বাঙালির প্রেম ও যৌন জীবন কীভাবে বদলে দিল বিলাতিয়া চুমু?

Kiss in Literature: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ ইত্যাদি উপন্যাস পড়েই বাঙালি ছেলেমেয়েরা চুম্বনের কায়দাকানুন শিখছে।

ইংরেজ-সংস্কৃতি শাসিত আধুনিক বাঙালির বদলে যাওয়া নিত্যদিনের অভ্যাস সামলাতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছিল তারই দেশিয় প্রতিবেশী। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত ‘সাহিত্য ও সমাজ অথবা বঙ্কিম বাবুর বিষবৃক্ষ’ গ্রন্থে শ্রীমহেন্দ্রচন্দ্র মজুমদার এই পড়শি জনেরই বিরাগকথা বর্ণনা করেছেন। আপত্তির একদিকে যদি হ্যাট, কোট পরিহিত বাঙালিবাবুর ইংরেজ-সাহেব সাজার প্রসঙ্গ পাই, তবে অন্যদিকে রয়েছে ইংরেজি নিয়মে গাউন পরে বঙ্গললনার চুম্বন ও আলিঙ্গন শিক্ষা। উনিশ শতকের পাল্টাতে থাকা সমাজে অতিথি অভ্যর্থনা ও সহবৎ-শিক্ষার অংশ হিসেবে চুম্বন প্রথার আগমন একটা গোষ্ঠীকে নতুন এক আতঙ্কের সম্মুখীন করেছিল। অতিথিকে নমস্কার বা ঘটির জলে পা ধুইয়ে দেওয়ার বদলে এমন ধারার স্পর্শের অধিকার বদলে দেয় সম্পর্কের সমীকরণ। সহবৎ-এর অংশ হিসেবে এই চুম্বন কিন্তু কোনও অর্থেই প্রেম বা যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিত নয়।

মহেন্দ্রচন্দ্রের ধারণা ছিল বাঙালিকে নতুন ধরনের চুম্বন-শিক্ষা দিচ্ছেন ইংরেজি-শিক্ষিত কবি ও সাহিত্যিক সমাজ। আর এ খেলার আসল নাটের গুরু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস থেকে কমলমণি ও শ্রীশচন্দ্রের মুখচুম্বনের বর্ণনা তুলে এনে তিনি যেন ফাঁস করতে চাইলেন বঙ্কিমের গোপন চুম্বন-প্রকল্প। বঙ্কিম লিখেছেন-

“তখন কমলমণি...কুন্দদন্তে অধর টিপিয়া ছোট হাতে একটা কিল দেখাইল।”

কিল দেখে শ্রীশচন্দ্র কমলের খোঁপা খুলে দিলেন। রেগে গিয়ে কমল শ্রীশচন্দ্রের দোয়াতের কালি পিকদানিতে ফেললেন। অতঃপর

“রাগে শ্রীশচন্দ্র দ্রুতগতি ধাবমান হইয়া কমলমণির মুখচুম্বন করিলেন। রাগে কমলমণিও অধীরা হইয়া শ্রীশচন্দ্রের মুখচুম্বন করিল।”

মহেন্দ্রর দৃঢ়বদ্ধ ধারণা, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ ইত্যাদি উপন্যাস পড়েই বাঙালি ছেলেমেয়েরা চুম্বনের কায়দাকানুন শিখছে।

তবে শুধু বঙ্কিমের উপন্যাস নয়, ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত নবীনচন্দ্র সেনের ‘কুরুক্ষেত্র’ কাব্যখানিও নাকি ‘চুম্বন’ ও ‘আলিঙ্গন’ মাহাত্ম্যে ভরপুর। ‘কুরুক্ষেত্র’কে ‘চুম্বন কাব্য’ নামে অভিহিত করেছেন মহেন্দ্রবাবু। ‘বিবি উত্তরা গর্ভবতী’, এমতাবস্থায় ‘প্রাণনাথ’ অভিমন্যুর কাছে প্রার্থনা তার-

