শেষ ম্যাচেই ইতিহাস! যেভাবে টি-২০ বিশ্বকাপের মাইলফলক ছুঁলেন বিরাট রোহিত
Virat Kohli Rohit Sharma: নিজের কেরিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৫৯ বলে ৭৬ রানের অসামান্য ইনিংস খেলেছেন বিরাট কোহলি।
কথায় বলে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। শেষে সব ভালো হলে আগের সমস্ত ভুল যেন ঢেকে যায়। ২৯ জুন ২০২৪, বার্বাডোজের ক্রিকেট ময়দানে তেমনই এক ঐতিহাসিক সফরের মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘোষণা করলেন ভারতীয় ক্রিকেটের দুই স্তম্ভ বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা। আন্তর্জাতিক টি-২০ ফরম্যাটকে চিরতরে বিদায় জানালেন এই দুই তারকাই। বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হাতে নিয়ে বিদায় ঘোষণা করলেন বিরাট। অন্যদিকে, পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে দর্শকদের মন ভাঙলেন রোহিতও। অবসান হলো বিশ্ব ক্রিকেটের বর্ণাঢ্য এক যাত্রার। বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে বিদায় বলার সুযোগ ক'জন পান? খুব ভাগ্যবান বা পরিশ্রমী হলেই হয়তো এই অসাধ্যসাধন করা যায়। রোহিত আর বিরাটের ক্রিকেটিয় অমরত্ব আর কে ঠেকায়!
ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পুরস্কার হাতে নিয়ে বিরাট বলেন, "এটাই আমার শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এই শিরোপাটাই আমি চিরকাল অর্জন করতে চেয়েছিলাম। এতদিন আমার কাছে অধরা ছিল। শেষ পর্যন্ত হাতে পেলাম এই ট্রফি। এই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই আমার ব্যাটে রান আসছিল না। তারপর হঠাৎ কিছু একটা ঘটল। ফাইনাল ম্যাচে ব্যাট বলের সংযোগ হতে শুরু করল। বাকিটা ইতিহাস। ঈশ্বর সত্যিই মহান! যদি তিনি চান, সব সম্ভব। আমি দলের হয়ে কাজটা করেছি। ভারতের হয়ে আমার শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নিজের সবটুকু কাজে লাগাতে চেয়েছি।"
নিজের কেরিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৫৯ বলে ৭৬ রানের অসামান্য ইনিংস খেলেছেন বিরাট কোহলি। ভারত ১৭৬ রান করেছিল এই ম্যাচে। তার মধ্যে ৭৬ রান শুধুমাত্র বিরাট কোহলির ব্যাট থেকেই এসেছিল। এই মহাতারকা তাঁর ইনিংসটি সাজিয়েছিলেন ছয়টি চার এবং দু'টি ছক্কা দিয়ে। এই ইনিংসের উপরে ভর করেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিরাট টার্গেট দিয়েছিল ভারত। ফলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার তো বিরাটের হাতেই সব থেকে ভালো মানায়। তাঁর ব্যাটের জোরেই দীর্ঘ ১৩ বছর পর বিশ্বকাপ জিতেছে টিম ইন্ডিয়া। একজন ক্রিকেটার হিসেবে যা জয় করা সম্ভব, তার প্রায় সবই জিতে নিয়েছেন কোহলি।
আরও পড়ুন- কোথায় হলো ভুল? কেন ১০ ম্যাচ জিতেও ফাইনালে হার বিরাট-রোহিত-শামিদের?
