একজনে ছবি দেখে একমনে

শীতের শহরে সার্কাস আসে। সিনেমাও আসে। শহরে তো বটেই, শহরতলি, মফসসলে এমন কিছু ছেলেমেয়ে সবসময় থাকত, নিশ্চয়ই আজও আছে, যাদের ইচ্ছেরা বুনোফুলের মতো বেয়াড়া। শীত এলে তারা হাতির পাঁচ পা দেখে। ঘরের খেয়ে পরের ফিল্ম দেখতে যায়। মা সাতসকালে পরোটা আর আলুভাজা টিফিনকৌটোয় ভরে দিয়েছে। আর ওরা আগের রাতেই দেখে রেখেছে কোথায় কোন ছবি, গুরু ধরে জেনে নিয়েছে কী কী দেখতে হবে। গুরু বলেছে, হাতে সাতদিন, রোজ তিনটে ছবি দেখতেই হবে। কাঁধে কলেজের ব্যাগ, সাতসকালে সেইসব ছেলেরা যে যার মতো নগরের কেন্দ্রস্থিত নন্দনে যাচ্ছে, ৯টার শো ধরতে হবে। অত বড় হলে ঘুঁটঘুটে অন্ধকারে ওরা প্রত্যেকে একা। বেলা বাড়লে ফাঁকতালে খেয়ে নেবে বাড়ির খাবার। কেননা পকেটে স্রেফ যাতায়াতের টাকাটুকুই আছে। রাতে যখন বাড়ি ফিরবে, ওই ফাঁকা টিফিনকৌটোয়, ওদের সঙ্গে ফিরবে নানা দেশ। কোনোদিন ব্রাজিল, কোনোদিন দক্ষিণ কোরিয়া, কখনও ইরান, কখনও আবার প্যালেস্টাইন। টিফিনবক্সে বিশ্বরূপ। রোজ জমা হওয়া খণ্ড খণ্ড দৃশ্যমালাই সেই দূর দেশের একমাত্র স্মারক হয়ে থেকে যাবে সদ্য কৈশোর শেষ করা মনে। জীবন গড়াবে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। সমস্ত বন্ধুরা ছিটকে যাবে এধার-ওধার। জীবনের প্রেক্ষাগৃহে ওরা সেই ফেলে আসা দিনের মতোই একা। শুধু থেকে যাবে ঈশ্বরসম দৃশ্যমালা, ইমেজে ভর করে যখনতখন ইরান-লেবানন, কাহিনি-আলো-ক্যামেরা—ভ্রমের দেশে ভ্রমণের অন্তিমতম সুযোগ, বর্ণময় পরিচালকদের সঙ্গে সংলাপের অনন্ত সম্ভাবনা। ওরা পরে, অনেক পরে, গভীর রাতে বাড়ি ফিরে খুঁজবে পুরনো ডায়েরি, যদি কোনো এন্ট্রি খুঁজে পাওয়া যায়! দেশান্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনার শিরোনাম দেখে মনে করার চেষ্টা করবে- সিনেমায় কী ঘটেছিল।