“কানন কপোত, বন কপোতিনী মত, /মুখে মুখে বুকে বুকে থাকি অবিরত”।

পুনশ্চ, উত্তরার মুখে অভিমন্যুর বাবা ‘মেস্তর’ [মিস্টার] অর্জুন, মাতুল শ্বশুর ‘মেস্তর’ শ্রীকৃষ্ণ, পিতা ‘লর্ড’ বিরাট বহুবার চুম্বন করেছেন। মহেন্দ্রচন্দ্রের কাছে এই ধারার চুম্বন নিতান্তই অশ্লীল। চুমুর এই ছোঁয়াচ থেকে নাকি রক্ষা পাননি উনিশ শতকের মহিলা কবিগণও। শ্রীমতী সরোজ কুমারী দেবীর কবিতা পাঠ করে এমন ধারণা বেশ পাকাপোক্ত হয়েছিল মহেন্দ্রচন্দ্রের মনে।

১৮৮৫ সালে প্রকাশিত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতাসংগ্রহের ভূমিকায় ‘চুম্বন’ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এক ধরনের মতামত মেলে। তিনি লিখছেন, ইংরেজের কাছে ‘প্যানটালুন বা উরুদেশের’ নাম অশ্লীল। ইংরেজের মেয়ের কাছে সে নাম মুখে আনতে নেই। বাঙালি কিন্তু ‘ধুতি, পায়জামা বা উরু’ শব্দগুলিকে অশ্লীল মনে করে না। মা, ভগিনী, কন্যা কারও কাছে এ সকল কথা ব্যবহার করতে বাঙালির লজ্জা নেই। পক্ষান্তরে ‘স্ত্রীপুরুষে মুখচুম্বন’টা বাঙালি সমাজে অতি ‘অশ্লীল ব্যাপার’। ইংরেজের চোখে তা আবার অতি ‘পবিত্র কার্য্য’ এবং পিতামাতার সামনেই মুখচুম্বন করা যায়। অতঃপর বঙ্কিম উবাচ- সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে, বাঙালি দেশি জিনিস সকলই হেয় বলে ত্যাগ করছে, আর বিলাতি জিনিস ভালো বলে গ্রহণ করছে। এমনকী “শিক্ষিত বাঙ্গালী এমনও আছেন যে তাহাদের পরস্ত্রীর মুখচুম্বনে আপত্তি নাই। কিন্তু পরস্ত্রীর অনাবৃত চরণ! আলতা পরা, মলপরা পা দর্শনে বিশেষ আপত্তি”। বঙ্কিম বলতে চাইলেন, বাঙালির দেশিয়-রুচি ও সংস্কৃতিবোধের সঙ্গে প্রকাশ্যে তথা সহবৎ বা আতিথেয়তা প্রসঙ্গেও মুখচুম্বন ব্যাপারটা খাপ খায় না মোটেই।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫) তাঁর ‘আদবকায়দা’ প্রবন্ধে বর্ণনা করেছেন, দেশভেদে সহবৎ শিক্ষার বিপুল বৈচিত্রের কথা। পথে দেখা হলে বাঙালি যেমন ভক্তিভরে কারও পায়ের ধুলো নেয়, কাউকে আবার একটি ‘কুড়ুলে’ নমস্কার করেই যথেষ্ট মান্য হয়েছে বলে মনে করে। ফ্রান্স দেশেও তেমনি ভদ্রলোকে ভদ্রলোকে দেখা হলে, অনেক স্থলে ‘পরস্পরকে চুম্বন’ করার রীতি আছে। রায়চৌধুরী এরপর শোনালেন চুম্বন-অভিবাদনের মজার এক কাহিনি। এক ফরাসি একবার তাঁর এক ইংরেজ বন্ধুকে দেখতে গেলেন। ফরাসি বন্ধু এসেছে শুনেই ইংরেজটি তাড়াতাড়ি স্নানের ঘরে গিয়ে মুখময় সাবান মেখে এলেন। ফরাসিকে অগত্যা বন্ধুর টাক পড়া তালুতে চুম্বন করে ভদ্রতা রক্ষা করতে হলো।

