কলকাতা ভোলেনি বন্দরের 'গ্যাংযুদ্ধ'! সেকালের হত্যাকাণ্ডের সমাধানে ঘুম উড়েছিল পুলিশের

Gang War of Kolkata: মণিময় ব্যানার্জি লেনে নর্দমার ধারে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে একটি ছেলে। জীবিত না মৃত বোঝা যাচ্ছে না! খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে গেলেন ওয়াটগঞ্জ থানার ওসি।

৩০ অগাস্ট, ২০০১। হোলি নয় বলে শুধু ‘হোলি হ্যায়’ বলতে পারছে না ওরা। নচেৎ উদযাপন তার চেয়ে কিছু কম নয়। লোয়ার কোর্ট চত্বরে লাল, নীল, সবুজ বিভিন্ন রঙের আবির উড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে অসময়ে নেমে এসেছে হোলি। একদল যুবক, বলা ভালো গুন্ডা, তাদের চার নেতাকে কাঁধে নিয়ে উচ্ছাসে মেতেছে। সাড়ে তিন বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে তাদের ‘দাদা’-রা। একইসঙ্গে ভেসে আসছে স্লোগান, “লুজার লুজার, লালবাজার!”। দূর থেকে এইসব তামাশা দেখছেন অতনু। মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে তাঁর। কিছুক্ষণ আগে কোর্টের ভেতর যা হল, তা প্রহসনের চেয়ে কম কিছু নয়। ১৯৯৮-এ জোড়া খুনের মামলায় গ্রেফতার হয় বন্দর এলাকার চার ক্ষমতাশালী আসামী। প্রায় তিন বছর মামলা চলার পর, আদালত সম্পূর্ণ একতরফা রায় দিয়ে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে ওই আসামীদের। লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের দুঁদে অফিসার ৩৬ বছর বয়সী অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি এমন কোনও রায় আসতে পারে। অতনু ভেবেছিলেন ফাঁসির সাজা না হলেও নিদেনপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে! সেসব তো হলই না, আসল অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে গেল, উল্টে লালবাজারের চার্জশিটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন বিচারপতি। তিনি নিশ্চিত, হয় অর্থ অথবা প্রতিপত্তির দ্বারা প্রভাবিত করা হয়েছে এই মামলার রায়কে। তবে অতনু মনে মনে ঠিক করে নিলেন, এর শেষ দেখেই ছাড়বেন। কিছুতেই নিজের কেরিয়ারে কালো দাগ লাগতে দেবেন না।

৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৭। সকাল দশটা নাগাদ ওয়াটগঞ্জ থানার নিকটস্থ রামকমল স্ট্রিটে বসে চা খাচ্ছেন উদয় সিং। তাঁর সঙ্গী নরেশ, কল্যাণ, বোমানিয়া, নিতাই এবং উদয়ের ছোট ভাই রঞ্জিত। হঠাৎ করেই পায়ের কাছে এসে বিকট শব্দ করে ফাটল একটি বোমা! ওখানেই লুটিয়ে পড়েছে উদয় সিং এবং নরেশ। বাকিরাও কিছুটা ছিটকে গিয়ে দূরে পড়েছে। চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। তার মাঝেই শুরু হলো গুলির বৃষ্টি! এলোপাথাড়ি চলল গুলি। যদিও কাউকে ছুঁতে পারেনি সেই গুলি। কল্যাণ এবং বোমানিয়ার কানের কাছ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে গুলি। বোমার আঘাত সামলে কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়েছেন রঞ্জিত এবং নিতাই। কিন্তু ততক্ষণে বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছে উদয় সিংয়ের দেহ। গুরুতর আহত হয়েছে নরেশ। স্থানীয় কয়েকজনের মধ্যে বেশ কয়েকজন তাড়া করে আততায়ীদের। এদের মধ্যে তিনজন পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে যায় একজন। এদিকে স্থানীয়দের সাহায্যে উদয় সিং এবং নরেশকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েন রঞ্জিত, নিতাই এবং কল্যাণ। কিন্তু যেতে যেতে পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে উদয়। নরেশকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলেও শেষরক্ষা হয়নি। উদয়ের সঙ্গেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে তাঁর সবচেয়ে অনুগত অনুচর নরেশ। গোটা এলাকায় দাবানলের মত ছড়িয়ে যায় যে, বোমার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন উদয় সিং! সেই সময় কলকাতা বন্দর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলেন উদয় সিং। শুধুমাত্র তার অঙ্গুলিহেলনেই আমদানি-রপ্তানি হত কয়েক কোটি টাকার মাল।

