দশ মাথা, দশ পা! বিপ্লবীদের হাতে পূজিত হতেন মালদহের মহাকালী
Kalipuja 2022: প্রথম প্রতিমা তৈরি করেছিলেন রামকেষ্ট দাস এবং প্রথম পুরোহিত ছিলেন শরৎ পণ্ডিত। বংশ পরম্পরায় তাঁদেরই পরিবার এখনও প্রতিমা তৈরি এবং পুজো করে আসছেন
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। দুর্গার বিদায়ের রেশ কাটতে না কাটতেই কালীর আগমন বার্তা। কার্তিক মাসের ঘোর অমাবস্যায় আলোয় সেজে ওঠে সারা শহর। মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয় কালীপুজো ও দীপাবলি। এই কার্তিকী অমাবস্যাতেই আলোকসজ্জা এবং আতসবাজির শব্দের মধ্যেই সম্পন্ন হয় কালীপুজো। এককালে কালীর আরাধনা সীমাবদ্ধ ছিল তন্ত্র সাধক এবং ডাকাতদের ডেরা পর্যন্তই। ডাকাতির আগে কালীর কাছে পুজো নিবেদন এবং নরবলি নিয়ে নানান কিংবদন্তি এখনও প্রচলিত আছে। তবে শুধু ডাকাত বা তান্ত্রিকরাই নয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ভারতীয় বিপ্লবীদেরও মাঝে মাঝে দেখা গিয়েছে শক্তির আরাধনা করতে। যেমন মালদহে বিপ্লবীদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল দশমাথার মহাকালী পুজো।
এলোকেশী, নরমুণ্ড ধারিণী উগ্ররূপের মাঝেও সাধারণের মনে জায়গা করে নিয়েছে দেবীর অভয়দাত্রী রূপ। বাংলায় দক্ষিণাকালী রূপটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও তোড়ল তন্ত্র মতে কালিকা হলেন ‘অষ্টধা’ অর্থাৎ দেবীর আটটি রূপ। দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডা কালী, শ্মশানকালী, এবং মহাকালী। মালদহে এই মহাকালীরই আরাধনা এক কালে করতেন স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখা একদল বিপ্লবী।
ইতিহাস
সালটা ১৯৩০। দেশে তখন অরাজক অবস্থা, চারিদিকে ইংরেজদের রাজত্ব। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিন লড়াই করছেন শয়ে শয়ে বিপ্লবীরা। মালদহর বাতাসেও তখন বিপ্লবের গন্ধ। সারা দেশের সঙ্গে মালদহতেও সাধারণ মানুষের ওপর চরম অত্যাচার চালিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ শাসকদের সেই অত্যাচার সহ্য করতে পারছিল না মালদহবাসীও। সেই সময় এলাকার কিছু যুবক ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নানাবিধ অস্ত্রে সজ্জিত বিদেশিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে চাই শক্তি আর সাহস। শারীরিক ভাবে নিজেদের সুদৃঢ় করে তুলতে সেই সময় যুবকরা ইংরেজবাজার ব্যায়াম সমিতি নির্মাণ করলেন। একই সঙ্গে নিজেদের মনকে শক্ত করতে শুরু করেন মহাকালীর আরাধনা। শক্তির আরাধনায় তাঁদের আরাধ্য ছিলেন মহাকালী।
আরও পড়ুন- কেলে ডাকাত থেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বংশ, জিরাট গ্রামে ডাকাতেকালীর রোমাঞ্চকর ইতিহাস
ইংরেজবাজার শহরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের গঙ্গাবাগ এলাকায় ১৯৩০ সালে স্থাপিত হয় এই বিপ্লবী ব্যায়াম সমিতি। ওই বছরই শুরু হয় মহাকালীর আরাধনা। সমিতির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিপ্লবী কমলকৃষ্ণ চৌধুরী। তিনিই শুরু করেছিলেন এই পুজোর। এখন তিনি না থাকলেও পুজো হয়ে আসছে সেই একই নিয়মে। এই সমিতিতে ব্যায়ামের পাশাপাশি লাঠি চালানোও শেখানো হত। প্রথমদিকে পুড়াটুলি এলাকায় গোপনে কালীপুজো এবং শরীরচর্চা চলত। পরে গঙ্গাবাগ এলাকায় নিজস্ব জায়গায় কালীর আরাধনা শুরু হয়। পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য তথা প্রবীণ নাগরিক নটরাজ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গঠন করা হয়েছিল ব্যায়াম সমিতি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করতে মহাশক্তির আরাধনা করেছিলেন তাঁরা। ইংরেজরা পুজো বন্ধের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছিল।”
মহাকালী মূর্তির বৈশিষ্ট্য
