নববধূর বেশে গঙ্গাস্নান করতেন স্বয়ং কালী! কালনার যে আখ্যান আজও অমলিন
বর্ধমানের রাজারা ছিলেন শৈব্য অর্থাৎ শিবের উপাসক। তাই কালনা জুড়ে বহু শিবমন্দিরের অস্তিত্ব দেখা যায়। এছাড়াও রাজপরিবারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বহু মন্দির,কালনাকে করে তুলেছে মন্দির শহর। পাশাপাশি এই শহর এক সময়ে তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান ছিল, তারও বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। সারা কালনা শহর জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন কালী-মন্দির।সিদ্ধেশ্বরীকালী,সাধনকালীর সাধন কুঞ্জ, সিদ্ধান্ত কালী,আনন্দময়ীকালী,সত্যনাথেরকালী, কমলাকান্তের কালী,ভবাপাগলার কালী-- তালিকা সুদীর্ঘ। কালনা শহরকে তাই কালী-ময় কালনা বা কালী-ক্ষেত্র কালনা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কালী থেকেই এই শহরের নামকরণ কালনা কিনা তা নিয়ে আজো চর্চা চলে। এই শহরের আরাধ্যাদেবী মা-সিদ্ধেশ্বরী। যাঁর পূর্ব নাম অম্বিকা,তাঁরই নামানুসারে এই শহরের নাম 'অম্বিকা কালনা'।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা
হাজার বছরের পুরাতন এই দেবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু জনশ্রুতি। রূপরাম চক্রবর্তীর 'ধর্মমঙ্গল'কাব্যে দেবী অম্বুয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,"তোমার মহিমা মাতা কি বলিতে পারি,অম্বুয়ার ঘাটে বন্দে কালিকা ঈশ্বরী"।এই অম্বুয়ার ঘাট হলো সিদ্ধেশ্বরী বাড়ির নিকটস্থ গঙ্গারঘাট, যা অম্বুয়ারঘাট বা সিদ্ধেশ্বরী ঘাট নামে প্রসিদ্ধ। মন্দিরের ফলকে যা উল্লেখ আছে সেই অনুযায়ী ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেন,অম্বুরীশ ঋষির উপাস্য দেবী মাতা অম্বিকা বা সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির পুননির্মাণ তথা সংস্কার করান। কিন্তু জনশ্রুতি অনুসারে এর হাজার বছর পূর্বে আনুমানিক ১৬০০খৃষ্টাব্দে দেবী অম্বু বা অম্বুয়া তন্ত্রসাধক অম্বরীশের আরাধ্যা দেবী ছিলেন। মন্দিরের নিকটেই অম্বিকাপুকুর থেকে নিমগাছ কেটে দেবীর মূর্তি তৈরি হয়েছিল।অম্বরীশ মুনির নামানুসারে দেবীর নাম হয় অম্বু বা অম্বুয়া,পরে তা হয় অম্বিকা।
দেবী এখানে বামাকালী,দেবীর উচ্চতা পাঁচ ফুট,দেবী দন্ডায়মানা ভয়ঙ্করী রূপে।দেবীর এই রূপকে অনেকেই মনে করেন জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গের মিলিত রূপ, আবার কেউ কেউ বলেন, তৎকালীন আর্থ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে দেবীর জেহাদ।
শিব এখানে শবরূপী। দেবীমূর্তির সঙ্গে শিবমূর্তির কোনো সামঞ্জস্য নেই। দেবীমূর্তি দারুকাঠের হলেও শিবমূর্তি কাঠের নয়।এর থেকে অনুমান করা হয় শিবমূর্তি পরে স্থাপন করা হয়েছে।
নিত্যভোগে দেবীকে মাছ দেওয়া হয়।যেদিন মাছ ভোগ হয় না সেদিন দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। কালীপুজোর দশদিন আগে থেকে মায়ের অঙ্গরাগ চলে। এই সময়ে মূল ঘট গর্ভগৃহের বাইরে স্থানান্তরিত করে নিত্য পুজো করা হয়। কালীপুজোর আগের দিন মা হন বিবস্ত্রা-দিগম্বরী। সর্বাঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা মা অপরূপা। কিন্তু মায়ের এই রূপ একমাত্র নারীরাই দর্শন করতে পারে।এদিন পুরুষদের প্রবেশাধিকার থাকে না।