এহেন প্রভাবশালী ব্যক্তির এমন করুণ পরিণতি মেনে নিতে পারেননি তাঁর অনুগামীরা। লাঠি-ছুরি-তলোয়ার সব নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে উদয় সিংয়ের কয়েকশো অনুগামী। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় ওয়াটগঞ্জের সব দোকান। পথ চলতি গাড়িগুলি ভাঙচুর শুরু হয়। ওয়াটগঞ্জ থানার আশেপাশের পাঁচটি থানা থেকে পুলিশবাহিনী পাঠানো হয় ওয়াটঞ্জে। বাধ্য হয়ে র‍্যাফ ডাকে পুলিশ। তাতেও কাজ না হলে শুরু হয় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, জল কামানের ব্যবহার। পাল্টা শুরু হয় ইট বৃষ্টি। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে কলকাতা পুলিশ। এরই মধ্যে খবর এল, মণিময় ব্যানার্জি লেনে নর্দমার ধারে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে একটি ছেলে। জীবিত না মৃত বোঝা যাচ্ছে না! খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে গেলেন ওয়াটগঞ্জ থানার ওসি। গিয়ে দেখা গেল নর্দমার ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে বছর ২৫-২৬ এর একটি ছেলে। রক্ত ভেসে যাচ্ছে জামা, আর জামার পাশেই পড়ে রয়েছে একটা দেশি পিস্তল। পিস্তলটিতে তিনটে গুলি ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, কুড়ি-পঁচিশ জন মিলে ধাওয়া করছিল ছেলেটিকে। তারপর তাঁকে বাগে পেয়ে বেদম পিটিয়ে এখানেই ফেলে রেখে চলে গেছে তারা। পুলিশের বুঝতে বাকি রইল না ওই চারজন আততায়ীর মধ্যে যে ধরা পড়েছে, সেইই এই যুবক। তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হল যুবকটিকে। ওসি সাহেব খবর নিয়ে জানতে পারলেন যুবকটির নাম বাদল মুখার্জি। বেহালার পাঠক পাড়ার বাসিন্দা বাদলের খিদিরপুরে একটি দোকান আছে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার মারামারি এবং হুমকি দিয়ে হপ্তা তোলার অভিযোগ রয়েছে। দিনে দুপুরে উদয় সিংয়ের খুন করায় ঘটনাটি নিয়ে বেশ শোরগোল পড়ে যায় শহর জুড়ে। তার উপর ওয়াটগঞ্জ থানা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ঘটেছে ঘটনাটি। থানার এত কাছে, এরকম বীভৎস ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মানসম্মান নষ্ট হয় কলকাতা পুলিশের। যথারীতি দায়িত্ব গেল লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কাছে। লালবাজারের ওসি হোমিসাইড এবং ওসি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অত্যন্ত পছন্দের পাত্র সাব-ইন্সপেক্টর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়। উপর মহল থেকে হুকুম এসে গেল, “অতনুকে কেসটা দিয়ে দাও।”

আরও পড়ুন- সূচ ফুটিয়ে খুন, অধরা ভাড়াটে খুনি! কলকাতার সেই হত্যাকাণ্ড সাড়া ফেলেছিল পৃথিবীজুড়ে

