সারা কলকাতা জানে 'থিঙ্ক চাইনিজ, থিঙ্ক চাওম‍্যান', যেভাবে শুরু হল চাওম্যানের যাত্রা!

Chowman Kolkata: 'চাওম‍্যান' ও 'আউধ ১৫৯০'-এর কান্ডারি দেবাদিত‍্য চৌধুরী এই মুহূর্তে শহরের অন‍্যতম বড় হোটেলিয়ার।

গানেও আছেন, খাবারেও। লক্ষ্মী তাঁকে ঘিরে থাকে, কিন্তু 'লক্ষ্মীছাড়া'-কে ছাড়েননি আজও। 'চাওম‍্যান' ও 'আউধ ১৫৯০'-এর কান্ডারি দেবাদিত‍্য চৌধুরী এই মুহূর্তে শহরের অন‍্যতম বড় হোটেলিয়ার। ব‍্যস্ততার ফাঁকে ধরা দিলেন ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে।


'চাওম‍্যান'-এর জার্নি শুরু হয়েছিল কীভাবে?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: 'চাওম‍্যান'-এর জার্নি শুরুর কথা বলতে গেলে আমার ব‍্যক্তিগত জার্নির কথাটা বলতে হয় আগে। আমি 'লক্ষ্মীছাড়া' নামে একটি জনপ্রিয় বাংলা রক ব‍্যান্ডের সদ‍স‍্য ছিলাম। শো করার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতাম, এবং যেখানেই যেতাম, সেখানকার স্থানীয় রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারতাম। কোনও ফাইভ স্টার হোটেল নয়, ছোটখাটো রেস্তোরাঁ। সেই অভিজ্ঞতাগুলো ফিরে এসে বন্ধুদের বলতাম। এর মাঝেই একটি নামী এফএম চ‍্যানেল একটি অনুষ্ঠান করতে বলল আমাকে। অনুষ্ঠানটার নাম ছিল, 'খেতে খেতে চলো দেবাদিত‍্যর সাথে'। কলকাতার নানা জানা-অজানা রেস্তোরাঁর কথা সেখানে উঠে এসেছিল। তারপর কিছু টাকা জমিয়ে প্রথমে গলফ ক্লাব রোডে ছোট পরিসরে চালু হল 'চাওম‍্যান'। কলকাতায় এত চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, আমি আবার নতুন করে একটা রেস্তোরাঁ খুলব কেন? আসলে এক্ষেত্রে আমার কনসেপ্টটা একটু আলাদা ছিল। আমি আলফ্রেড ফোর্ডের খুব ভক্ত, উনি অটোমোবাইলের ধারণাটির সাধারণীকরণ করতে চেয়েছিলেন। তিন লাখ থেকে তিন কোটি, সবরকমের গাড়ি রাখতে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। আমিও ঠিক করলাম ফাইন ডাইনিং সকলের কাছে পৌঁছে দেব। ফাইন ডাইনিং সকলের কাছে অ্যাফর্ডেবল নয়, প্রথমত। দ্বিতীয়ত, এটিকেট, ম‍্যানারস ইত‍্যাদির কথা ভেবে অনেকেই ফাইন ডাইনিংয়ে যেতে চান না। সেই কারণে আমি গলিতে গলিতে 'চাওম‍্যান' করলাম, যাতে ফাইন ডাইনি‌ংয়ের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব ঘুচে যায়।

একটা প্রজন্মের স্মৃতিতে আপনি 'লক্ষ্মীছাড়া'-র সদ‍স‍্য হিসেবেই বেশি পরিচিত। আবার এখন 'চাওম‍্যান'-ই আপনার পরিচিতি। সংগীত এবং খাওয়াদাওয়া, এই দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগ আছে আপনার যাপনে?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: অবশ্যই। দুটোই সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত। আর 'চাওম‍্যান'-এর ডেকর, মেনু- ইত‍্যাদির ভাবনার মধ্যেও কিন্তু সৃজনশীলতা আছে। কীভাবে নতুন খাবারের সঙ্গে মানুষের পরিচয় করানো যায়, সেটাও তো সৃজনশীল ভাবনা। তবে 'চাওম‍্যান' অত‍্যন্ত সফল এন্টারপ্রাইজ এখন নিঃসন্দেহে, এবং সেই সূত্রে আমিও অনেক পুরস্কার পাই, স্বীকৃতি পাই; কিন্তু 'লক্ষ্মীছাড়া'-র ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে আমার পরিচিতিটাকে আমি অবহেলা তো করিই না, বরং সেটাকেই অগ্রাধিকার দিই। এখনও কনসার্টে যাই 'লক্ষ্মীছাড়া'-র।

