কেমন আছেন তেভাগার শেষ জীবিত সৈনিক?
বয়সজনিত কারণে অবিভক্ত দিনাজপুরে তেভাগার শেষ জীবিত এই সৈনিক খুব বেশি কথা বলতে পারেন না। মাঝেমধ্যে চিনতে পারেন না নিজের মানুষজনকেও।
সে হাসি একদিন গোধুলি-মিছিলে ছুটত। না, সবার অলক্ষ্যে নয়, বরং একেবারে সামনের সারিতে। লাল ঝান্ডা কাঁধে চাপিয়ে পার করতেন দিনাজপুরের কাদার মাঠ, পাটের খেত। মাইল মাইল অভিমান জড়ো হতো গলা চিরে যাওয়া স্লোগানে, ফুটিফাটা গোড়ালিতে। তিনি সরোজনন্দিনী সরকার, তেভাগার শেষ স্বর। উত্তাল ছেচল্লিশ-সাতচ্চলিশে রুখে দিয়েছেন পুলিশি সন্ত্রাস, জোতদারি পরোয়ানা। বুঝে নিয়েছেন হকের ধান। আজ পঁচানব্বই বছর বয়সে যখন কানের সামনে 'লাল সেলাম' বলা হয়, চোখদুটো তার জ্বলজ্বল করে ওঠে। দৃঢ় হয় বয়সের ভাঁজ। চিনতে অসুবিধে হয় না সেদিনের আন্দোলনের মহিয়সীকে। আজ যখন বাংলার সংসদীয় রাজনীতিতে কাস্তে-হাতুড়ি আসন সংখ্যার নিরিখে শূন্য, তখন এই সরোজনন্দিনীদেরই ভীষণ সত্যি মনে হয়, যারা শিখিয়েছিল সংসদীয় রাজনীতির বাইরেও বামপন্থীদের একটা জায়গা আছে, যার নাম রাজপথ। যেখান থেকে শ্রমিকের, কিষাণের, মজুরের কান্না শুনতে পাওয়া যায়।
বালুরঘাট শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার। জায়গাটার নাম পতিরাম। ঝাঁ-চকচকে সড়ক। হিলি সীমান্তগামী সেই রাস্তার ধারে একখানা টিনের ছাউনিওয়ালা কমিউনিস্ট পার্টির পোড়ো অফিস। কালিঝুলি-মাখা কার্ল মার্কস, লেনিনের ছবি। ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কিছু পতাকাতেও ধুলোর আস্তরণ। ঘড় ঘড় করে ফ্যান ঘুরছে। দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে লাল পার্টির অফিস বয়ে নিয়ে চলেছে তেভাগা আন্দোলনে ফেব্রুয়ারি মাসের কালজয়ী ইতিহাস। সেই অফিসকে পিছনে ফেলে গ্রামের ভেতর কিছুটা এগোলেই একটা মাটির বাড়ি, তাতে খড়ের ছাউনি। ঘরের ভেতর আলো পৌঁছয় নিমিত্তমাত্র। বর্তমান দক্ষিণ দিনাজপুরের সারা ভারত কৃষক সভার জেলা সম্পাদক অমিত সরকার আমাদের সেখানে পৌঁছে দিলেন। ঘরে একটা রক্তপতাকা, সঙ্গে কিছুটা অগোছালো মশারি, বইটই।
বয়সজনিত কারণে অবিভক্ত দিনাজপুরে তেভাগার শেষ জীবিত এই সৈনিক খুব বেশি কথা বলতে পারেন না। মাঝেমধ্যে চিনতে পারেন না নিজের মানুষজনকেও। যে মানুষটা একদিন আত্রেয়ী নদী বরাবর মিছিলে পেরিয়েছেন মাইল মাইল পথ, তাকে আজ ঘরের বাইরে বেরোতেও নাতির সাহায্য নিতে হয়। ছেলে কুমার সরকার বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, সময়টা সম্ভবত স্বাধীনতার ঠিক আগের বছর। তৎকালীন গ্রামে জোতদার রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উসকানিতে এক শীতের রাতে পুলিশ ঘিরে ফেলে সরোজ দেবীর পৈতৃক ভিটে। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বাবা এবং ভাইকে সেদিন পুলিশের গ্রেফতারি মেনে নিতে পারেনি কিশোরী সরোজ। বাড়ি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত প্রিজন ভ্যানে তাদের তোলা পর্যন্ত সরোজ স্লোগান দিলেন ইনকিলাব জিন্দাবাদ, কৃষক আন্দোলন জিন্দাবাদ। সেই প্রথমবারের জন্য কৃষকের ঘামের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। যে ঘামে ভিজেছেন তিনি, যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: একানব্বই বছর বয়সে গ্রামবাংলা নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন তরুণ মজুমদার
১৯৪৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি। আধা নয়, তেভাগা চাই। জান দেব, তবু ধান দেব না, কৃষকের স্লোগানে খাঁপুর গ্রামের মাটি সেদিন কেঁপে উঠেছিল। জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগীদের চোখে চোখ রেখে সেদিন প্রাণ দিয়েছিলেন যশোদারানি সরকার, চিয়ারসাই শেখ, গুরুচরণ বর্মন, কৌশল্যা কামারনিরা। সরকারি হিসেব অনুযায়ী সেদিন তেভাগার দাবি চেয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন বাইশ জন কৃষক।
মোট উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দাবি পূরণই শুধু নয়, বাম জমানার একেবারে শুরুতে ভূমিসংস্কারের ফলে আজ জমিদার অসিতমোহন সিংহরায়দের পাততারি গুটিয়ে চলে যেতে হয়েছে খাঁপুর-পতিরাম থেকে। জমির মালিকানা পেয়েছে স্বয়ং কৃষক। কিন্তু এই অবস্থা একদিনে আসেনি। প্রথমে ব্রিটিশ সরকার ও তার পুলিশ, স্বাধীনতার পরে ফের সামন্ত প্রভুদের সঙ্গী করে পুলিশের জুলুম। কৃষক মরেনি, প্রাণ দিয়েছে।
দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলনের মুল ভূখণ্ড খাঁপুরকে ধরা হলেও মুলত এর পটভূমি পতিরামই। রাজ্যজুড়ে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে তখন অবনী লাহিড়ী, কৃষ্ণদাস রায়, বগলা গুহর মতো কমিউনিস্ট নেতারা। আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়েছে দিনাজপুর, রংপুর পেরিয়ে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। আত্রেয়ীর মোহনা ছাড়িয়ে লালে লাল হয়ে গিয়েছে চব্বিশ পরগণার কলাগাছি নদীর জল। সেসব আন্দোলনের স্মৃতি আজ অস্পষ্ট। তেভাগার শেষ স্বর যশোদারানিও কিছু বলতে পারেন না। অগোছালোভাবে মাঝেমধ্যে উত্তর দেন। মৃদু জলে চিকচিক করে ওঠা চোখে কাস্তে-হাতুড়িটা সিলুয়েটে বাঁচে।
বর্তমানে পতিরাম পঞ্চায়েতটির দখল নিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত দাশগুপ্তর সংসদীয় এলাকায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা তেভাগার শহিদ পরিবার কিংবা যশোদার খবর রাখেন না আজকালকার কৃষ্ণরা। শুধু আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মনে হয়, 'আমরা কোথায় আছি'!