এভারেস্টের চেয়ে খাটো, তবু আজও কেন ‘অজেয়’ কৈলাস, রহস্যে মোড়া শিব ঠাকুরের আপন দেশ!

Kailash Mansarovar: এভারেস্টের চেয়েও কম উচ্চতার পর্বত কৈলাসে আজ পর্যন্ত কেউ উঠতে পারেননি। রহস্যজনকভাবে কাজটি অসম্পন্নই রয়ে গেছে।

পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের। দেবী দুর্গা শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ কৈলাস পর্বত ছেড়ে আসছেন বাপের বাড়িতে। ছোট থেকেই আমরা জেনে এসেছি কৈলাস পর্বতে শিবের বাসস্থান। প্রতিবছর হাজার হাজার দর্শনার্থী তাই ছুটে যান শিব ঠাকুরের বাসস্থান অর্থাৎ কৈলাস দর্শন করতে। রহস্যময় এই পর্বতের আকর্ষণে যুগ যুগ ধরে মানুষ কৈলাস পর্বতের পদতলে আসেন। রহস্যে ঘেরা দুর্গম এই পর্বত সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত অনেক কিছুই জানা যায়নি। রহস্য ভেদ করার চেষ্টা অনেকেই করেছেন, তবে সকলেই বিফল হয়েছেন।

তিব্বত মালভূমি থেকে ২২,০০০ ফুট ওপরে অবস্থিত কৈলাস হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও বৌদ্ধদের কাছেও অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় স্থান। কৈলাস পর্বতের বেশিরভাগটাই এখনও পর্যন্ত রহস্যের অন্ধকারে ঘেরা। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই পর্বতের বেশিরভাগ অঞ্চলেই যাওয়া সম্ভব হয় না। এই পর্বতের একদম চূড়ায় কোনও বরফ জমে না। কারণ পর্বতটি এতটাই খাড়া যে, বরফ নিচে পড়ে যায়। আর ওই বরফ গলে গিয়ে উৎপত্তি হয় নদীগুলির। মরুভূমির মতো স্থানে শ্বেত-শুভ্র পর্বত হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে কৈলাস। হিমালয়ের প্রথম ও প্রধান রেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতটি।

এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪৯ মিটার হলেও এই পর্বত অনেকেই জয় করেছেন। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, এভারেস্টের চেয়েও কম উচ্চতার পর্বত কৈলাসে আজ পর্যন্ত কেউ উঠতে পারেননি। রহস্যজনকভাবে কাজটি অসম্পন্নই রয়ে গেছে। এই পর্বতের উচ্চতা ৬,৬৩৮ মিটার। অর্থাৎ এভারেস্টের চেয়ে ২২০০ মিটার কম। তবে কেন পর্বতারোহীরা এর চূড়ায় আজও উঠতে পারেননি সেই রহস্যের সমাধান আজও অধরা। শোনা যায়, যাঁরা এই পর্বতে উঠতে চেষ্টা করেছে তাঁদের কেউ কেউ সেখানেই অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন, আর যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁদের অধিকাংশের বক্তব্য, হঠাৎ করে তুষার ঝড় শুরু হয়ে যাওয়ায় অভিযান থামিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। অনেকে দাবি করেন, তাঁরা উঠতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করেন সামনে আর পর্বত নেই। পর্বতারোহীরা লক্ষ্য করেছেন ওই পর্বতে ওঠার কিছুক্ষণ পরই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

আরও পড়ুন- বছরে একবার নিশুতি রাতে জন্ম নেয় ব্রহ্মকমল! হিমালয়ের ফুল ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য

অনেকেই মনে করেন কৈলাস পর্বতই হল পৃথিবীর কেন্দ্র। এখানে কম্পাস কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় চৌম্বকীয় ক্ষেত্র এটি। এই কারণে কৈলাস পর্বতের উপর দিয়ে বিমান ওড়াও নিষিদ্ধ। উড়লে তার ফল কী হয় তা হাতেনাতে টের পেয়েছিলেন একজন। সে প্রসঙ্গে আসছি পরে। সাধারণভাবে, মানুষের নখ-চুল যে হারে বাড়ে, কৈলাস পর্বতে অন্তত ১২ ঘণ্টা কাটালে নাকি এই বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। অকালবার্ধক্য চলে আসে পর্বতারোহীর শরীরে। এরকম হাজারো বিস্ময়ের ধারক ও বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৈলাস পর্বত। শোনা যায়, একবার কয়েকজন সাইবেরিয়ান পর্বতারোহী কৈলাস পর্বতের নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বয়স কয়েক দশক বেড়ে যায় এবং এর এক বছর পরেই বয়সজনিত কারণে মৃত্যু হয় তাঁদের।

চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত কৈলাস পর্বতকে দূর থেকে দেখলে পিরামিড বলে মনে হয়। তাই অনেকে আবার কৈলাস পর্বতকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পিরামিডও বলে থাকেন। পিরামিডের মতই খাড়া এই পর্বত। আরও অদ্ভুত বিষয় হল, কৈলাস পর্বতের চারটি পৃষ্ঠ, চারটি আলাদা আলাদা শিলা দিয়ে তৈরি। এমন পর্বত পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ! পিরামিডের আকারের এই পর্বতটির গায়ে অনেক প্রাচীন গুহা রয়েছে। এখানে দেখা মিলতে পারে বৌদ্ধ ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের। লোকমতে, এই সন্ন্যাসীরা লোকচক্ষুর আড়ালে বহু বছর ধরে তপস্যা করে চলেছেন গুহায়।

