আরজি কর সামনে, আগ্নেয়গিরি বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে, কেন বিদ্রোহ?
Junior Doctor's Agitation: আরজি কর কাণ্ডের আবহে বিভিন্ন প্রান্তের মেডিক্যাল কলেজ থেকেই অশান্তির খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্না অব্যহত জুনিয়র ডাক্তারদের। এর মধ্যেই আবার ছাত্রবিক্ষোভের আঁচ উস্কে উঠল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেও। দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে থাকা তাপস কুমার ঘোষকে ডিনের পদ থেকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সেখানকার জুনিয়র ডাক্তারেরা। একই সঙ্গে অশান্তির আঁচ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজেও। সেখানে অমানবিক অত্যাচার, টিএমসিপি ইউনিটের নামে হুমকি ও তোলাবাজির অভিযোগে সরব হন চিকিৎসক-পড়ুয়ারা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজও। আরজি করের আবহে যেভাবে বিভিন্ন জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অশান্তি-বিক্ষেভ শুরু হয়েছে, তাতে স্বাস্থ্য পরিষেবা-সহ একাধিক বিষয় নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
আরজি কর কাণ্ডের আবহে বিভিন্ন প্রান্তের মেডিক্যাল কলেজ থেকেই অশান্তির খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেও। অভিযোগ, টিমসিপির একদল ছাত্রনেতা দিনের পর দিন কোনও অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই ফেল করানোর ভয় দেখায়। মেধাবী পড়ুয়ারা ভালো পরীক্ষা দিলেও টিএমসিপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত আরজি কর কাণ্ডে চর্চায় আসা চিকিৎসক অভীক দে’কে ও তার দলবলের অঙ্গুলিহেলনে ও অধ্যক্ষ, ডিন ও কিছু চিকিৎসকদের সাহায্যে তাঁদের ক্ষেত্রে নম্বর কেটে দেওয়া হতো বলেও অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে টিএমসিপি ইউনিটের নামে হুমকি ও তোলাবাজির অভিযোগে সরব হন চিকিৎসক-পড়ুয়ারা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে।
আরও পড়ুন: ‘আমার কাছে এটাই উৎসব’: জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে যা বললেন তিলোত্তমার মা
তার পর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ১২ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই ১২ জনের মধ্যে তিনজন গ্রুপ-এ অফিসার, তিনজন হাউস স্টাফ, একজন ইন্টার্ন ও পাঁচজন ছাত্র। পাঁচ ছাত্রকে ‘ডিস-কলেজিয়েট’ করা হয়। এরই প্রতিবাদে মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালসের অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে পাঁচ ছাত্র-সহ অন্যান্যরা। মধ্যরাতে প্রবল উত্তেজনা ছড়ায়। চাপের মুখে মাঝরাতে বৈঠকে বসে কলেক কর্তৃপক্ষ। আট সদস্যের বৈঠকে আপাতত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।
এদিকে, এক ব্যক্তি, এক পদ’, এই দাবি তুলে বুধবার আন্দোলন চলেছে বর্ধমান মেডিক্য়াল কলেজে। আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন, সহ-অধ্যক্ষ তথা হাসপাতাল সুপার এবং ডিন অফ স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স কেন একই ব্যক্তি সামলাচ্ছেন? জুনিয়র ডাক্তারদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন অধ্যক্ষ মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, ডিন পদ থেকে তাপসকে অপসারণ না-করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
বিক্ষোভকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন ‘‘কর্তৃপক্ষের মদতে এখানে নানা বেনিয়ম চলেছে। বিরূপাক্ষ বিশ্বাসেরা যথেচ্ছচার করেছেন। গেস্ট হাউস থেকে ক্যান্টিনে নানা অপকর্ম হয়েছে। ডিন হিসাবে এর দায় তাপসকুমার ঘোষ এড়াতে পারেন না।’’ বিক্ষোভ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ জানান, ‘থ্রেট কালচার’ নিয়ে ছাত্রেরা যা অভিযোগ করছে তা তদন্ত কমিটির বিচারাধীন। ছাত্রদের দাবি মেনে জরুরি ভিত্তিতে কলেজ কাউন্সিলের সভাও ডাকা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এমএসভিপি পদে আসার আগেই তাপসকুমার ঘোষ ডিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। আগে বেশ কয়েক বার তিনি ডিনের দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েছেন। কিন্তু কোনও সমস্যা হয়নি বলে তাঁকে পদ ছাড়তে বারণ করা হয়েছিল। এই শিক্ষাবর্ষে ওই পদ ছাড়া সম্ভবও হবে না বলে মনে করছি। এ নিয়ে কলেজ কাউন্সিলের সভা ডাকা হয়েছে।’
