রূপান্তরকামী সন্তানকে নিয়ে গর্বিত বাবা, ভারতীয় অভিভাবকরা শিখবেন?

২০২২ সালে এসে ছেলের রূপান্তরকামী পরিচয়কে গর্ব করে ঘোষণা করে খালেদ লিখেছেন, “আমার মেয়ে একজন রূপান্তরকামী।” কন্যা হ্যারিসের ছবি ট্যুইটারে শেয়ার করে খালেদ লিখেছেন, “আমি বরাবরই ওর জন্য গর্বিত। আমার মেয়ে আমাদের পরিবারকে সাহস...

শরীর বড়ই বিড়ম্বনার। তারও চেয়ে বিড়ম্বনার, শারীরিক পরিচয়। শরীরের মধ্যে যে ঘর, তাতে যে থাকে, তার যদি এই বসতি পছন্দ না হয়? যদি বাসা বদলে নতুন করে সাজানোর ইচ্ছে হয়? হাজার হাজার প্রশ্ন এসে জিজ্ঞাসা করবে, “কাগজ দেখাও!" যদি কেউ বলে, এ আমার শরীর, এতে আমারই অধিকার, আমার পরিচয় আমার শরীরে আঁটছে না, এই পরিচয়ের কোনও কাগজ নেই, নথি নেই। স্কুলের খাতায় লেখা ভুল ‘সেক্স’ কারও সামাজিক লিঙ্গপরিচয় ঠিক করতে পারে না... এসব আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও অধিকারই নেই। শরীর যতটুকু ‘মেল’ বা ‘ফিমেল’ করে পাঠিয়েছে, তার খাঁচা ভেঙে ‘অন্য’ হয়ে ওঠার সাহস সেখানে বাড়ন্ত। যাঁরা সাহস দেখান, তাঁদের ব্যাতিক্রম বলে। আর ব্যাতিক্রম নিয়মেরই ছায়াতে বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদিন স্বতন্ত্র হয়। স্নেহ বা শ্রদ্ধা সবটাই দেহোত্তীর্ণ। এই সহজ সত্যটুকুই উদযাপন করছেন খালেদ হোসেইনি, উদযাপন করছেন তাঁর কন্যা হ্যারিস হোসেইনি। পুরুষ শরীরে বড় হয়েও বাবার কাছে কন্যা হয়ে ওঠার নতুন পরিচয় পেয়েছেন হ্যারিস।

ঔপন্যাসিক খালেদ হোসেইনির শারীরিক পুত্র এখন শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই কন্যা। হতেই পারে। নতুন বা অবাস্তব কিছুই নয়। তবে এত চর্চা কেন? খালেদ হোসেইনি সাহিত্যিক বলে? খালেদ হোসেইনি প্রভাবশালী, পরিচিত নাম বলে? না কি খালেদ আসলে একজন বাবা বলে, যিনি সত্যকে মর্যাদা দিতে জানেন। ২০১৭ সালেও যিনি হ্যারিসের জন্মদিনে লিখেছিলেন, “আমার ছেলের আজ ১৭ বছর হল।” ২০২২ সালে এসে ছেলের রূপান্তরকামী পরিচয়কে গর্ব করে ঘোষণা করে খালেদ লিখেছেন, “আমার মেয়ে একজন রূপান্তরকামী।” কন্যা হ্যারিসের ছবি ট্যুইটারে শেয়ার করে খালেদ লিখেছেন, “আমি বরাবরই ওর জন্য গর্বিত। আমার মেয়ে আমাদের পরিবারকে সাহস এবং সত্য সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছে।”

এই ‘গর্ব’-কে নিয়েই তো আলোচনা। সন্তানকে নিয়ে আর পাঁচটা সাধারণ গর্বের মতোই, তাঁর রূপান্তরকামী হওয়া বা নিজের সেই শরীরী বাড়ির ভেতর নতুন করে ঘর তৈরি করাও যে স্বাভাবিক ও সমান গর্বের, সেই সহজ সত্যই বলেছেন সাহিত্যিক খালেদ হোসেইনি। ২১ বছর বয়সি ছেলের কন্যা হয়ে ওঠার সফরকে মান্যতা দেওয়াকে উদাহরণ করেছেন খালেদ। অপছন্দের শরীরের ভেতর নিজেকে নিয়ে বেড়ে ওঠা কতখানি অসহনীয়, তা এক সংবেদনশীল মানুষের মতোই অনুভব করেছেন খালেদ, অনুভব করেছেন এক বাবা। খালেদ মেয়েকে নিয়ে লিখেছেন, “আমি জানি এই প্রক্রিয়াটি ওর জন্য কতটা বেদনাদায়ক। রূপান্তরকামী মানুষরা যে নিষ্ঠুরতার শিকার হন তা সম্পর্কে ও সচেতন। তবে আমার মেয়ে অনেক শক্ত এবং নির্ভীক।”

