কলকাতাকে থমকে যেতে দেন না, প্রাচীন ঘড়িদের রোগ হলে সারান এই 'ঘড়িবাবু'!
Kolkata Old Clocks: নিউ মার্কেটের বিখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার ঘড়ি, মানিকতলা বাজারের জার্মান ঘড়ি, ধর্মতলা গির্জার ঘড়ির দেখভাল করেন স্বপন দত্ত
পাখিরা ছাড়াও কলকাতাকে অনেক উপর থেকে নিয়মিত দেখে কিছু চরিত্ররা। শুধু দেখে না, লিখেও রাখে। সে এক বিচিত্র খাতা, হাতে তোলা যায় না, মাথায় ঠেকানো যায় না, ভারে নুয়ে পড়া সেই লিখনকে মহাকাব্যও বলা যেতে পারে, টিক-টিক করে লিখিত হওয়া এক মহাকাব্য। সারা কলকাতা জুড়ে চলা সেই টিক-টিক সিম্ফোনি নিচু তলার মানুষের কানে বাজে না, অথচ সেই সমস্ত মানুষ, বাস, ট্রামলাইন, ঝাঁকামুটে, বেকার, পড়ুয়া, কেরানি, চোস্ত যুবতী মিলে এক একটা পাতা লিখে দেন সেই কাব্যের। কলকাতার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে সময়যন্ত্র। যুগের পর যুগ, রোদে, জলে যারা লিখে যাচ্ছে এক আখ্যান। কলকাতার সেই ঘড়িদের বাস কোনও গির্জার মাথায়, কোনও পোস্ট অফিসের শীর্ষে, বাজারে, স্টেশনে, এমনকী ব্যস্ততম চৌরাস্তার মোড়ে। সেই সময়যন্ত্রগুলির অনেকেরই চাকা বিকল হয়েছে, স্ক্রু খুলে পড়েছে, কাঁটা থেমে গেছে, পেন্ডুলাম থমকে গিয়েছে। বিশেষত শেঠ থমাস এবং মার্কিন নৌবাহিনীর তৈরি দেওয়াল ঘড়িগুলো একেবারেই অকেজো হয়ে পড়েছে। অথচ এককালে কলকাতার বহু বাড়িতে সময়ের হিসেব রাখত এই ঘড়িরাই। আর এই ঘড়িদের খেয়াল রাখেন কলকাতার ঘড়িবাবুরা।
বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে এই প্রাচীন ঘড়িদের বাঁচিয়ে চলেছেন ঘড়িবাবুরা! কলেজস্ট্রিটের স্বপন দত্ত এমনই এক ‘ক্লক-ম্যান’। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলকাতার ঘড়িদের প্রাণ বাঁচানোর দায়িত্বে আছেন স্বপন। তাঁর বাবা পতিতপাবন দত্ত নিজেও একজন বিখ্যাত ঘড়ি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। বাবার কাছ থেকেই শহর কলকাতার এই অসংখ্য ঘড়ির স্বাস্থ্য দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছিলেন স্বপন দত্ত।
আরও পড়ুন- শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ি! কিংবদন্তির যে ইতিহাস আজও অজানাই
নিউ মার্কেটের বিখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার ঘড়ি, মানিকতলা বাজারের জার্মান ঘড়ি, ধর্মতলা গির্জার ঘড়ি এবং সেন্ট জেমস চার্চের ঘড়ি সহ তিলোত্তমার বিখ্যাত ঘড়িগুলির দেখভাল করেন স্বপন দত্ত। রয়্যাল কলকাতা টার্ফ ক্লাবের ঘড়িটিও সামলান তিনিই। এই সমস্ত ঘড়িদের মেশিনগুলির সম্পর্কে বিশদ লিখে রাখেন স্বপন দত্ত এবং সেই অনুসারেই নিজের কর্মশালায় ঘড়ির নানা অংশের যত্ন নেন, মেরামত করেন। প্রায়ই স্বপন এবং তাঁর দল নেপাল বা আগরতলায় পাড়ি দেন। এইসব প্রাচীন ঘড়ির নানা যন্ত্রাংশ কলকাতার বাজারে পাওয়া যায় না। সেইসব ছোটখাট যন্ত্রপাতি খুঁজতে তাই দেশের বা বিদেশের নানা স্থানে সন্ধান চালাতেই হয়। নেপাল এবং আগরতলায় এমন অনেকগুলি প্রাচীন ঘড়ি রয়েছে। সেগুলি সামলানোর দায়িত্বও স্বপন দত্তর।
