্র একজন। তার নাম ছিল দিনা শনিচর। ১৮৬৬ সালে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর জেলার জঙ্গলে অদ্ভুত এক জানোয়ারের সন্ধান পান গ্রামবাসীরা। তার পিছনে ধাওয়া করে তাঁরা পৌঁছে যান একটি গুহার কাছে। গুহার কাছে গিয়ে সকলে অবাক হয়ে যান, কারণ প্রাণীটা আসলে ছিল বছরছয়েকের একটি মানবশিশু। ছোট থেকেই সে মানুষ হয়েছে এই জঙ্গলে, একদল নেকড়ের মধ্যে। ছেলেটিকে যখন গ্রামবাসীরা ধরতে এসেছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাধা দিয়েছিল সেই নেকড়ের দল। কিন্তু তাদের প্রত্যেককেই হত্যা করে ছেলেটিকে নিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আগ্রার সেকান্দ্রা মিশন অনাথাশ্রমে। সেখানেই তার নাম রাখা হয় দিনা শনিচর। শনিবার দিনাকে আনা হয়েছিল বলে তার নাম দেওয়া হয় দিনা শনিচর। এরপর সেই অনাথ আশ্রমই হয়ে ওঠে তার বাসস্থান। কিন্তু সেখানেও কারও সঙ্গে মেলামেশা করত না সেই ছেলেটি। কেবল একটি বন্ধু ছিল। তাকেও এক জঙ্গল থেকেই উদ্ধার করে আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই ছেলেটি স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল। মানাতে পারেনি দিনা। তাকে মানুষের ভাষা শেখানো যায়নি। তবে বহু কষ্টে মানুষের মতো দু'পায়ে হাঁটা এবং জামাকাপড় পরা শেখানো গিয়েছিল। আধিকারিকরা জানিয়েছিলেন, দিনা বরাবরই খাওয়ার আগে খাবারের গন্ধ শুঁকত। রান্না করা মাংস খেতে পারত না, বাধ্য হয়েই কাঁচা মাংস খাওয়াতে হতো। দীর্ঘ ২৮ বছরের চেষ্টাতেও সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায়নি দিনাকে। এরপর টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় দিনা শনিচরের।

Dina Shanichar
দিনা শনিচর

রুডইয়ার্ড কিপলিং কখনওই স্বীকার করেননি যে, তিনি দিনা শনিচরের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মোগলির চরিত্রটি বানিয়েছিলেন। তিনি বরাবরই বলে এসেছেন মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল তাঁকে টানত। কর্মজীবনে থাকাকালীন বহুবার তিনি সেই জঙ্গলগুলিতে গিয়েছেন। এই কারণেই জাঙ্গল বুকের প্রেক্ষাপট মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল। এছাড়াও ছোটবেলায় শোনা গল্প তো ছিলই। তবে অনেকে মনে করেন রুডইয়ার্ড কিপলিং আসলে ভারত এবং বুনো শিশু, অর্থাৎ ফেরাল চাইল্ডদের নিয়ে স্লিম্যানের লেখাগুলি পড়েন। একইসঙ্গে দিনা শনিচর এবং কিপলিং যেহেতু সমসাময়িক ছিলেন তিনি দিনার কাহিনি শুনেছিলেন। এই দুইয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিপলিং রচনা করেন মোগলি-র এক অনন্য উপাখ্যান। তবে আমরা ‘দ‍্য জাঙ্গল বুক’-কে এক বাবার নিজের মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের জন্য নির্মিত এক অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে দেখতে পারি, যা আজও সকলের কাছে সমান জনপ্রিয়।

More Articles