কীভাবে লক্ষ্মীর বাহন হলো নিশাচর পেঁচা? জানুন লক্ষ্মীপেঁচার নেপথ্যের কাহিনি
Lakshmi Puja 2022: শত অন্ধকার সত্ত্বেও সঠিক রাস্তা খুঁজে বার করতে পারে পেঁচা। এই কারণেই পেঁচাকে মনে করা হয় জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার প্রতীক। এই সমস্ত গুণাবলীর কারণে লক্ষ্মী বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছেন পেঁচাকে।
সদ্য সমাপ্ত হয়েছে দুর্গাপুজো। মানুষ এখনও বিষাদে ডুবে, সকলেই আবার এক বছরের অপেক্ষা নিয়ে কাজে ফিরেছেন। তবে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ধীর পায়ে হাজির হয়েছে লক্ষ্মীপুজো। দুর্গাপুজো পরবর্তী সময়ে মানুষের মনের যে বিষাদ তা অনেকটাই কমিয়ে দেয় লক্ষ্মীপুজো। দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। বাঙালির প্রতিটি ঘরে এই দিন কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো করা হয়। বেশিরভাগ বাঙালিরাই প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন। পুরাণে বলা হয়েছে ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী। জগৎকে আলোকিত করে রাখেন দেবী। এছাড়াও মা লক্ষ্মী শস্য সম্পদের দেবী বলে ভারতের অনেক জায়গায় ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, আশ্বিন পূর্ণিমা এবং দীপাবলীতে লক্ষ্মীর পুজো করা হয়। লক্ষ্মী মানে সুশ্রী বা সুস্বভাবের অধিকারী। পেঁচা হল দেবীর বাহন। কিন্তু কেন প্রাচুর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন এমন বিচিত্র এক পাখি?
পৌরাণিক এবং বেদজ্ঞ পণ্ডিতরা এই সম্পর্কে তিনটি ধারণা দিয়েছেন। প্রথমত, পৌরাণিকরা মনে করেন কেউ যদি মা লক্ষ্মীর স্বভাবগত গুণগুলি যেমন- তপস্যা, ক্ষমা, সেবাভাব, প্রেম, পবিত্রতা অর্জন করতে চান, তাহলে তাঁকে পেঁচার ধর্ম পালন করতে হবে। এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই পেঁচার ধর্ম কী? পৌরাণিক মতানুসারে, যিনি সকল জাগতিক মোহ-মায়া উপেক্ষা করে, ষড়রিপুর উপর বিজয় লাভ করে মানুষের কল্যাণার্থে নিজেকে নিয়োগ করবেন তিনিই লক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি লাভ করবেন। সকলেই জানি, পেঁচা দিনে ঘুমায় আর রাতে জেগে থাকে। সকল সাধক সাধিকাদের পেঁচার মতই নিদ্রা গ্রহণ করা উচিত। রাত্রিবেলা যখন সবাই ঘুমাবে তখন তাঁদের কল্যাণার্থে অতি গোপনে কাজ করতে হবে। পেঁচা কিন্তু অত্যন্ত গোপনচারী। অতি গোপনে এরা বাস করে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। পৌরাণিক মতে, সাধকের সাধনাও এমনভাবেই লোকচক্ষুর অন্তরালে অর্থাৎ দৃশ্যমান জগতের বাইরে হওয়া উচিত। মূল কথা হল সাধক সাধিকাদের লোকচক্ষুর আড়ালে কাউকে না জানিয়ে মানুষের কল্যাণার্থে কাজ এবং সাধনা করে যেতে হবে। তবেই দেবীর আশীর্বাদ বর্ষিত হবে তাঁদের উপর। ঋকবেদে বলা হয়েছে, পেঁচা আসলে সংযমের প্রতীক। ধনোপার্জনের অন্যতম চাবিকাঠি হল সংযম ও বুদ্ধি। মনে করা হয় মানুষের মধ্যে সংযম, বুদ্ধি এবং ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত রাখে পেঁচা। পুরাণে বলা হয়েছে কোজাগরীর রাতে মা লক্ষ্মী সব গৃহস্থ বাড়িতে খোঁজ নেন কে জাগ্রত রয়েছে। জেগে থাকা ব্যক্তিকেই তিনি ধনের সন্ধান দেন। মনে করা হয় এই কারণেই পেঁচা প্রতি রাতেই জেগে থাকে এবং দিনে ঘুমায়।
আরও পড়ুন- লক্ষ্মী সরার ইতিকথা
দ্বিতীয় ধারণাটি খানিকটা এরকম- কথিত আছে, দুর্বাসা মুনির অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র শ্রী হীন হয়ে যান। ফলত স্বর্গের শ্রী অর্থাৎ সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী সমুদ্রে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে সমুদ্র মন্থনের সময় অন্যান্য দেবতাদের আরাধনায় দেবী লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে উত্থিত হন এবং শ্রীবিষ্ণুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু চঞ্চলা দেবী লক্ষ্মী কোনও প্রাণীকেই স্থায়ীভাবে নিজের বাহন করতে পারছিলেন না। গুপ্তসম্রাট কুমার গুপ্তের মুদ্রায় দেখা যায় মা লক্ষ্মীর পাশে বাহনরূপে রয়েছে ময়ূর, শশাঙ্কের মুদ্রার দেখা গিয়েছে মা লক্ষ্মী চলেছেন লোক মাঝে। অর্থাৎ সেখানে সেরকম কোনও বাহনের উল্লেখ নেই।