বিরাটের টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল কেরিয়ার শুরু হয় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালে অভিষেক কোহলির। এরপর ১২৫টি ইন্টারন্যাশনাল টি২০ ম্যাচে ব্যাট হাতে দেখা গিয়েছে বিরাট কোহলিকে। ৪১৮৮ রান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। বিরাট কোহলির টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালের স্ট্রাইক রেট ১৩৭.০৪ এবং অ্যাভারেজ ৪৮.৬৯। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের দ্বিতীয় সব থেকে বেশি রান সংগ্রহকারী হলেন বিরাট কোহলি। তাঁর উপরে রয়েছেন শুধুমাত্র ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা।
টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালে সবথেকে দ্রুত ৩৫০০ রান করা ব্যটারও বিরাট কোহলি। মাত্র ৯৬টি ইনিংস খেলে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন তিনি। ৫০টি ম্যাচে ভারতের অধিনায়কত্ব করেছিলেন বিরাট কোহলি। এর মধ্যে ৩৫ ম্যাচে ব্যাট হাতে নামেন তিনি। সেইসব ম্যাচে শুধুমাত্র ভারতের অধিনায়কত্ব ছাড়াও ১২৯২ রান করেছিলেন ভারতের রান মেশিন। পাশাপাশি, তিনিই ভারতের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি দু'টি আলাদা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি রান পেয়েছেন।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশে ৩১৯ রান করেন তিনি। এরপর ২০২২ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াতে ২৯৬ রান করেন তিনি। দুই বিশ্বকাপে সবথেকে বেশি রান করার রেকর্ড বিরাট কোহলির হাতে রয়েছে। ২০১৪ সালে যখন তিনি ৩১৯ রান করেছিলেন সেই সময় তাঁর অ্যাভারেজ ছিল ১০৬.৩৩। বিশ্বকাপের মতো জায়গায় এটাই ছিল ইতিহাসের সর্বাধিক রান সংগ্রহকারীদের সবথেকে ভালো অ্যাভারেজ। এর পাশাপাশি ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আইসিসি ম্যান টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল টিমের একজন সদস্য ছিলেন বিরাট কোহলি।
বিরাটের এই সমস্ত রেকর্ড হয়তো সারা জীবন রেকর্ড থাকবে না। হয়তো আর কয়েক বছরের মধ্যেই বিরাটকে টপকে অন্য কেউ হয়ে উঠবেন বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা খেলোয়াড়। তবে, বিরাট নিজেকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন, তা সবার জন্য সহজ কাজ হবে না। ইতিহাসের পাতায় বিরাটের নাম থেকেই যাবে। তাই জন্যই বিরাট এবারে দলের নবীন সদস্যদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে চাইছেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট ছাড়ার ঘোষণা করে তিনি বলেছেন, "ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম আমরা। আজ সেটা পারলাম। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি ব্যাট চালাতে পারতাম আজকের ম্যাচে। ব্যাটের সঙ্গে বলের সংযোগ ভালো হচ্ছিল কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে আমাকে একটু স্লো খেলতে হয়েছে। অবসরের বিষয়টা একটা ওপেন সিক্রেট ছিল বলা যেতে পারে। এবার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পালা। দলে তরুণ ক্রিকেটাররা রয়েছেন। এবার তাঁরা ভারতের পতাকাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। হয়তো যেগুলো আমরা করতে পারিনি, তারা হয়তো সেগুলো করে দেখাবেন।"
আরও পড়ুন- ১৩ বছর পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত, চোকার ট্যাগ সরিয়ে ইতিহাসের পাতায় রোহিত অ্যান্ড কোং
অন্যদিকে, স্বপ্নের বিশ্বকাপ জয়ের পর আবেগঘন হয়ে পড়েন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মাও। বিশ্বকাপ জয় করেই তাঁর চোখে জল। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর ঘরের মাঠে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যে কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারেননি রোহিত, ২০২৪ সালের ২৯ জুন দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেই কাজই সম্পূর্ণ করলেন রোহিত এবং তাঁর সেনানী। তাই এবারের সাংবাদিক সম্মেলন অন্যবারের থেকে আলাদাই ছিল। বিশ্বকাপ হাতে নিয়েই বিরাটের মতোই ঘোষণা রোহিতেরও। রোহিতও জানিয়ে দেন, এটাই তাঁর শেষ টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ।
রোহিত শর্মা বলেছেন, "এটাই ছিল আমার শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। আমি যখন থেকে খেলা শুরু করি, তখন থেকেই এটা আমি উপভোগ করছি। ২০০৭ সালে যখন ফাইনাল হয় তখন সেই ফাইনালে ব্যাট করার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমিও দলের সংগ্রহে সাহায্য করতে পেরেছিলাম। সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু। আর আজ সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। আমি মনে করি এটাই সেরা সময় বিদায় বলার। আমি এটাই চেয়েছিলাম, শুধু একটা বিশ্বকাপ।"
রোহিত শর্মার কেরিয়ারের দিকে নজর রাখলে দেখা যায়, সারা বিশ্বে শুধুমাত্র রোহিত শর্মা একাই রয়েছেন যিনি রানের দিক থেকে টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় বিরাট কোহলিকে টপকে গিয়েছেন। ১৫৯ ম্যাচে ৪২৩১ রান করেছেন রোহিত শর্মা। ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্বে প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন রোহিত শর্মা। সেখান থেকে ২০২৪ সালে ভারতীয় জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করা। রোহিত শর্মার সফরও ছিল স্বপ্নের মতো।
আরও পড়ুন- চরম মুহূর্তে কেন ব্যর্থ রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা?
