নীল আর্মস্ট্রং নাকি চাঁদে পা রেখে মুখে পুরছেন এই দোকানের পান, এক খিলি ১০০১!

বাঙালির এই তাম্বুলবিলাসের ঐতিহ্যই কি কল্পতরুর এত রমরমার একটা বড় কারণ? সে যাই হোক মোদ্দা কথা হল নো কম্প্রোমাইজ ইউএসপি নিয়ে বাঙালিকে তাম্বুল বিলাসের স্বর্গীয় অনুভূতি উপহার দিয়ে চলেছে কল্পতরু।

...ও খৈকে পান বনারস বালা

খুল জাযে বেংড অকল কা তালা।...

না স্বর্গীয় পানের স্বাদ নিতে আপনাকে যেতে হবে না বেনারস। এই শহরের বুকেই পানের এক বিচিত্র সম্ভার নিয়ে হাজির কল্পতরু পান ভাণ্ডার। বাঙালির পানাভ্যাস বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে তাম্বুলবিলাসীদের নিত্যকার অভ্যেস। এখন ঘরে ঘরে পানের বাটা, দিদিমার সাজা পান, খয়েক রাঙা ঠোঁট এসব অতীত। তবে গৌরবের অতীতে ভর করে এখনও উজ্জ্বল কল্পতরু।

নীল আর্মস্ট্রং নাকি চাঁদে পা রেখে কল্পতরুর পান মুখে পুরছেন। এই দোকানের এমন চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন অবাক করত পানপ্রেমীর। ‘পদর্পণ করে বদন প্রসন্ন করুন’ লেখা ছাড়াও একটি বোর্ডে বিচিত্র সবনাম সহযোগে বহু পানের দাম টাঙানো থাকতো।

নাম কল্পতরু পান সেন্টার। ইন্দিরা গান্ধী থেকে রাধাকৃষ্ণন, উত্তমকুমার থেকে মান্না দে, বহু গুণীজন এই দোকানের পান খেয়েছেন।

ভাত খাওয়ার পরে চুন, খয়ের দিয়ে এক খিলি পান মুখে পড়লে মন্দ হয় না বৈকি! বাঙালির সঙ্গে পানের সম্পর্ক আজকের নয়। দিদিমা ঠাকুমাদের ঘরে খুঁজলে পানের বাটা আজ‌ও দুই একটা মিলে যেতে পারে। আর বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সেই পানের সঙ্গে আজ‌ও তাল মিলিয়ে চলছে কল্পতরু পান সেন্টার। এই ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়েছিল সাবেক পূর্ববঙ্গে। দেশভাগ হ‌ওয়ার পরে কলকাতায় এসে পানের সেই ব্যবসা হয়ে উঠল কল্পতরু ভাণ্ডার৷

আরও পড়ুন-আসলে ঝুলন্ত হাওড়া ব্রিজ, কলকাতার এই গর্বের সঙ্গে জড়িয়ে যে অজানা ইতিহাস

আর এই দোকানেরই ১০০০ টাকার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১০০১ টাকার পানের চাহিদা আজও অটুট। ৫ টাকা দামের ‘মুখরঞ্জন’ই হোক বা ১০১ টাকা দামের ‘বেনারস রুচি’। এই দোকানে রয়েছে নানা ধরনের পানের সম্ভার। তবে, সবচেয়ে বিখ্যাত হল ১০০১ টাকা দামের পান ‘কল্পতরু স্পেশ্যাল’। কিন্তু এত দাম কেন এই পানের? বংশ পরম্পরায় বর্তমানে দোকানের দায়িত্বে রয়েছেন শ্যামল দত্ত। জানা যায়, এলাহাবাদ, লখনউ, চেন্নাইয়ের মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে পান সাজার জন্য বাছাই করা সেরা উপকরণগুলি আনা হয়। তাই দিয়ে বানানো হয় এই ‘কল্পতরু স্পেশাল’। তাই কোয়ালিটির দিক থেকে কোনোরকম আপস করে না এই পান। ঠিক কী কী জিনিস থাকে ১০০১ টাকা দামের ‘কল্পতরু স্পেশাল’ পানটিতে একটু দেখে নেওয়া যাক! নেহরু পাতি, জাফরানে সংরক্ষিত সুপুরি, লং কেশর, জনকপুরী খয়ের, মুক্তাভস্ম চুন, বিশেষ মিক্সচার এবং আসল রুপোর তবক।

১৯৩৭ সাল নাগাদ স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই দোকানটি। সেই সময় এই দোকানটি পানের গুণগতমান এতই উন্নত ছিল যে, বর্তমানের ৫০১ দামের বাদশাহী পান মুখে দিয়ে কেউ পাড়ায় ঢুকলে নাকি গোটা পাড়ায় সেই গন্ধ পাওয়া যেত। ‌‌ ব্রিটিশ সরকারের মুখেও পড়েছিল সেই পান। পেয়েছিল উচ্চ প্রশংসা! ইন্দিরা গান্ধী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, উত্তম কুমার, মান্না দে, পিসি সরকার কে না কল্পতরুর পান খাননি!

