বাংলা গান যত দিন টিকে থাকবে ততদিন লতা থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে
প্রথম বাংলা রেকর্ড যখন তিনি করতে যান, তখন বাংলাভাষাকে ঘিরে প্রবল আগ্রহ থাকলেও রাইকিশোরী লতা মঙ্গেশকারের ভিতরে বাংলা গান গাইবার বিষয়টা ঘিরে একটু একটু ভয়ও কাজ করছিল। যদিও তিনি তখন হিন্দি ,মারাঠি গানের প্রায় একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী সেই বয়সেই হয়ে উঠেছেন। এইচএমভি থেকে তাঁকে যখন প্রস্তাব দেওয়া হল বাংলা গান গাইবার, তিনি কিছুটা দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। এইচএমভি-তে তখন গান কে লিখবেন, তাই নিয়ে এইচএমভি-র এক কর্তার সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠিত গীতিকারদের একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে। সেই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জেরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো গায়িকা এইচএমভি-র তালিকাভুক্ত গীতিকারের গান রেকর্ড করবেন না বলেই ঠিক করে নিয়েছেন।
সেই মতো পবিত্র মিত্রকে সন্ধ্যা বর্জন করলেও লতা মঙ্গেশকার কিন্তু তাঁর প্রথম বাংলা গানের গীতিকার হিসেবে পবিত্র মিত্রকে যথোচিত মর্যাদা দিলেন।কে করবেন সেই গানের সুর? শুনলেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। সতীনাথ, যাঁকে ' শিউনাথ' বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান। তার আগে বিভিন্ন মাইফিলে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছেন লতা মঙ্গেশকার। বিশেষ করে কলকাতা রাজভবনে হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রাজ্যপাল থাকাকালীন। বিভিন্ন ত্রাণকার্যে যে সমস্ত অনুষ্ঠানগুলি তৎকালীন রাজ্যপাল সংগঠিত করতেন, সেই সব আসরে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গেই আসতেন লতা। ফলে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে একটা ভীষণ ভালো লাগা তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর তাই যখন তিনি শুনলেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রথম গাওয়া বাংলা গানের সুর করবেন, খুব খুশি হয়েছিলেন।
এরপর সৃষ্টি হল,' আকাশ প্রদীপ জ্বলে 'আর ,'কত নিশি গেছে নিদ হারা' র মতো দু'টি কালজয়ী বাংলা গান। বাংলা গানের স্বর্ণযুগে এই দুটি গান শুধুই ইতিহাস নয়, একটা মাইলফলক। গানের সুর, কথা, গায়নভঙ্গি ,প্রায় হাতে ধরে লতা মঙ্গেশকারকে শিখিয়েছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। আর লতা মঙ্গেশকারের মতো অমন বিস্ময় প্রতিভা, ছোট ছাত্রীর মতো তাঁর কাছে বসে গানগুলি তুলেছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে রেকর্ড করেছিলেন। তার পর তো ইতিহাস ।
বহু বাংলা গান গেয়েছেন লতা। বেসিক রেকর্ড করেছেন। ফিল্মে গেয়েছেন। কিন্তু সেই সব গানের ভেতরেও ,'আকাশ প্রদীপ ','আর কত নিশি গেছে' যেন একটা অন্য মাত্রা এনে দেয় ।অন্য আবেগ এনে দেয়. আবেশের একটা অন্য স্তরে শ্রোতাকে পৌঁছে দেয়। বাংলা গান যত দিন টিকে থাকবে, যতদিন বাঙালির আবেগ বেঁচে থাকবে গানকে ঘিরে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতার প্রথম গাওয়া এই বাংলা গান দু'টি অমর হয়ে থাকবে।
পরবর্তী সময়ে সাতের দশকের মাঝামাঝি মহম্মদ রফিকে দিয়ে,' পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না' রেকর্ড করার জন্য সতীনাথ মুখোপাধ্যায় যখন বোম্বেতে গিয়েছিলেন, লতাজির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। প্রথমেই কিন্তু লতা সেই আকাশপ্রদীপের শেষ স্মৃতি রোমন্থন করতে ভোলেননি।
