কেন চাইলেও মোছা যায় না আঙুলের ভোটের কালি? জানেন, নির্বাচনী কালির ইতিহাস?
Indelible Voting Ink : ৯৬১ সালে এই কালি তৈরি করে ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি (NPL)। নয়াদিল্লির CSIR-এর একটি গবেষণাগার হচ্ছে এই এনপিএল৷
আঙুলে ভোটের কালি মানেই সেই ব্যক্তির সিদ্ধান্তের গুরুত্বের মুখাপেক্ষী রাষ্ট্র। যখন সোশ্যাল মিডিয়া আসেনি, আঙুলে ভোটের কালির গুরুত্ব ছিল এক অন্যরকম। সোশ্যাল মিডিয়া পরবর্তী সমাজে ভোটব্যবস্থা যে আসলে এক 'উৎসব' তা প্রমাণিত। ভোট সুনিশ্চিত করার প্রমাণ আঙুলে কালির দাগ৷ সেই কালি ওঠে না সহজে। দীর্ঘদিন থেকে যায় গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসবে সামিল হওয়ার প্রমাণটি। ভোটারদের আঙুলে ব্যবহৃত এই প্রায়-স্থায়ী রংটিই কেন ব্যবহৃত হয়? ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটার জালিয়াতি প্রতিরোধে এই কালির ব্যবহার শুরু করল কীভাবে?
এই ভোটের কালির ব্যবহার ভারতে শুরু হয় ১৯৬২ সালে। তারপর থেকে সমস্ত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে ব্যবহার করা হয়েছে এই বিশেষ কালি। নাগরিকদের কর্তব্য এবং গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের এই চিহ্ন স্থানীয় প্রশাসনিক সংস্থার নির্বাচনেও ব্যবহৃত হয়। নির্বাচনী এই কালিটি নির্বাচনী বিধি, ১৯৬১-র বিধি ৪৯কে-এর অধীনে ব্যবহৃত হয়। এই বিধিতে কোনও ভোটারের জালিয়াতি রুখতে নির্বাচকের বাম আঙুলে একটি কালির চিহ্ন দেওয়ার কথা বলা আছে।
নির্বাচনী কালিটি প্রায়-স্থায়ী একটি কালি। যার ফলে সহজে তা ওঠে না। একবার ভোট দিয়ে সেই কালি মুছে ফেলে আবার কোনও ভোটার ভোট কারচুপি করতে পারেন না তাই। একই ব্যক্তির একাধিক ভোটদান প্রতিরোধে সাহায্য করে এই কালি। নির্বাচন কমিশন ভোট প্রক্রিয়ার সততা ও সুষ্ঠুতা বজায় রাখতে তাই এই কালির শরণাপন্ন হয়।
আরও পড়ুন- ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সাধারণ জনগণের কিছুই এসে যায় না
এই কালি দিয়ে আঙুলে ছাপ দেওয়া মানে তা সহজেই দৃশ্যমান, সহজেই মুছে ফেলা যায় না। ফলে ভোটারদের জালিয়াতি করাও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু চাইলে কি এই কালি ব্যবহার করতে পারেন যে কেউ? যে কোনও কারণে?
নির্বাচনী কালি কিন্তু সহজেই বাজারে চাইলেই পাওয়া যায় না, সাধারণ মানুষের জন্য এই কালি উপলব্ধ নয়। ১৯৬১ সালে এই কালি তৈরি করে ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি (NPL)। নয়াদিল্লির CSIR-এর একটি গবেষণাগার হচ্ছে এই এনপিএল৷ এই কালির স্বত্ত্ব রয়েছে CSIR-ন্যাশনাল রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনরই (NRDC)৷ এনআরডিসি ১৯৬২ সালে কর্ণাটক সরকারের অধীনস্থ মাইসোর পেইন্টস অ্যান্ড বার্নিশ লিমিটেডকে এই কালি ব্যবহারের লাইসেন্স এবং ব্যবহারের যাবতীয় বিধি ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
CSIR-NRDC এবং MPVL-এর মধ্যে এই না মুছতে পারা কালির একচেটিয়া উত্পাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই থেকে, MPVL ভারতের নির্বাচন কমিশনের জন্য এই কালি প্রস্তুত করে চলেছে। ভারতের একমাত্র অনুমোদিত প্রস্তুতকারক এই সংস্থাই।
প্রাথমিকভাবে, নির্বাচনী কালিটি কাঁচের বোতলে ভরেই সরবরাহ করা হতো কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতি হওয়ার পরে MPVL প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করে। এর ফলে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষে এই কালি দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়ে নিয়ে যাওয়াও সুবিধাজনক হয়েছে।
MPVL মালয়েশিয়া, কানাডা, কম্বোডিয়া, ঘানা, আইভরি কোস্ট, আফগানিস্তান, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, নেপাল, মাদাগাস্কার, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মঙ্গোলিয়া, সিয়েরা লিওন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক সহ ৩০টিরও বেশি দেশে এই কালি রপ্তানি করে।
আরও পড়ুন- ভোটের আগে নয়া জুজু! কেন সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হল কংগ্রেসের দলীয় অ্যাকাউন্ট?
নির্বাচনী কালিতে সিলভার নাইট্রেট থাকে যা ত্বক এবং নখের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে কিছুকালের জন্য স্থায়ী একটি চিহ্ন রেখে যায়। কালি ত্বকে দেওয়ার কিছু পরেই শুকিয়ে যায় এবং এক মিনিটেরও কম সময়ে কালো/বেগুনি একটি চিহ্ন রেখে যায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে এই চিহ্ন আমাদের আঙুলে থেকে যায়। এই কালি ত্বকের জন্য নিরাপদ এবং জল, ডিটারজেন্ট, সাবান এবং অন্যান্য দ্রাবকেও তা ক্ষয়ে উঠে যায় না। ফলে একজন ভোটার সহজেই এই চিহ্ন মুছে ফেলতে পারবেন না এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার ভোট দিতে পারবেন না।
ভোটকেন্দ্রে ভোটারের পরিচয় যাচাই করার সঙ্গে সঙ্গেই ভোটারের বাম হাতের তর্জনীতে এই কালি লাগিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচকরা ভোট দিয়ে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই এই কালি শুকিয়ে দাগ তৈরি হয়ে যায়।
আপনি কি চাইলেই এই কালি আঙুলে লাগাতে অস্বীকার করতে পারেন? ভোটার যদি নির্দেশ অনুযায়ী বাম তর্জনীতে কালি লাগাতে না চান, বা তাঁর হাতে যদি আগে থেকেই কোনও কালি থাকে তাহলে তাঁকে ভোট দিতে দেওয়া হবে না। ভোটাররা ওই কালির চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য কিছু করলেও ভোট দিতে তাঁদের বাধা দেওয়া হবে। যদি আঙুলে কোন তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত পদার্থ লেগে থাকে, অর্থাৎ ভোটার যদি আগে থেকে কোনও তেল বা ক্রিম জাতীয় পদার্থ লাগিয়ে আসেন কালি মোছার জন্য তাহলে নির্বাচনী কর্মকর্তারা প্রথমে আঙুলটি পরিষ্কার করবেন এবং তারপরে কালি দেবেন।