'খ্রিস্ট' : ঈশ্বর নয়, রোমানদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যিশুর প্রতিবাদের কাহিনি
Khristo Book Review Anupam Mukhopadhyay : নিজের মতো করে, সর্বস্ব ছেড়ে বিপ্লবের মন্ত্র শেখাচ্ছেন। ঈশ্বর আসবেন, খ্রিস্ট এসে সবাইকে শক্তি দেবেন।
পাথরের রাস্তা ধরে ক্রুশকাঠ হাতে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন। শতচ্ছিন্ন পোশাক, চাবুকের মার যেন শরীরের অর্ধেক রক্ত বের করে দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছে মাংস। কাঁটার মুকুটটা যেন কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো মাথায় চেপে বসেছে। লম্বা চুল বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে মাটিতে। খানিক পর এই ক্রুশকাঠের সঙ্গে তাঁকে পেরেক গেঁথে ঝোলানো হবে। ফর্সা, ঈশ্বরের সন্তান যিশু নিজের মৃত্যুর তিনদিন পর আবার বেঁচেও উঠবেন। আর বিশ্বের প্রতিটা ক্যাথিড্রালে, চার্চে, দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে তাঁর এই ক্রুশবিদ্ধ, শুভ্র, রক্তাক্ত মুখটাই ভেসে উঠবে। সেইসঙ্গে বাজবে সেই অমোঘ বাক্য “হে পিতা, তুমি এদের ক্ষমা করো। এরা জানে না কী করছে…”
যিশু খ্রিস্টের জীবন, তাঁর আত্মত্যাগ, বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ খ্রিস্ট ধর্মের কথাগুলি শুনেছেন, কেউ কেউ মেনে চলেন, কেউ আবার রহস্যের দিকে পা বাড়ান। জেরুসালেমের নাজারেথের সামান্য এক যুবক, কাঠের মিস্ত্রির ছেলে, যিনি কিনা নিজেই ক্রুশ বানাতেন। সেই ছেলেই মানব সভ্যতার একটা অধ্যায় তৈরি করেছে। ক্রুসেডের মতো ঘটনা, যিশুর কয়েকজন শিষ্যকে হত্যার ব্যাপার সরিয়ে রাখলে কী দেখা যাবে? যিশুর শান্তির বাণী। তবে আমরা যা দেখছি, যা শুনছি বা জানছি, তার সবটাই কি সত্যি? মেঘের আড়ালে কি কোনও গোপন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?
পাঠক, আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়বে ড্যান ব্রাউনের কথা। মনে পড়বে ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’, ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস’-এর মতো বইয়ের কথা, যা থেকে পরবর্তীতে সিনেমাও হয়েছে। মনে পড়বে মেরি ম্যাগডালেন আর যিশুকে নিয়ে তৈরি হওয়া অপার রহস্যের কথা। খ্রিস্ট ধর্ম ও বাইবেলের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা গোপন সুড়ঙ্গ। তা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। তবে বিতর্ক নয়, সত্যকে খোঁজার, সত্যকে যাচাই করার সেই রাস্তার হাত ধরেই হেঁটেছে আরও একটি বই। লেখক অনুপম মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘খ্রিস্ট’।
আরও পড়ুন : আনন্দগ্রন্থ, শোকগ্রন্থ : আলো-আঁধারির আবিষ্কার কবি অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
বইটির প্রচ্ছদের দিকে একবার নজর দেওয়া যাক। লাল একটি চালচিত্র, সেখানে খ্রিস্ট লেখাটি কাঁটার মুকুটের এলোমেলো কাঁটাগুলির মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আর সঙ্গে আলখাল্লা পরা যিশুর ছবি। ক্রুশের ভার নিয়ে তিনি বসে পড়েছেন। একমুখ দাঁড়ি, চুলের মাঝে ওই দেখা যাচ্ছে কাঁটার মুকুটটি। আধো অন্ধকারে মেশানো ক্রুশকাঠ, যা তাঁর বাবা তৈরি করেন। তৈরি হয়েছে এক আবহমান দৃশ্য; যেন হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই ক্রুশের কষ্ট, রক্ত, আর্তনাদ বয়ে নিয়ে পথ পেরোচ্ছেন এক মানুষ। এক বিপ্লবী ইজরায়েলীয়। ওই লাল রং আর ক্রুশ বয়ে এগিয়ে যাওয়া যিশুর মধ্যে ধর্ম নয়, ঈশ্বর নয়; বরং এক বিপ্লবের চলন লুকিয়ে রয়েছে।
