ম্রিয়মান পটুয়া গান! লোকসংস্কৃতির অন্তর্জলিযাত্রায় লক্ষ্মীর পট, পাঁচালির গান
Lakshmi Puja Pattachitra: ত্রয়োদশ শতকে পটশিল্প বিস্তার লাভ করেছিল। আরও পরে পনেরো শতকে গাজীর পট জনপ্রিয় হয়েছিল। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের বাণী প্রচারের জন্য পটের ব্যবহার হত।
“এই পথে মা গিয়েছে। এখনও শিউলি পড়ে আছে।
এখনও বইছে হাওয়া মৃদু তার শরীরের ঘ্রাণ
তার জলেভেজা মুখ এখনও নদীতে ভাসমান।”
দশমীতে কৈলাসে ফিরে গেছেন দুর্গা। এবার মর্ত্যে আসছেন লক্ষ্মী। দেবী দুর্গার পর মর্ত্যে পূজিত হন লক্ষ্মী। ইতিমধ্যেই বাঙালির ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গিয়েছে কোজাগরী লক্ষ্মী আরাধনার তোড়জোড়। লক্ষ্মী ধন-দৌলত, অর্থের দেবী। কালীপুজোর দিনেও অনেকে লক্ষ্মীপুজো করে থাকেন। এছাড়াও লক্ষ্মী সম্পদদায়িনী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিনের শেষ পূর্ণিমাতেও পূজিত হন। তবে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমায় যে লক্ষ্মীপুজো হয়ে থাকে, তাকেই কোজাগরী বলা হয়।
আসলে, কোজাগরী শব্দটির উৎপত্তি ‘কো জাগতী’ থেকে। যার অর্থ ‘কে জেগে আছো?’ পুরাণে কথিত আছে, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন মা মর্ত্যে আসেন। সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশীর্বাদ দেন। কিন্তু যে বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে, সেই বাড়িতে দেবী প্রবেশ করেন না। মুখ ফিরিয়ে চলে যান। সেজন্য নাকি রাত জেগে লক্ষ্মীর পুজো হয়। আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে সেই পুজো হওয়ায় একে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বলা হয়। সকল হিন্দুগৃহে প্রতি বৃহস্পতিবার এই দেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হলেও দেবীর বার্ষিক পুজো হয়ে থাকে শারদ পূর্ণিমা রাতে। এই সময়ে, কেউ মাটির মূর্তি গড়ে, কেউ বা পূর্ণকলস জলে আমের পাতা দিয়ে তার ওপর কলসের মুখে বংশবৃদ্ধিমূলক উর্বরতা বিশ্বাসের প্রতীক ডাব বসিয়ে রেখে লক্ষ্মীপুজো করে। কোনও কোনও গৃহে, বিশেষ করে, অব্রাহ্মণ গৃহে লক্ষ্মীপট বসিয়ে পুজো করা হয়। লক্ষ্মীপটে লক্ষ্মীর মূর্তি আঁকা থাকে।
লক্ষ্মীপটের উদ্ভব বাংলাদেশে। এর পটশৈলী, মূর্তি অঙ্কন ও আচাররীতি সবকিছুতেই আদি লোকজ ও দেশজ পরিচয় এবং যুগপৎ সনাতন হিন্দু ধর্মের মূলধারা থেকে বিচ্যুতির বিষয় সুপরিস্ফুট। লক্ষ্মীপট পুজোয় যে মন্ত্রপাঠ করা হয় তা সংস্কৃত শ্লোকে করা হয় না, বরং তা করা হয় পাঁচালি নামের এক বিশেষ ধরনের বাংলা লোকরচনা থেকে, যাতে পাপের বিরুদ্ধে পুণ্যের জয়মূলক নীতিবাক্যই তুলে ধরা হয়।
আরও পড়ুন- ফুল ফোটে ১২ বছরে মাত্র একবার, কেবল এদেশেই! রহস্যময়ী নীলকুরিঞ্জিকে দেখতে কেন ছুটে আসেন মানুষ
লক্ষ্মীসরা মোটামুটি চাররকমের দেখা যায়। তবে এগুলির আবার নানা রকমফেরও আছে। উল্লিখিত চার শ্রেণির সরা হলো:
