প্রিয় রবিবাবু থেকে ভানুদাদা, ঠিক কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ ও লেডি রাণুর সম্পর্কের ভিয়েন
শান্তিনিকেতনের গরমে তাঁর প্রিয় ভানুদাদা যাতে কষ্ট না পান তার জন্যে উদয়নে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বসানো হল এসি। উপহার দিয়েছিলেন কবির আদরের রাণু, লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়।
ছোটবেলা থেকেই বই অন্তপ্রাণ মেয়েটি। হাতের কাছে যা বই প্রায় সবই পড়ে ফেলে। সবরকম উপন্যাস পড়লেও লেখক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বেশি পছন্দ রবিবাবুকে। রবিবাবুর উপন্যাস, ছোট গল্প পড়তে পড়তেই একদিন দুঃসাহস দেখিয়েই ফেলল বছর এগারোর মেয়েটি। চিঠি লিখে বসল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। চিঠির সম্ভাষণ শুরু ‘প্রিয় রবিবাবু’ দিয়ে। চিঠিতে লেখা "প্রিয় রবিবাবু, আমি আপনার সব গল্পগুলো পড়েছি, আর বুঝতে পেরেছি কেবল ক্ষুধিত পাষাণ বুঝতে পারিনি।……আমার আপনাকে দেখতে খু ঊ ঊ ঊ ঊ ঊ ঊ ব ইচ্ছে করে। একবার নিশ্চয় আমাদের বাড়িতে আসবেন কিন্তু। না এলে আপনার সঙ্গে আড়ি। আপনি যদি আসেন তবে আপনাকে আমাদের শেষের ঘরে শুতে দেব"। ১৯১৭ সালে ছাপান্ন বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথকে এই চিঠি লিখছেন রাণু অধিকারী।
রবীন্দ্রনাথ তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবির ব্যস্ততা বেড়েছে। কিন্তু একাদশ বর্ষীয়া কিশোরীর এই অমোঘ ডাককে কিছুতেই সেদিন ফেরাতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। সেই শুরু, তারপর থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু অবধি বজায় ছিল রাণু-রবীন্দ্রনাথের মিতালি।
সময় যত এগিয়েছে আলাপচারিতা গাঢ় হয়েছে। এসবের মাঝেই ১৯১৮ সালে সপরিবারে কলকাতা আসেন রাণুর বাবা, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ফণীভূষণ অধিকারী। কলকাতার ল্যান্সডাউন রোডের এক ভাড়া বাড়িতে উঠেছেন রাণু। কলকাতা এসেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার আবদার করলেন রাণু। রবীন্দ্রনাথের জীবনে তখন টালমাটাল পরিস্থিতি। একে একে স্ত্রী পুত্র কন্যাকে হারিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুশয্যায় কবির পরম আদরের কন্যা বেলা। ১৯১৮ এর ১৬ মে যথারীতি নিয়ম করে আদরের ‘বেলি বুড়ি’-কে দেখতে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গিয়ে শুনলেন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মাধুরীলতা। এক মুহূর্ত আর সেখানে না থেকে সোজা কবি গেলেন ল্যান্সডাউন রোডে অধ্যাপক ফণীভূষণ অধিকারীর বাড়ি। বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকতেই দরজা খুললেন রাণু। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের চরম বেদনার দিনেই প্রথম মুখোমুখি রাণু ও রবীন্দ্রনাথ।
সেই ১৯১৮ সাল থেকেই রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে গেলেন রাণু। কবির দরবারে এখন তাঁর ‘নিত্য আসা-যাওয়া’। শুধু তাই নয় সে নিয়মিত চিঠি লেখে রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর নিজের কাছে থাকা পুতুলের মতোই যত্ন নেয়। শাসন করে চিঠিতে লেখে, "শুনুন আপনি ভাল করে চুলটুল আঁচড়াবেন। কাপড়ও বেছে বেছে পরবেন, দিনরাত লিখবেন না। দুপুরবেলাও ঘুমুবেন। আর রাত্রিতে শিগগির ঘুমুতে যাবেন।" অন্য পুতুলের মতোই রবিবাবুকেও সে কাছেই রাখতে চায়। তাই সে লেখে "আমার আপনার জন্য মন কেমন করে।"