হ্যাঁ, বিপ্লবী। খুব সচেতনভাবেই শব্দটি ব্যবহার করলাম। কারণ, এই বই জুড়ে বারবার এই শব্দের প্রতিই দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন লেখক অনুপম। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে, সমাজের দিকে। কেন আমরা ঈশ্বর বানিয়ে রেখেছি যিশুকে? একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখা যাক। পৃথিবীর প্রতিটি চার্চে, ক্যাথিড্রালে, ছবিতে যিশুর চেহারাটি খেয়াল করুন। শুভ্র, লম্বা চুল, নায়কোচিত চেহারা। যারা মহান, ইতিহাস স্রষ্টা হন তাঁদের বোধহয় এমন ‘নায়ক’ হতেই হয়! কিন্তু বাস্তব কী বলে? বেশ কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমরা যেভাবে যিশুকে দেখি, যিশুর ছবি যেভাবে ফুটে ওঠে, তা একেবারেই সত্য নয়। উপন্যাসের প্রাক-কথন থেকেই সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন লেখক। সেখানে তিনি লিখেছেন,
“যিশু নামের একজন মানুষ গত দু-হাজার বছর ধরে মানুষের ভক্তি-অভক্তি, আকর্ষণ-বিকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে আছেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি হল, যে মানুষ হিসাবে তিনি অতুলনীয়, সেই মানুষের বদলেই তাঁকে ঈশ্বর বানানো হল, যে রোমানদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল, সেই রোমানদের দেওয়া পরিচয়ই তাঁর সমগ্র জীবনকে আড়াল করে দিল।”
ঠিক এই জায়গাতেই উপন্যাসটি অন্য খাতে বয়ে যায়। গোটা বিশ্বে যিশুর প্রচলিত ছবি দেখলে মনে হবে, সেটা কোনও মহান রোমান মানুষের ছবি। ইতিহাসের দিকে নজর দিলেও দেখা যাবে, একটা সময় পর রোমানদের হাত ধরেই খ্রিস্ট ধর্ম নিজের ‘বৈভব’-এ পৌঁছয়। ভ্যাটিকান সিটির চাকচিক্য চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেয়। আর সেই ধাঁধাঁয় আমরা ভুলে যাই ইজরায়েলের সংগ্রামের ইতিহাস। ভুলে যাই যিশু (এই উপন্যাসে ঈশুয়া) এবং জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের (উপন্যাসে যোহন) কথা। ভুলে যাই পিতর, যাকোব, যুদদের মতো মানুষদের কথাও – যারা আদতে ছিল দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষ। যিশুর নিজের শরীর ছিল বেশ দুর্বল, রাজকীয় চেহারার কোনও রেশই ছিল না। আর প্রত্যেকেরই একটাই বক্তব্য, রোমানদের হাত থেকে ইজরায়েলকে মুক্ত করতে হবে। হয়তো কোনও মসিহা-ই সেই কাজ করতে পারবেন!
আরও পড়ুন : ‘দৈব’: পার্থিব কবিতার শিরায় জড়িয়ে থাকা মহাজাগতিক আখ্যান
এই জায়গায় এসে উপন্যাসে একটা অদ্ভুত মোচড় আসে। অতীত, বর্তমান সব মিলেমিশে যায়। সেখানে চলে আসে ভারতের সভ্যতা, চলে আসেন গৌতম বুদ্ধ। অজান্তেই নিজের পদস্পর্শ রেখে যান মহাত্মা গান্ধী। অহিংসা – যে সংগ্রামের রাস্তা তিনি দেখিয়েছিলেন, তা তো আসলে বহু যুগ ধরে ভারতের রক্তে বইছে। রামকৃষ্ণ পরমহংসের গল্পকথায় একটি সুন্দর কথা আছে, “যদি কেউ আঘাত করতে আসে, মারবি না। কেবল ফোঁস করবি”। হ্যাঁ, ওই ফোঁসটুকুই তো দরকার। উপন্যাসের এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের এক গুম্ফায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সামনে বসে আছে তরুণ যিশু। তাঁর মনে দোলাচল, একটাই চিন্তা – রোমানদের অত্যাচার, তাঁদের দাস রাজাদের হাত থেকে দেশবাসীকে কী করে রক্ষা করবে। ততদিনে জন বা যোহন নিজেকে ‘মসিহা’ বলে অবতীর্ণ হয়েছেন। নিজের মতো করে, সর্বস্ব ছেড়ে বিপ্লবের মন্ত্র শেখাচ্ছেন। ঈশ্বর আসবেন, খ্রিস্ট এসে সবাইকে শক্তি দেবেন। ওই পাষণ্ড রোমীয়দের হাত থেকে ইজরায়েলীয়দের রক্ষা করবেন তিনি।
ভারতের সেই ঠাণ্ডা, বরফাবৃত পরিবেশে, গুম্ফায় বসে নানা প্রশ্ন ভিড় করে আসছে যিশুর মধ্যে। ভিড় করে আসছে শয়তানের চেহারাও। কিন্তু সেই শয়তান কে? উপন্যাসে ভিক্ষুর উত্তর,
“… তাকে কি তুমি মানুষেরই অবয়বে আর স্বভাবে কল্পনা কর না? একজন অপরূপ সুন্দর মানুষ হিসাবেই কি সে তোমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে না?… সে তো ঠিক মানুষেরই মতো। তার চেয়ে বড়ো শুভচিন্তক মানুষের কে কবে হয়েছে? সে কি মানুষকে প্রথম জ্ঞান আর প্রগতির ধারণা দেয়নি?… সে-ই তো তাহলে মানুষের প্রথম মুক্তিদাতা!”