মনে পড়ে, একবার ইটালির পরিচালক ন্যানি মোরেত্তির উই হ্যাভ এ পোপ বলে একটা ছবি এল। ন্যানি মোরেত্তি নিজের স্ট্যাম্প সংগ্রহ বিক্রি করে সুপারএইট ক্যামেরা কিনেছিলেন। সিনেমা বানাতে না পারলে ওয়াটারপোলো খেলে জীবন কাটাতেন। রাজ্যে বামজামানা শেষ হওয়ার বছরেই মোরেত্তি বানায়, উই হ্যাভ এ পোপ। সকাল ন'টায় চালানো হলো ওঁর ছবি, এক সাধারণ পাদ্রী পোপ হয়ে গিয়েছেন কাকতালীয় ভাবে, ভোটাভুটির সময়ে সম্ভাব্য পোপেরা এসে না পৌঁছনোয় এই কাণ্ড। এখন এই কাকতালীয় পোপ মেলভিল ভ্যাটিক্যানের রাজকীয় জীবনটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। এত সুখ তার সইছে না। কোনো দায়িত্বই তিনি নিতে চাইছেন না। কেন তিনি এমন বেগড়বাই করছেন বুঝতে সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এই কাকতালীয় পোপ পালানোর তাল করছেন। একসময় সুযোগ পেয়ে তিনি চলেও যান বাইরে। ভ্যাটিক্যানের জানলায় দাঁড়িয়ে জনতাকে বরাভয় দেওয়ার বদলে তিনি পোশাক ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায় গুলতানি করেন, তাস পেটান। অপেক্ষামুখর জনতাকে অন্য সাধুসন্তরা তখন প্রবোধ দিচ্ছেন, এই পোপ এলেন বলে। অবশেষে সদ্য নির্বাচিত পোপ মেলভিলকে ভ্যাটিক্যান খুঁজে বের করে জানলার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ভাবে এবার শান্তিকল্যাণ। কিন্তু হায়! উদ্বেলিত জনতার দিকে তাকিয়ে পোপ বলেন, "তোমরা যে নেতাকে খুৃঁজছ আমি সে নই। আমার কিছুই দেওয়ার নেই।" শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ পথে যেতে যেতে। এই তো চেয়েছিলেন মেলভিন! মোরেত্তি দেখিয়েছিলেন, ভ্যাটিক্যান ব্যবস্থাটা বাইরে থেকে যেমনই দেখাক, ভেতরে ভেতরে কী ঠুনকো! মোরেত্তি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সকলেই ক্ষমতার চেয়ারে বসে ছড়ি ঘোরাতে চায় না, কেউ কেউ ক্ষমতাবিমুখ, কিন্তু ক্ষমতা এ কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। 

এভাবেই দেখা মুসা তুরের ছবি লা পিরোগ। এ ছবি দেখে ওদের কেউ বাড়ি নিয়ে ফিরেছিল একফালি সেনেগাল। সেনেগালের এক গ্রামে কেউ ভালো নেই। কপাল ফেরাতে ওরা অনেকেই ইওরোপ যেতে চায়। ইওরোপে গিয়ে নানাজন নানা কাজে জুটে যাবে, স্বপ্ন এটুকুই। ওদেরই একজন, কাবা, বার্সিলোনায় খেলতে চায়। অতএব দোবরের চ্যাং চলেছে গঙ্গাসাগরে। এক মোটরবোটে ৩১ জন যাত্রী। কেবল একজনই মেয়ে। আটলান্টিক ধরে ক্রমে এগোয় সামান্য নৌকো, একে একে সমস্যা গভীরতর হতে থাকে। খাবার ভাগ নিয়ে সমস্যা, নারীকে নিয়ে সমস্যা, ভাষার সমস্যা, রাতের অন্ধকারে আটলান্টিকের রুদ্ররূপ ছিন্নভিন্ন করে দেয় দলটিকে। নৌকোটাই যেন বিশ্ব। ইওরোপে থিতু হওয়ার স্বপ্ন জলের অতলে তলিয়ে যায়, পথেই মরতে হয় অধিকাংশকে। সেই মৃত্যু মনে করায়-কত না বছরকাল এ ভাবেই আফ্রিকা থেকে ইওরোপে এসেছে দাস, বাড়তি মনে হলে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে তার দেহ। ছবিতে পুলিশ জীবিত ক'জনকে আটক করে। ছবির শেষে, দীর্ঘদিন পর দেখা যায়, রাতের অন্ধকারে গ্রামে ঢুকছে কাবা। চোরের মতো। গায়ে সেই বার্সিলোনার জার্সি। মানুষ মরে, মানু্ষের মারেই মরে, জলে ডুবে যায়। শুধু স্বপ্ন জেগে থাকে, চোরের মতো স্বপ্ন জনপদে প্রবেশ করে রাত গাঢ় হলে। পশ্চিম প্রতিবছর নিশির ডাক ডাকে কালো চামড়ার মানুষজনকে, নতুন দিনের লোভে ওরা ভেলা ভাসিয়ে দেয় অজানিতে। সমুদ্র প্রাণ নেয়, তার অতলে যেন এক ক্ষুধার্ত চুল্লি জ্বলছে। সেদিন আফ্রিকা নিয়ে বাড়ি ফেরে ওদের কেউ।