কলকাতায় অনেক মাল্টিকুইজিন রেস্তোরাঁ আছে, যেখানে চাইনিজ পাওয়া যায়। এছাড়া টেরিটিবাজার, চায়নাটাউন, মেনল‍্যান্ড চায়নার মতো খুব খাঁটি চাইনিজের ঠিকানাও রয়েছে। 'চাওম‍্যান'-এর চাইনিজকে আলাদা করার, অভিনব করার কোনও ভাবনা আপনার ছিল?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: হ্যাঁ। সেটা অবশ্যই ছিল। পাঁচতারা রেস্তোরাঁর খাবার একতারার দামে, এটাই আমাদের ব‍্যবসার মূল লক্ষ্য ছিল। আম‍রা ফাইন ডাইনিংয়ের ক্ষেত্রেও কোনও কার্পণ্য রাখিনি। কাজেই কেবল খাবার নয়, 'চাওম‍্যান' একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা। আমাদের জলের বোতলটাও নিজস্ব।

এই সুইগি-জোমাটোর যুগে আপনাদের ডেলিভারি সিস্টেমও তো নিজস্ব...

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: হ্যাঁ। ২০১০-এ যখন শুরু করি, তখন থেকেই আমরা নিজস্ব হোম ডেলিভারির ব‍্যবস্থা রেখেছি, কলকাতার যে কোনও চাইনিজ ফুড চেনের থেকে আমাদের এই হোম ডেলিভারির চাহিদা বেশি। সুইগি-জোমাটোতেও সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় আমাদের খাবারই। আমরা চপস্টিক দিই, আমাদের প‍্যাকেজিং অভিনব। বাড়িতে বসেও যাতে ফাইন ডাইনিং অ্যাভেল করা যায়, তার ব‍্যবস্থা আমরা রাখি।

এই মুহূর্তে 'চাওম‍্যান'-কে কি শুধু চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বলবেন, না কি এসিয়ান রেস্তোরাঁও বলবেন?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: এমনিতে আমরা বলি, 'থিঙ্ক চাইনিজ, থিঙ্ক চাওম‍্যান'। যাতে চাইনিজ বলতেই 'চাওম‍্যান'-এর কথা মনে হয়। কিন্তু বিশ্বায়নের পর বহু মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার নানা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানকার খাবারের স্বাদ পাচ্ছেন, কলকাতায় সেই খাবারের সন্ধান পেতে চাইছেন। আমরা তাদের কথা মাথায় রেখে একটা থাই সেকশন রেখেছি। র‍্যামেন, থাই বওল, বার্মিজ খাউসুয়ে- বিভিন্ন দেশের একটি করে সিগনেচার ডিশ আমরা মেনুতে রেখেছি। কিন্তু মূলত আমরা চাইনিজ।

কলকাতার মতো জায়গায় একটা এই ধরনের চাইনিজ ফুড চেন চালানোর চ‍্যালেঞ্জ কতটা?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: চ‍্যালেঞ্জ তো প্রথম দিন থেকেই ছিল। এমনিতেই বাঙালি ব‍্যবসা করতে পারে না, এই একটা মিথ আছে, সেই মিথটাও আমি ভাঙতে চেয়েছিলাম। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে নামী রেস্তোরাঁর মধ্যে একটা 'চাওম‍্যান'। এছাড়াও আমরা রাজ‍্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে বেঙ্গালুরু, দিল্লিতে পৌঁছে গেছি, শিগগিরই মুম্বই, পুনে, হায়দরাবাদে ব্রাঞ্চ খুলতে চলেছি আমরা। এই মুহূর্তে ম‍্যানপাওয়ার একটা বড় চ‍্যালেঞ্জ। কারণ প্রতি বছর আমাদের ছ'টা থেকে আটটা আউটলেট খুলছে, সেখানে আমাদের প্রবল ম‍্যানপাওয়ার প্রয়োজন, যেটা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। সেই চ‍্যালেঞ্জটারও সম্মুখীন হয়েছি আমরা আমাদের মতো করে।

আমরা শুনেছি, 'চাওম‍্যান'-এর বহু ইনগ্রেডিয়েন্টস বাইরে থেকে আসে। আপনি নিজে গিয়ে সেগুলো সংগ্রহ করে আনেন...