২০২৪ সালের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের হয়ে সব থেকে বেশি রান করেছিলেন রোহিত শর্মা। ৮টি ম্যাচ খেলে ২৫৭ রান করেন ভারতীয় অধিনায়ক। রোহিত শর্মার ঝুলিতে রয়েছে আরও একটি বড় রেকর্ড। এখনও পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালে পাঁচটি শতরান রয়েছে তাঁর। তাঁর রেকর্ড ছুঁয়েছেন শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ৩৫ বছর বয়সি রোহিত শর্মা ৬২টি টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচে ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন। এর মধ্যে ৪৯টি ম্যাচে ভারত জিতেছে, হেরেছে মাত্র ১২টি ম্যাচে। অন্যদিকে, বিরাট ৫০টির মধ্যে ভারতকে জিতিয়েছেন ৩০টি ম্যাচে এবং ভারত হেরেছে ১৬টি ম্যাচে।
২০২৪ সালের জয় রোহিত শর্মা উৎসর্গ করেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়কে। ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য রাহুলের অবদান মনে করিয়ে দেন রোহিত শর্মা। তাঁর ২০ থেকে ২৫ বছরের বিরাট অবদানের কথা উল্লেখ করেন রোহিত। দলের অন্যান্য সদস্যদেরও কৃতজ্ঞতা জানান। বিশেষ করে কৃতজ্ঞতা জানান বিরাট কোহলি, জসপ্রিত বুমরাহ এবং অর্শদীপের প্রতি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এই ম্যাচটি জীবনের সেরা ম্যাচ কিনা জানতে চাইলে রোহিত শর্মা বলেন, এটা তাঁর পুরো ক্রিকেট জীবনের সবথেকে সেরা ম্যাচ হতে বাধ্য। "জয়ের জন্য আমি একেবারে মরিয়া ছিলাম। ২০২৩ বিশ্বকাপে জিততে জিততেও আমরা হেরে যাই। বিগত বছরগুলোতে আমি যত রান করেছি তা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি রেকর্ডের ভক্ত নই। আমার কাছে রেকর্ড খুব একটা দাম রাখে না। জয় আমার আসল পুরস্কার।"
কিন্তু শেষ উচ্ছ্বাসের মধ্যেও কোথাও বিষাদের ছায়া রয়েই গেল। বিরাট এবং রোহিতের জুটি আর নামবে না টি-টোয়েন্টির মাঠে। টি- টোয়েন্টির মাঠে আর লেখা হবে না রো-কো'র বিজয়গাথা। একটা বিশ্বকাপ জয়ের জন্যই সমস্ত স্লেজিং, সমস্ত দুঃখ ভুলে হয়তো অপেক্ষা করছিলেন দু'জনে। বিশ্বকাপ জিতলেন আর ব্যাটন তুলে দিলেন নতুন প্রজন্মের হাতে। এবারে হয়তো হার্দিক পাণ্ডিয়া হবেন দলের অধিনায়ক। ঋষভ পন্থ পূরণ করবেন বিরাটের জায়গা। তবে রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলির জুটিকে মিস করবে গোটা ভারত।