অপরপক্ষে নেপালে গেলে দেখতে পাওয়া যায় সেখানে মা লক্ষ্মীর বাহন কচ্ছপ। এই কারণে পুরাণে কচ্ছপকেও সম্পত্তি এবং ঐশ্বর্যর প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। এবার প্রশ্ন হল, শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীর বাহন হবে কে? হাঁস নিয়েছেন সরস্বতী, কার্তিকের বাহন ময়ূর তাই মনে করা হয় শেষ পর্যন্ত এক প্রকার বাধ্য হয়েই পেঁচাকে বাহন করেন লক্ষ্মী।
আরও পড়ুন- ম্রিয়মান পটুয়া গান! লোকসংস্কৃতির অন্তর্জলিযাত্রায় লক্ষ্মীর পট, পাঁচালির গান
তৃতীয় যে ধারণাটি দেওয়া হয়েছে, পণ্ডিতদের মতে সেটিই সবচেয়ে নির্ভুল। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, পূর্ব দিক থেকে পেঁচার ডাক ভেসে এলে সংসারের আর্থিক উন্নতি হয়। অনেকেই মনে করেন বিদেশ যাত্রার সময় বা কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে যাওয়ার আগে মাথার উপর পেঁচা উড়লে বা পেঁচার ডাক শোনা গেলে তা একটি অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। মনে করা হয়, রাত্রিবেলা যখন সাধারণ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েন তখন জেগে ওঠেন সাধকেরা। নিঃশব্দ ও অন্ধকার পৃথিবী থেকে জ্ঞানের আলো আহরণ করে ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁরা যোগনিদ্রায় যান। লক্ষ্য করে দেখলে বোঝা যাবে, পেঁচাও কিন্তু এভাবেই নিদ্রা গ্রহণ করে। পেঁচা যেহেতু অন্ধকারেও দেখতে পায়, তাই মনে করা হয় পেঁচা দিব্যচক্ষুর অধিকারী। শত অন্ধকার সত্ত্বেও সঠিক রাস্তা খুঁজে বার করতে পারে পেঁচা। এই কারণেই পেঁচাকে মনে করা হয় জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার প্রতীক। এই সমস্ত গুণাবলীর কারণে লক্ষ্মী বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছেন পেঁচাকে।
উত্তরভারতের লোককথা
তবে এই তিনটি ধারণা ছাড়াও উত্তরভারতে প্রচলিত রয়েছে একটি লোককথা। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী মনে করা হয়, ত্রিদেব ছাড়া, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং অন্যান্য দেবদেবীকে সৃষ্টি করেছিলেন দেবী আদিলক্ষ্মী। মনে করা হয়, সৃষ্টিলাভ করার পর দেবতারা মর্ত্যে এসেছিলেন দেবী আদিলক্ষ্মীর সৃষ্টি করা জীবকুল দেখতে। সেই সময় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন দেব-দেবীরা। যা দেখে খুব ব্যথিত হয় মর্ত্যের পশুপাখিরা। তারা স্বেচ্ছায় দেবদেবীদের বাহন হতে চায়। এরপর সব দেব-দেবীরা নিজেদের পছন্দমতো বাহন বেছে নিলেও সমস্যা দেখা দেয় লক্ষ্মীর বাহন বেছে নেওয়ার সময়। সুখ ও সমৃদ্ধির দেবী মা লক্ষ্মীর বাহন হওয়ার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল সমস্ত পশুপাখিদের মধ্যে। দ্বন্দ্ব থামাতে মা লক্ষ্মী বলেছিলেন, আগামী কার্তিক মাসের অমাবস্যায় তিনি পুনরায় আসবেন মর্ত্যে। সেই সময় যে প্রাণী এসে আগে তাঁর পায়ের কাছে বসবে সেই-ই হবে মা লক্ষ্মীর বাহন। যথারীতি কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি এসে উপস্থিত হল। দেবী আসতে অনেক দেরি করেছিলেন ফলত অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে মর্ত্যের প্রাণীকুল। স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণে জেগে ছিল পেঁচা-সহ বেশ কিছু নিশাচর প্রাণী। কিন্তু সকল নিশাচর প্রাণীর থেকে আলাদা পেঁচার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। অন্ধকারেও পেঁচার দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। তাই রাতের অন্ধকারে পেঁচা দূর থেকে মা লক্ষ্মীকে দেখতে পেয়ে উড়ে গিয়ে বসেছিল দেবীর পায়ের কাছে। পেঁচার কর্তব্যপরায়ণতা ও ভক্তি দেখে তুষ্ট হয়েছিলেন লক্ষ্মী। সেই থেকে দেবী লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে পাকাপাকি স্থান পেয়েছিল পেঁচা।