(১) ঢাকাই সরা- বলাবাহুল্য, এ ধরনের সরার উৎপত্তিস্থল ঢাকায়। এ সরার কানা বা চারদিকের কিনার ঈষৎ উঁচু, যদিও এর উত্তল অংশটি খুব বেশি উঁচু নয়।
(২) ফরিদপুরী- ফরিদপুর অঞ্চলে এ ধরনের সরার উৎপত্তি। এ ধরনের সরায় প্রতিমা অঙ্কনে স্থানবিভাজন ও পটভূমি সাদা রাখা হয়; ঢাকাই সরার মতোই কেবল সরার কানাটি উঁচু করা হয় না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শৈলীর তারতম্য রয়েছে।
(৩) সুরেশ্বরী- ফরিদপুরের একটি গ্রাম সুরেশ্বরে এ ধরনের সরার উৎপত্তি। এই সরার গোলাকার জায়গা পাঁচটি খাড়া প্যানেলে ভাগ করা হয়। এসব ভাগের মধ্যভাগের প্যানেল অলঙ্কৃত করে প্রধান দেবীমূর্তি, আর বলাবাহুল্য মূর্তির আকার অপেক্ষাকৃত বড়।
(৪) গণকী- এ হলো হিন্দু সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের লোকজনের ব্যবহৃত সাধারণ সরা বা লক্ষ্মীর পট। এই সরার পটভূমি ঘন লাল। সরার স্থানবিভাজনও করা হয়েছে অনুভূমিকভাবে, উপরের অর্ধাংশ অপেক্ষাকৃত বড়, নিচের অর্ধাংশ ছোট প্যানেলে। সরার কানায় কালো রং দেওয়া। উপরের দিকের প্যানেলে একটি অর্ধ বৃত্তাকার পুষ্প অলঙ্করণমূলক পটি বা বন্ধনী সংযোজন করা হয়েছে।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এগিয়ে এলেই বাঘাযতীনে পটশিল্পীরা লক্ষ্মীর পট বা সরা নিয়ে এখানে এসে পসরা সাজিয়ে বসেন। করোনা কালে তাঁদর ব্যবসা একেবারে মার খেয়েছিল। এবার তাঁদের ব্যবসা অনেকটাই চাঙ্গা। মাটির লক্ষ্মী প্রতিমা এবং সরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ দাস। তিনি জানালেন, আগের কয়েক বছরের তুলনায় শুরুর দিন থেকে ব্যবসা ভালোই জমেছে। তবে তাঁর বাপ ঠাকুরদার আমলে লক্ষ্মীর পটের যা চাহিদা ছিল, এখন তা নেই বললেই চলে।
লোকশিল্পের একটি অতিপ্রাচীন ধারা হল পট। কাপড়ের ওপর কাদামাটি কিংবা গোবরের প্রলেপ দিয়ে জমিন তৈরি করে পট আঁকা হত। আজ এই শিল্পের অন্তর্জলিযাত্রা ঘটেছে। তবু ইতিহাসের গায়ে লেগে আছে এই দেশজ শিল্পের গরিমা। পট নিয়ে শিল্পীরা গান গাইতেন। সপ্তম শতকেও পটের চল ছিল বলে জানা যায়। সেই সময় পটের বিষয় ছিল বুদ্ধদেবের জীবনী। ত্রয়োদশ শতকে পটশিল্প বিস্তার লাভ করেছিল। আরও পরে পনেরো শতকে গাজীর পট জনপ্রিয় হয়েছিল। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের বাণী প্রচারের জন্য পটের ব্যবহার হত। উনিশ শতকে কালীঘাট পট বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিত্রশৈলী মিশিয়ে কালীঘাট পট তৈরি হত। যাঁরা পট তৈরি করতেন, তাঁদের বলা হত পটুয়া। কয়েকটি প্যানেলে ক্যানভাসকে ব্যবহার করে পটুয়ারা কোনও কাহিনিকে ফুটিয়ে তুলতেন। সাধারণত পৌরাণিক কাহিনি বা লোককথা পটের মাধ্যমে তুলে ধরা হত। পটের কাহিনিকে গান গেয়ে গায়েনরা প্রকাশ করতেন।
“রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়/ গিন্নির পাপে গিরস্ত নষ্ট, ঘরের লক্ষ্মী উড়ে যায়।/
মহারাজের দেশে দেখ জল নাইক হ’ল/ রাজার প্রজাগণ কষ্ট পেয়ে পলাইতে লাগিল।”
