ভোরবেলা প্রকাশ্যে পিস্তল হাতে লড়েছিলেন হেস্টিংস! কলকাতার এই রাস্তায় গিয়েছেন কখনও?

Kolkata Duel Avenue History: পিস্তল হাতে দু'জন পরস্পরের থেকে ঠিক ১৪ পা দূরে দাঁড়ান। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজতেই গোনা শুরু হয়- এক, দুই, তিন!

'দ্বন্দ্ব' শব্দটির ইংরেজি করলে 'ডুয়েল' দাঁড়ায় ঠিকই, তবে সবসময় সেই ডুয়েল শারীরিক নয়, মানসিকও। সম্মুখ সমরে 'ডুয়েল' বলতে কী বোঝা উচিত তা আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে বিভিন্ন হলিউড সিনেমা। ডুয়েল বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিস্তল হাতে লম্বা 'হ্যাট' পরিহিত দু'টি মানুষ। দু'জন মানুষের হাতেই রয়েছে একটি করে পিস্তল এবং তাতে রয়েছে একটি করে গুলি। দু'জন একইসঙ্গে দু'জনের দিকে লক্ষ্য করে বন্দুক চালাবে। যে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে সে বেঁচে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই, অপরজন হয় আহত হবে, নয় নিহত। কলকাতা শহরেও এমন এক ডুয়েল হয়েছিল। ঐতিহাসিক সেই ডুয়েলের সাক্ষ্য মেখে খাস কলকাতায় এখনও রয়েছে একটি স্থান।

শুরু করা যাক সাধারণ একটি প্রশ্ন দিয়ে। ভারতের সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেবি কোনটি? উত্তর জানাই, ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা জাতীয় গ্রন্থাগার যা দক্ষিণ কলকাতার আলিপুরে অবস্থিত। কয়েক লক্ষ বই-পুস্তিকা এবং দলিল-দস্তাবেজের সমাবেশ এই গ্রন্থাগারে। এই ন্যাশনাল লাইব্রেরিরই উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি গাছে ঘেরা রাস্তা। রাস্তাটির নাম ডুয়েল অ্যাভিনিউ। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, এই রাস্তাতেই লড়া হয়েছিল সেই ডুয়েল। ১৭৮০ সালের ২৫ অগাস্ট, ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় এই রাস্তাতেই ডুয়েল লড়েছিলেন দুই ইংরেজ ভদ্রলোক। প্রথম জন ছিলেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এবং দ্বিতীয় জন ফিলিপ ফ্রান্সিস। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই লড়াই? ওয়ারেন হেস্টিংস এবং ফিলিপ ফ্রান্সিসের মধ্যে 'দ্বন্দ্ব'ই বা কেন ছিল? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে। তবে ইতিহাসেরও কাছে যাওয়ার আগে আমাদের ফিরে যেতে হবে মহাভারতের কালে।

মহাভারত যুদ্ধের শেষে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে সুযোগ দিয়েছিলেন একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধ অর্থাৎ 'ডুয়েল' লড়ার। দ্বন্দ্বে ভীমকে হারাতে পারলেই তিনি ফিরে পাবেন তাঁর রাজপাট। তবে সেই গদাযুদ্ধের পরিণাম কী হয়েছিল তা আমরা সকলেই জানি। কিছুটা যুদ্ধের নিয়ম ভেঙেই ভীম দুর্যোধনের কোমরের নিচে, উরুতে আঘাত করেন এবং পরাজিত হন দুর্যোধন। দুর্যোধনের পরাজয়ের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় মহাভারতের যুদ্ধ। মহাভারত ছাড়াও প্রাচীন ভারতে কিন্তু এই ডুয়েল প্রথা প্রচলিত ছিল। সেই সময় অবশ্য এই যুদ্ধ বন্দুক দিয়ে লড়া হতো না, এর নিয়ম ছিল একটু অন্য রকমের।

জাতীয় গ্রন্থাগার, কলকাতা

আরও পড়ুন- ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কীসের চোরাকুঠুরি? বাংলার গুপ্তধন নিয়ে রয়েছে যে যে জল্পনা

ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ভারতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রচলন ছিল। মূলত মৃত্যুর সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে উপনীত হতো একে অপরের সঙ্গে। যুদ্ধের শেষে একজন বেঁচে থাকত এবং আরেকজন নিহত হতো। যে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকল অর্থাৎ যুদ্ধ জিতে গেল, সে ছাড়া পেয়ে যেত। এছাড়াও বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেই দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রচলন ছিল। অন্যান্য মানুষদের ক্ষেত্রে হত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হলেও শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে জিতে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো। সেই যুদ্ধ অবশ্য কোনও মানুষের সঙ্গে লড়া হতো না। সেই যুদ্ধ লড়তে হত বদ্ধভূমিতে হিংস্র পশুর সঙ্গে। পশুকে হারাতে পারলেই জীবনদান, নচেৎ বদ্ধভূমিতেই বীরগতি। পর্তুগিজ ভূপর্যটক দুয়ারতে বারবোসা লিখেছেন,

‘ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেমঘটিত কারণেও দ্বন্দ্বের চল ছিল। কোনও নারীকে পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনও স্থানে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হতো দুই পুরুষ। যুদ্ধের অস্ত্র বলতে ঢাল-তলোয়ার এবং একটি ধারালো ছুরি। তবে দ্বন্দ্বযুদ্ধ যে কারণেই হোক, দুই যোদ্ধার সঙ্গে একজন সঙ্গী থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। তাদের কাজ ছিল যুদ্ধের নিয়ম ঠিকমতো পালন হচ্ছে কিনা তা দেখা। কোনও সম্ভ্রান্ত বংশের দুই পুরুষের দ্বন্দ্বযুদ্ধ হলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক সময় রাজারাও সেই যুদ্ধ দেখতে আসতেন।’

এই তো গেল ভারতে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ইতিহাসের কথা। ভারতের পাশাপাশি ইউরোপেও এই দ্বন্দ্বযুদ্ধ কিংবা ডুয়েল সমান জনপ্রিয় ছিল। ১৮ শতকের শেষ ভাগে পশ্চিমের অধিকাংশ মানুষের কাছেই বন্দুক ছিল সহজলভ্য। ফলত কথায় কথায় ডুয়েল লড়া এক প্রকার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এর যথাসম্ভব ফায়দা তুলছিল বন্দুকের কোম্পানিগুলি। একটা সময় ডুয়েলের জন্য পিস্তলের সেট পর্যন্ত বানাতে শুরু করল তারা। এই সেটে থাকত দু'টি পিস্তল, দু'টি গুলি এবং অন্যান্য যাবতীয় সরঞ্জাম। সাধারণ পিস্তলের তুলনায় এই পিস্তলগুলির নল লম্বা এবং ভারী হতো যাতে সঠিকভাবে লক্ষ্যভেদ হয়। বন্দুকের নলগুলিকে বাদামি রঙ দিয়ে রঙ করা হতো যাতে সূর্যের আলোয় সেগুলি চকচক না করে। পিস্তলের গুলিও সাধারণ পিস্তলের গুলির তুলনায় অনেকটাই লম্বা এবং ভারী হতো। পিস্তলের গুলি যাতে একবারেই সামনের জনকে গুরুতর আহত কিংবা নিহত করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্যই এমন ব্যবস্থা। আগেই বলেছি, ডুয়েলের অলিখিত নিয়ম যে, এক পক্ষকে গুরুতর আহত কিংবা নিহত হতে হবে।

ফিলিপ ফ্রান্সিস

যাইহোক, ইতিহাসের পাতা থেকে এবার ফিলিপ ফ্রান্সিস এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের যুদ্ধে ফিরে আসা যাক। হেস্টিংস এবং ফ্রান্সিস দু'জনেই নিজেদের জীবন মোটামুটি একইভাবে শুরু করেছিলেন। ১৭৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে একজন ক্লার্ক হিসেবে যোগ দেন হেস্টিংস। পলাশির যুদ্ধের পরে তাকে মুর্শিদাবাদে রেসিডেন্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। রেসিডেন্ট অফিসার অর্থাৎ নবাবের সামনে কোম্পানির প্রতিনিধি। ১৭৬৯ সালে কলকাতার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন ওয়ারেন হেস্টিংস। এরপর ১৭৭২ সাল নাগাদ ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। অন্যদিকে ফিলিপ ফ্রান্সিসও ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাকে প্রশাসনিক কর্তা বানিয়ে কলকাতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানি। আর এখানেই শুরু হয় দু'জনের দ্বন্দ্ব।