জানা যায়, ওই দোকানের বিজ্ঞাপন‌ও ছিল চমকপ্রদ! নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখেই কল্পতরুর পান মুখে পুরছেন! যা অবাক করেছিল মানুষকে। ‘পদর্পণ করে বদন প্রসন্ন করুন’ লেখা ছাড়াও একটি বোর্ডে বিচিত্র সবনাম সহযোগে বহু পানের দাম টাঙানো থাকতো।

কল্পতরু ভাণ্ডার। কলকাতার কলেজ স্টিটে ছোট্ট একটা পানের দোকান। ভিতরে পান-মশলার সঙ্গে গাদাগাদি করে আছে শংসাপত্র। তাঁদের অনেকের সঙ্গে দোকানের পুরোনো মালিকের ছবিও রয়েছে – তিনি পান দিচ্ছেন। এই তালিকায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সর্বোপল্লি রাধাকৃষ্ণন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, শিল্পী মান্না দে... আরও কত নাম। হাল আমলের বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি তাঁদের প্রশংসা করেছেন।

কল্পতরু ভাণ্ডারে এক খিলি পানের দাম ৫ টাকা থেকে ১০০১ টাকা। তাদের নামও আছে – মুখরঞ্জন (৫ টাকা), মুখবিলাস (১১ টাকা), দিলখোস (২১ টাকা), মন মাতোয়ারা (৫১ টাকা), বেনারস রুচি (৫০১ টাকা) ও বাদশাহী (১০০১ টাকা)।

কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার ঐতিহ্য রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কয়েকটা সাহেবি আমলের স্কুল, বিখ্যাত বইপাড়া, মহাবোধি সোসাইটি, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, কফি হাউস, দুর্গাপুজো... তার মধ্যে কল্পতরু ভাণ্ডার। তাই এখান থেকে কোনও শপিং মলে উঠে গিয়ে ঐতিহ্য হারাতে চান না শ্যামল দত্ত।

জানা যায়, শুধুমাত্র কলকাতার মানুষ নন, কল্পতরু ভাণ্ডারের পান খেতে ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন মানুষ ছুটে আসতেন। একটা সময় তো নাকি হেদোর পুকুর পাড়ের দুর্গা ঠাকুর দেখে বেরিয়ে, ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট হলের সামনে কল্পতরুর ভান্ডার থেকে পান কিনে মুখে না দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতেন না বাঙালি। আজও তিলোত্তমার বুকে সেই প্রাচীন পানের ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে চলেছে কল্পতরু পান সেন্টার!

বরাবারই পানের দিওয়ানা বাঙালি। কারণও ছিল। বাংলার জলহাওয়ায় পানের বড়ই বাড়বাড়ন্ত। এতে কপাল খুলে গিয়েছিল বণিকদের। তাঁদের সপ্তডিঙা দক্ষিণভারতের সমুদ্র উপকূল হয়ে গুজরাট অবধি পৌঁছে দিত বাংলার পান-সুপারি। আর এর বদলে মাণিক্য আর মরকত নিয়ে ফেরা। বংশীদাসের মনসামঙ্গল আর কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল দিচ্ছে এই তথ্য।

আরও আছে। সেবাস্টিয়ান মানরিক, এক ক্যাথলিক মিশনারি লিখছেন, মুঘল শাসকরা ঢাকা থেকে যা কর আদায় করত, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। আর এর উদাহরণ দিতে গিয়ে শুধু পান থেকে প্রাপ্ত করের হিসেব দেওয়াই তিনি যথেষ্ট মনে করেছেন। সেবাস্টিয়ানের দাবি, বাদশাহি তহবিলে প্রতিদিন কর বাবদ জমা পড়ত চার হাজার টাকা!

সে বড় সুখের সময় ছিল। সেই কোন প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার ‘গুবাক’ পশ্চিম ভারতের শূর্পারক বন্দর হয়ে পাড়ি দিত আরব আর পারস্যে। এই দাবি ঐতিহাসিকদের। সুপারি নামকরণে রয়ে গেছে সেই ইতিহাসের ইঙ্গিত। শূর্পারক থেকে সুপ্পারক, সোপারা হয়ে সুপারি।

বাঙালির এই তাম্বুলবিলাসের ঐতিহ্যই কি কল্পতরুর এত রমরমার একটা বড় কারণ? সে যাই হোক মোদ্দা কথা হল নো কম্প্রোমাইজ ইউএসপি নিয়ে বাঙালিকে তাম্বুল বিলাসের স্বর্গীয় অনুভূতি উপহার দিয়ে চলেছে কল্পতরু।

More Articles