সবার প্রথমে তদন্ত শুরু করা যাক উদয় সিংকে দিয়েই। সত্তরের দশকের উত্তাল কলকাতায় তিন পুত্র সমেত স্থায়ী জীবন খুঁজতে এসেছিলেন ছোটু সিং। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে দিনমজুরের কাজ পেয়ে যান তিনি। আয় ছিল সামান্যই, কিন্তু তা দিয়েও তিন ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করেন ছোটু। কিন্তু কারওই পড়াশোনায় সেরকম মন ছিল না। যথারীতি অল্প বয়সেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেয় তারা। সিগারেট, দেশি মদ, ফুটবল আর গঙ্গার ঘাট- এই দিয়েই বেশ জীবন কেটে যাচ্ছিল। আরেকটু বড় হলে বড় ছেলে সংগ্রাম সিংকে ফ্যান্সি মার্কেটের এক দোকানে কাজে ঢুকিয়ে দেন ছোটু সিং। মেজো ছেলে উদয় আঠেরোয় পড়লে তাঁকে গুলমোহর ঘাটের এক ফুলের দোকানে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। সকালে উদয় ভালো ছেলের মতো কাজে যায়। কিন্তু বিকেলবেলা ফুলের দোকানের মালিক এসে ছোটু সিংয়ের হাতে-পায়ে ধরে বলে ছেলেকে আর পাঠাতে না কাজে। ওই ছেলে ওখানে গিয়ে কাজ তো করেইনি, উপরন্তু মারামারি করে এক কর্মীর নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। ছোটু সিং বুঝে যান, উদয়কে দিয়ে আর যাই হোক চাকরি হবে না। কবি বলেছেন, ‘১৮ বছর বয়স মানে না কোন বাধা।” উদয়ের ক্ষেত্রে তা এক্কেবারে ১০০% ফলে যায়! সে অল্প বয়সেই ঠিক করে ফেলেছিল আর যাই হোক না কেন, কারও অধীনে থেকে চাকরি সে করবে না। স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করবে।

উদয়কে রাস্তা দেখালেন মা গঙ্গা স্বয়ং! গঙ্গার ধারে ঘুরতে ঘুরতেই কলকাতা বন্দরের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হয় উদয়ের। ওইটুকু বয়সেই বন্দরের ভেতর ঢুকে কোথায় কীভাবে কোন কাজ হত, সব খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করে সে। সেই সময় কলকাতা পোর্টে সব ‘ভাই’দের রমরমা। জিতেন ভাই, আনোয়ার ভাই, আসলাম ভাই, প্রত্যেকে পোর্টের অঘোষিত ভগবান। এই সময় কলকাতা বন্দর দাপিয়ে বেড়াত এই ডনদের সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রত্যেকের কোমরে গোঁজা মেশিন (পড়ুন বন্দুক)। রাত বাড়লেই বিলিতি মদ, দামি দামি গাড়ি, সুন্দরী কন্যা- এই সবে গমগম করত কলকাতা বন্দর। প্রত্যেকেরই মালিক কোনও না কোনও ‘ভাই’। রাতে বাড়ি ফেরার সময় এইসব দেখত উদয়, আর দেখত স্বপ্ন। এরকমই একটা জীবন পাওয়ার স্বপ্ন, এরকমই ক্ষমতাবান হওয়ার স্বপ্ন। সিনেমা হলে এতক্ষণে রাজা কৃষ্ণপ্পা বেড়িয়া ‘রকি ভাই’ হয়ে গেছে। কিন্তু এটা বাস্তব, সুতরাং সময় লাগে। উদয়ের ক্ষেত্রেও সময় লাগল। ২২ বছর বয়সে প্রথমবার জেলে যায় উদয়। হোলির দিন কোথাও মারামারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য জামিন পেয়ে যায়। বেরিয়ে এসে কলকাতা পোর্টের লেবার ইউনিয়নের এক নেতাকে খুন করার চেষ্টা করে এবং বিফল হয়। এক বছর পর নিজের হাতে প্রথম খুন করে উদয় সিং। কিন্তু ধরা পরে যাওয়ায় দেড় বছরের জেল হয় তার। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই প্রভাব খাটিয়ে জামিন পেয়ে যায় সে। ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব কায়েম করে উদয় সিং ক্রমেই বন্দর এলাকায় হয়ে ওঠে উদয় ‘ভাই’। আশির দশকে উল্কার গতিতে উত্থান হয়েছিল উদয় সিংয়ের। স্ক্র্যাপ লোহা এবং বন্দরে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা তাঁর ভাগ্য খুলে দিয়েছিল।