দিন কয়েক আগেই বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকে সাসপেন্ড করেছে স্বাস্থ্যভবন। যিনি নাকি কুখ্যাত উত্তরবঙ্গ লবি-র অংশ বলেও অভিযোগ। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। শুধু বর্ধমান মেডিক্যালেই নয়, একাধিক মেডিক্যাল কলেজে প্রভাব খাটাতেন এই চিকিৎসক। মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে পরীক্ষায় বসা থেকে নম্বর বাড়ানো, পরীক্ষক পদ থেকে অপসারণ, বদলি, বহু দুর্নীতিতেই জড়িত এই বিরূপাক্ষ। এরই মধ্যে কলকাতার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিতে ভর্তি করিয়ে দেবেন বলে ৮ লক্ষ টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে বুধবার চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের নামে। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির ঘটনা। ছাত্রের বাবার অভিযোগ, ২০২১ সালে টাকা নিয়েও ওই পড়ুয়াকে ভর্তি করতে পারেননি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। টাকাও ফেরত দিতে চাননি। অভিযোগকারীর দাবি, সেইসময় প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেও সুরাহা মেলেনি। অবশেষে আদালতের দ্বারস্থ হন ছাত্রের বাবা। আদালতের নির্দেশে ২০২১-এ জলঙ্গি থানায় বিরূপাক্ষর বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। তবে এতদিন টাকা না দিলেও অভিযোগকারীর দাবি, গত সপ্তাহে বিরূপাক্ষর সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি ধাপে ধাপে টাকা ফেরতের আশ্বাস দেন এবং প্রথম ধাপে ৪৫ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন।
বর্ধমান থেকে বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তাঁকে মদতদাতা বহু চিকিৎসক-কর্মীই এখনও হাসপাতালে বহাল তবিয়তে কাজ করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধেই এবার সরব জুনিয়র ডাক্তারেরা। কলেজ কাউন্সিলে সভা ডাকা হলেও নিজেদের অবস্থান অনড় জুনিয়র ডাক্তারদের বড় অংশ। দাবি না মেটা পর্যন্ত বেনিয়মের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই চলবে বলেই জানিয়েছেন তাঁরা।
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালেও জুনিয়র ডাক্তারেরা সরব দুর্নীতি চক্রের মাথাদের পদত্যাগ চেয়ে। দুর্নীতির পাশাপাশি যেভাবে থ্রেট কালচারকে মদত দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা। এই আন্দোলনে চিকিৎসকদের একাংশ পড়ুয়াদের পাশে রয়েছেন। পাঁচ চিকিৎসক পড়ুয়া যাদের বিরুদ্ধে তোলবাজি ও হুমকির দুর্নীতির, তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত হলেও বুধবার এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পুরোপুরি বহিস্কারের পথে হাঁটবেন না কর্তৃপক্ষ। কার্যত শাস্তি কমিয়ে তাঁদের একটি সেমিস্টার থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে । কেন রাতারাতি সিদ্ধান্ত বদল করা হল এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাজা কমিয়ে দেওয়া হল, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর জল্পনা । তবে কী উত্তরবঙ্গ লবির চাপেই সিদ্ধান্ত বদল করা হল ? এখন এই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে চিকিৎসক মহলে । পাঁচ এমবিবিএস পড়ুয়ার সাজা কমানো হলেও বাকি সাত অভিযুক্তদের সাজা বহাল থাকছে বলে কাউন্সিল সূত্রে জানা গিয়েছে । তবে এদিনও কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ জানানো হয় যে, থ্রেট কালচার এখনও বন্ধ হয়নি ৷
এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডিন অফ স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স অনুপমনাথ গুপ্তা বলেন, "কোনও চাপে সিদ্ধান্ত বদল করা হয়নি । পড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখেই নিময় মেনে মাঝরাতে কাউন্সিলের বৈঠক হয়েছিল। সম্পূর্ণ সাসপেনশনের বদলে ছয়মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হল । এর মাঝে তাঁরা আর কোনও ক্লাস করতে পারবেন না । পাশাপাশি গোটা এমবিবিএস কোর্সে তাঁরা হস্টেলে থাকতে পারবেন না ।" অভিযুক্ত অরিত্র রায় ও তীর্থঙ্কর রায় এ বিষয়ে বলেন, "আমাদের বিরুদ্ধে কেন এই সিদ্ধান্ত কাউন্সিল নিল জানা নেই । আমাদের কোনও কথা শোনা হয়নি।"
আরও পড়ুন: সেমিনার রুম নয়? কেন আরজি করের বন্ধ লিফটকেই রহস্যের চাবিকাঠি বলছে সিবিআই?
আরজি কর কাণ্ডের পর কলকাতা জুড়েও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। স্বাস্থ্যভবনের সামনে এখনও ধর্না চলছে তাঁদের। মুখ্যমন্ত্রীর তরফে আলোচনার ডাক মঙ্গলবার অগ্রাহ্য করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। নবান্নের তরফে যে মেল করে তাঁদের বৈঠকে ডাকা হয়েছিল, তা অপমানজনক আখ্যা দিয়ে আন্দোলন জারি রাখেন তাঁরা। বুধবার তাঁরা পাল্টা মেল করে স্বাস্থ্যসচিবকে জানান, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রাজি। তবে তার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে তাঁদের। সেই সব শর্ত মানা হলে তবেই হবে আলোচনা। নাহলে তাঁদের আন্দোলন ও কর্মবিরতি আগের মতোই চলবে। সব মিলিয়ে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় জুনিয়র ডাক্তারদের বিক্ষোভের জেরে স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমস্য়া দেখা দিচ্ছে। বিপদে পড়েছেন অজস্র সাধারণ রোগী। যা রাজ্য সরকারের কাছে বেশ উদ্বেগের। তবে দুর্নীতি-মুক্ত স্বাস্থ্য-শিক্ষা পরিকাঠামোর দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনে সায় দিয়েছেন রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষই।