এই মন্দিরে বাস ভাত-গুড়খেকো নিরামিষাশী কুমিরের! অলৌকিকের নেপথ্যে লুকিয়ে যে সত্য

Vegetarian crocodile: নিরামিষাশী কুমির বাবিয়া একটি পুরুষ কুমির। মন্দিরের পুকুরেই তার বাস ছিল। আর প্রিয় খাবার মন্দিরের চাল ও গুড়ের নৈবেদ্য।

রেখা এবং শত্রুঘ্ন সিনহা অভিনীত খুন ভরি মাং সিনেমার কথা মনে আছে? অত্যাচারী স্বামীকে রেখা একটি হ্রদে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন যাতে স্বামীর দেহ ছিঁড়েখুঁড়ে খায় কুমিরের দল। রেখা যদি শত্রুঘ্নকে অনন্তপদ্মনাভস্বামী মন্দিরের পুকুরে ফেলতেন তাহলে কী হতো তা অবশ্য বলা মুশকিল। কারণ এই মন্দিরের হ্রদের কুমিরটি নিরামিশাষী! কুমিরের আক্রমণ যে কী ভয়ানক হতে পারে তা সামান্য খোঁজখবর রাখা মানুষই জানেন। তবে প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত! বাবিয়া নামের এই কুমিরটি মাংস ছুঁয়েও দেখে না। ভক্তদের বিশ্বাস খোদ ঈশ্বরের বার্তাবাহক এই কুমির, তাই শুধুমাত্র মন্দির এবং এর দর্শনার্থীদের দেওয়া নিরামিষ খাবারই খায় এই কুমির। খায় বললে ভুল হয়, খেত। সম্প্রতি ৭৫ বছর বয়সে মারা গিয়েছে ভারতের এই নিরামিষাশী কুমির।

কাসারগোডের শ্রী অনন্তপদ্মনাভ স্বামী মন্দিরের নিরামিষাশী কুমির বাবিয়া একটি পুরুষ কুমির। মন্দিরের পুকুরেই তার বাস ছিল। আর প্রিয় খাবার মন্দিরের চাল ও গুড়ের নৈবেদ্য। ভক্তরা মন্দিরে পুজোর পর দিনে দু'বার প্রসাদ দিতেন, আর তাই পেট ভরে খেত বাবিয়া। কীভাবে কুমিরের মতো হিংস্র মাংসাশী প্রাণী হয়ে উঠল এমন সাত্ত্বিক? এই মন্দিরের আশেপাশে কোনও নদী বা অন্য কোনও জলাশয় নেই। কীভাবে এই বিশাল সরীসৃপটি মন্দিরের পুকুরে এসে পৌঁছল তা নিয়েও নির্দিষ্ট কোনও তথ্য জানা নেই কারও!

দ্য হিন্দুর একটি প্রতিবেদন বলছে, লোকের বিশ্বাস যে ১৯৪৫ সালে এক ব্রিটিশ সৈন্য এই মন্দিরে একটি কুমিরকে গুলি করে। দিন কয়েকের মধ্যেই দেখা যায় মন্দিরের সেই পুকুরে ফের আবির্ভূত হয়েছে কুমিরটি। মানুষের বিশ্বাস জন্মে যায়, এই মন্দিরটিই রাজ্যের রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের বিখ্যাত শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের দেবতা পদ্মনাভ অর্থাৎ বিষ্ণুর আদি আসন বা মূলস্থানম। প্রায় সাত দশকের এই আবাসে কখনই হিংস্র হয়ে ওঠেনি এই কুমির, কোনও দিন কোনও ভক্তকে আক্রমণ করেছে বলেও জানা যায়নি। শুধু মানুষ নয়, মন্দিরের আশেপাশের একটি পাখিও বাবিয়ার হামলার মুখে পড়েনি। কোনওদিন অন্য কোনও প্রাণীকে হত্যা করেনি এই কুমির, এমনকী যে জলাশয়ে সে থাকত সেখানকার মাছরাও ছিল সবচেয়ে নিরাপদে! মন্দিরের সমস্ত জায়গায় প্রবেশাধিকার ছিল বাবিয়ার। হামেশাই মন্দিরের চারপাশের পুকুরে বা মন্দিরের সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখা যেত এই কুমিরকে। প্রবল গরমের মাসগুলিতে বাবিয়া মন্দির চত্ত্বরের ৬০ মিটার দূরে, গবাদি পশুর জন্য তৈরি এক কাদামাটির ডোবায় নিজেকে ডুবিয়ে বসে রইত।

মন্দিরের পুরোহিতদের কথা অনুযায়ী, প্রায় ৩,০০০ বছর আগে দিবাকর মুনি ভিলওয়ামঙ্গলম স্বামী নামে এক ঋষি এখানে তপস্যা এবং পুজো করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, একদিন বিষ্ণু স্বয়ং তাঁর সামনে হাজির হন। ভিলওয়ামঙ্গলমের ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে তাঁর একটি মূর্তি তৈরি করার অনুমতি দেন বিষ্ণু।

একদিন, ভিলওয়ামঙ্গলম যখন বিষ্ণুর নিয়মিত পুজো করছিলেন, তখন বিষ্ণু নাকি এক শিশুর রূপ ধারণ করে তাঁর সামনে উপস্থিত হন। ওই শিশু অচিরেই ভিলওয়ামঙ্গলমের ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে এবং তাঁকে তাঁর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, ভিলওয়ামঙ্গলম নিজেকে নিয়ে খুব গর্বিত হয়ে পড়েন। তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিষ্ণু।

একদিন, এই শিশুটি ভিলওয়ামঙ্গলমের আচার-অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা করে রাখা পবিত্র জল দিয়ে স্নান করতে যায়। প্রচণ্ড রেগে ভিলওয়ামঙ্গলম শিশুটিকে ধমক দিয়ে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেন। অপমানিত শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায়। যেতে যেতে সে বলে যায়,যদি ভিলওয়ামঙ্গলম তাকে দেখতে চান তবে তাঁকে সর্প দেবতা অনন্তের বন অনন্তকাটে যেতে হবে। এই শিশুর নিখোঁজ হওয়ার জায়গায় ভিলওয়ামঙ্গলম একটি গুহা খুঁজে পান। শিশুটিকে সেখানে পাওয়া যায় কিনা তা দেখার জন্য তিনি ভিতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আরও পড়ুন- ৯ ডিগ্রি কোণে হেলানো মন্দির! রহস্যময় এই শিবমন্দির কেন চলে যায় জলের তলে?

সেই গুহাতেই ছিল বাবিয়ার বসবাস। মন্দিরের পুরোহিতদের মতে, বাবিয়া বেশিরভাগ সময়ই কাটাত গুহার ভিতরে এবং বিকেলে বেরিয়ে আসত। মানুষের বিশ্বাস, বাবিয়া সেই গুহাটি পাহারা দেয় যেখানে স্বয়ং বিষ্ণু অদৃশ্য হয়েছিলেন।

কুমিরের এমন অবিশ্বাস্য আচরণ নিয়ে কী বলছেন কুমির বিশেষজ্ঞরা?

কুমির বিশেষজ্ঞদের মতে, কুমির খুবই বুদ্ধিমান প্রাণী এবং তারা কঠিনতম পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকা লড়াকু প্রাণী। বাবিয়া ছিল মুগার কুমির এবং এদের প্রাকৃতিক বন্য খাদ্য প্রাথমিকভাবে মাছ। তবে হরিণ, বন্য শুকর ইত্যাদির মতো ছোট এবং বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীও তারা খায়৷

আরও পড়ুন- ভারতের এই মন্দিরে পূজিত হয় মোটরবাইক! ‘বুলেট বাবা’-র নেপথ্যে রয়েছে গা ছমছমে যে ঘটনা

তবে কুমিরকে খাবার বাছতে দিলে সে সবসময়ই তার প্রাকৃতিক খাদ্যই চাইবে। মানুষের বিশ্বাস না হলেও, কুমির ওই মন্দিরের পুকুরের মাছ খেত এবং দীর্ঘকালের অভ্যাসে সে ভাত খেতেও অভ্যস্ত। কিন্তু কোনও মানুষকে আক্রমণ না করার সহবত শিক্ষা সে পেল কোথায়? বিশেষজ্ঞদের মতে, কুমিরের শেখার ক্ষমতা রয়েছে। একটি কুকুরকে শেখানর চেয়েও নাকি একটি কুমিরকে প্রশিক্ষিত করা অনেক সহজ। কুমির তখনই আক্রমণ করে যখন সে ভয় পায়। আসলে এই মুগার কুমির খুব লাজুক প্রাণী। তার প্রকৃতি আর মানুষের আস্থা মিলেমিশে তাই এক দৈব ঘটনার জন্ম দিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন বাসিন্দা এই কুমিরকে সম্মান জানাতে মন্দিরের মাটিতেই কবর দেওয়া হয়েছে সকলের ভালোবাসার বাবিয়াকে।

More Articles