এখান থেকেই বাড়ি ফেরা ইরানকে সঙ্গে নিয়ে। যে দেশ একজন পরিচালককে কুড়ি বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। মদনতাঁতিরা সুতো না থাকলে ফাঁকা তাত বোনে। নিষিদ্ধ জাফর পানাহি গৃহবন্দি অবস্থায় কেকের মধ্যে চিপ ভরে বিশ্বের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই চিপে ভরা আছে এই বন্দিদশায় মোবাইল ব্যবহার করে তার বানানো ছবি দিস ইজ নট এ ফিল্ম।  এ শহরে অগণিত মানুষের মাঝে বসে দেখা তাঁর ছবি ট্যাক্সি। ট্যাক্সিচালকের ভূমিকায় পরিচালক নিজে। গাড়িতে ওঠা যাত্রীদের মুখের কথায় ধরা পড়ে যায় ইরানের সমাজের ছবি। একজন মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ তার ট্যাক্সিতে ওঠে। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তিনি। মেয়ে জেলে অনশন করছে। পুরুষদের ভলিবল দেখতে যাওয়ার 'অপরাধে' তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার অনশনের কথা যাতে বাইরে না আসে তা সুনিশ্চিত করতে মরিয়া ইরানের প্রশাসন। ভদ্রমহিলা পানাহিকে সাবধান করেন, এসব কথা যেন বাইরে না বলা হয়। পানাহি ট্যাক্সিতে তোলেন স্কুলফেরত ভাগ্নীকে। তার হাতে ছোট ডিজিটাল ক্যামেরা। স্কুল থেকে তাকে বলেছে বাস্তবের আবর্জনা মুক্ত একটি সিনেমা বানাতে। গাড়ির কাচে মুখ রেখে পরিচ্ছন্ন বাস্তব খোঁজে মেয়েটি, কারণ শাসক তেমনই দেখতে ও দেখাতে চায়। ছবির শেষে পানাহি ছোট্ট মেয়েটির হাত ধরে, গাড়ি থেকে নেমে একটা ছোট ঝোরার দিকে রওনা হন। মুখঢাকা বাইকবাহিনী এসে তার গাড়ি ভাঙচুর করে। দেখা যায় গাড়ির ভেতর হয়তো তাদেরই জন্য রাখা রয়েছে একগোছা গোলাপ।

ছুতোর মিস্ত্রির জীবনের গল্প নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন কেন লোচ। মৃণাল সেন কর্মজীবন থেকে ততদিনে অবসর নিয়েছেন, তার রাজ্যের সিনেমা থেকে গরিব মানুষ ততদিনে গায়েব। ফলে সস্তা মানুষকে নিয়ে যে এমন একটা ছবি হতে পারে ওরা কেউ কখনও ভাবেনি। হার্ট অ্যাটাকের ফলে কাজ গিয়েছে ড্যানিয়েলের। ক্রমে নিজেকে অনেকটাই সুস্থ, কর্মক্ষম অবস্থায় দেখতে চান এই বৃদ্ধ। আগের মতোই কাজ করতে পারবেন, মনে করেন ড্যানিয়েল। কিন্তু নানা দফতরের গড়িমসিতে বিপত্নীক এই বৃদ্ধর কাজ পাওয়া আর হয় না। তিনি কম্পিউটার চালাতে জানেন না, সেকেলে লোক, কে তাঁকে অন্যতর কাজ দেবে! এদিকে গৃহহীনা এক মা কাতি সন্তান-সহ তাঁর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। সন্তানকে বাঁচাতে কাতিরও কাজ চাই। বৃদ্ধ স্বজনহীন ড্যানিয়েল চান, ওরা ওর কাছেই থাকুক। পেটে ভাত নেই, কাতি শপিংমল থেকে চুরি করে খাবার খায়, জিনিসপত্র চুরি করে বাড়ি নিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়ে। ড্যানিয়েল-কাতিরা শত অপমানেও মরে না গিয়ে বাঁচে। ড্যানিয়েল স্রেফ চলে যাওয়ার আগে একদিন প্রতিবাদ করেন। স্প্রে জোগাড় করে দেওয়াল জুড়ে লিখে দেন, আমার নাম ড্যানিয়েল ব্লেক, না খেয়ে মরার আগে, ফোনের রিংটোন বদলে ফেলার আগে আমার কাজের আবেদনটা দেখা হোক।