আসলে বাংলা আর বাঙালির প্রতি একটা অসাধারণ মনের টান, প্রাণের আবেগ ছিল লতার। একজন যথার্থ মারাঠি ব্যক্তিত্ব যে সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্বে কি করে পরিণত হতে পারেন, বাংলা -বাঙালি- বাংলা গানকে ঘিরে লতা মঙ্গেশকারের আবেগকে যদি একটু রোমান্থন করা যায়, তাহলে সেটা আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সলিল চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব লতা মঙ্গেশকারের সঙ্গীতজীবনে খুব বড় বড় একটা জায়গা নিয়ে আছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রতি লতা মঙ্গেশকরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জায়গাটা ছিল ঠিক একদম ছোট বোনের মতো। নিজের বড় দাদার বাইরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে কখনো ভাবতে পারতেন না লতা মঙ্গেশকার আর হেমন্তবাবুও কখনো নিজের ছোট বোনের বাইরে ভাবতে পারতেন না লতাকে।এক অদ্ভুত রসায়ন এই দুই ভারতজোড়া শিল্পীর মধ্যে ছিল।
হেমন্তবাবু যদি লতা মঙ্গেশকরকে কোনো গানের অনুরোধ করতেন, সেই অনুরোধ এড়িয়ে যাওয়া লতা মঙ্গেসকারের মতো শিল্পীর পক্ষে কখনোই সম্ভবপর ছিল না। আবার হেমন্তবাবু অশক্ত শরীরে গান গাইছেন, তাঁর কণ্ঠের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং সেই চাপ তাঁর শরীরের ওপরেও পড়ছে, মনে র ভিতরেও পরছে- এগুলি লতা মঙ্গেশকারকে ছোট বোনের মত আহত করত। সেই মনের অবস্থাটাকে তাঁর হেমন্তদাকে অকপটে বলা থেকে কখনো বিরত হতেন না লতা মঙ্গেশকার।
আসলে এমন একজন শিল্পী তিনি ছিলেন , যিনি আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করে ,গোটা দেশের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ৩৮ ভাষায় ৩০ হাজারের বেশি গান গাইতেন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা -মহারাষ্ট্র- কর্ণাটক থেকে কাশ্মীর ,পাঞ্জাব-- কোন প্রদেশের মানুষ মনে করেন না ,লতা মঙ্গেসকার তাঁদের ঘরের মেয়ে নন? অথচ নিজের মারাঠি সত্তাটিকে কিন্তু লতা মঙ্গেশকার একটিবারের জন্যও অস্বীকার করেননি। ভুলে যাননি। ভুলে থাকেননি। বিশ্বমানব হওয়ার জন্য শাশ্বত বাঙালি হওয়ার যে জাগ্রত চেতনার কথা বিশ শতকের শুরুতে ব্রতচারীর প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত বলেছিলেন, তা যেন শাশ্বত মারাঠি হয়ে, লতা মঙ্গেশকার আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেলেন
লতা মঙ্গেশকারের সন্তান তুল্য সংগীত পরিচালকেরা বারবার বলেছেন; লতা যখন খ্যাতির শিখরে, তখনও কোনো গান রেকর্ড করতে গেলে ,একেবারে একজন ষোড়শীর মতো বাধ্য ছাত্রী হিসেবে সেই সন্তানতুল্য সঙ্গীত পরিচালকের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিতেন ।একটিবারের জন্য নিজের প্রতিভাকে ঘিরে এতোটুকু দম্ভের প্রকাশ না ঘটিয়ে ,অসাধারণ অধ্যাবসায় ,পরিশীলিত যত্ন আর আবেগ দিয়ে নিজের সৃষ্টিকে ফুটিয়ে তুলতেন লতা মঙ্গেশকার। তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন,তা তাঁদের প্রত্যেকের স্মৃতিচারণ থেকেই বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি।
লতা মঙ্গেশকার নাকি একবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন; আমার মত পাতলা আওয়াজ থেকে ক্লাসিক্যাল গান ঠিক মতো হয় না। লতা মঙ্গেশকার জানতেন, তাঁর সীমার মাঝে অসীমের পরিধিটাকে, তাই কখনোই আশা ভোঁসলের মত পশ্চিমী দুনিয়ার গান ,পপ- ডিস্কো ইত্যাদি গাইতেন না। সেইসব গান যে তিনি গাইতে পারতেন না,তা কিন্তু নয়। তাঁর মতো অমন কালজয়ী শিল্পী অবশ্যই পারতেন ওইসব গান গাইতে। কিন্তু নিজের কোথায় দক্ষতা ,আর কোথায় নিজের সীমাবদ্ধতা- এটা অসম্ভব ভাল করেই বুঝতে পারতেন তিনি।
