কঙ্গনাকে যোগ্য জবাব! যে যে প্রশ্ন তুলে দিল কুলবিন্দরের সপাট চড়

Kangana Ranaut: আসলে কঙ্গনা রানাউত যে চড়টা খেলেন, সেটা আসলে একদিনের নয়। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ওই চড়।

বলিউড চিত্রতারকা কঙ্গনা রানাউত। এই মূহুর্তে বিজেপির হিমাচল প্রদেশের মান্ডি লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত সাংসদও তিনি। সেই কঙ্গনা চড় খেয়েছেন সিআইএসএফের মহিলা কর্মী কুলবিন্দর কৌরের কাছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। আসলে কঙ্গনা রানাউত যে চড়টা খেলেন, সেটা আসলে একদিনের নয়। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ওই চড়। কী প্ররিপ্রেক্ষিতে এই থাপ্পড়টা খেলেন কঙ্গনা? কৃষক আন্দোলনের সময় বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে নিয়ে একটি টুইট করেছিলেন অভিনেত্রী সেই ২০২০ সালে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন একশো টাকার বিনিময়ে আন্দোলন করতে এসেছেন বৃদ্ধা।

এই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক বার বিজেপির পক্ষ নিয়ে নানান বিদ্বেষমূলক বক্তব্য করেছেন তিনি সাবেক টুইটারে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, যে টুইটারের তৎকালীন মাথা জ্যাক ডরিস তাঁর অ্যাকাউন্টটিই টুইটার থেকে সাসপেন্ড করে দেন। বলা হয়েছিল, টুইটারে আর কোনওদিন তিনি ফিরতে পারবেন না। পরে অবশ্য টুইটারের মালিকানা বদল হয় এবং এলন মাস্ক টুইটার কিনে নেন। নাম থেকে শুরু করে বদলে যায় টুইটারের হুলিয়া। নয়া নিয়ম অনুযায়ী ঠিক হয়, যে কোনও ব্যক্তিকে আজীবন টুইটার তথা এক্স থেকে নির্বাসিত করা যাবে না। অতএব কঙ্গনা আবার ফিরে আসেন টুইটার তথা এক্স-এ। এবং ফের সেখানে তিনি তাঁর ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। যথারীতি তার পুরষ্কার হিসেবে তাঁকে হিমাচল প্রদেশের মান্ডি থেকে বিজেপির টিকিট দেওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে তিনি জিতেও যান।

আরও পড়ুন: যে চড় ভুলবেন না কোনওদিনও! কঙ্গনাকে থাপ্পড় মারা সিআইএসএফ কনস্টেবল আসলে কে?

কুলবিন্দর কৌর পাঞ্জাবের কৃষক পরিবারের মেয়ে। সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সে কাজ করেন। ফোর্সের সমস্ত অনুশাসন, শৃঙ্খলা সত্ত্বেও ধৈর্য্য হারালেন কুলবিন্দর। যার ফলস্বরূপ চড় খেতে হল কঙ্গনাকে। এবার থেকে যখনই কঙ্গনার নাম আসবে কুলবিন্দর কাউরের চড়ের কথাও আসবে। দুটি অস্তিত্ব জুড়ে গেল এখন থেকে। রেখা শর্মা, যিনি জাতীয় মহিলা কমিশনের মাথা সেদিন ওই মন্তব্যের জন্য কঙ্গনার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেছিলেন? না, তা করেননি। কিন্তু আজ খুব তৎপর হয়ে কড়া অ্যাকশন নেবার জন্য সিআইএসএফের হেডকোয়ার্টারে বলেও দিয়েছেন। কী আশ্চর্য না? নারী তো ওই কৃষক মহিলাও ছিলেন। তাঁদের জন্য রেখারা কিছু করেন না কখনো! এই রেখা শর্মা সন্দেশখালিতে চলে আসেন। নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণের অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে, কিন্তু তাঁদের একবারও মনে হয় না, মণিপুরে দু’জন মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হয়। আর এই পার্থক্যের জন্যও দিনে দিনে অনেক অঢেল বারুদ জমা হতে থাকে।

