মেটকাফ হল যেন টাইমমেশিন! পা রাখলেই বাঙালির ইতিহাসে ডুব
দেওয়ালজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বিখ্যাত বাংলা সিনেমার এবং পুরনো বিজ্ঞাপনের পোস্টার টাইমমেশিন ছাড়াই কাউকে গত পাঁচটি দশকে সফর করিয়ে আনতে পারবে।
প্রাচীন গ্রিক মন্দিরের অনুকরণ এবং ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির মিশ্রণে ইংরেজদের তৈরি এক বিশাল স্থাপত্যের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে বাংলার রূপের ছটা। কলকাতা হাই কোর্ট এবং ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে হাঁটা পথে গঙ্গার ধারে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা মেটকাফ হল এবং সেখানে প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে চলতে থাকা 'আমি কলকাতা' প্রদর্শনীকে সম্ভবত এইভাবে বর্ণনা করা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব একশো থেকে পঞ্চাশ অব্দের মধ্যে তৈরি প্রাচীন এথেন্সের মন্দিরের স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৪০ সালে মেটকাফ হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং পরবর্তী প্রায় চার বছর ধরে মেটকাফ হল তৈরি করা হয়। ১৮৩৫-'৩৬ সাল অবধি ভারতের গভর্নর ছিলেন জেনারেল লর্ড মেটকাফ। তাঁর নাম অনুসারেই নামাঙ্কিত হয়েছিল মেটকাফ হল। যদিও মেটকাফ হলের নকশা এবং পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন কলকাতার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট সি. কে. রবিনসন।
লর্ড কার্জন থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম মেটকাফ হলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও আমরা তার ব্যাপারে প্রায় জানি না বললেই চলে। মেটকাফ হল লাইব্রেরিরূপে আত্মপ্রকাশ করলেওষ আজ সেই লাইব্রেরির বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই। যদিও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের অনেককিছু বদলে ফেলে আজ সে বাংলা এবং বাঙালির গল্প শোনাতে চায়।
আরও পড়ুন: ঘর থেকে দু’পা গেলেই বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম সিটি, হয়ে উঠতে পারে আপনার উইকএন্ড ডেস্টিনেশন
মেটকাফ হলের একতলা মাটি থেকে প্রায় দশ ফুট উঁচু। প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে একতলায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়বে আলপনার মতো বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির এক অনন্য উদাহরণ। দুর্গাপুজোর প্রতিমা থেকে ঢাক, হাতে টানা রিক্সা থেকে হাওড়া ব্রিজ, ছৌ নাচ থেকে ময়দানে ফুটবল, গড়গড়া হাতে বসে থাকা বাবু থেকে ঘোড়ায় টানা গাড়ি- সবকিছুই জায়গা করে নিয়েছে সেই সত্তর ফুট দীর্ঘ আলপনায়। একতলায় দুটো ঘরে কলকাতার পুরনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার ছবি এবং মেটকাফ হলের সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত রূপের ছবি ছাড়াও রয়েছে একটা ছায়াছবির প্রদর্শনী। 'ছায়াছবি' এখানে আক্ষরিক অর্থেই বলা যায়, কারণ বিভিন্ন ধরনের ছায়া দিয়ে ছবি তৈরি করে তার মাধ্যমে বাংলার নিজস্বতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
কাঠের প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে দেওয়ালজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বিখ্যাত বাংলা সিনেমার এবং পুরনো বিজ্ঞাপনের পোস্টার টাইমমেশিন ছাড়াই কাউকে গত পাঁচটি দশকে সফর করিয়ে আনতে পারবে। 'আগন্তুক' থেকে 'পরশপাথর', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' থেকে 'ঝিন্দের বন্দী', 'অযান্ত্রিক' থেকে 'সুবর্ণরেখা' অথবা পুরনো ক্যালেন্ডার থেকে সেলাই মেশিন, গ্রামোফোনের বিজ্ঞাপন সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপে বিগত সময়ের গল্প বলে।
দোতলায় পৌঁছে প্রথম ঘরে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন পুরনো হাতে আঁকা ছবি দেখে এগিয়ে গেলেই ছবিতে ছবিতে ধরা দেবে বাংলার নবজাগৃতি। একতলায় পুরনো বাংলা এবং বাঙালি থেকে দোতলার শেষ প্রান্তে নতুন বাংলা এবং বাঙালির সঙ্গে পরিচয় করতে গেলে মাঝে এই নবজাগরণের ঘর পার করতেই হবে। কবিগুরু থেকে বিদ্রোহী কবি, রাজা রামমোহন রায় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বেগম রোকেয়া থেকে স্বামী বিবেকানন্দর কিছু বিখ্যাত উক্তি পড়লে বোঝা যায় যে ঘরে বাইরে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েও কিছু বিখ্যাত মানুষ কীভাবে বাংলা তথা সমগ্র দেশকে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছিলেন।
দোতলায় তৃতীয় ঘরের ছবিগুলো আমাদের চুপি চুপি বলে যে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য আমাদের দেশের পরিচয় এবং বাংলা তার ব্যতিক্রম নয়। দুর্গাপুজোর পুষ্পাঞ্জলিতে ব্যস্ত মহিলা থেকে নাখোদা মসজিদে অপেক্ষারত একটি ছেলে, চিনা নববর্ষ পালন অথবা ক্রিস্টানদের গুড ফ্রাইডে উদযাপন থেকে ইহুদিদের উৎসব, সবকিছুই এই ঘরে ছবির মাধ্যমে জায়গা পেয়েছে। বাঙালির মাছের বাজার থেকে কফিহাউজের সেই আড্ডা, রাস্তার ধারে ফুচকা খাওয়া থেকে মিষ্টির দোকানে ভিড়- সবকিছুই পটচিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছে দোতলার চতুর্থ ঘর।
বাঙালি মানেই গান গাইতে পারে অথবা গল্প লিখতে পারে, নাচতে পারে অথবা ভালো অভিনয় করতে পারে- বাঙালির সম্পর্কে এই রকমের ধারণা বহু বছর ধরেই রয়েছে এবং তার কারণ এই সকল ক্ষেত্রেই কিছু বিখ্যাত বাঙালির অবদান। গান, নাচ, থিয়েটার, সাহিত্য এই সব ক্ষেত্রেই বাঙালির কিছু অবদান ছবি আর লেখার মাধ্যমে মানুষকে বলতে চায় দোতলার শেষ ঘর। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে সুকুমার রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে প্যারীচাঁদ মিত্র, সত্যজিৎ রায়, পূর্ণদাস বাউল থেকে বিনোদিনী দাসীর নাম এই ঘর জানাতে চায়।
ঘর থেকে সিঁড়ির কাছে ফিরতে গেলে একটা লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে হবে। এখানে রয়েছে এক অদ্ভুত সুন্দর সংগীতের ব্যবস্থা। আমাদের চারপাশের নানারকম আওয়াজকে সুন্দরভাবে জড়ো করে এই সংগীত তৈরি করা হয়েছে।
মেটকাফ হল সোমবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সকাল ন'টা থেকে পাঁচটা অবধি একা বসে গল্প বলার জন্য অপেক্ষা করে, বাংলা ও বাঙালির গল্প।