কৃষ্ণের অবতারবিষয়ক একটি পটের গানে সামাজিক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- আর্তের পাশে দাঁড়ানোই ধর্ম: একান্তে মালবাজার বিপর্যয়ের ‘হিরো’ মহম্মদ মানিক
পটুয়াদের পট এবং গানের বিষয় বিচিত্র। তার মধ্যে যমলোক, বৌদ্ধ জাতক, গাজী পীর, রামকাহিনি, কৃষ্ণকাহিনি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় সামাজিক কোনও ঘটনা নিয়েও পটুয়া গান রচিত হত। পটুয়া সঙ্গীত এক প্রকার লোকগীতি। আজ সেই সংস্কৃতি প্রায় বিলীনের পথে। পটুয়ারা এ গানের রচয়িতা ও পরিবেশক বলে এর নাম হয়েছে পটুয়া সঙ্গীত। পটুয়ারা পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন ধরনের পট তৈরি করতেন এবং সেই সব পটের বিষয় অনুযায়ী গান রচনা করতেন। এই গানগুলি তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট প্রদর্শনের সময় উপস্থাপন করেন। গানের সঙ্গে কখনও কখনও নৃত্যও পরিবেশিত হত। এর মাধ্যমে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন।
বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান পটচিত্র। ভারতে নানা রকম পটচিত্র প্রচলন ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত। তখন পটচিত্র দেখিয়ে গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ধর্ম ও লোকাচার নিয়ে নানা শিক্ষা দেওয়া হতো। পটচিত্র দেখিয়ে পটের গান গ্রাম-গঞ্জের মানুষের বিনোদনও ছিল। কাগজ আবিষ্কার হওয়ার আগে সকল পটচিত্র কাপড়েই আঁকা হতো।
রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল, শক্তি, যম, দশাবতার, চণ্ডীমঙ্গল, গাজীর পটের প্রচলন ছিল এদেশে। ব্রিটিশ আমলের ময়মনসিংহ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৬৩টি পট সংগ্রহ করেছিলেন। তার বেশির ভাগই সংগ্রহ করেছিলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ থেকে। গুরুসদয় দত্ত তার মধ্যে আটটি পট সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা থেকে। এই আটটি পটই ছিল গাজীর পট। গুরুসদয় বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনও পট সংগ্রহ করেননি বা পাননি।
গুরুসদয় দত্ত ‘পটুয়া সঙ্গীত’ নামে একটি বই লেখেন ১৯৩৯ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বইটিতে ২৯টি পটের গান রয়েছে। সেখানে কোনও গাজীর পটের গান নেই। তবে পটে আঁকা ছবি দেখিয়ে গাওয়া হত গাজীর গান। এই পটের গানও আমাদের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক সময় গাজীর পট দেখিয়ে গাওয়া গান ছিল বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিনোদন। সম্ভবত পীর গাজী তখন জনপ্রিয় ছিলেন। আচার্য বংশের প্রতিমা শিল্পীরা তৈরি করতেন এই পট। তাঁদের থেকে পট কিনে নিয়ে পটের গান গাইতেন বেদে সম্প্রদায়ের মানুষও। আধুনিকতার দাপটে জনপ্রিয় এই লোকসংস্কৃতি এখন বিলীনই বলা চলে। তবে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এলে ঘর আলো করে আসনে বসে মা লক্ষ্মীর চিরকালীন পট।