অবশ্য বারুদ যে জমে তা ওঁরা বিলক্ষণ জানেন। কঙ্গনা যেমন চড় খেয়ে এখন বলছেন, পাঞ্জাবে উগ্রপন্থা যে বাড়ছে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা দরকার। একটা চড় উগ্রপন্থা? তাহলে নিজের দলের মন্ত্রীর 'গোলি মারো শালো কো' কিংবা ধর্ণায় বসা কৃষকদের গাড়িতে পিষে দেওয়া, কিংবা রাস্তায় লোহার পেরেক লাগিয়ে দেওয়া, কিংবা যেখানে সেখানে সুযোগ পেলেই দাঙ্গা করিয়ে ভোট আর ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা, এমন শত শত বিষয়গুলো কী? এই বাংলার বিরোধী দলনেতা যখন একজন শিখ আইপিএসকে ‘খালিস্তানি’ বলে দাগিয়ে দিয়ে পার পেয়ে যান, তখন কঙ্গনাদের তো মনে হয় না, তার বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত। বারুদ যে জমে আছে, তা দেশের শাসকদলের বহু সাংসদ বোঝেন। সংসদে ঢুকে পড়া যুবকেরা মণিপুর নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে জানান দেন যে বারুদ জমে আছে। কুলবিন্দর কাউর বলেছেন, কঙ্গনা যখন ঐ মন্তব্য করেছিল তখন তাঁর মা বসেছিলেন ধর্ণায়। তাঁর মা-কে একশো টাকায় কিনে নেওয়ার কথা কেউ বলবে, আর তিনি শুনে নেবেন? এই ক্ষোভ এতদিন জমিয়ে রেখে রেখে এতোদিনে শোধ তুলেছেন। তা-ও খুন-জখম নয়, স্রেফ একটা চড়ে। আর হ্যাঁ, চড়টা কঙ্গনার গালে পড়েছে ঠিকই! বাজছে কিন্তু দিল্লির মসনদে, বিজেপির নেতা মন্ত্রীদের গালে।

লোকসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরেই চারদিকটা কেমন যেন অন্য রকম লাগছে। ভারতবর্ষ একের পর এক চড় মেরেই চলেছে ওদের গালে! এ ভারতবর্ষ অনেক সহ্য করে তারপরে একদিন ফুঁসে ওঠে। সেই ফুঁসে ওঠা, অনেক সময়েই হয়তো আইন বা নিয়ম মেনে হয় না। হয়তো কুলবিন্দর কৌরকে এর জন্য অনেক মূল্য চোকাতে হবে, কিন্তু তাঁর মারা এই চড়টা তিনি একা মারেননি, তিনি অনেকের হয়ে মেরেছেন।

বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, দিল্লি পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টারের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ জুড়ে। সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, মনোজ কুমার টোমার নামাজ পড়াকালীন কিছু মুসলমান মানুষকে লাথি মেরে সরাচ্ছেন। তাঁর যুক্তি ছিল, তিনি রাস্তা ফাঁকা করছিলেন। বেশিরভাগ মানুষের সেদিনের যুক্তি ছিল, ঠিকই তো রাস্তা জুড়ে কেন নামাজ পড়া হবে? যাঁরা আজকে উর্দি পরে, একজন নির্বাচিত সাংসদকে চড় মারার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের কতজন সেদিন ঐ লাথি মারার ঘটনার নিন্দা করেছিলেন?

আরও পড়ুন: ভোটে জিতেও মিলল না ছাড়! মহিলা জওয়ানের হাতে সপাটে চড় খেলেন কঙ্গনা

গত দশ বছরে, যতজন মুসলমান মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তার কোনটার নিন্দা তাঁরা করেছিলেন? করেননি, তাঁর কারণ, তাঁদের অন্তরে মুসলমান বিদ্বেষ আছে এবং আগেও ছিল। উল্টে মনের ভিতর থেকে উপভোগ করেছিলেন ওই পিটিয়ে মারা এবং নামাজিদের লাথি মারাকে। সেই বিদ্বেষকে কোনওদিনও দেশের শাসকদলের পক্ষ থেকে নিন্দা করা হয়নি বলেই আজ এই অবস্থা। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই যখন নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মুসলমানদের ঘুসপেটিয়া বলেন এবং বিভাজনের রাজনীতিকে সমর্থন করেন, তখন সেই দেশে মনোজ কুমার টোমারদেরই বাড়বাড়ন্ত হয়। মনোজ কুমার টোমার কিংবা কুলবিন্দর কৌরের মধ্যে কিন্তু একটা মৌলিক তফাৎ আছে। কুলবিন্দর কৌর কিন্তু সমাজের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ানোর কাজ করেননি। উল্টে যাঁরা কৃষক আন্দোলনকে অপমান করে, যাঁরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়, তাঁদের উদ্দেশ্যে একটা বার্তা দিয়েছেন। ঠিক যেভাবে ভারতের নির্বাচক মণ্ডলী নরেন্দ্র মোদির দর্পচূর্ণ করার রায় দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই কঙ্গনা রানাউতকে চড় মারার মধ্যে দিয়ে একটা বার্তা দিলেন কুলবিন্দর কৌর।

সমাজের সম্পূর্ণ সুবিধাভোগী মানুষদের উদ্দেশ্যে এই বার্তা। যাঁরা ঘরে বসে কৃষকদের রক্ত ঘাম ঝরানো জিনিস খুব সহজে পেয়ে যান, তাঁদের উদ্দেশ্যে এই বার্তা। হয়তো কুলবিন্দর কৌর শাস্তিও পাবেন, কিন্তু চড়টা মেরে তিনি প্রমাণ করলেন, দেশটা এখনও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। এখনও কিছু আশা বাকি রয়ে গিয়েছে কোথাও।

More Articles