চে নয়, বাঙালির এক মরণজয়ী মাস্টারদা ছিল, সূর্য সেনকে ফিরে দেখা

মধ্যরাত্রি ছুঁতে আর পাঁচ ঘণ্টা বাকি। একটা মোটা দড়ির ফাঁসে অস্ত যাবেন সূর্য। তারপর তার রোগাটে ধাঁচের ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে জেলখানা থেকে বেরনো হবে ট্রাকে করে। প্রায় ভোর রাতে চার নম্বর স্টিমার ঘাটে এসে দাঁড়াবে সেই ট্রাক। ব্রিটিশ ক্রুজার The Renown ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘাটে। সদ্যোজাত লাশের বুকে ভারী লোহার টুকরো বাঁধা হচ্ছে সতর্ক হয়ে। তারপর ভোর হওয়ার মুখে স্টিমার রওনা দেবে, একটা ঝুপ করে আওয়াজ হবে। সূর্য ডুবছে, সূর্য উঠছে। তবে এসব কিছু হওয়ার পাঁচঘণ্টা আগে সূর্য সেন লিখছেন, “এই আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম?” মৃত্যু আনন্দময়! ফাঁসি পবিত্র! দাঁত ও নখ উপড়ে ফেলা একটা যন্ত্রণাবিক্ষত দেহ লিখছে, “এই তো আমার সাধনার সময়।” মানুষের মৃত্যু হলে তবু তো মানব থেকে যায়, দেহের মৃত্যু হলে তবু তো চেতনা থেকে যায়। একজন মাস্টারমশাইয়ের চেতনা, একজন সংগঠকের চেতনা, একজন বিপ্লবীর চেতনা। তাকে আগুনেই পোড়াও বা জলেই ডোবাও, অবিনশ্বর। 

শাসকের বিরুদ্ধে আজীবনের লড়াই, মৃত্যুর ঠিক আগে একটুও ঘৃণা নেই, বিদ্বেষ নেই, ক্ষোভ নেই চিঠির কোনও আনাচে কানাচে। ঘৃণার মাথায় স্বপ্ন বসিয়ে দিয়েছেন মাস্টারদা। এই চিঠির মাস্টারদা সায়াহ্নের একজন শিক্ষক, যিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্য রেখে যাচ্ছেন এক স্বপ্ন। “একটি সোনালী স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন।” কর্ণফুলি নদীটির পাশে সেই স্বপ্নের জন্ম। যে স্বপ্নে মাঝে মাঝেই মিশে গিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা স্বাধীনতার লড়াইয়ের গল্প, বিদেশের বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে, বোধ তৈরি হচ্ছে ‘দি ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ দিয়ে। আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী ড্যানিয়েল ব্রিনের ‘মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম’-এর ইতিহাস সূর্য সেনের ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নে বেঁচে উঠছে। একজন শিক্ষক গড়ে তুলছেন আর্মি, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। লক্ষ্য, চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহ, অস্ত্রাগারের দখল। হ্যাঁ, যাকে লুন্ঠন বলেই ডাকা হয়। ভাষার রাজনীতিতে বিপ্লবী হুট বলতেই হয়ে যান সন্ত্রাসবাদী, দখলের গর্ব হয়ে যায় লুঠতরাজের অরাজকতা। সন্ত্রাসবাদীর মাথার দাম দশ হাজার। স্বাধীন চট্টগ্রামের স্বাধীন বিপ্লবী সরকারের প্রধান মাস্টারমশাই জেলে বসে লিখছেন, “মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে।”