মুক্তি! এই মুক্তির কথাই বারবার উঠে এসেছে এখানে। রোমীয়দের বর্শা আর ক্রুশবিদ্ধের যন্ত্রণা দেখেছেন যিশু। এখানেতিনি ঈশ্বর নন; কালো, কৃশকায় এক বিপ্লবী যুবক। যাকে অনায়াসে ক্ষুদিরামের পাশে রাখা যায়। দেবত্বের বিচারে নয়, এই বইয়ের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে ওই বিপ্লবের মন্ত্রে। কিন্তু রক্ত নয়, সেখানে নেমে আসবে অহিংসা, সেই বিপ্লবের পথেই তৈরি হবে ঈশ্বরের বাণী। উপন্যাসে যিশু নিজেই বলছেন, ইজরায়েলীয়দের সামরিক শক্তি নেই, আছে ঈশ্বর, আছে খ্রিস্ট, মসিহা। তাহলে সেই পথেই অগ্রসর হোক বিপ্লব।
আরও পড়ুন : “থিও ভ্যান গঘ: ১৮৫৭-১৮৯১” – অচেনা বই, অচিন এক জীবনের খোঁজ
বইতে ফিরে এসেছে মেরি ম্যাগডালেনের কথা। তাঁর অপমানকে বুক পেতে গ্রহণ করেছিলেন যিশু। এই উপন্যাসেও মেরি ম্যাগডালেন যিশুর স্ত্রী হয়ে উঠেছেন, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় তিনি সন্তানসম্ভবা। কিন্তু সত্যিই কি যিশুর ক্রুশকাঠেই মৃত্যু হয়েছিল? বিপ্লবের বাণী প্রচার করতে গিয়ে মাথা খোয়াতে হয়েছিল জন-কে। যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি মারা গিয়েছিলেন তিনি? তিনদিন পর তাঁর বেঁচে ওঠার পেছনে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে? উঠে এসেছে যুদাসের কথাও। তিনিও কি সত্যিই বিশ্বাসঘাতক ছিলেন? নানা প্রশ্ন, রহস্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে গিয়েছেন লেখক অনুপম। শেষ পর্যায়ে গিয়ে খানিকটা চমক লাগতে বাধ্য। তারপর হয়তো ফের ফিরতে হবে প্রথম অধ্যায়ে। এখানেই বইয়ের একটা Continuity তৈরি হয়। একটা চক্র আবর্তিত হয়।
বইয়ের ভেতর রয়েছে বেশ কয়েকটি ছবি। প্রাচীন সময়ের বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর ছবিতে যেভাবে যিশু ধরা দিয়েছেন, সেটাই উঠে এসেছে এই ছবিগুলিতে। সেগুলি রাখার তাৎপর্য কী? কারণ, লেখক হয়তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান, গোটা বিশ্ব এভাবেই যিশুকে তাঁর প্রাপ্য আসন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। যে রোমানদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন যিশু, সেই রোমানরাই তাঁকে ভগবান বানাল। তাঁরাই খ্রিস্ট ধর্মকে নিয়ে এগিয়ে গেল। তৈরি হল ভ্যাটিকান। আর যারা যিশুর নিজস্ব, কাছের লোক ছিলেন? যারা যিশুর বিপ্লবকে বিশ্বাস করতেন? প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন? তাঁরাও কার্যত হারিয়ে গেলেন রোমীয়দের এই স্রোতে। ‘খ্রিস্ট’ উপন্যাস সেই ভুলে যাওয়া ইজরায়েলীয় বিপ্লবীদের কথা বলে। সাধারণ, দরিদ্র, দুর্বল এক যুবকের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প বলে। প্রতিবাদ, প্রশ্ন করার সাহসের কথা শোনায়। সেইসঙ্গে ভিড় করে আসে দর্শন, বাইরে এসে দাঁড়ান গান্ধী, বুদ্ধ। দিনের শেষে তরোয়াল নয়, প্রেমের কথা বলে এই উপন্যাস। ‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি’ দিয়ে প্রতিকূলতা জয় করা যায়, শিখিয়ে যায় ‘খ্রিস্ট’।
উপন্যাস - 'খ্রিস্ট'
লেখক - অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদশিল্পী - রাজীব দত্ত
প্রকাশক - তবুও প্রয়াস
প্রকাশসাল - ২০২২
দাম - ৩৫০ টাকা