১৯৯৯ সালে রাশিয়ার এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ আরনেস্ট মুলদাশিফ ঠিক করেন কৈলাস পর্বতের রহস্য উন্মোচন করবেন। কৈলাসের আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক মাস ধরে নিজের দল নিয়ে সময় কাটান তিনি। এরপর তিনি একটি বই লেখেন ‘হোয়ার ডু উই কাম ফ্রম’। সেখানে নিজের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলেন আরনেস্ট। তিনি নিজের বইতে জানান, তাঁরা ওই পর্বতের ভেতর থেকে অদ্ভুত রকমের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। নিজের বইতে তিনি লিখেছেন, “এক রাতে আমি আর আমার দুই সহযোগী পাথর পড়ার আওয়াজ পাই। এই আওয়াজ কৈলাস পর্বতের পেটের ভেতর থেকে আসছিল। মনে হচ্ছিল ওই পিরামিডের মতো পর্বতটির মধ্যে হয়ত কোনও শক্তি আছে, যারা ঠিক মানুষের মতই কথা বলছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এই ঘটনা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে কঠিন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কৈলাস পর্বত ও তার আশেপাশের এলাকা অলৌকিক শক্তিতে ভর্তি এবং এটি পৃথিবীর সঙ্গে বাইরের জগতের সম্পর্ক স্থাপন করে।”

আরও পড়ুন-মাটিতে পোঁতা ছিল তিন ফুটের দুর্গা! বাগবাজারের হালদার বাড়ির যে ইতিহাস আজও অবাক করে

এই কৈলাস পর্বতের পায়ের কাছেই অবস্থিত মানসরোবর এবং রাক্ষসতাল হ্রদ। এই দুই হ্রদ এশিয়ার বেশ কিছু দীর্ঘতম নদীর উৎস। পর্বতের ১৪,৯৫০ ফুট উচ্চতায় মানসরোবর বিশ্বের উচ্চতম মিষ্টি জলের হ্রদ। সবচেয়ে মজার জিনিস হলো, মানস-রাক্ষস দুই হ্রদ পাশাপাশি আছে অথচ মানসরোবরের জল মিষ্টি ও শান্ত কিন্তু, রাক্ষসতাল হ্রদের জল নোনা ও অশান্ত।

এই কৈলাস পর্বতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক কিংবদন্তি। এই কৈলাস পর্বতের উপর উড়তে গিয়েই একবার মহা বিপদে পড়েছিলেন লঙ্কেশ্বর রাবণ!কৈলাস পর্বতের কাছেই ছিল রাবণের সৎভাই ধনসম্পদের দেবতা কুবেরের নগরী অলকাপুরী। দশানন রাবণ কুবেরকে পরাজিত করে কুবেরের থেকেই লুঠ করা পুষ্পকবিমানে ফিরে আসছেন লঙ্কায়। এমন সময় উড়তে উড়তে তিনি দেখেন এক অপূর্ব সুন্দর স্থান। কিন্তু সমস্যা হল, তার পুষ্পকবিমান সেই স্থানের উপর দিয়ে উড়ে পেরোতে পারছে না। তখনই রাবণের সঙ্গে দেখা শিবের অনুগত অনুচর নন্দীর। রাবণ জিজ্ঞাসা করলেন, কী কারণে পুষ্পক বিমান আর যেতে পারছে না। নন্দী উত্তর দেন, কৈলাসে দেবাদিদেব মহাদেব এবং মাতা পার্বতী এখন সময় কাটাচ্ছেন। তাই কৈলাস পর্বতের উপর দিয়ে এখন কাউকে যেতে দেওয়া হবে না। এই শুনে রাবণ নন্দী এবং শিবকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা শুরু করলেন। ক্রুদ্ধ নন্দী প্রভুর এই অপমান দেখে শাপ দিলেন রাবণকে, বানরদের হাতেই ধ্বংস হবে রাবণ।

ব্যাস! রেগে অগ্নিশর্মা রাবণ তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরলেন কৈলাস পর্বত, উপড়ে ফেলতে চাইলেন তাকে। থরথর করে কেঁপে উঠল পর্বত। তখন মহাদেব পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে চেপে দিলেন পর্বত আর তার তলায় রাবণ পড়লেন চাপা। শেষে হাজার বছর ধ্যান করে রাবণ শিবকে তুষ্ট করেন। মনে করা হয় পর্বতের নীচে চাপা পড়ে মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য রাবণ রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ‘শিব তাণ্ডব স্ত্রোতম’

“জটাটবীগলজ্জলপ্রবাহপাবিতস্থলে

গলেবলংব্য লংবিতাং ভুজংগতুংগমালিকাম্।

ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বযং

চকার চংডতাংডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম্...”

তবে যাই হোক না কেন ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশ’ অর্থাৎ কৈলাস আজও রহস্যে মোড়া এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষকে আজও টানে তার অন্তর্নিহিত রহস্য ভেদ করার জন্য।

More Articles