কলকাতা তথা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শাসনভার দেখার জন্য একটি সুপ্রিম কাউন্সিল গঠন করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সুপ্রিম কাউন্সিলের একজন সদস্য ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে এই কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসও। যখনই শাসন সংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার হতো হেস্টিংস এবং ফ্রান্সিসের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যেত। ওয়ারেন হেস্টিংস নিজের মতো শাসনকার্য চালাতে চাইতেন, কিন্তু ফ্রান্সিস চেষ্টা করতেন সুপ্রিম কাউন্সিলকে বড় করে দেখানোর। সুপ্রিম কাউন্সিলের ক্ষমতা জাহির করতে হেস্টিংসের সব কাজেই 'ব্যাগড়া' দিতে শুরু করেন ফ্রান্সিস। কর্মক্ষেত্রের এই বিরোধ প্রথমে দ্বন্দ্ব, তারপর বিদ্বেষ এবং শেষ পর্যন্ত শত্রুতায় পরিণত হয়। হেস্টিংস নিজেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকেও বড় করে দেখাতে চান এমনটাই প্রমাণ করতে চাইতেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। নিজের দাবি কোম্পানির কাছে প্রমাণ করতে বেশ কিছু নথিপত্রও জোগাড় করে ফেলেন তিনি। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার। ফ্রান্সিস হেস্টিংসের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হলে সেখানে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। মনে করা হয়, এই কারণেই নন্দকুমারের উপর চটে গিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে উদ্যত হন হেস্টিংস। বলাই বাহুল্য, হেস্টিং সফল হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় প্রথম ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন নন্দকুমার।

ওয়ারেন হেস্টিংস

নন্দকুমারের ফাঁসির কয়েক বছরের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় সুপ্রিম কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যদেরও। জীবিত বলতে শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। কলকাতা তথা ভারতে হেস্টিংস বিরোধী স্বর বলতে একমাত্র ছিলেন তিনিই। ১৭৭৫ সালে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধে উপনীত হয় ইংরেজরা। সেই যুদ্ধ চলে প্রায় পাঁচ বছর। এই যুদ্ধ চলাকালীন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে বারবার আর্থিক তছরুপের অভিযোগ আনেন ফ্রান্সিস। অভিযোগের পাশাপাশি প্রমাণসহ সব নথিপত্র তিনি লন্ডনেও পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। দু'জনের সংঘাত এতটাই চরমে পৌঁছয় যে ১৭৮০ সাল আসতে আসতে সুপ্রিম কাউন্সিলের প্রায় প্রতিটি মিটিংয়েই হেস্টিংস এবং ফ্রান্সিসের বাক-বিতণ্ডা অনিবার্য ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই বিতণ্ডা শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। অগাস্ট মাসের এক মিটিংয়ে দু'জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি এতটাই চরমে পৌঁছয় যে আইনের পরোয়া না করে ফ্রান্সিসকে ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেন হেস্টিংস। 'আইনের পরোয়া না করে' অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতে এই ডুয়েল ছিল সম্পূর্ণ আইনবিরোধী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই সময়ের আইন অনুযায়ী, ডুয়েলে কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে অপর ব্যক্তিকে হত্যার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হতো।

আরও পড়ুন- জোব চার্নক তামাক খেয়েছিলেন গাছতলায় বসে, কলকাতার এই বাজারের নাম সাক্ষী ইতিহাসের

