এবার অস্ত্র কাঁওয়ার যাত্রা! দোকানের মালিকের ধর্ম জেনে কী করবেন যোগী?
Kanwar Yatra 2024: উত্তরপ্রদেশ সরকার নির্দেশিকা জারি করে যে, কাঁওয়ার যাত্রাপথে অবস্থিত সমস্ত দোকানে বড় বড় অক্ষরে দোকানের নাম, মালিকের নাম ও আধার কার্ডের পরিচিতি লিখে রাখতে হবে।
হিন্দু ধর্মে শ্রাবণ শিবের মাথায় জল ঢালার মাস। পুণ্যার্থীরা গঙ্গা নদী থেকে জল সংগ্রহ করে তা নিজেদের পছন্দমতো শিব মন্দিরে নিয়ে যান। এই পুণ্যার্থীরা সমস্ত পথটা হেঁটে যান এবং এই যাত্রা 'কানওয়ার' বা 'কাঁওয়ার' যাত্রা নামে পরিচিত। পুণ্যার্থীদের কাঁওয়ারিয়া বলা হয় কারণ এরা কাঁওয়ার (বাংলায় যাকে বাঁক বলে) কাঁধে জলটা বহন করেন। সাধারণত উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার, বিহারের সুলতানগঞ্জে গঙ্গার জল সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে এই যাত্রা মুষ্টিমেয় সাধু-সন্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, আশির দশকের সূচনালগ্নে তা হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে, বিশেষ করে অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারের হিন্দুদের কাছে এক জনপ্রিয় ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে এই কাঁরওয়া যাত্রায় ৪-৫ কোটি ভক্ত সমাগম হয় এবং কুম্ভমেলার পরে এটাই দ্বিতীয় বৃহত্তম জন সমাবেশ।
পশ্চিমবঙ্গে 'বাবা তারকনাথ' সিনেমটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার পরে এই রাজ্যে যুব সম্প্রদায়ের কাছেও এটি একটি জনপ্রিয় 'ইভেন্ট'। এই ধরনের ধর্মীয় উৎসবগুলোয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ পূরণ করার চেষ্টা কোনও নতুন কথা নয় কিন্তু এবার এই যাত্রাকে ঘিরে যাত্রাপথে অবস্থিত দোকান মালিকদের ধর্মীয় পরিচিতি লেখার সরকারি নির্দেশ দিয়ে মেরুকরণের রাজনীতির যে ঘৃণ্য উদাহরণ যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং পরে উত্তরাখণ্ড সরকার করল, তার তুলনা বিরল।
এইবার শ্রাবণ মাস শুরু হওয়ার ঠিক আগে উত্তরপ্রদেশ সরকার এক নির্দেশিকা জারি করে বলে, কাঁওয়ার যাত্রাপথে অবস্থিত সমস্ত দোকানে বড় বড় অক্ষরে দোকানের নাম, মালিকের নাম ও আধার কার্ডের পরিচিতি লিখে রাখতে হবে। এই নির্দেশিকা যারা মানবে না, তারা দোকান খোলা রাখতে পারবে না। প্রথমে কেউ কেউ বলেন, শুধুমাত্র ভোজনালয়গুলোর (রাস্তার ধারের খাওয়ার দোকান যা ধাবা নামে পরিচিত) জন্য এই নির্দেশিকা কিন্তু পরবর্তীতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই নির্দেশিকা পান-বিড়ি, ফল, জল, ঠান্ডা পানীয়ের সমস্ত দোকান, এমনকী অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা ঠেলা, স্টলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সরকারের বক্তব্য শান্তিপূর্ণভাবে যাত্রা সমাপনের জন্য এবং শিবভক্তরা যাতে কোনও 'বিভ্রান্তির' শিকার না হন, তার জন্য এই ব্যবস্থা। সরকারপক্ষ ব্যবহৃত এই 'বিভ্রান্তি' শব্দটির মধ্যে আসল গল্পটা লুকিয়ে আছে। সংবিধানের সাধারণ সূত্রগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই নির্দেশিকা আসলে মুসলিমদের এই উৎসবের ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য চিহ্নিত করে তাদের আর্থিকভাবে বয়কট করতে চাইছে। রুটি-রুজি হারানোর ক্ষোভে মুসলিমরা যদি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের এক বাতাবরণ তৈরি হবে, যা শাসকদের নির্বাচনী সুবিধা দেবে।
আরও পড়ুন- যে কোনও যোগাযোগই রাষ্ট্রের হাতে? যে ভয়াবহ টেলিকম আইন ২০২৩ চালু হচ্ছে দেশে