আর বুঝতে পারতেন বলেই নিজের পরিশীলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে কখনো তিনি পা বাড়াননি। একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে যেভাবে সমৃদ্ধ করে গেলেন লতা মঙ্গেশকার, আগামী দিনে তেমন কেউ করতে পারবেন কিনা ,তা নিয়ে এখনই ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করতে পারা যায় ।সলিল চৌধুরীর সুরে যখন তিনি গাইছেন লোকসংগীত নির্ভর, 'ও তোর নয়নপাখি আমার রে' সেই গানের পূর্ববঙ্গকেন্দ্রিক যে উচ্চারণ, সেই উচ্চারণ গুলো শুনলে কাট বাঙালের পক্ষে পর্যন্ত ধরা সম্ভব নয়, গায়িকা পদ্মাপাড়ের কোন মানুষ নন , শুধু মহারাষ্ট্রের মেয়ে।
একই কথা প্রযোজ্য অন্য যে যে ভারতীয় ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন, সেইসব গানগুলি সম্পর্কে ও।উচ্চারণের এই ভঙ্গিমা ,এটা কোথা থেকে, কি করে আয়ত্ত করেছিলেন লতা মঙ্গেসকার তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
আরও পড়ুন-আজও সুরের মসনদের রানি লতা মঙ্গেশকর
হেমন্তবাবুর জীবিতাবস্থায় সলিল চৌধুরী, লতা মঙ্গেসকার কে দিয়ে' রানার' আবার গাইয়েছিলেন। সেই ঘটনাক্রম হেমন্তবাবুকে কিছুটা আহত করলেও করে থাকতে পারে ।অনেক সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছেই হেমন্ত বাবুর গাওয়া সেই গানগুলো আবার লতা কেন গাইলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে ।সেইসব তির্যক বিতর্কের মধ্যে না ঢুকেই বলতে হয় ,হেমন্ত বাবুর গান 'রানার' গানের যে আবেদন, সেই আবেদনকে অক্ষুন্ন রেখে, অসামান্য সুরেলা উপস্থাপনে লতা মঙ্গেশকার যে নিবেদন আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, তা শুনলে আজও আমাদের বিস্ময় জাগে।
লতা মঙ্গেশকারকে ঘিরে অনেকের অনেক রকম অভিযোগ আছে । অনেক কল্পনামিশ্রিত কাহিনি বিভিন্ন খবরের কাগজ ,পত্রপত্রিকাতে পাওয়া যায়। যেমন, তিনি নাকি সুমন কল্যাণপুরকে বাণিজ্যিক ঈর্ষার জন্য বোম্বের বাজারে দাঁড়াতে দেননি। কোনো কোনো অতিবাঙালি আবার সন্ধ্যা মুখার্জি-লতা মঙ্গেশকারকে নিয়ে নানা চটকদার গল্প করেন।
আসলে কোন মানুষ যখন কিংবদন্তি হয়ে যায়, সৃষ্টির একটা সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে ,তখন তাঁকে ঘিরে কাল্পনিক কিছু কথা বলে, তাঁর কারিশমায় কালি লাগানোর প্রবণতা -এটা কেবল বাঙালি নয় ,গোটা ভারতীয়দেরই একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর লতা মঙ্গেসকারের প্রতি শ্রদ্ধা আমরা দেখেছি। যখন শিবসেনা -বিজেপি জোট মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন থেকেছে, সেই সরকারের লতাজির প্রতি শ্রদ্ধার্পণে কার্পণ্য না করা, এইসব থেকে তাঁকে একটা রাজনৈতিক কৌণিক বিন্দু দেখার প্রবণতা কোন কোন মানুষের আছে। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকাকালীন, যখন সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে হোপ '৮৬ হয়েছে ,তখনকার কর্তাব্যক্তিদের অনুরোধে ,লতা কিন্তু কলকাতায় এসেছেন ।গান গেয়েছেন। শ্রোতাদের জয় করেছেন। যদিও এ সম্পর্কে তাঁরই সমবয়স্ক এক শিল্পীর স্বামী অভিযোগ করেছিলেন; লতা গান গাইবার সময় অনুষ্ঠান মঞ্চে মাইকটা ঠিক থাকলেও ,তাঁর পত্নী গাইবার সময় নাকি মাইক টাকে খারাপ করে দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই ধরনের কথার ভেতর দিয়ে হেমন্তবাবু ,লতাজি কখনোই কোনো রকম অসম্মানিত হন না। অসম্মানিত হন সেই সব ব্যক্তিরা যাঁরা লতা ,হেমন্তবাবু র মতো অসামান্য ব্যক্তিত্বের পদস্পর্শ করার যোগ্যতা না রেখেই ,তাঁদেরকে অহেতুক কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে থাকেন। আর একটা লতা মঙ্গেশকারের জন্য হয়তো গোটা বিশ্বের মানবজাতিকে আরো কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে। যেমন অপেক্ষা করতে হবে আত্মনিবেদিত কিন্নরকণ্ঠী জন্য এম এস সুব্বুলক্ষ্মীর জন্যেও।