ঘড়িকে সাধারণত দু'টি কারণে মানুষ মনে রাখে, মানে বিখ্যাত ঘড়িদের ক্ষেত্রে এই দু'টি কারণই প্রযোজ্য। ঘড়ি নির্মাতার নাম দিয়েই সাধারণত পরিচিত পায় সময়যন্ত্রগুলি। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, কীভাবে এই ঘড়িগুলিকে চালনা করা হয়। বেশ কয়েকটি অ্যান্টিক ঘড়ি নিজেদের নির্মাতাদের পরিচয়েই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। জেমস ম্যাকক্যাব, হ্যামিল্টন, কুক এবং কেলভি, শেঠ থমাস, রায় কাজিন এবং জেডব্লিউ বেনসন এমনই কিছু বিখ্যাত ঘড়ি যার 'ব্র্যান্ড' তার পরিচয়। আবার কিছু কিছু ঘড়ি নিজেদের আওয়াজে পরিচিত যেমন ওয়েস্টমিনস্টার, স্ট্রাইকিং বা গ্র্যান্ডফাদার্স ক্লক। স্বপন দত্তের পুত্র সত্যজিৎ দও বাবা-ঠাকুরদার এই দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছেন। কোন ঘড়ির কী বিশেষত্ব, কোন ঘড়ির রোগ লুকিয়ে কোথায় সবটা নখদর্পণে আনতে সারাটা দিন বাবার কর্মশালাতেই কাটান আগামী 'ঘড়িবাবু' সত্যজিৎ।
সত্যজিতের কথায় শহরের একমাত্র কর্মক্ষম ওয়েস্টমিনস্টার ঘড়ি হচ্ছে নিউ মার্কেটের বিশাল ঘড়িটি। প্রতি পনের মিনিটে এটি মিষ্টি আওয়াজ তুলে বাজে। প্রতি পনের মিনিটে চারবার বাজে ঘণ্টা, প্রতি আধঘণ্টায় আট বার, প্রতি পঁয়তাল্লিশ মিনিটে বারোবার আর প্রতি ঘণ্টায় ষোলবার। আবার, মানিকতলা বাজারের ঘড়িটি মনে হয় থেমেই আছে, কিন্তু প্রতি এক মিনিটে সে সময়কে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন- বাংলায় লেখা একমাত্র ঘড়ি! ভীম নাগের এই ঘড়ির সঙ্গে জড়িত দীর্ঘ ইতিহাস অনেকেরই অজানা
ঘড়ির ডায়ালে সংখ্যার লেখারও একটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্য রয়েছে। মানিকতলার ঘড়িটিতে বাংলা সংখ্যায় ১ থেকে ১২ লেখা। অন্য কোনও টাওয়ার ঘড়িতে এমনটা দেখা যায় না। যদি এখন এই বাংলা সংখ্যাগুলি আলাদাভাবে তৈরি করা হয় তবে ঘড়িটি ঐতিহ্য হারাবে। সত্যজিতের কথানুযায়ী, এক থেকে চার অবধি সংখ্যা রোমান সংখ্যা ‘I’ দিয়ে লেখা উচিত। চার লেখার জন্য ‘IV’ ব্যবহার করলে তা পুরনো রীতির বিরোধিতা হয়। পাঁচ থেকে আট অবধি আবার রোমান ‘V’ এবং ‘X’ দিয়ে নয় থেকে বারো লিখতে হবে। নেপালের দরবার মার্গের পোড়া ঘড়িটি ঠিক করতে গিয়ে একবার সত্যজিৎ আগেকার ‘IV’ বদলে দিয়ে ‘IIII’ লেখেন। চারদিকে শোরগোল পড়ে যায় ভুল লেখার জন্য। কিন্তু ঘড়িটি ঠিকভাবে চলতে থাকে!
কলকাতার এই অজস্র প্রাচীন সময়যন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে দত্ত পরিবার। বাঁচিয়ে রেখেছে শহরের সেই প্রাচীন মহাকাব্যকে যা বিরামহীনভাবে লিখে চলেছে এই ঘড়িরা। অনেক উঁচু থেকে কলকাতাকে দেখে, দেখে বদলে যাওয়াকে। আর মাঝে মাঝে অসুখ বিসুখে পড়লে স্বপন, সত্যজিতরা সুস্থ করে তাঁদের হৃদযন্ত্রে তরঙ্গ তুলে দেন। কলকাতা টিক-টিক সিম্ফোনিতে বুড়ো হয়ে যায় একটু একটু করে।