আগে যে ডনরা ছিল তাঁদের সরিয়ে আশির দশকের মধ্যভাগে কলকাতা বন্দরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে উদয় সিং। প্রায় ছয় ফিট উচ্চতা, পেটানো চেহারা, তীক্ষ্ণ চোখ-মুখ, পরণে সাদা শার্ট-প্যান্ট, এক কথায় হিরোর মতো চেহারা। চাইলে মনে মনে ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই’-এর সুলতান মির্জার কথা মনে করতে পারেন। শুধু বাহ্যিক ভাবেই নয়, উদয়ের কাজকর্মও ছিল হিরোর মতো। সবার জন্য না হলেও, কলকাতা বন্দর এবং তার আশেপাশের নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষের কাছে উদয় সিং ছিল মসিহা। কোনও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, সাহায্যের জন্য হাজির উদয় ‘বেটা’। কোনও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, বা কেউ কলেজের টাকা দিতে পারছে না, সাহায্যের জন্য হাজির উদয় ‘ভাইয়া’। কোনও ব্যক্তি সাহায্যের জন্য বা কাজের জন্য এসেছেন, তাদের সাহায্য করেছে উদয় ‘সাহাব’। আবার একই সঙ্গে, বিপুল ধনবান প্রোমোটার এবং কনট্রাক্টরদের কাছে ত্রাস উদয় সিং। টাকার জন্য উদয় ‘ভাই’ একটার বেশি দুটো ফোন করলে পরের দিনের সূর্যোদয় দেখা মুশকিল তাঁদের জন্য। তবে এভাবে ৩-৪ বছর চলার পর উদয় সিং খুন-খারাপি থেকে সরে আসার চেষ্টা করেন। রক্ত না ঝরিয়ে যতটা কাজ করা যায়, তারই চেষ্টা। এছাড়াও নিজের বেআইনি কাজগুলিকে আড়ালে রাখার জন্য প্রয়োজন হতো পর্দার। উদয় সিংয়ের ক্ষেত্রে এই পর্দার কাজ করল রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। কয়েক বছরের মধ্যেই রামকমল স্ট্রিটে নিজের একটি অফিস খুলে ফেললেন উদয়। ব্যবসাকে সামনে রেখে পিছনে চলতে থাকল সব বেআইনি কাজ-কারবার। ওই অফিসের নিচতলায় আরেকটি অফিস খুলেছিলেন উদয়ের ভাই রঞ্জিত সিং। তিনি অবশ্য দাদার মতো কোনও বেআইনি কারবার করতেন না। ঠিকঠাকই চলছিল সব। ইতিমধ্যেই নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন উদয় সিং।