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: প্রথম যখন 'চাওম‍্যান' শুরু হয়েছিল, তখন খাবারে ভিন্ন স্বাদ আনার জন্য সসগুলো আমরা ইমপোর্ট করিয়েছি। চিন থেকে থাইল্যান্ডে আসত, সেখান থেকে আমি নিজেই যেতাম সেগুলো সংগ্রহ করতে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন ব‍্যবসার পরিসর বাড়ল, তখন থেকে আর আমি নিজে যেতে পারি না। কিন্তু থাইল্যান্ড থেকেই এখনও সস আমদানি হয়, প্রায় প্রতি সপ্তাহে কার্টন কার্টন সস আসে।

এর পিছনে তো রীতিমতো রিসার্চও আছে। কোন খাবারে কোন সস লাগে...

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: প্রচণ্ড। আমি সবাইকেই বলি, এটা আমার কাছে কোনও ব‍্যবসা নয়, এটা আমার প‍্যাশন। প‍্যাশনের জন্য তো খাবারটা নিজের ভালো লাগতে হবে আগে। নিজের না ভালো লাগলে সেটা বিক্রি করব কী করে?

'আউধ ১৫৯০'-এর ভাবনা কি 'চাওম‍্যান'-এর সাফল‍্যের পর এসেছে, না কি তা আগে থেকেই ছিল?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: 'চাওম‍্যান' আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব। আমার দাদা, যার সঙ্গে আমি বড় হয়েছি। 'চাওম‍্যান' কিছু দূর এগোনোর পর আমি আর দাদা ঠিক করলাম, একসঙ্গে কিছু করব‌। কলকাতায় বিরিয়ানির দোকান ছিল হয় খুব দামি, নয়তো ততটা পরিবারের যাওয়ার জন্য নয়। এর মাঝামাঝি কিছু ছিল না। এই মাঝের ব্র‍্যাকেটটাতে 'আউধ'-কে নিয়ে এলাম। লখনউতে থেকে, রিসার্চ করে এটার পরিকল্পনা করলাম। বিরিয়ানির একটা অন্য ধারণা তৈরি হলো, কলকাতায় আওয়াধি হান্ডি বিরিয়ানি বা গালৌটি কাবাবকে নতুন করে জনপ্রিয় করল 'আউধ'।

দুটোই খাঁটি কুইজিনের জায়গা, একটা মোগলাই, একটা চাইনিজ...

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: ওই যে বললাম, আমার নিজের যা পছন্দ হবে না, সেই খাবার বিক্রি করব না। আরেকটা জিনিস লক্ষ করবেন, এই দু'জায়গাতেই খাবার খেয়ে কারও শরীর খারাপ করবে না। কারণ খাঁটি উপকরণ দিয়েই এগুলো বানানো।

কলকাতার বাইরে 'চাওম‍্যান'-এ কারা খেতে আসেন? মূলত বাঙালিরাই?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: প্রাথমিকভাবে বাঙালিরাই, কিন্তু স্থানীয় মানুষও উপচে পড়ছেন 'চাওম‍্যান'-এ এখন।

সামনে বড়দিন। উৎসবের মরশুমে রেস্তোরাঁর খাবারের মান একটু পড়ে যায় অনেক জায়গায়। আপনারা এক্ষেত্রে খাবারের গুণমান বজায় রাখেন কী করে?

দেবাদিত‍্য চৌধুরী: কিছু কঠিন ডিশ, যেগুলো তাড়াহুড়ো করে বানালে খারাপ হতে পারে। সেগুলো আমরা ওই সময় রাখি না। তাছাড়া আমাদের বিশাল টিম আছে, তারা এই নিয়ে পরিকল্পনা করে রাখে আগে থেকেই। আমরা যে কোনও উৎসবের জন্য তাই তৈরি থাকি।

 

More Articles