আরও পড়ুন- বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা
প্রথম চিঠির ‘রবিবাবু’ও ধীরে ধীরে বদলে যান ভানুদাদায়। রাণুর জন্য এই ভালোবাসার ডাক ঠিক করে দেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কোন ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী মারা যাওয়ার পর বেরিয়েছিল ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। আবার এত বছর পর রাণুর ডাকে ফিরে আসেন সেই তরুণ ভানুসিংহ। রাণুর কাছে তাঁর ‘ভানুদাদা’ চিরনবীন। বয়সের তোয়াক্কা না করেই কবির বয়স বেঁধে দিচ্ছেন রাণু। চিঠিতে লিখছেন, "কেউ আপনার বয়স জিজ্ঞেস করলে বলবেন আপনার বয়স সাতাশ"। রসিক রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে বলতেন, সাতাশকে লোকে ভুল করে সাতাশি ভাবতে পারে তার থেকে ছাব্বিশ বলাই শ্রেয়। গোটা জীবনে রবীন্দ্রনাথ রাণুকে প্রায় ২০৮ টি চিঠি লিখেছেন। পরবর্তীকালে যা সংকলিত হয় ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ নামে।
রাণু ও শেষের কবিতা
১৯২৮ এ জীবনের প্রায় প্রান্তভাগে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখতে শুরু করেন অমিত-লাবণ্যের রোম্যান্টিক প্রেমের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। শেষের কবিতার লাবণ্যর সঙ্গে রাণুর অদ্ভুত মিল। ১৯২৩-এ কবি এবং রাণুর শিলং পাহাড়ের দিনযাপনই যেন ফিরে আসে শেষের কবিতার পাতায় পাতায়। রোজ বিকেলে রাণুকে নিয়ে পাহাড়ের নির্জনতায় হাঁটতে বেরতেন রবীন্দ্রনাথ। অবিকল প্রায় একই দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতায়’। শিলং পাহাড়ে আলাপ হওয়ার পর যখন অমিত লাবণ্য বেড়াতে যেত তাতে ধরা আছে রাণু-রবীন্দ্রের সেই পাহাড় বেড়ানোর বর্ণনা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "কিছু দূরে যেতে যেতে দু'জনের হাত মিলে গেল, ওরা কাছে কাছে এল ঘেঁষে। নির্জন পথের ধারে নিচের দিকে চলেছে ঘন বন। সেই বনের একটা জায়গায় পড়েছে ফাঁক, আকাশ সেখানে পাহাড়ের নজরবন্দি থেকে একটুখানি ছুটি পেয়েছে; তার অঞ্জলি ভরিয়ে নিয়েছে অস্তসূর্যের শেষ আভায়…."। রাণুর লাবণ্য হয়ে ওঠার প্রসঙ্গে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখছেন, "স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোনও গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, নাটকে স্বনামে এমন প্রত্যক্ষভাবে এমন বৃহত্তর ভূমিকায় কোথাও কখনও এমনভাবে উপস্থিত হননি। আগাগোড়া সমস্ত উপন্যাসটিই যেন রবি ঠাকুরের কবিতার এক মোহিনী মায়াজালে মোড়া"।
রাণুর মতোই লাবণ্যর প্রিয় কবিও রবি ঠাকুর। প্রেমে, বেদনায় রাণুর মতোই লাবণ্যর শেষ আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ। আবার রবীন্দ্রনাথের লাবণ্যের বর্ণনার সঙ্গে রাণুর যথেষ্ট মিল রয়েছে। এমনকী আশ্চর্যের বিষয় রাণু ও লাবণ্যের বাপের পেশাগত মিল। রাণুর বাবা ফণীভূষণ অধিকারীর মতোই লাবণ্যর বাবা অবিনাশ দত্তও কলেজের অধ্যাপক। আবার কবির বর্ণনায় লাবণ্য যেমন বয়ঃপ্রাপ্ত কুমারী, ১৯২৩-এ বছর সতেরোর রাণুও তখন যৌবনে পদার্পণ করছেন। শেষের কবিতার শেষে অমিত লাবণ্যের পথ এসে থামে এক রাস্তায়, তারপর লাবণ্যর বিয়ে হয় শোভনলালের সঙ্গে আর অমিত বিবাহ করে কেতকীকে। ১৯২৮-এ যখন রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা লিখছেন তার ঠিক তিন বছর আগেই স্যার বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় রাণুর। অমিত-লাবণ্যের মতোই রাণুর বিবাহ সংবাদে রাণু ও ভানুর সেই আট বছরের নিবিড় সম্পর্কের শেষ হয়।