স্বাভাবিকভাবেই এই অসাংবিধানিক, ঘৃণ্য এবং বিভেদমূলক নির্দেশিকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল সরব হয়েছে। এমনকী এনডিএ জোটের শরিক অবিজেপি দলগুলোও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে। বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন, একজন সদ্য নির্বাচিত সাংসদ এই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছেন এবং সুপ্রিম কোর্ট তার অন্তর্বর্তী আদেশে এই নির্দেশিকায় স্থগিতাদেশ দিয়ে বলেছে, দোকানিরা শুধু তাদের বিক্রয়যোগ্য পণ্যের নাম ও দাম লিখতে বাধ্য থাকবে। যদিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আদালতের রায় সত্ত্বেও আইন রক্ষকদের ভয়ে দোকানে পরিচয়পত্র লেখা শুরু হয়ে গেছে। উত্তরাখণ্ড সরকারও যোগীর অনুকরণে একই ধরনের নির্দেশিকা জারি করেছে। মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আরও মারাত্মক বিষয় হলো কোনও সরকারি নির্দেশিকা ছাড়াই তথাকথিত শান্তিরক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকার কাঁওয়ার যাত্রাপথে অবস্থিত বিভিন্ন মাজার ও মসজিদকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে। এক কথায় বিভেদের রাজনীতিতে ভর দিয়ে যোগী সরকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে চাইছে।
কাঁওয়ার যাত্রা নিয়ে প্রশাসনের যুক্তি যে নেহাতই ছেঁদো তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই যাত্রা এবছর হঠাৎ করে শুরু হচ্ছে না, দীর্ঘ সময় ধরে হচ্ছে। এমনকী যোগি আদিত্যনাথ প্রায় আট বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে আছেন, কখনও বিভ্রান্তির প্রশ্ন ওঠেনি। উত্তরপ্রদেশে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটলেও কাঁওয়ার যাত্রার সময় উত্তেজনার খবর পাওয়া যায় না। কাঁওয়ারিয়াদের যাত্রাপথ উত্তরপ্রদেশে একাধিক, যেমন কাটাউলি-মুজাফরনগর, সাহারানপুর-জামলি, দিল্লি রোড ইত্যাদি। এই যাত্রাপথে বহু জায়গায় মুসলিম মহল্লা আছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন এই যাত্রাপথে সৌহার্দ্যের বার্তা নিয়ে প্রতিবছর উপস্থিত থাকে। মুজফফরনগরে 'পয়গাম-ই-ইনসানিয়ত', 'আওয়াজ-ই-হক', 'সেকুলার ফ্রন্টস' নামক বিভিন্ন সংগঠন পুণ্যার্থীদের জন্য ভান্ডারার আয়োজন করে। এই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে আজ নিরাপত্তা ও শান্তির দোহাই দেওয়া হচ্ছে।
যোগী আদিত্যনাথের এই সিদ্ধান্ত এক সুগভীর রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ। এই নাম লেখার দাবি আসলে তিনবছরের পুরনো। কোভিডকালে বন্ধ থাকার পর, ২০২১ সালে এই যাত্রা যখন আবার শুরু হলো তখন মুজফফরনগরের বাগরা আশ্রমের জনৈক হিন্দুগুরু যশবীর মহারাজ প্রথম এই দাবি তোলেন। তিনি বলেন যে, এমন বহু ধাবা এই যাত্রাপথে আছে যাদের মালিকরা মুসলিম। এদের কাছে খাবার খেলে যাত্রীদের অর্থাৎ কাঁওয়ারিয়াদের ধর্ম ভ্রষ্ট হবে। অনেকের মনে থাকবে, কোভিডকালে এরকমও গুজব ছড়ানো হয় যে মুসলিম দোকানিরা হিন্দুদের খাবার বিক্রি করার আগে তা 'অশুদ্ধ' করে দেয়। এ নিয়ে সে সময় কিছু ফেক ভিডিও ছড়ানো হয়। এই ধরনের প্রস্তাবকে যোগী সরকার মান্যতা দেয়নি। এর প্রতিবাদে যশবীর মহারাজ মুজফফরনগরে ধরনা দেন গত বছর। এবার কিন্তু যোগী সরকার অন্য অবস্থান নিয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণটা অবশ্যই রাজনৈতিক। এ বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তার সহযোগী দলগুলি উত্তরপ্রদেশে সাফ হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর, কৈরানা, মুজাফরনগরে বিজেপির কোনও সাংসদ নেই। উত্তরাখণ্ডে হরিদ্বারের আশেপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও বিরোধীরা জয়লাভ করেছে।
এই অবস্থায় আগামী দিনে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে যোগী সরকার মরিয়া। তারা বুঝেছে 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশের' বুজরুকি দিয়ে ভোট বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। এই জন্য তারা আরও বেশি করে মেরুকরণের রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরেছে। এ জন্য যদি জোট ধর্ম পালন করতে মোদি-শাহ জুটি অসুবিধায় পড়েন, তাতে যোগী আদিত্যনাথের কোনও সমস্যা নেই। বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদি-শাহ লবির সঙ্গে আদিত্যনাথ লবির 'সুমধুর সম্পর্ক' সর্বজনবিদিত। তাই আগামী দিনে মেরুকরণের রাজনীতিকে যে আরও নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা বলাই বাহুল্য। কাঁওয়ারিয়াদের বোড়ে বানিয়ে নির্বাচনে সুবিধা পাওয়াই এই নিষেধাজ্ঞার কারণ।
আরও পড়ুন- এবার সেনাও চলবে হিন্দুত্বের আদর্শে! সৈনিক স্কুল নিয়ে কী করতে চাইছে বিজেপি?