সহবৎ অর্থে মুখচুম্বন নিয়ে মহেন্দ্রচন্দ্রের মতো লেখকদের আপত্তি যাই থাকুক না, এর সঙ্গে বাঙালির বোঝাপড়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে বঙ্কিম উপন্যাসের আগে থেকেই। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে ঢুঁ মারলে দেখা যায়: বোন প্রসন্নর গালে নবকুমারের ‘চুমো’ খাওয়ার ঘটনাটি বর্ণনা দিতে গিয়ে অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের হাসি তামাশার অন্ত নেই। নব বাবুর স্ত্রী হরকামিনী নিজ স্বামী এবং ননদের নতুন ধারার সম্পর্ক নিয়ে বলেন-

“সে দিন বাবু জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা থেকে ফিরে এসে ঠাকুরঝিকে দেখেই অমনি ধরে ওর গালে একটি চুমো খেলেন; ঠাকুরঝি তো ভাই পালাবার জন্যে ব্যস্ত, তা তিনি বললেন যে— কেন? এতে দোষ কি? সায়েবরা যে বোনের গালে চুমো খায়, আর আমরা কল্লেই কি দোষ হয়?”

কীভাবে বাঙালি তার আদর-স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ করবে, আর সেই প্রকাশের পথে চুমুর ভূমিকা কেমন হতে পারে, এ যেন এক নতুন বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছিল সমাজমানসে।

তবে শুধু সহবৎ অর্থে নয়, বরং অন্ত্য উনিশ শতকের বাঙালির প্রেম ও যৌন জীবনেও বিলাতিয়া চুমুর পদ্ধতি বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত শ্রীপ্রেমদাস ভিখারী প্রণীত ‘প্রেম-তরঙ্গ’ গ্রন্থটির কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। দম্পতিরা কীভাবে তাঁদের বিবাহিত জীবনে সুখী হতে পারেন এবং প্রেমের উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হবেন, সেই তত্ত্বের বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রেমদাসের ব্যাখ্যায় চুম্বন হলো, ‘কামনা’ এবং ‘লালসা’ প্রবৃত্তির হাত থেকে মুক্তির ‘ঔষধ’ বিশেষ। ব্যাপারটা ঈষৎ জটিল এবং আমরা যেভাবে প্রেম-যৌনতার ইতিহাস ভাবি বা পড়ি তার থেকে খানিক আলাদা। প্রেমদাসের কথানুযায়ী, যখন নারী পুরুষ আত্মবিস্মৃত হয়ে ‘পাশব প্রবৃত্তি’ চরিতার্থ করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে, ঠিক সেই সময় চুম্বন ‘কামনা’-কে শান্ত করতে পারে। এই দৈহিক কামনা বাসনার জাল থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেই ‘করুণাময় ভগবান’ উপায় হিসাবে চুম্বনের সৃষ্টি করেছেন। তার মানে এই নয় চুম্বনে কামনা বাসনা নেই। প্রেমদাসের মতে, চুম্বনে যেমন লালসা আছে, তেমন ‘পবিত্রতা’ও আছে। প্রশ্ন উঠবে, তাহলে কোন চুম্বন লালসার আর কোন চুম্বন পবিত্রতার? প্রেমদাস কিন্তু এক্ষেত্রে চুম্বনকে ভালো-মন্দের সহজ দ্বিত্বে বিভাজিত করেননি। গড়েননি আধুনিক/প্রগতিশীল বনাম নৈতিকের সীমারেখা। বরং নানা স্তরে বিভাজিত চুম্বনের কিছু মাপক গড়ে তোলেন তিনি। আর এই মাপনের ক্ষেত্রে শরীরের নানা অঙ্গ প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল।