মৃত্যু চিন্তা নিয়ে যতই রোম্যান্টিসিজম করা হোক না কেন, তাবড় শিরদাঁড়াও ম্রিয়মান হয়ে আসে সময়কালে। কেবল কেউ কেউ শূন্যের মধ্যে অসীমকে খুঁজে পান। কেউ কেউ সমস্ত স্তব্ধ বিশ্বাসঘাতক সময়েও নিজের আদর্শকে শাশ্বত বিশ্বাসের মতোই প্রোথিত করেন। ফাঁসির ঠিক আগে সূর্য সেন লিখছেন, “আমার এই বৈচিত্রহীন জীবনের একঘেয়েমিকে তোমরা ভেঙে দাও, আমাকে উৎসাহ দাও।” চূড়ান্ত বিপ্লবী প্রেমিকই এমন উৎসাহের মাধুকরী করে। একজন শিক্ষকের শেষ জবানিতে প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের থেকে এটুকু গুরুদক্ষিণাই তো লেখা থাকে। “আমার এই সাধনাকে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিও” কারণ বিপ্লব স্রোতবান, তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সে বহতা। মাস্টারদার বিপ্লব অস্ত্রাগার দখলের ঊর্ধ্বে এক সাধনা, যে সাধনার হাল কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতার মতো ঋজু শিষ্যরা ধরে রেখেওছিলেন। 

জেলে বসে মৃত্যুর ঠিক পাঁচঘণ্টা আগে বসে সংগঠনকে ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন সূর্য সেন। একজন বিপ্লবী সংগঠক চিরকালই বিপ্লবের হোলটাইমার, মৃত্যুর মুহূর্তেও। বিপ্লবী অনিবার্য নাও হতে পারেন, কিন্তু বিপ্লব অনিবার্য। হয়তো এই গভীর বোধের জায়গা থেকেই মাস্টারমশাইয়ের শেষ চিঠিতে শাসকের প্রতি ঘৃণা নয় বরং নিজের স্বপ্নের প্রতি আস্থাই প্রবল। মৃত্যুর মুখোমুখি সে আস্থা অত্যন্ত শান্ত অথচ চরম তীব্র-তীক্ষ্ম। ঘৃণা পরজীবী, কিন্তু বিপ্লবের খোয়াব তো দীর্ঘজীবী। ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারির শীতে একটা স্যাঁতস্যাঁতে জেল কুঠুরিতে, নখ উপড়ে যাওয়া আঙুল দিয়ে এক বিপ্লবী মাস্টারমশাই বিশ্বাস করেছেন, দাসত্বের দিন দীর্ঘস্থায়ী নয়। তিনি থাকুন, বা না থাকুন একটা সূর্য ডোবা শেষ হলেও সূর্যের যাত্রা বহুদূর।

মাস্টারদার শেষ চিঠি, সেই জেলখানা থেকে

“আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এইতো আমার মৃত্যুকে বন্ধুর মতো আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার সময়।
আমার ভাইবোনগণ, তোমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, আমার এই বৈচিত্রহীন জীবনের একঘেয়েমিকে তোমরা ভেঙে দাও, আমাকে উৎসাহ দাও। এই আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম? শুধু একটি মাত্র জিনিস, তা হল আমার স্বপ্ন। একটি সোনালী স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথম এই স্বপ্ন দেখেছিলাম। উৎসাহ ভরে সারাজীবন তার পেছনে উন্মত্তের মতো ছুটেছিলাম। জানিনা, এই স্বপ্নকে আমি কতটুকু সফল করতে পেরেছি।

আমার মৃত্যুর শীতল স্পর্শ যদি তোমাদের মনকে এতটুকু স্পর্শ করে, তবে আমার এই সাধনাকে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিও, যেমন আমি তোমাদের দিয়েছিলাম। বন্ধুগণ, এগিয়ে চলো। কখনো পিছিয়ে যেওনা। দাসত্বের দিন চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার লগ্ন আসন্ন। ওঠো, জাগো। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কথা কোনদিনও ভুলোনা। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দনগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময়েই মনে রেখো। যে সব বীর সৈনিক স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম মনের গভীরে রক্তাক্ষরে লিখে রেখো। 
আমার একান্ত অনুরোধ এই সংগঠনকে তোমরা কোনোদিনই ভেঙে দিওনা। জেলের বাইরে ও ভেতরে সবার জন্য আমার আশীর্বাদ ও ভালোবাসা রইল।
বিদায়!


চট্টগ্রাম জেল,
১১ জানুয়ারি, ১৯৩৪
সন্ধ্যা ৭ ঘটিকা
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!
বন্দে মাতরম!”

More Articles