এই নির্দেশিক শুধু যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি করছে, এমনটা নয়। একইসঙ্গে উত্তরপ্রদেশের বহু মানুষের জন্য আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনছে। সংখ্যালঘুদের ব্যবসাপত্র গুটিয়ে দিয়ে তাদের আর্থিক স্থিতি দুর্বল করার চেষ্টা বহুদিন ধরে চলছে। তবে এবারের নির্দেশিকায় শুধু মুসলমান ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না। আসলে এই ধাবার ব্যবসা ধর্মের বিচার করে চলে না। কাঁওয়ারিয়াদের যাত্রাপথে এমন বহু ধাবা আছে যার মালিক মুসলমান কিন্তু কর্মচারীরা হিন্দু। আবার বহু ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো। এখন দেখা যাচ্ছে, মুসলমানরা ধাবা বন্ধ রাখলে প্রায় মাসখানেক সময়কাল ধরে হিন্দু কর্মচারীরা কাজ হারাচ্ছেন। আবার হিন্দু ধাবার মালিকদের বলা হচ্ছে তাদের দোকানে কাজ করা মুসলিম কর্মীদের ছুটি দিয়ে দিতে। বহু হিন্দু ধাবার মালিক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে তাদের ধাবা বন্ধ রাখা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই ব্যবসা যেখানে হিন্দু- মুসলিমরা একসঙ্গে কাজ করত, তাকে রাজনীতির উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হচ্ছে। এই একমাস ধরে চলা কাঁওয়ার যাত্রা, যাতে অন্তত চার কোটি লোক অংশগ্রহণ করে, তার ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। কোনও ধাবা মালিক বা ছোট দোকানদার সরকারের কাছে কখনও কোনও আবেদন জানায়নি, শুধুমাত্র মৌলবাদী রাজনীতির স্বার্থ পূরণ করার জন্য এই সিদ্ধান্ত। সবচেয়ে বড় কথা, যারা মুসলমানদের এই ধর্মীয় উৎসব থেকে বিযুক্ত করতে চাইছেন, তারা এ কথাটা বলছেন না, যে বাঁকটি নিয়ে পূণ্যার্থীরা যাত্রা শুরু করে, সেই বাঁকটি (কাঁওর) মুসলিম কারিগররাই তৈরি করেন।
মহাত্মা গান্ধি তাঁর 'My Experiments with Truth' গ্রন্থে ১৯১৫ সালে হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত কুম্ভমেলা দর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, সাহারানপুর থেকে হরিদ্বার যাওয়ার পথে প্রচণ্ড তৃষ্ণা সত্ত্বেও তীর্থযাত্রীরা রাস্তায় জল খেত না।তখন 'মুসলমান জল', 'হিন্দু জল', 'মুসলমান চা', 'হিন্দু চা' নামক অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত ছিল। গান্ধিজি এই আচরণের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ওষুধ খাওয়ার সময় হিন্দুদের এই ছুঁৎমার্গতা দেখা যায় না। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, নতুন ভারতে এর অস্তিত্ব থাকবে না। গান্ধিজি বেঁচে থাকলে দেখতেন, যোগী আদিত্যনাথ ও ধামির মতো মুখ্যমন্ত্রীদের সৌজন্যে ভারত আবার পেছনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে আর্থিক বয়কট করার আশঙ্কা করেই ডাঃ বি.আর. আম্বেদকর সংবিধানে আমাদের সতর্ক করেছিলেন:
"Whoever publicly makes or publishes or circulates a proposal for or nakes, publishes or circulates any statement, rumor or report with the intent to, or which he has reason to believe to be likely to cause or in any other way instigates or promotes the boycotting of any person or class of person, shall be guilty of the offence of instigating or promoting a boycott"।
অবশ্য আজকের ভারতের শাসকেরা প্রকাশ্যেই এই সংবিধানকে অস্বীকার করে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির সঙ্কল্প ঘোষণা করে। ফ্যাসিবাদের সেই উত্তুঙ্গ দিনগুলিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের দোকান, ব্যবসাকে ধ্বংস করার কৌশল নিয়েছিলেন, কাঁওয়ার যাত্রার মধ্যে সেই অশনি সঙ্কেত স্পষ্ট।