উচ্চভাবের বিচারে প্রথমেই আসে হস্ত চুম্বনের কথা। প্রেমদাসের বক্তব্য অনুসারে, হস্ত চুম্বন আমাদের দেশে সেভাবে পরিচিত নয় কিন্তু ‘ইয়োরোপে’-এর বিশেষ প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। হস্ত চুম্বনে ‘কামনা’র লেশমাত্র থাকে না, এতে হৃদয়ে ‘ভক্তি’র উদ্রেক হয়। যৌন কামনাহীন এই হস্ত চুম্বন কিন্তু একেবারেই প্রেমিক প্রেমিকার প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বনের উচ্চ আদর্শে ইওরোপই সেদিন প্রধানভাবে অনুকরণীয়। হস্ত চুম্বনের থেকে অধিক ভাবব্যঞ্জক কপাল চুম্বন। কপাল চুম্বনে হৃদয়ে ‘স্নেহের’ উদ্রেক হয়। এক্ষেত্রেও বিন্দুমাত্র ‘লালসা’ স্থান পায় না। এইজন্য হস্ত চুম্বন এবং কপাল চুম্বন হলো প্রেম বৃদ্ধির প্রধান উপায়। কিন্তু প্রেম যখন এতদূর বিস্তৃত হয়েছে যে প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়ে ‘আলিঙ্গন’রত, তখন তো আর হস্ত বা কপালেই সীমাবদ্ধ থাকবে না চুম্বন। ‘লালসা’কে দমন করার জন্য ‘গণ্ড’ বা গালে চুম্বন করা প্রয়োজন। যেমন হস্ত চুম্বন ‘ভক্তি’ প্রকাশক এবং কপাল চুম্বন ‘স্নেহ’ প্রকাশক, গণ্ড চুম্বনও সেইরূপ হৃদয়ে ‘প্রেম’ প্রকাশক। অতঃপর আসে ওষ্ঠ চুম্বন। এই চুম্বন ‘লালসা’ চরিতার্থের উপায় বিশেষ। স্ত্রী-পুরুষ সম্মিলনে ওষ্ঠ চুম্বনে সুখানুভব হয় মানবশরীরে। তবে সে সুখের অতি অল্পমাত্র ছায়া হৃদয়ে প্রতিবিম্বিত হয়।

ওষ্ঠ চুম্বনেও যাদের ‘লালসা’ দমিত হয় না, শান্ত হয় না চিত্ত, তাঁদের ‘লালসা’ প্রবৃত্তির শান্তি হয় হৃদয় চুম্বনে। ‘স্তনক্রীড়া’, ‘দংশন’, ‘জিহ্বালেহন’ ইত্যাদি ‘সহবাসের’ আনুষঙ্গিক সমস্ত কার্যের সমষ্টির নামই হৃদয় চুম্বন। গ্রন্থকার বলেন, ওষ্ঠ চুম্বন এবং হৃদয় চুম্বন থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কারণ এতে ‘লালসা’কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। নিতান্ত আত্মসংযমে অক্ষম যারা, তাদের জন্য ‘সহবাস অপেক্ষা’ হৃদয় চুম্বনই শ্রেয়। তার মানে এই নয় যে হৃদয় চুম্বনকে বাতিল করার কথা বলা হচ্ছে। বরং এক্ষেত্রে আরোপিত হচ্ছে শর্ত। উভয়পক্ষে ‘প্রকৃত প্রেম’ জন্মালে তবেই এই পথের পথিক হওয়া ভালো।

তৎকালে ইওরোপ আমাদের বারবার জানান দিচ্ছিল, সহবৎ চুম্বন ঠিক নেটিভদের বিষয় নয়। আসলে বর্তমানই ঠিক করে স্মৃতি কেমন হয়ে উঠবে। বর্তমানই ঠিক করে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাসকে কেমন করে মনে রাখব আমরা। সেই বর্তমানের প্রতিভূ ইওরোপ হয়ে উঠছিল সেদিন। লন্ডন ও ফিলাডেলফিয়া থেকে ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত সি. সি. বোমবাগের ‘দ্য লিটারেচর অব কিসিং গ্লীনড ফ্রম হিস্টরি, পোয়েট্রি, ফিকশন অ্যান্ড অ্যানেকডট’ গ্রন্থটি বিশেষ পর্যালোচনার দাবি রাখে। বস্তুত ইওরোপে চুম্বন প্রথার সাংস্কৃতিক ইতিহাস লিখেছেন তিনি। চুম্বনের সামাজিক ইতিহাস যে ‘সভ্য’ ইওরোপের বাইরেও থাকতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল তাঁর। সহবৎ চুম্বন নিয়ে প্রাচ্যদেশ নাকি আতঙ্কিত সে কথা জানা যায় বোমবাগের লেখায়। আসলে চুম্বনকে একপ্রকার ইওরোপিয় উত্তরাধিকার হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন ঔপনিবেশিক প্রভুরা।

