সুনীলের মাথায় অন্তর্বাস, প্রফুল্ল চন্দ্রের সামনে আবর্জনা! এই সৌন্দর্যায়ন চেয়েছিল কলকাতা?
Kolkata Street Art: মেডিকেল কলেজের মোড়ের প্রশান্তচন্দ্রের মুখের উপর ঝোলানো আছে কয়েকটি ডাব, ওটি যেন সংলগ্ন ডাব বিক্রেতার ডিসপ্লে বোর্ড।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “কর্পোরেশনের এখন হয়েছে নেই-কাজ তো খই-ভাজা।...এইভাবে পুরপিতারা এই পুরনো শহরটার বাপের নাম ভুলিয়ে দিব্যি আমাদের ছেড়ে দিচ্ছে।” এই লেখা যখন লেখা হয় তখন কলকাতার লন্ডন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা বা প্রতিশ্রুতি কিছুই ছিল না, ‘বিশপ লেফ্রয়’ তখনও ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’ হয়ে ওঠেনি। সেই সময়েই সুভাষ এই বক্তব্য রাখছেন, তাহলে কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না সুভাষ আজ এই পরিস্থিতিতে কী বক্তব্য রাখতেন। শহরের নিজের শিকড়কে ভুলিয়ে দেওয়ার রোগ অনেকদিনের, বিগত ১১-১২ বছরে সেই রোগ প্রচণ্ডভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে এটাই কি একমাত্র সত্য, না কি এর কোনও অন্য দিক আছে? আছে।
বিগত কিছু মাস ধরে কলেজ স্ট্রিট, সূর্য সেন স্ট্রিট, মেডিকেল কলেজ, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ও তার সংলগ্ন এলাকায় ইলেকট্রিসিটি ফিডার বক্সগুলি সেজে উঠেছে নতুন রঙে। ফুটে উঠেছে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি যাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কফি হাউস ও বই পাড়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এবং যাঁরা শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও রাজনীতির জগতের নক্ষত্রপ্রতিম। এই ফিডার বক্সে যাঁদের ছবি আঁকা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন আচার্য্য প্রফুল্যচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, তেমনই আছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঋত্বিককুমার ঘটক, অশোক কুমার, আবার অন্যদিকে আছেন জ্যোতি বসু, সৈয়দ মোহাম্মদ আলি বগুড়া, লক্ষ্মী মিত্তল।
আরও পড়ুন- ‘আমি খুঁজি আমাকে’: ‘কলকাতার তলায় থাকা’ মানুষকে যেভাবে ডাক দিলেন অনির্বাণ-ঋদ্ধি
এই কাজটি কলকাতা পৌরসভার পক্ষ থেকে হচ্ছে, না সিইএসসি র পক্ষ থেকে হচ্ছে না কি কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত উদ্যোগে হচ্ছে সেই তথ্য সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটা ছবি একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে (PATTERN) আঁকা। প্রতিটি ছবির তলায় একটি গোল চাকতি, তাতে কার ছবি সেটি এবং তিনি কী করে এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত (প্রেসিডেন্সি বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা কফি হাউসে নিত্য আনাগোনার সূত্রে) সেই সকল তথ্য লেখা। ছবির তলায় শিল্পীর নাম লেখা, ‘চিত্রকর’। অন্তর্জাল বলছে, এই শিল্পী বহুকাল ধরেই কলকাতা শহরকে রঙে রঙে সাজিয়ে তুলছেন ফিডার-বক্স-চিত্রের মাধ্যমে।
কলকাতা তথা বাংলায় কোনও বিশেষ ব্যক্তির ছবি দেওয়ালে আঁকার ট্রাডিশন বহুকালের। ‘জনঅরণ্য’র ওপেনিং দৃশ্যের কথাই ধরা যাক। ব্ল্যাকবোর্ডের উপরের দেওয়ালে ৭০-এর দশক মুক্তির দশক ইত্যাদি স্লোগানের সঙ্গে বোর্ডের বাঁ দিকের দেওয়ালে কী আঁকা ছিল মনে পড়ছে? ঠিক, কমরেড মাওয়ের ছবি। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরের দেওয়ালে লেনিন, মাও, চে থেকে শুরু করে জীবনানন্দ, ফ্রিদা কাহলো, রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিবা ফুলে, আন্তনীয় গ্রামসি, ভগৎ সিং, সুভাষ বোস এমনকী বঙ্গবন্ধুর ছবিও আঁকা থাকতে দেখা যায় বহুকাল এবং আজও। কিছুদিন আগে শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখেছি দেওয়ালে দেওয়ালে চারু মজুমদারের স্টেন্সিল। এতক্ষণ যে সকল ছবিগুলির কথা বললাম, তা সবক’টাই কোনও না কোনও ছাত্র সংগঠনের কোনও না কোনও প্রোপাগান্ডার অংশ, কিন্তু কলেজ স্ট্রিট ও তার সংলগ্ন অংশ যে রঙিন ইলেকট্রিক ফিডার বক্সে সেজে উঠেছে তাতে খুব গভীরভাবে খুঁজলেও সরাসরি রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যায় না (যদিও চিত্র তালিকায় জ্যোতি বসু আছেন)। এই সবক’টি ছবিকে নিছক শহর সাজানো ও আমাদের শিকড়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার উপাদান হিসাবেই দেখা যেতে পারে।
এবার আসা যাক এক অন্য প্রসঙ্গে। আমাদের শহর, শহরের মানুষগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন? ঘরের ওই মানুষটার মতো, যে না ছবি আঁকে, না রং মাখে, কেবল ছবি নষ্ট করতেই গোটাদিনের ফুর্তি! শহরের প্রতিটা দেওয়াল, প্রতিটা রাস্তা, প্রতিটা ল্যাম্পপোস্ট দায়িত্ব নিয়ে ‘জুবা কেশরি’র রঙে রেঙে উঠেছে তাই স্বাভাবিকভাবেই। শুধু এই টুকুতেই ক্ষান্ত হইনি, একসময় কলকাতার একটি অঞ্চলে কিছু গ্রাফিতি হয়েছিল, তার উপরে ফ্লেক্স ঝুলিয়েছি, যেখানে ইচ্ছা পোস্টার মেরেছি, তার উপর আবার পোস্টার মেরেছি, যত ইচ্ছা, যেমনভাবে ইচ্ছা দৃশ্যদূষণ ছড়িয়েছি। কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন ফিডার বক্সগুলোর ক্ষেত্রে যে আলাদা কোনও ঘটনা ঘটবে সেটা ভাবাই অনৈতিক, আর আলাদা কিছু ঘটেওনি।
মেডিকেল কলেজের মোড়ের প্রশান্তচন্দ্রের মুখের উপর ঝোলানো আছে কয়েকটি ডাব, ওটি যেন সংলগ্ন ডাব বিক্রেতার ডিসপ্লে বোর্ড। পাশের বক্সে আঁকা (যতদূর চেনা যাচ্ছে) সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ছবি, তার উপর মারা হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের একটি জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কিছু পোস্টার, যার ফলে ছবিটির ৫০% ঢেকে গেছে। যে পোস্টারগুলি দেওয়া হয়েছে সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও তার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েও বলতে হয়, পোস্টারগুলোকে কি ছবি বাদ দিয়ে অন্য কোথাও আটকালে, বক্তব্যের ধার কমে যেত?
আরও পড়ুন- ফিদেল-মারাদোনা-কলকাতা-ফুটবল! আর্জেন্টিনার জয়ে আজও কেন জিতে যায় বাঙালি?
এবার চলে আসি সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পার করে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের দিকে, বাঁকের মুখে দেখতে পাবেন লেবুর শরবত আর দই ফুচকার দোকান। সেই দোকানগুলির আড়ালে প্রায় লুকিয়ে পড়ে আছেন সুনীল। যতগুলো ফিডার বক্স আঁকা হয়েছে, তার মধ্যে সুনীলের অবস্থা সবথেকে খারাপ। বিভিন্ন রকম জঞ্জাল প্রায় স্তুপীকৃত হয়ে আছে সুনীলের উপর।
লক্ষ্মী মিত্তল বা আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অবস্থাও তথৈবচ, একজনের মুখের উপর ঝুলছে জামাকাপড় তো অন্যজনের সামনে স্তুপ করে রাখা শুকনো পাতা। ছবিগুলোর অবস্থা দেখে যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কষ্ট হতে বাধ্য।
যারা ছবিগুলোর সঙ্গে এই আচরণ করছেন, তাঁদেরই অবশ্য একমাত্র দোষ দিলে চলে না। দেখা যাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ নিতান্ত ঠেকায় পড়ে এই কাজ করেছেন। একটু বড় প্রেক্ষিতে ভাবলে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফুটপাথে বসবাসকারী মানুষদের দুরবস্থা এবং হকার সমস্যাও। নাগরিকদের যেমন দায়িত্ব থাকে শহরকে সুস্থ রাখার, সুন্দর রাখার, তেমনই যারা এই শহরকে ‘লন্ডন’ বানাতে চেয়েছিলেন, তাদেরও কি কোনও দায়িত্ব থাকে না?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও জানা।