তবে এবার ‘সুলতান মির্জা’-র জীবনে আবির্ভাব হল ‘শোয়েব’-এর। কয়েকদিন ধরেই বন্দর এলাকায় শোনা যেতে লাগল একদল নতুন ছেলে এসে হপ্তা তুলছে। হুমকি দিচ্ছে প্রোমোটারদের। হপ্তা না দিলে প্রাণে মারার হুমকিও দিচ্ছে। এই ঘটনা কানে যেতে সময় লাগল না উদয় সিংয়ের। যথারীতি বোমানিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হল ‘নতুন ছেলে’গুলির ঠিকুজি-কুষ্টি বার করতে। জানা গেল, এই নতুন গজিয়ে ওঠা গ্যাংয়ের নেতা হচ্ছেন বামা। তাঁর সঙ্গী আরও তিনজন, বাদল, পটা আর টুটি। এই গ্যাং বেশ কয়েক মাস ধরে উদয়ের কয়েকটা স্ক্র্যাপ লোহার কন্সাইনমেন্ট আর বন্দরে মাল সাপ্লাইয়ের টেন্ডার হাতিয়ে নিচ্ছিল। প্রথমে ‘বাচ্চা ছেলে’ বলে ছেড়ে দিলেও, পরে রীতিমতো গিয়ে শাসিয়ে আসা হয় তাঁদের। তবে তাতে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা উল্টে উদয়ের ব্যবসায় আরও বেশি করে নাক গলাতে শুরু করে তাঁরা। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় কয়েক মাস আগেই বন্দরে মাল সাপ্লাইয়ের খুব বড় মাপের একটি টেন্ডার বেরিয়েছিল। সেই টেন্ডারও উদয়ের চোখের সামনে দিয়ে হাতিয়ে নেন বামা। আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি উদয় সিং। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজের সাম্রাজ্য কায়েম করেছেন উদয়। সেখানে অন্য কারও দখলদারি বরদাস্ত করবেন না তিনি। নিজে, বামার বাড়ি গিয়ে বামাকে কড়া ভাষায় শাসিয়ে আসেন উদয়। তবে এরপর স্পর্ধা আরও বেড়ে যায় বামা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের। পরদিন বিকেলে যখন উদয় রামকমল স্ট্রিটে ছিলেন না, বন্দুক উঁচিয়ে এসে সকলকে হুমকি দিয়ে যান বামা এবং তাঁর দলবল। এই ঘটনার কথা জানতে পেরে উদয় নিতাইকে নির্দেশ দেন ওয়াটগঞ্জ থানায় এফআইআর দায়ের করিয়ে রাখতে। জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে অতনু বুঝতে পারেন সুযোগ থাকলেও খুনোখুনি এবং পুলিশি ঝঞ্ঝাটের থেকে বেরোতে চাইছিলেন উদয়। তবে পরিস্থিতি যে আরও জটিল হচ্ছে তা বোঝা যায় উদয়ের মৃত্যুর ৭ দিন আগে। সেদিনও আরেকটি মোটা অঙ্কের সাপ্লাইয়ের টেন্ডার বেরিয়েছিল। টেন্ডার ফেলার আগেই বামা অ্যান্ড কোম্পানি উদয়ের অফিসে এসে হুমকি দিয়ে যায় যদি তাঁরা এই টেন্ডার না পান তাহলে এসে “উদয় ভাইয়ার চেম্বার চিরতরে খালি করে দেবে”। এবারও উদয় নিতাইকে পাঠান আরেকটি এফআইআর দায়ের করাতে। এফআইআরের ভিত্তিতে সেদিন বিকেলেই বামা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের ডেরায় রেড চালায় পুলিশ। কিন্তু কারওই দেখা মেলে না। এর এক সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় উদয় সিংকে।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় রঞ্জিত, কল্যাণ, বোমানিয়া, নিতাই সকলে একবাক্যে অতনুকে জানান, তাঁরা স্পষ্ট দেখেছেন ওই চারজনকেই। ওরাই বোমা মেরেছিল এবং গুলি চালিয়েছিল। অতনু জানতেন, বাদলের নাম বাদে বাকিগুলি ভাঁড়ানো নাম। আসল নাম অন্য কিছু। এবার তিনি দ্বারস্থ হলেন পুরনো পুলিশি রেকর্ডের। ঘটনাচক্রে এই ছেলেগুলির নামে এর আগেও পুলিশে এফআইআর হয়েছিল। সুতরাং পুলিশি রেকর্ড থেকে তাঁদের সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য মিলল। বামা ওরফে প্রণব নাগ খিদিরপুরের হরিসভা লেনের বাসিন্দা। টুটি ওরফে শংকর দত্তও খিদিরপুরের ছেলে এবং পটা ওরফে শুভাশিস মুখার্জি স্থানীয় এলাকার ছেলে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে নিজের তদন্ত শুরু করেন অতনু। সমস্ত ডেরায় হানা দিয়েও এদের দেখা পাওয়া গেল না। ঠিক করা হল, সিভিল ড্রেসে পুলিশ মোতায়েন করা হবে। ফল মিলল হাতেনাতে। এক সপ্তাহের মধ্যেই গার্ডেনরিচ থেকে ধরা পড়ে গেল পটা এবং টুটি। এতদিন আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল, মামলা শান্ত হয়েছে কিনা দেখতে এলাকায় বেরিয়েছিলেন, আর তখনই পাকড়াও করে পুলিশ। খবর পেতেই ফেরার হয় বামা। তবে এক সপ্তাহের মাথায় তাঁকেও মাঝেরহাট থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিল বাদল, তাই তাঁকেও জেলে চালান করে দেওয়া হয়। ১৯৯৮-এর জানুয়ারি মাসের মধ্যে চারমূর্তিই জেলে। জেরায় তাঁরা স্বীকার করেন যে, বন্দরে উদয়ের একচেটিয়া আধিপত্য শেষ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন সকলে। বিগত ছয়-সাত মাস ধরে উদয়ের বেশ কয়েকটি টেন্ডার হাতিয়েছিলেন তাঁরা। বন্দরের ডাকসাইটে ব্যবসায়ী তথা ডন উদয় সিংও বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হাজির হয়েছে। অপরাধীদের স্বীকারোক্তি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান এবং নিজের তদন্তের ভিত্তিতে তিন মাসের মাথায় চার্জশিট পেশ করেন অতনু। প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে রঞ্জিত, কল্যাণ, নিতাই, বোমানিয়া ছাড়াও যুক্ত হল স্থানীয় এক ধোসা বিক্রেতা, বাচ্চুকে। সেদিন বোমার আঘাতের তিনিও আহত হয়েছিলেন। অতনু ভেবেছিলেন জলের মতো পরিষ্কার কেস। চার্জশিট পেশ করলেই সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি হয়ে যাবে বামাদের। কিন্তু তা হল না।