জাতি গৌরব তথা সাংস্কৃতিক কৌলীন্য বিচারের মাপক হয়ে উঠেছিল চুম্বন। চুমুর প্রশ্নে জাপানি জাতিকে খোঁচা দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৮৯ সালের ১৬ অক্টোবর সত্যেন্দ্রনাথ ‘পারিবারিক খাতা’য় লিখেছেন: “চুম্বন রহস্য কে বলিবে? অধরে অধর মিশাইয়া একটী নিঃশব্দ শব্দ উচ্চারণ— ইহার অর্থ কী?” ইন্দিরা দেবীর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ থেকে জানা যায়: ঠাকুর পরিবারের ভবানীপুরের বাড়িতে সিঁড়ির ওপরে শিকল দিয়ে বাঁধা একটা ‘পারিবারিক খাতা’ ছিল। যার যখন ইচ্ছে তাতে নিজের বক্তব্য লিখে রাখতেন। ‘পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক’ নামাঙ্কিত এই খাতাটি রবীন্দ্রভবনের ২৭২ সংখ্যক পাণ্ডুলিপি। এহেন ‘পারিবারিক খাতা’য় সত্যেন্দ্রনাথ লিখলেন যে, তিনি নাকি শুনেছেন ‘জাপানী জননী শিশুকে বুকে লইয়া আদরে চুম্বন করে না’। এতে যথেষ্ট অবাক হন তিনি। শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে তার হাসি হাসি মুখ, ছোট ছোট হাত, তুলতুলে গাল, জ্বলজ্বল চোখ দেখে তো কোনও মানুষই চুমো না খেয়ে আর থাকতে পারে না। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন: “এ আমাদের স্বাভাবিক—হৃদয়োচ্ছ্বাস। কিন্তু জাপানীদের অপত্য স্নেহ যদি আমাদের সঙ্গে সমান, তারা চুম্বনে এমন উদাসীন কেন?” সত্যেন্দ্রনাথের প্রশ্নগুলি ভাবিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। প্রত্যুত্তরে রবিঠাকুর উসকে দিলেন চুমুর প্রেক্ষিতে এক জাতিগত প্রশ্ন:

“চুম্বন প্রথা কি কেবল আর্য্যজাতীয়দের মধ্যেই বদ্ধ নহে? সেমেটিক মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতিদিগের মধ্যে কি চুম্বন প্রচলিত আছে?”

চুম্বনের মূলে এই জাতিগত প্রশ্ন উত্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ একে ভাগ করলেন দু'টি শ্রেণিতে: স্বাভাবিক এবং প্রথাগত। পারিবারিক খাতায় তিনি লিখলেন:

“আমরা মনেই করিতে পারিনা হৃদয়ের মধ্যে স্নেহ প্রেমের উদ্রেক হইলে অধরের প্রতি অধরের আকর্ষণ না হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু উহা কি কতকটা স্বাভাবিক এবং কতকটা প্রথাগত নহে?”

স্বাভাবিক আর প্রথাগতর ফারাক বুঝতে রবীন্দ্রনাথ জন্তুদের জগতে প্রবেশ করেছেন, স্মরণ করেছেন জন্তুদের আচরণ সমূহ। রবীন্দ্রনাথের কথায়: “জন্তুদের মধ্যে ত চুম্বন নাই- আঘ্রাণ, লেহন, গাত্রঘর্ষণ আছে। বানরী কি করিয়া আপন শাবকের প্রতি স্নেহ প্রকাশ করে কেহ বলিতে পারেন?” মোদ্দা কথা এই, উনিশ শতকের বঙ্গ জীবনে চুম্বন শুধু একটি সহবৎ আচরণ বা যৌন সুখের উপায় না থেকে বরং নারী/পুরুষের শরীরের গঠন কেমন, সে কোন নৃগোষ্ঠীর অংশ, তার জাতি পরিচয় কী ইত্যাদি কতকগুলি জটিল প্রশ্নের সঙ্গে আবর্তিত হচ্ছিল।

More Articles