কিছুতেই বাঁচা যাচ্ছে না, তবু বাঁচতেই হয়, চুরি করে, আধপেটা খেয়ে, এ জীবন যে দেখেছে, এই ছবি দেখে তার ঘুম উড়ে যায়। সে বুঝতে পারে ছোটলোকেরও নিজস্ব লন্ডন আছে। এই কেন লোচই বানিয়েছিলেন স্যরি, উই হ্যাভ মিসড ইউ। এক ডেলিভারি শ্রমিক রিকির পরিবারের গল্প। রিকি ডেলিভারির গাড়িটা কেনেন বাড়ির গাড়ি বিক্রি করে। স্রেফ কাজটা বাঁচিয়ে রাখতে গোটা ছবি জুড়ে লাঞ্ছনা সইতে হয় ওঁকে। সময়ে পৌঁছতে হবে তাই বাথরুম সারতে হয় গাড়িতেই। দুষ্কৃতীরা সেই গাড়ির মাল চুরি করে পালানোর সময় ওর গায়েই সেই প্রস্রাব ঢেলে দেয়। মার খেয়ে অপমানিত হয়ে, লাঞ্চিত হয়ে ক্লান্ত দেহটা নিয়ে একদিন বাড়িতে বসে থাকার অধিকার নেই রিকির। কেন লোচ দেখান, পরিবারের শত স্নেহার্দ্র ওজর-আপত্তি থাকলেও ছুটি নেই। নতুন যুগের নতুন দাসকে আমৃত্যু শরীরটাকে খাটাতেই হবে। গোটা পৃথিবীর ডেলিভারি শ্রমিকরা কেমন আছে, আঁচ পায় শহরতলি থেকে ছবি দেখতে আসা কেউ।

টিফিনকৌটোয়  বাড়ি ফিরেছে প্যালেস্টাইন। মাই মাসরির ছবি ৩০০০ নাইটস- এ উঠে এসেছে এক ফিলিস্তিনি স্কুলশিক্ষিকার গল্প। সাদামাটা এই শিক্ষিকা অনেকটা যেন পাশের দেশের অপি করিমের মতো দেখতে। মাইসা এলহাদি নাম। ছবিতে লায়লা আসফৌর। লায়লার অন্যায় যাতায়াতের পথে তিনি এক আহত ফিলিস্তিনি সদ্যযুবাকে গাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাকে জঙ্গি মদতদাতা সন্দেহে জেলে ভরে ইজরায়েলি পুলিশ। ৩০০০ দিন জেলে কাটাতে হয়। জেলেই সন্তানের জন্ম দেন তিনি। সন্তান জেলেই বড় হয়। নারকীয় অত্যাচারে দিন কাটে লায়লার। বাচ্চাকে তার থেকে আলাদা করা হয়। তবু তিনি হারেন না। দমেন না। সেনার দমনপীড়নের সঙ্গে লড়তে তিনি অসহযোগের পথ নেন। ৩০০০ দিন, জীবনের  সমস্ত ফুলেল সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ইহুদি পুলিশ একদিন তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়।

শীতের শহরে সিনেমা এসেছে আবার। শহরতলির কেউ কেউ নিশ্চয় হাত সেঁকছে সেই আগুনে। প্রেক্ষাগৃহে একা। রাতের ফাঁকা লোকাল ট্রেনে ফিরছে বারুইপুর, রানাঘাট, শ্যামনগর। আর কেউ তাকিয়ে আছে পৃথিবীর  দিকে। সম্প্রতি ইজরায়েল জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন এক ফিলিস্তিনি নারী, আহেদ তামিমি। দূরে বসে এ দৃশ্য যে দেখেছে সিনেমাই তাকে পৃথিবী দেখার চোখ দিয়েছে।

More Articles