যে কোনও কেসের তদন্তের মূলত তিনটি পর্যায় থাকে। প্রথম পর্যায়ে অকুস্থলে গিয়ে এভিডেন্স সংগ্রহ করা হয় এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান শোনা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এভিডেন্স এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তৃতীয় পর্যায়ে চার্জশিট পেশ করা হয় এবং তার ভিত্তিতে রায় দান করে আদালত। এই তৃতীয় পর্যায় সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এবং এই পর্যায়েই যে কোনও কেসের গতিপথ ঘুরে যায়। এই কেসের ক্ষেত্রেও তাইই হল। যে ডাক্তার পোস্টমর্টেম করেছিলেন তিনি নির্দিষ্ট শুনানির দিন আসতে পারলেন না। ফলত কেস পরের তারিখে ফেলা হল। এদিকে প্রাণভয়ে বাচ্চু নামক ধোসা বিক্রেতা নিজের বয়ান পাল্টে দিল। ওদিকে বাদল দাবি করলেন, উদয়ের অনুগামীরা নয় বরং পুলিশই তাঁকে মেরে নর্দমার ধারে ফেলে গিয়েছিল। বামা-সহ ধৃত অন্যান্যরা দাবি করেন, জেলে তাঁরা যে বয়ান দিয়েছেন তা পুলিশের চাপে পড়েই। একের পর এক নতুন সাক্ষী জুড়তে থাকল এবং বেরোতে থাকল। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন বছর কেস চলার পর অবশেষে এল সেই দিন। ৩০ অগাস্ট ২০০১ অর্থাৎ, দ্য জাজমেন্ট ডে। এদিনই শেষ শুনানি হওয়ার কথা এবং শুনানির পরে রায়দান হবে।

আরও পড়ুন- কাটা মুণ্ডুকে মেকআপ, একই ঘরে যৌনতা! আফতাবের মানসিক বিকৃতির আড়ালে লুকিয়ে যে সত্য

আগেই বলেছি, এই মামলার যিনি বিচার করছিলেন সেই বিচারপতি যে কোনও কারণেই হোক বামাদের পক্ষপাতিত্ব করছিলেন। কোর্টে ঢুকেই অতনু বুঝতে পারেন কিছু একটা গোলমাল আছে। কোর্ট চত্বরে অনেক নতুন ছেলেপুলেদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। তারা স্লোগান দিচ্ছে। ডিফেন্স কাউন্সিলের সঙ্গে কথা বলছে। শুনানি শুরু হতেই অতনু বুঝে যান তাঁর আশঙ্কা সত্যি। প্রথমেই ডিফেন্স কাউন্সিল প্রশ্ন করে যদি সেদিন গুলি চলেই থাকে তাহলে বুলেট শেলগুলি কোথায়? পাবলিক প্রসিকিউটার জানান, পুলিশ সেখানে ওই ঘটনার প্রায় ১৫ মিনিট পর পৌঁছেছিল। ততক্ষণে সেখানে মানুষের হই-হট্টগোল বেঁধে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বুলেট শেল খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু, বিচারপতি ঘোষণা করে দিলেন, সেদিন ওখানে কোনওরকম গুলি চলেনি এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা নিজেদের মতো বয়ান ‘বানাচ্ছেন’। উদয়ের অবর্তমানে তাঁদের কোম্পানির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ বামা অ্যান্ড কোম্পানি। ফলত যদি বামাদের জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে রঞ্জিত, নিতাইদের জন্য রাস্তা ফাঁকা। সুতরাং উদয়ের খুন বামারা নয় অন্য কোন গ্যাংয়ের লোকেরা করেছে। এর সপক্ষে যুক্তি দেখানোর জন্য ডিফেন্স কাউন্সিল ডেকে আনে রামকমল স্ট্রিটের এক নাপিতকে। যেদিন উদয় সিং এবং নরেশকে হত্যা করা হয় সেদিন দোকানেই ছিলেন ওই নাপিত। তাঁকে ডিফেন্স কাউন্সিল প্রশ্ন করে, বোমা মারার পর সেখান দিয়ে কোনও গাড়ি যেতে দেখেন কিনা তিনি। জবাবে নাপিত জানান, হ্যাঁ! যখন বোমা ফাটল তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একটি গাড়ি যেতে দেখেছেন। ডিফেন্স কাউন্সিল দাবি করে, ওই গাড়িতে করেই আততায়ীরা এসেছিল, তার মক্কেলকে অহেতুক ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