কথিত আছে পূর্বে ডাকাতরা নরবলি দিতো এবং সেই নরমুন্ড মন্দিরে ঝুলিয়ে রেখে ডাকাতি করতে যেত। বর্তমানে কালী পুজোর রাত্রিতে ছাগ,চালকুমড়ো,আখ,কলা ইত্যাদি বলি দেওয়া হয়।
বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেন সাতগাছিয়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের এক সন্তান তারাপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়কে দত্তক নেন এবং তাঁর হাতে দেবীমায়ের সেবার ভার অর্পণ করেন।এরপর থেকে আজও বংশানুক্রমিক ভাবে এরাই সিদ্ধেশ্বরী মাতার সেবা করে আসছে। মায়ের সেবার অধিকার পেয়েছেন বলে এদের বংশের উপাধি হয় 'অধিকারী'।
সিদ্ধেশ্বরী মাতাকে ঘিরে অনেক লৌকিক ও অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে।শোনা যায় এই বংশের সেবাইত ভুতনাথ অধিকারী (চট্টোপাধ্যায়), তিনি ছিলেন ধ্যানযোগী এবং তন্ত্রসাধক। মাতৃরূপ দর্শন করার তাঁর ছিল অদম্য বাসনা। তিনি গঙ্গাতীরে সাধারণত ধ্যানমগ্ন থাকতেন। অতি ভোরে উঠে তিনি গঙ্গাস্নান করে সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরের বাহিরে প্রণাম সেরে নিতেন। তাঁর আগে কেউ কখনো গঙ্গাস্নান করত না।একদিন তিনি গঙ্গাস্নানের নিমিত্তে ঘাটে নামছেন, হঠাৎ দেখেন একটি ঘোমটা পরিহিতা বধূ স্নান করছে।তিনি বিস্মিত হলেন।ভাবলেন এতো ভোরে কোন্ বাড়ির কূলবধূ স্নান করছে? যাই হোক পরদিন একই ঘটনা ঘটল, তিনি দেখলেন বধূটি স্নান সেরে চলে যাচ্ছে। তার পরদিন তিনি আরও অনেক ভোরে গঙ্গাতীরে স্নানের জন্য উপস্থিত হলেন, ভাবলেন আজ আমার আগে কিছুতেই আমি ওই বধুটিকে স্নান করতে দেবোনা।আশ্চর্য..... আজকেও তিনি দেখলেন বধূটি স্নান সেরে চলে যাচ্ছে। তখন তিনি বধূটির পিছু নিলেন।বধুটি আগে আগে চলেছে,উনি পিছনে অনুসরণ করে চলেছেন।তারপর তিনি দেখলে সেই নববধূ সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করল। উনিও ঢুকলেন। মূল মন্দির বন্ধ। তখনো দেবী মাতাকে জাগানো হয়নি। সিঁড়ি বেয়ে বধূটি সেই যে মন্দিরে গেলো,আর নেমে এলোনা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভুতনাথ অধিকারীও সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন,কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। শুধু আলতা পরা জলসহ পায়ের ছাপ ছাড়া,সেই পায়ের ছাপ মন্দিরের দরজার সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। ঠাকুরমশাইয়ের বুঝতে কিছুই বাকি রইল না।
সিদ্ধেশ্বরী মাতা কালনাবাসীর আত্মার আত্মীয়। কারো বাড়ির বিবাহ,অন্নপ্রাশন,পৈতে এমনকি যে কোনো পুজো শুরু করার আগে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পুজো দিয়ে তবে শুরু হয় শুভ অনুষ্ঠান।অনেকে সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরকে, কালনার 'দক্ষিণেশ্বর'বলেন। সিদ্ধেশ্বরী মাতা কালনার অধিষ্ঠাত্রী দেবী,কালনা ধন্য হয়েছে মায়ের পূণ্য স্পর্শে।
সাধন কালীমাতা
ভুতনাথ অধিকারী মাতৃসাধনায় বিভোর হয়ে মাতৃরূপ অন্বেষণে অধীর হন।তিনি সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের সংলগ্ন শ্মশানে তন্ত্রসাধনা ও শবসাধনা এবং সেই সঙ্গে মাতৃসাধনা করতেন।১৯৪৫-৪৬সালে স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে তিনি সাধন কালী মন্দির টি স্থাপন করেন। তিনি শ্মশানে বসে স্বপ্নাদেশ পান,তাই এর নাম শ্মশানকালী, আবার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন বলে,এর আরেক নাম হয় সাধনকালী।