আরও পড়ুন: আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! পথ দেখাচ্ছেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী ড্রোন পাইলট

খালেদের সাহিত্যিক পরিচয়কে সরিয়ে রেখে শুধু একজন বাবার রঙে যদি তাঁকে দেখা যায়, সবচেয়ে উজ্জ্বল তারার মতোই হয়তো দেখাবে। মেয়ের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, “আমি আমার কন্যাকে ভালোবাসি, ও সুন্দর, বুদ্ধিমতী এবং উজ্জ্বল।” আসলে এই প্রতিটি গুণের সঙ্গেই দেহের কোনও সম্পর্কই নেই। কে কত ভালো ছবি আঁকেন, কে কত জোরে দৌড়ন, কে কত ভালো অঙ্ক কষেন বা কত ভালো রান্না, এর সঙ্গে দেহের কী-ই বা সম্পর্ক, কী-ই বা সংঘাত! ‘হ্যারিস’ নামের মধ্যের মানুষ, যিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মানবাধিকার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, যিনি আধুনিক সামাজিক লিঙ্গবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেন, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির বিরুদ্ধে যিনি সচেতন, তাঁকেই তো চেনে সবাই, তাঁকেই তো ভালবাসা অথবা অপছন্দ করার কথা। শরীর নয়। শরীরের ভেতরে যে ধারণা, সেই সত্য।

হ্যারিসের এই রূপান্তরের সফর সম্পর্কে খালেদ হোসেইনি বলেন, “আমি গত বছর থেকেই হ্যারিসের এই সফর সম্পর্কে জানি এবং আমি ওঁকে বেশ কিছু ব্যক্তিগত সময় গভীর ভাবনা ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি। নিজেকে রূপান্তরিত করা একটি জটিল বিষয়। আবেগের দিক থেকে, শারীরিকভাবে, সামাজিকভাবে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে— কিন্তু হ্যারিস ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার সঙ্গেই প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে।”

দুই কন্যার বাবা হয়ে গর্ব করেছেন খালেদ। গর্ব শ্রেণিভেদে বদলে যায়, সমাজভেদে পালটে যায়। আফগান-আমেরিকান সাহিত্যিক বাবার গর্ব মধ্য ভারতের গ্রামের কোনও বাবার ভোগান্তি ও লজ্জা হয়ে যাবে। হ্যারিসের নির্ভীক মন ও আত্মবিশ্বাস বাংলারই কোনও এক ঘুপচি বা অট্টালিকায় গ্লানি হয়ে যাবে। ট্যুইটারে সন্তানের রূপান্তরকামী হওয়ার সগর্ব ঘোষণা অন্য কোনও পাড়ায়, অন্য কোনও দেশে গণপিটুনিতে হত্যা হয়ে যেতেই পারে। রোজ এমন কত কী ঘটে, যাহা তাহা। শুধু মাঝে মধ্যে দু’একটা আলোর খবর আসে। হ্যারিস বা হ্যারিসের মতো যাঁরা নিজেদের শরীর ও পরিচয়ের অন্তর্দ্বন্দ্বকে গ্রহণ করেছেন, লড়েছেন, স্বতন্ত্র মুখ হয়েছেন, খালেদের মতো সংবেদনশীল বাবা পাননি অধিকাংশই। নিজের রূপান্তরিত সত্তার গর্বে পরিবারকে পাশে পাননি অনেকেই। তবু, লড়াই ছেড়ে যাননি।

পরিবার জীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠান বলে, সেখানেই প্রাথমিক আশ্রয় ও আশকারা খোঁজেন মানুষ। সমাজের যোগ্য ‘স্টেকহোল্ডার’ হয়ে ওঠা বহু পরিবারই প্রথাবিরুদ্ধ কোনও অন্যতার পাশে থাকেনি। আগামীতেও হয়তো থাকবে না। খালেদ হোসেইনি মেয়েকে নিয়ে লেখার শেষ অংশে বলেছেন, “এ সৌভাগ্যের বিষয় যে ও একজন সুন্দর, জ্ঞানী এবং উজ্জ্বল মহিলা হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রবেশ করল।” নিজের ভেতরের যে দরজা হ্যারিস খুলতে পেরেছেন, খালেদ খুলতে পেরেছেন, রোয়া খুলতে পেরেছেন, সেই দরজা দিয়ে আরও অনেক রামধনু ঘুড়ি মহাবিশ্বে উড়বে একদিন, হয়তো। হয়তো, সমাজের তথাকথিত প্রভাবশালী ও বুদ্ধিজীবী মহলের বাবা-মেয়ের এই উদাহরণকে পাশ কাটিয়েই যাবেন অনেকে। তবু, ‘সত্যরে লও সহজে’, সে সত্য আফগানিস্তানের হোক বা মস্কোর, মণিপুরের হোক বা ইথিওপিয়ার, হ্যারিস ও খালেদের এই সহজতা সংক্রামিত হোক।

 

More Articles