ইতিমধ্যেই বাচ্চু, বামা-বাদলদের চিনতে অস্বীকার করেছে। ধৃতরা জেলের মধ্যে একরকম বয়ান দিয়ে কোর্টে এসে আরেক বয়ান দিয়েছে। যাইহোক, ডিফেন্স কাউন্সিলের এই যুক্তির ওপর ভিত্তি করে লোয়ার কোর্টের বিচারপতি রায় দিয়ে দিলেন বামা, বাদল, টুটি এবং পটা সম্পূর্ণ নির্দোষ। পুলিশ তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে এবং একই সঙ্গে পুলিশকে তীব্র ভর্ৎসনাও করেন তিনি। বিচারপতির এহেন পক্ষপাতিত্ব দেখে অবাক হয়ে যান অতনু। বাইরে ততক্ষণে ওই চারমূর্তিকে নিয়ে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। ডিফেন্স কাউন্সিল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে অতনুকে দেখে। আর এইসব দেখে রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে অতনুর। কিন্তু কিছুই করার নেই। মানসিকভাবে প্রায় ভেঙে যেতে বসেছেন অতনু, হঠাৎই ফোন আসে কমিশনারের। অতনু আস্থা হারিয়ে ফেললেও কমিশনার তাঁর উপর আস্থা হারাননি। তিনি অতনুকে আশ্বস্ত করেন, তাঁরা এই মামলা নিয়ে হাইকোর্টে যাবেন। নতুন করে উদ্যম ফিরে পান লালবাজারের সাব-ইন্সপেক্টর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়। ফের শুরু হল আইনি যুদ্ধ।

পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০০৬ সালে মেলে প্রকৃত ন্যায়। লোয়ার কোর্টের রায়কে প্রভাবিত করা গেলেও হাইকোর্টে তা আর সম্ভব হল না। হাইকোর্ট লোয়ার কোর্টের রায়কে খারিজ করে দিল। সঙ্গে লোয়ার কোর্টের বিচারপতির জুটল তীব্র ভর্ৎসনা। ৩১ পাতার জাজমেন্টে হাইকোর্ট সাফ জানিয়ে দেয়, লোয়ার কোর্টের বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন তা যথাযথ নয়। এরপর সব তদন্তের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা হয় বামা, বাদল, পটা এবং টুটিকে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তাদের। হাইকোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে অতনু দেখতে পান ডিফেন্স কাউন্সিল রীতিমতো উদ্ধত স্বরে কথা বলছে বামার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে। অতনু শুনতে পান, তাঁরা বলাবলি করছে যে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। তাতে বিশেষ কান দেন না অতনু। আজ বড় হালকা লাগছে তাঁর। আইনের উপর থেকে যে ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন তা আবার ফিরে এসেছে। মনের আনন্দে, পুলিশের জিপ ছেড়ে হাইকোর্ট থেকে হাঁটতে হাঁটতেই লালবাজারের দিকে রওনা দেন তিনি। তবে এরপর সত্যিই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন বামাদের উকিল। তবে সেখানেও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই কেসে ‘justice delayed’ হলেও ‘justice denied’ হয়নি।

 

তথ্যসূত্র : কলকাতা পুলিশ ফেসবুক পেজ

More Articles