বড়োকালী বা আশাদেবীকালী
কালনার বিখ্যাত এবং জাগ্রত আর এক কালী, লক্ষ্মণ পাড়ার বড়োকালী বা আশাদেবীকালী। আকৃতির কারনে বড়োকালী বলে পরিচিত হলেও বিশেষ কোনো আশা নিয়ে গেলে সেই মনোবাসনা পূরণ হয় বলেই এই কালী আশাদেবীকালী নামে খ্যাত।
তখন ব্রিটিশ রাজত্ব।ভাগীরথীর ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় প্রতিমার উচ্চতা মাপা হতো।উচ্চতার নিরিখে সর্বোচ্চ লক্ষণপাড়ার ভট্টাচার্য পরিবারের কালী প্রতিমা।এগারো ফুট উচ্চতা দেবী মাতার।লক্ষ্মণপাড়ার ওই এলাকা বড়কালীতলা নামে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে একবার কালী পুজায় ১১ফুটের বেশী উচ্চতার একটি ঠাকুর গড়া হয়েছিল, কিন্তু নিরঞ্জনের সময় দেখা গেলো বড়কালীর থেকে সেই প্রতিমার উচ্চতা কমে গেছে। কালীপুজোর সময় কালনার কোনো ঠাকুর বড়কালীর সমান বা তার থেকে বেশি উচ্চতার হয় না।দেবীমায়ের পুজামন্ডপের বিপরীতেই ভট্টাচার্য বাড়ি। আনুমানিক ১৮৬০-৬৫সাল থেকে এই পুজোশুরু হলেও,প্রায় ৫০বছর পর৺অক্ষয় ভট্টাচার্যের আমলে এই পুজা খ্যাতিলাভ করে।স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক৺অক্ষয় ভট্টাচার্যের ছাত্ররাই আশাদেবী মাতাকে আদরনীয় করে তোলে কালনা বাসীর হৃদয়ে।পুজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন পরিবারের সদস্যরাই। ১০৮-টি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীর পুজো শুরু হয়।
আজ থেকে ৪০০বছর আগে মাটির মন্দিরে মায়ের পুজো শুরু হয়,তখন ওই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা,বাঘের উপদ্রবের হাত থেকে বাঁচতে অমাবস্যার রাতে দুটি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হতো।ঐতিহ্য মেনে আজও পুজোর সময় দুটি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হয়।রীতিমেনে দু'জোড়া ঢাক বাজানো হয়।রথের দিন সিঁদুর দান ও পাটা পুজোর পর শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ।দেবীমূর্তি এখানে সম্পূর্ণ বিবসনা,ভীষণা, আলুলায়িত কেশী,রক্তবর্ণ লোল জিহ্বা,মুন্ডমালিনী,অলঙ্কারে ভূষিতা।অসামান্যা রূপের ছটায় আলোকিত করে রাখেন চর্তুর্দিক। তান্ত্রিক মতে তৈরি এই দেবীমূর্তি।
দেবীর ভোগে আছে বৈচিত্র্য। চিংড়ি সিদ্ধ করে বেসন দিয়ে ভেজে দেওয়া হয়,এছাড়া খিচুড়ি,পুষ্পান্ন(ফ্রায়েড রাইস),ন'রকম ভাজা,দু'রকম তরকারি,ও মাছ;এছাড়া থাকে পরমান্ন,মিষ্টান্ন। দেবীর ভোগ,স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী হয়ে থাকে।
শোনা যায় দেবী মা মধ্যরাতে নূপুর পায়ে ঘুরে বেড়ান এবং সেই নূপুরের আওয়াজ অনেকেই শুনেছেন।সেই কারনে দেবীর মুর্তিকে সোনার নূপুর পড়ানো হয়....আর এই কারণেই পরিবারের কেউ নূপুর পড়েন না এবং কাউকে নূপুর দান করেন না।
কালনার আরো অনেক জাগ্রত কালীর মহিমা আলোচনা বাকি রয়ে গেল। পরবর্তীতে আবার আসব কালীক্ষেত্র কালনার কথা বলতে।
[তথ্যসূত্র:-কালনার জনশ্রুতি,তন্ময় রায় চৌধুরী, হিমাংশু দত্ত কর্তৃক আলোচিত]