১৯২৩ সালে শিলং থেকে ফেরার পরে কলকাতায় বিসর্জন অভিনীত হয় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনায়। বরাবরই বিসর্জনে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সেইবার আর রঘুপতি নয়, জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করলেন রবীন্দ্রনাথ, উল্টোদিকে অপর্ণার ভূমিকায় কবির আদরের রাণু। বাষট্টির রবীন্দ্রনাথ হলেন পঁচিশের তরুণ যুবক জয়সিংহ। মোট তিনবার অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রাণু।
১৯২৫-এ রাণুর বয়স তখন ১৯। কলকাতার বিখ্যাত শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র স্যার বীরেনের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব এল রাণুর। প্রবল অভিমান নিয়ে এক চিঠিতে রাণু তাঁর ভানুদাদাকে লিখলেন, "আমি কাউকেই বিয়ে করবো না- আপনার সঙ্গে তো বিয়ে হয়ে গেছে। ভানুদাদা, আপনি হয়তো মানবেন না কিন্তু আমি মানি….. মনে মনে জানব যে একদিন আমি ভানুদাদার সমস্ত আদর পেয়েছি"। রাণু-রবীন্দ্রনাথের এই সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা হয়েছিল স্যার রাজেনের পরিবারে। সেখানেও মধ্যস্থতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রাণুর শাশুড়িকে লিখেছিলেন যদি শমীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতো তবে তিনি রাণুকে শমীর বউ করতেন। এই স্বীকারোক্তির পর আর কোনও বাধা তৈরি হয়নি।
আরও পড়ুন- বিয়েতে নিজেকেই নিজে সম্প্রদান করেছিলেন এই বিধবা কনে, আশীর্বাদ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
কবি নিজেই আস্তে আস্তে সরিয়ে নিলেন নিজেকে। রাণুর বিয়েতে সশরীরে উপস্থিত থাকেননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আলমারি ভরে নিজের যাবতীয় লেখা উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে। আর দিয়েছিলেন সোনার কাসকেটে সাজিয়ে নিজের মাথার কয়েক গুচ্ছ চুল যে চুলের প্রতি রাণুর ছিল অমোঘ টান।
আস্তে আস্তে সম্পর্কের বাঁধন শিথিল হলেও রবীন্দ্রনাথ যখন শেষ শয্যায়, শান্তিনিকেতনে ছুটে এসেছিলেন রাণু। শান্তিনিকেতনের গরমে তাঁর প্রিয় ভানুদাদা যাতে কষ্ট না পান তার জন্যে উদয়নে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বসানো হল এসি। উপহার দিয়েছিলেন কবির আদরের রাণু, লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়। রোগশয্যায় শুয়েও রবীন্দ্রনাথ তাঁর আদরের রাণুকে দিয়েছিলেন হোয়াইট মেটালের মাঝখানে ছোট্ট ডিমের মতো চোখ ধাঁধানো নীলা। তার চারপাশ জুড়ে আঠেরোটা ছোট্ট হিরে বসানো একটি আংটি।
জীবনের শেষ বয়সে এসে এক চিঠিতে লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় তাঁর ভানুদাদাকে নিয়ে লিখেছিলেন, "আমার পনেরো বছর বয়েসের শরীর তোমার চোখে ছিল ভরা পূর্ণিমা, তুমি সেকথা জানিয়েছ তোমার একটি গানে, ওই গানেই বলেছ আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন তুমি আমার ঘুমের সুবাস পাও। সে গন্ধ তোমার কাছে প্রথম আষাঢ়ের কেতকী ফুলের সৌরভের মতন। ভানুদাদা, পৃথিবীর আর কোনও পুরুষ কখনও আমার ঘুমের গন্ধ পায়নি।"
গ্রন্থঋণ : রবীন্দ্রনাথ রাণু ও শেষের কবিতা, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, সাহিত্যম