দুর্গার দশ হাতের কথা সকলেরই জানা। লঙ্কার রাজা রাবণেরও ছিল দশ মাথা। তবে দশ মাথা ও দশ পা বিশিষ্ট কালী মূর্তির কথা খুব কম মানুষই জানেন। মালদহর ইংরেজবাজার সংলগ্ন এলাকার মানুষরা প্রায় ৯১ বছর ধরে আরাধনা করে আসছেন এমনই কালী মূর্তির। লোকমুখে এই পুজো দশবিদ্যার মহাকালী পুজো নামেও খ্যাত।
এই মূর্তিও দশভুজা। তবে মহামায়া নয়, মহাকালী। চতুর্ভুজের বদলে তিনি দশভুজা। প্রতিমার প্রথম দর্শনে মনে ভয় জন্মানো স্বাভাবিক। হিন্দু পুরাণ মতে মহাকালী মহাকালের সঙ্গিনী। কিন্তু চিরাচরিত ভাবে দেখে আসা কালীর মূর্তির সঙ্গে এই মূর্তির অনেক পার্থক্য। প্রতিমায় শিবের কোনও অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র মহাশক্তিরই আরাধনা করা হয়। কালীর পায়ের তলায় রয়েছে অসুরের কাটা মুণ্ডু। তাঁর দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভূসুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ। উদ্যোক্তারা জানান, শ্রী শ্রী চণ্ডী গ্রন্থের বৈকৃতিক রহস্যে এই মূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিহারের বিন্দুবাসিনীতে পাহাড়ের গায়ে ও প্রাচীন যুগে এই মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। প্রথম প্রতিমা তৈরি করেছিলেন রামকেষ্ট দাস এবং প্রথম পুরোহিত ছিলেন শরৎ পণ্ডিত। বংশ পরম্পরায় তাঁদেরই পরিবার এখনও প্রতিমা তৈরি এবং পুজো করে আসছেন। গঙ্গাবাগ এলাকায় মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে।
মন্দির নির্মাণ নিয়েও এলাকায় রয়েছে অনেক কাহিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যেখানে মহাকালীর মন্দির রয়েছে, সেখানে তন্ত্র সাধনা করতেন এলাকার বাসিন্দা প্রফুল্লধন মুখোপাধ্যায়। সাধনার জন্য তৈরি করেছিলেন পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেই আসনের ওপরে কালীর বেদি নির্মিত হয়েছে। প্রফুল্লধনের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধর ও স্থানীয় মানুষজন এই পুজো চালিয়ে আসছেন।
আরও পড়ুন- চোদ্দ ফুটের প্রতিমা! ‘জাগ্রত বড়মা’-কে দেখতে আজও ভিড় জমে নৈহাটির কালীপুজোয়
মহাকালী পুজোর রীতি
মালদহর ইংলিশ বাজার ব্যায়াম সমিতির এই পুজোর ঐতিহ্য আজও অটুট। তার প্রমাণ অবশ্যই জাঁকজমকপুর্ণ মহাকালীর শোভাযাত্রা। প্রতিমা আনার সময়ও চমক দেয় পুজোর আয়োজক ব্যায়াম সমিতি। হরেক রকম বাদ্যযন্ত্র, নাচের দল, ধুনুচি নাচ থেকে ভাঙড়া, কান্দির রাইবেশ ও মুর্শিদাবাদের ডগর বাজনায় মুখরিত হয় গোটা এলাকা। মৃৎশিল্পী অষ্টম চৌধুরীর ফুলবাড়ির কারখানা থেকে শহর পরিক্রমার মাধ্যমে দশভুজা মহাকালী আসেন গঙ্গাবাগের মন্দিরে।
এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এখানে অমাবস্যার পরিবর্তে তান্ত্রিক মতে পুজো হয় কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। অমাবস্যা শুরুর আগে অর্থাৎ চতুর্দশীতে দিনের বেলায় পুজো করা হয়। এখনও দিনের বেলায় একই তিথিতেই পুজো হয়। দশ দেবীর শক্তিকে একত্রিত করার জন্য এমন প্রতিমা করা হয়েছিল বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। ফুলবাড়ির মৃৎশিল্পী অষ্টম চৌধুরীর বাড়িতে প্রতিমা নির্মাণ করা হয় এবং সেখান থেকে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা আনা হয় মন্দিরে। পাঁঠা বলি দিয়ে রক্ত উৎসর্গের মাধ্যমে পুজো শুরু হয়। এখনও পাঁঠা বলির রীতি চালু আছে। বলির শেষে শোল মাছের টক রান্না করে দেওয়া হয় কালীকে। পাশাপাশি পাঁচদিন ধরে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শেষের দিন নরনারায়ণ সেবা।
দীর্ঘ ৯১ বছর ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। দেবী এখানে মহাকালী নামের চেয়ে দশ মাথার কালী নামেই বেশি পরিচিত। মহাকালীর এই ভয়ঙ্কর রূপকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি করে তুলেছিলেন বিপ্লবীরা।