ডুয়েল অ্যাভিনিউ

যাই হোক, হেস্টিংসের সেই চ্যালেঞ্জ সদর্পে গ্রহণ করেন ফ্রান্সিস। ঠিক হয় ২৫ অগাস্ট ভোরবেলা সবার অলক্ষ্যে লড়া হবে এই ডুয়েল। স্থান, আজকে যেই রাস্তাকে আমরা ডুয়েল অ্যাভিনিউ বলে চিনি। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে দু'জনেই নিজের সঙ্গীর সঙ্গে সেই শুনশান গাছগাছালিতে ঘেরা গলিতে হাজির। দু'জনের হাতেই পিস্তল এবং তাতে একটি করে গুলি। পিস্তল হাতে দু'জন পরস্পরের থেকে ঠিক ১৪ পা দূরে দাঁড়ান। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজতেই গোনা শুরু হয়- এক, দুই, তিন! ঠিক তিনের মাথায় কান ফাটানো শব্দ করে চলে একটি গুলি এবং একই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় এই বহু প্রতীক্ষিত ডুয়েল। জিতেছিল কে? সরাসরি এর উত্তর না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলি। ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের গভর্নর ছিলেন ১৭৮৫ পর্যন্ত। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ১৭৮০ সালের সেই ডুয়েল কে জিতেছিল। এই ডুয়েলে গুরুতর আহত হন ফিলিপ ফ্রান্সিস। তার ডান কাঁধে গিয়ে লাগে গুলিটি। মুহূর্তেই ধরাশায়ী হয়ে যান তিনি। হেস্টিংস এতই দ্রুত বন্দুক চালিয়েছিলেন যে গুলি চালানোর সুযোগ পর্যন্ত পাননি ফ্রান্সিস।

রাগের মাথায় ডুয়েল লড়তে এলেও, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হেস্টিংস গুলি চালিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি কত বড় ভুল করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়া ফ্রান্সিসের কাছে ছুটে যান হেস্টিংস এবং তাঁকে নিজের জুড়ি গাড়িতে চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। কাঁধে গুলি লাগায় তড়িঘড়ি চিকিৎসা করানোয় শীঘ্রই সুস্থ হয়ে ওঠেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। এরপর ১৭৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার সুপ্রিম কাউন্সিল ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে পাড়ি দেন তিনি। ফ্রান্সিস দেশে ফিরে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। কিন্তু গুলি খাওয়া ফ্রান্সিস পণ করে নিয়েছিলেন ভারতের এই গভর্নর জেনারেলের থেকে তিনি প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বেন। ভারত থেকে যাওয়ার সময় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ এবং নথি নিজের সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রান্সিস।

শিল্পীর কল্পনায় সেই ডুয়েল

১৭৮৪ সালে লিবারেল পার্টির টিকিটে ভোটে দাঁড়ান ফ্রান্সিস এবং জিতেও যান। সাংসদ হয়ে পার্লামেন্টে ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে একের পর এক নথি পেশ করতে থাকেন তিনি। পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাপে ১৭৮৫ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তার বদলে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন লর্ড কর্নওয়ালিস। এরপর আগামী বেশ কয়েক বছর ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে মামলা চলে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন আদালতে। মামলাগুলি জিতলেও, এর খরচ টানতে টানতে একপ্রকার ফতুর হয়ে যান ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল। ভারত থেকে মোটামুটি যা অর্থ উপার্জন করেছিলেন হেস্টিংস, তার সবই চলে যায় মামলা লড়তে। রাজনীতির ময়দানে নেমে হেস্টিংসকে এক প্রকার পথে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন ফ্রান্সিস। একে ফিলিপ ফ্রান্সিসের নৈতিক জয় বলে ধরে নেওয়া যেতেই পারত যদি না একটি ঘটনা ঘটত। কথায় বলে, মরা হাতি লাখ টাকা। ১৮০৭ সালে এর জলজ্যান্ত প্রমাণ পান ফিলিপ ফ্রান্সিস। সেবছর জুন মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে নিজের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন তিনি। ফ্রান্সিসকে জানানো হয়েছিল যে, তিনিই হতে চলেছেন ভারতের পরবর্তী গভর্নর জেনারেল। এই খবর জানতে পেরেই নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখান ওয়ারেন হেস্টিংস। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্রিটেনের রাজনৈতিক মহলে তখনও বেশ ক্ষমতা ছিল হেস্টিংসের। নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফ্রান্সিসের গভর্নর জেনারেল হওয়া ভেস্তে দেন হেস্টিংস। পরিবর্তে ১৮০৭ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হন হেস্টিংসের আস্থাভাজন লর্ড মিন্টো। এই রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ফিলিপ ফ্রান্সিস। এরপর রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে একপ্রকার গুটিয়ে নেন তিনি। ১৮১৮ সালে ঠিক চার মাসের ব্যবধানে প্রয়াত হন এই দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ এবং মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় তাদের এই বৈরিতা।

More Articles