মৃত্যুপথযাত্রী ট্রাম, ১৪৯ বছর বাঙালির ওঠাপড়া ভাঙাগড়ার সাক্ষী যে যান

"সকালবেলার ট্রাম তুমি কতোখানি পারো নিয়ে যেতে আমাকে এখন... "

ভালোবাসা - মন্দবাসার শহর কল্লোলিনী তিলোত্তমা।দিন শেষে রাতের নিয়ন আলো গায়ে মেখে প্রতিদিন হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী থাকে এই শহর কলকাতা ।এখানে ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাত্রে।উত্তর থেকে দক্ষিণ পূর্ব থেকে পশ্চিম চেনা অজানা মানুষের জটলায় বারংবার নিজেকে খুঁজে ফেলে ' সিটি অফ জয়।' বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিমারীর মধ্যে আবারো নতুন এক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কলকাতাবাসী। বছর দুয়েক আগেই কলকাতা শহরের বুকে শুরু হয়েছিল প্রথম ট্রাম লাইব্রেরি, এসপ্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত যার যাত্রাপথ। স্থির হয়েছিল নতুন বইয়ের আনকোরা গন্ধ নিতে নিতেই ট্রাম ছুটে যাবে খোদ বইপাড়ার উপর দিয়েই। কিন্তু কোভিড এসে সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। এখন আবার সেই চলাচল শুরু হয়েছে। লাইব্রেরি, শিল্পহাব ইত্যাদি নানা পরিকল্পনার মাধ্যমেই ট্রামযাত্রাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। কারণ কলকাত্তাইয়া বাঙালির শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ট্রামের গতায়ত। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেওয়া যাক ট্রামের গোড়াপত্তনের কাহিনি, জীবনানন্দ দাশ থেকে জ্যোতি বসু যে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ওতপ্রোতভাবে।

সালটা ১৮৭৩। সে বছরের শীতটা যাবো যাবো করছে। শীতের অলস দুপুর আর পাতাঝরা বিকেলকে সঙ্গে করে সন্ধ্যে নামছে গঙ্গার ঘাট ভিক্টোরিয়া অথবা পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে। প্রেমিক - প্রেমিকরা ভিড় জমিয়েছে পার্কের প্রায় প্রতিটি বেঞ্চে। এমনই এক শীতের দিনে পথচলা শুরু কলকাতার ট্রামের। দিনটা ছিল ২৪ এ ফ্রেব্রুয়ারি ১৮৭৩।এরপর থেকেই বিভিন্ন উত্থান - পতনের সাক্ষী কলকাতার এই ট্রামলাইনগুলো। ১৮৭৩ সালে শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত চলাচল ছিল এই ট্রামের। লাইনটি ছিল মিটারগেজ লাইন। যদিও সে ট্রাম ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম।আশানুরূপ যাত্রী না হওয়ায় কিছুকালের মধ্যে বন্ধও হয়ে যায় সেই ট্রাম চলাচল।

পুনর্বার ১৮৮০ সালে যাত্রা শুরু হয় ট্রামের।ট্রাম চালানোর জন্য ঘোড়া আমদানি করা হয় সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে কিন্তু বিধি বাম! কলকাতার প্রচন্ড গরমে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হতে হলো সেই অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ ঘোড়াদের,এমনকি কয়েকটি ঘোড়া অসুস্থ হয়ে মারা যায়।ইতিমধ্যে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ' কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি।' তাদের হাত ধরেই ১৯০২ সালে কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে চলতে শুরু করলো প্রথম বাষ্পচালিত ট্রাম। না কলঙ্কের দাগ থেকে বাঁচতে পারেনি এই ট্রামও, এই ট্রামের ধাক্কাতেই মৃত্যু হয় কবি জীবনানন্দের। নিশীথের অন্ধকারে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের অভিমুখে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার অকাল সমাপ্তি ঘোষণা হলো শহর কলকাতাতেই, ট্রামের ধাক্কায়।

তবে এখানেই শেষ নয় কলকাতার ট্রাম তার চলার পথের সঙ্গী করে ফেলেছে আরও এক লজ্জাজনক ইতিহাসকে। ১৯৫৩ সালে কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ঘোষণা করে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া বৃদ্ধি হবে।যদিও ভাড়া বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র এক পয়সা।এখনকার হিসেবে তেমন কিছু না হলেও তৎকালীন সময়ে এই ঘোষণার পরেই ফুঁসে ওঠে কলকাতার নাগরিক সমাজ।শুরু হয় প্রবল আন্দোলন যার পুরোভাগে ছিল ছাত্র এবং শ্রমিকরা। ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে তৈরি হলো ' ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ কমিটি ' যার অন্যতম সভ্য ছিলেন জ্যোতি বসু এবং সুবোধ ব্যানার্জী।

আরও পড়ুন-অন্তরালে থাকার সময় কার সঙ্গে দেখা করতেন সুচিত্রা সেন!

২ জুলাই ১৯৫৩,স্বয়ং বিধানচন্দ্র হুঁশিয়ারি দিলেন সরকারি সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করা হবে না। সঙ্গে তিনি এও বলেন বিশ্বের অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় ট্রামের ভাড়া অত্যন্ত কম।কিন্তু জ্যোতি বসু সুবোধ ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন 'প্রতিরোধ কমিটি ' পিছু হটেনি তারপরেও।৩ জুলাই পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ালেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা।

এরপর ৫ জুলাই। কলকাতার ইতিহাসে এক কালো দিন, রাষ্ট্রীয় জুলুমের সঙ্গে আরও একবার পরিচয় ঘটলো আপাত নিরীহ শহর কলকাতার। ইন্ডিয়ান স্টিল কোম্পানির বিক্ষোভরত শ্রমিকদের উপর বিনা প্ররোচনায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলো পুলিশ। এতেই আগুনে পড়ল ঘি। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলো বহুগুণ। ১৬ তারিখ সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা হলো ১৪৪ ধারা। ১৭ জুলাই ট্রাম কোম্পানির শ্রমিকরা যোগ দিলেন আন্দোলনে। সম্পূর্ণ হলো আন্দোলনের একটি বৃত্ত।

১৯৬৭ সালে ট্রামের জাতীয়করণের ঘোষণা করে সরকার।তারপর থেকে গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়ানোর সাক্ষী  হিসেবে রয়ে গেছে আমাদের প্রিয় কলকাতা। শহরে লেগেছে আধুনিকীকরণের ছোঁয়া,তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়িয়ে চলেছে ট্রামের চাকা। ইতিহাসকে পুঁজি করে আধুনিকীকরণের হাওয়া তার গায়েও লেগেছে বৈকি!কলকাতার বইপাড়ার উপর দিয়ে চলে যাওয়া ' ট্রাম লাইব্রেরি ' সেই ইতিহাস এবং আধুনিকতা নস্টালজিয়ার অন্যতম উদাহরণ হয়ে থেকে যাবে আপামর কলকাতাবাসীর মানসপটে।

তথ্যসূত্র - বর্তমান পত্রিকা 
রোর মিডিয়া

More Articles