অরুণাভ-রা গর্জান, অভিজিৎ বর্ষান || যে ভাবে বারবার দুর্বলের পক্ষ নিলেন...

তাঁর জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তিনি বাজারে বেরলে লোকে নাকি অটোগ্রাফের জন্য তাঁকে ছেঁকে ধরছে।

এজলাস ডুয়েল দেখেছে।

বুনো ওল-বাঘা তেঁতুলের লড়াই দেখেছে রাজ্য।

আইনজীবী, বিচারপতিকে বলেছেন, তিনি আইন জানেন না।

কে সেই বিচারপতি? খোদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পাল্টা দেন যে, রুল জারি করে অরুণাভ ঘোষকে জেলে পাঠাবেন। পরে সেই বিবাদের পরিণতি এজলাসেই মধুরেণ সমাপয়েৎ! সে যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, বারবার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমাণ করেছেন, তিনি শুধু গর্জান না, বর্ষানও। তাই তাঁর দ্বারস্থ হয়ে বিচার পেয়েছেন রাজ্যের চাকরিপ্রার্থীরা। নিজের রায়ের মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় ফেলে দেওয়া নাম এই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এক সাঁওতাল পরিবারের ছেলের পড়াশুনো থেকে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ই। বারবার প্রমাণ করেছেন গরিব মানুষের 'মসিহা’ তিনি। তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে, 'ভারতে একটা জুডিশিয়ারি আছে।' আইনের দ্বারস্থ হওয়ার অসহায় মানুষদের এভাবেই ন্যায়ের ঠিকানা দেখিয়েছেন। সংবিধানে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সমস্যার সমাধান করা রাজ্যের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করে রাজ্যকে পাঠ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

এক সন্তানের প্রতি তাঁর সৎ মায়ের বঞ্চনার ঘটনা যে এই মাত্রায় পৌঁছতে পারে, তা কোনওদিন ভাবতে পারেনি রাজ্য প্রশাসনের কেউ। তবে যে দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে পালন করতে হতো, তা পালন করে দেখায় আদালত। সংবিধানে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সমস্যার সমাধান করা রাজ্যের দায়িত্ব। তবে এবারে সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সাঁওতাল পরিবারের ছেলের পড়াশোনা থেকে বসবাসের সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই। পাশাপাশি সৎ মায়ের বিরুদ্ধে ওঠে বঞ্চনার অভিযোগ। কেন চার মাস ধরে সৎ মা পিঙ্কি কোনও টাকা দেননি, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই সৎ মায়ের বেতন বন্ধর নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন: পরেশ থেকে মানিক, যেভাবে একে একে রাঘববোয়ালকে জালে ফেলছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

ঘটনার শুরু ২০১৫ সালে। সেই বছর রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন সাঁওতাল পরিবারের এক ছেলে বামাপদর (নাম পরিবর্তিত) মা রমা। তারপর হঠাৎ রহস্যজনকভাবেই মারা গিয়েছিলেন বাবা বংশী টিঙ্গুয়া। মা মারা যাওয়ার পর পেশায় স্কুলের শিক্ষাকর্মী হিসেবে কর্মরত বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। পরে বাবা মারা যাওয়ার পর সেই চাকরি পান তাঁর সৎ মা। শর্ত ছিল, চাকরি পাওয়ার পর পরিবারের দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই সৎ মায়ের বঞ্চনার শিকার হতে শুরু করেন বামাপদ। একই সঙ্গে অসহায় হয়ে পড়েন তাঁর বৃদ্ধ ঠাকুরদাদা। অবশেষে দাদু এবং নাতি গিয়ে ওঠেন গাছ তলায়। ত্রিপল টাঙিয়ে দাদু-নাতির সংসার। কিন্তু সংসার চালানো বৃদ্ধ দয়ানাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এই কারণে আদালতে গিয়ে খোরপোষের দাবি করে মামলা দায়ের করেন ওই বৃদ্ধ। গত বছর ডিসেম্বর মাসে ওই সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানতে চান নাতি এবং দাদু এই মুহূর্তে কোথায় থাকেন? তাঁদের দু’জনের বাসস্থানের ছবি দেখে তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে যান। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত কোনও একটি গ্রামে বটগাছের তলায় তাঁরা কোনক্রমে ত্রিপল খাটিয়ে রয়েছেন। সাঁওতাল সম্প্রদায় ভুক্ত হওয়ার কারণে বিশেষ সুবিধা তাঁরা পান না বলে অভিযোগ। এরপরেই জেলা শাসককে ডেকে আদালত নির্দেশ দিয়েছে প্রকল্প অনুযায়ী বাড়ি বানিয়ে দিতে। শুধু তাই নয়, সেই সময় ওই ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সম্প্রতি ৮০ শতাংশর বেশি নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে ওই ছেলেটি। এদিন ভরা এজলাসে এই শুনে অত্যন্ত আপ্লুত বিচারপতি। বামাপদর উদ্দেশ্যে বিচারপতি বলেন, "ভালো করে পড়াশোনা করো, আমরা সকলে তোমার পাশে আছি।" তার সঙ্গেই আদালত জানিয়েছে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এই মামলা আদালতের নজরদারিতে থাকবে।

নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক মামলায় তোলপাড় ফেলে দেওয়া নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের ভরসার পীঠস্থান। বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় তিনি ঝড় তুলেছেন। এর জেরে খোদ রাজ্য সরকারের আসনে চিড় ধরেছে। কারণ এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে তিনি পরের পর চাঞ্চল্যকর রায় দিতেই আসরে নামে খোদ ইডি। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে। তাঁর ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় টাকার পাহাড়। এরপর ঝুলি থেকে একের পর এক বেড়াল বেরতে থাকে। অনুব্রতর দুর্নীতির পর্দাও ফাঁস হচ্ছে ধীরে ধীরে।

জুন মাসে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে সরিয়ে দেন। এই নিয়ে বেশ কিছু অসংগতি তাঁর সামনে আসতেই তিনি পদক্ষেপ করেন। এদিকে রাজ্য বিভিন্ন দুর্নীতি ইস্যুতে জেরবার হতেই গৌতম পালকে মানিকের জায়গায় বসায়।

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এযাবৎ সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য নির্দেশ হলো, এসএসসি মামলায় মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর শিক্ষকতার চাকরি কেড়ে নেওয়া এবং ৪১ মাসের বেতন ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ। এসএসসি সংক্রান্ত মামলা কেবলমাত্র সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া নয়, এর পাশাপাশি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বকেও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন তিনি।

তাঁকে আইনজীবী অরুণাভ, আইন জানেন না বলে কটাক্ষ করেন। তিনি কিন্তু এজলাসে বারবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাঁদের হয়ে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে গেছে, তাঁদের কাছে কি মসিহা নন এই বিচারপতি?

বিচারপতি, আইনজীবী, আমলা- এত গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব সামলানোর আগে কম বয়সে সাংবাদিকতাও করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ৬০ ছুঁয়েছেন। কিন্তু বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি। অনেকের ধারণা, ব্যক্তিগত জীবনে খুব রাশভারী এবং গুরুগম্ভীর। মন্ত্রী থেকে দাপুটে নেতা- যে কাউকে অন্যায়ের হদিশ পেলে পাঠিয়ে দেন সিবিআই দফতরে। পরপর গুরুত্বপূর্ণ মামলার মানবিক রায় দিয়ে সাধারণের মুখে মুখে তাঁর নাম। শোনা যাচ্ছে, তাঁর জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তিনি বাজারে বেরলে লোকে নাকি অটোগ্রাফের জন্য তাঁকে ছেঁকে ধরছে।

এই কথার মধ্যে সত্যি কতটা, কতটা জল মেশানো, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় সাধারণ মানুষকে যিনি আইনের ভরসা জুগিয়েছেন, তিনি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

More Articles